আমি দেশ ছেড়েছি ১৯৮০ সালে, তখন বয়েস বিশ ছাড়িয়েছে। এসেছি দক্ষিণ ইলিনয়ের একটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে, বরের কাছে। এখানে ও পড়াশুনো করতে আসে ১৯৭৮ সালে। বাংলাদেশে আমাদের বাড়িতে ইদের দিনে অন্যান্য আর সব পরিবারের মতই নানান কিছু রান্না হতো। মা সারারাত জেগে রান্না করতেন। রোজার ইদ বা ইদলফিতর ২৯ শে না ৩০ শে রোজার পর হবে সব সময় তা আগে থেকে জানা যায় না। চাঁদ দেখেই সেটা ঠিক হয়। ফলে ইদের দুয়েকদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি চলতে থাকে।যেমন বাড়ির পর্দা, বিছানার চাদর ধোয়া। ঘর বাড়ি গোছানো, কে কি পরবে ইস্তিরি করে রাখা। মশলা তৈরি করে রাখা বা কাবাব বা চপ বানিয়ে রাখা। রোজার ইদে মায়ের মেনু হতো দুধ সেমাই, চালের জর্দা, কাবাব, চটপটি, তেলের পিঠে, পোলাও, মুরগির কোরমা, গরুর ঝাল তরকারি। একসময় মা ইদে পোলাও ছাড়াও খিচুড়ি রান্না শুরু করেন, সব রকম ডাল দিয়ে। যেটা সবাই খুব পছন্দ করতো।
আমি যখন আমেরিকায় আসি তখন আমি যে শহরে ছিলাম সেখানে কোন দেশী গ্রোসারি স্টোর ছিলো না। এদেশী দোকান গুলোতে কিছু কিছু দেশী মশলা পাওয়া যেতো। আমার বর জানতোও না যে সেই শহরে কোন মসজিদ আছে কি না। সব মিলিয়ে আমরা ২০/২৫ জন বাংলাদেশি ছিলাম, কাউকে কখনো মসজিদে জুম্মা পড়তে যেতে শুনিনি। আমি আসার পর প্রথমবার আমি একাই সব রোজা রেখেছি। কিন্তু কেউ ইদ করেনি বলে আমিও কিছু করিনি। ইদের দিন সকাল বেলা দেখি মালয়েশিয়ান আর ইন্দোনেশিয়ান ছাত্রছাত্রীরা রঙ-বেরঙের কাপড় পরে ক্যাম্পাস হাউজিং-এর বিভিন্ন বাসায় যাচ্ছে। আমি জানলা দিয়ে দেখে কেঁদেছিলাম। আশরাফ মনে হয় স্কুলে গিয়েছিলো। ও ততদিনে ইদের দিন কোন কিছু না করায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বছর থেকে আমি ইদের দিন রান্না শুরু করলাম এবং বন্ধুবান্ধবদের আসতে বলতাম। সেই যে শুরু হলো আজ পর্যন্ত সেটা চালু আছে। আমিও আমার মায়ের মতো রাত জেগে ইদের আগের দিন রান্না করি। ইদের দিন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন মিলে সারাদিন খাইদাই আর আড্ডা দিই। টেবিলে সব সাজানো থাকে, পটে চা থাকে। বেশির ভাগ ইদে আমার মেনু হয় নানা রকম বেকিং গুডস, দুধ সেমাই, জর্দা সেমাই, কখনো কখনো চালের জর্দা, রসমালাই, সরের মিষ্টি, বা নানা রকম নাড়ু, চটপটি, কাবাব বা আলুর চপ। পোলাও, রোস্ট, বিফ কারি, বেগুনবাহার, মাটন চাপ, ইত্যাদি। আর মায়ের ট্রাডিশন ধরে রাখতে সব রকম ডাল দিয়ে খিচুড়ি।
প্রতি ইদেই আমি একবেলা সবাইকে আসতে বলি, হয় দুপুরে নয় রাতে। এছাড়া কেউ কেউ জাস্ট দেখা করে যায় । ইদের দিন আসলে ওপেন হাউজ থাকে। দেশে বাড়িতে সবসময় কেউ না কেউ থাকে আর মায়েরা তো কোথাও যান না। ফলে বলে কয়ে না গেলেও অসুবিধে হয় না। বিদেশে তো তা না সেজন্য একটা সময় ধরে দিলে সুবিধে। এবারের ইদেও সবসময় যা যা করি তাই করেছি। তবে গত কয়েক বছর হলো মেনুতে যোগ হয়েছে দহিবড়া আর কিছু নিরামিষ ডিশ। নিরামিষাশীদের জন্য। এখন এই ষাট পেরুনো বয়েসে অতকিছু করা হয় না বা অত লোকজনকেও দাওয়াত দেওয়া হয় না। তবে ইদের দিন সারাদিন আড্ডা চলে এবং ইদের আগের রাতে রাতভর রান্না হয়।
ইদ মানেই আনন্দ, ইদ মানেই খাওয়াদাওয়া এবং খাওয়ানো। ইদ মানেই রংবরংয়ের শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালওয়ার কামিজ পরে জম্পেশ আড্ডা দেয়া।