রেল লাইনের ধারে ফাঁকা জমিতে মোহিম তার পোষা কুকুরটার মৃতদেহ কবর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝাপসা চোখে আপন মনে বলতে থাকে সে – “কালুয়া ! কবরই আমার জীবন জীবিকা; আর তোকে আমার হাতেই কবর দিতে হল?”
সে পেছন দিকে আর না তাকিয়ে একা উস্কোখুস্কো হয়ে যবুথবু পা ফেলতে থাকে রেল লাইন ধরে। তার ডানহাতের দিকে রেল পাঁচিল আর কয়েকটি ভাঙাচোরা রেল কোয়ার্টার, কোয়ার্টারগুলো এখন মালিকানাহীন ভূতুড়ে আস্থানা; কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, মনে মনে বলে সে “হে আল্লাহতালা! যেসব ডাক্তাররা আমার কালুয়ার চিকিৎসা ঠিক মতো করেনি; তাদের তুমি হেদায়েত দান করো, ক্ষমা করে দিও তাদের।”
রেল সাইডিঙের পাঁচিলের পেছনের একটা ঝুপড়িতে বউ আর তিন মেয়ে নিয়ে মোহিমের সংসার। বড় মেয়েটা এবার কলেজে উঠবে; ছোট দুটো এখনও হাইস্কুলে। বৌ তার লক্ষ্মীমতী; রেল বাবুদের বাড়িতে ঠিকা কাজ করে, মোহিম তার সাইকেলটা হাতে নিল, সাইকেলের ব্রেকের তারগুলো খোলা; একটাও মর্ডগার্ড নেই। ইচ্ছে মতো সামনের চাকা ঘোরাতে পারে সে, সাইকেল নিয়ে নানান কেরামতি খেলা দেখায় সে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত ছেড়ে সাইকেল চালাতে পারে, সাইকেল চালাতে চালাতে জামাকাপড় বদলাতে পারে; ভাতও খেতে পারে সাইকেলের ওপর।
সাইকেলের খেলা ছাড়াও মোহিম আরো কয়েকটা ভয়ঙ্কর খেলা দেখায়; যেমন – বুকের ওপর পাথর রেখে সেটার উপরে হাতুড়ির ঘা মেরে মেরে পাথরটাকে টুকরো টুকরো করা, দু-গালে ও ঠোঁটে লোহার শিক গাল-ঠোঁট ফুটো করে ঢুকিয়ে দেওয়া। আর সবচেয়ে ভয়াবহ হল জীবন্ত অবস্থায় কবর খুঁড়ে ঢুকে গিয়ে মাটি চাপা দেওয়া আবার বাহাত্তর ঘণ্টার পর অক্ষত অবস্থায় কবর থেকে উঠে আসা। ইদানীং প্রচুর দমের কষ্ট হয় তার; বয়স হয়েছে কিনা। মাঝে মাঝে হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ উল্টে যায়। কিন্তু ঐ কবরের খেলা দেখাতে গেলে দমের দরকার খুব। এটুকু মোহিম বেশ বোঝে। কিন্তু অভাব যে তার নিত্য সঙ্গী; প্রচুর টাকার দরকার যে তার।
দূরে চক্ররেল ছুটে যাওয়ার শব্দ শুনে মোহিমের খেয়াল হয়, বড় মেয়ের নাম ধরে ডাকে সে – “সায়রা! ছটা বাজে; লুডো খেলা বন্ধ রেখে উনুনটা ধরিয়ে ভাতটা বসিয়ে দে মা। তোর আম্মির ফিরতে আজ অনেকটা দেরি হবে মনে হচ্ছে। নতুন আর একটা কাজ ধরেছে। আমি গিয়ে দেখে আসি –” কথাগুলো বলে ঐ বিদঘুটে সাইকেলটায় চেপে বসল মোহিম। সটান পেডল করতে লাগল।
মোহিমের দু-পাশে ছায়ার মতো সারি সারি দাঁড়িয়ে গাছ; গতকাল পূর্ণিমা ছিল, তাই আজও চাঁদের অনেকটা আলো খালের জলে পড়ে রুপোলি ঢেউ উঠছে। পথের পাশের ঝুপড়িগুলোতে সেই ঢেউয়ের ছায়া তরঙ্গ খেলছে। এসব দেখতে মোহিমের বেশ লাগে, মনটা উদাস হয়ে ওঠে তার।
আজ মণিপুরের মাঠে তার খেলা দেখানোর ডাক এসেছে; সাইকেলের গাঁটে-গাঁটে ভাল করে তেল-মোবিল দিয়ে সে তৈরি হতে থাকে। বাধ সাধল তার বিবি; মোহিমকে বাধা দিয়ে বলল – “তোমাকে কতবার বলেছি – তুমি সব খেলা দেখাবে কিন্তু ওই কবরে যাবার খেলাটা না! দরকার পড়লে তুমি এসব ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকো; তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না, অমন রোজগারের টাকা আমাদের দরকার নেই। এভাবে আল্লাহর ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে; আল্লাহর পরীক্ষা নেবার গুনাহ তুমি বারবার কোরো না।”
মোহিম একগাল হেসে বলে – “আরে ধুর! পুরুষ মানুষ বাড়ি বসে থাকলে চলে নাকি? আমি তো আল্লহতালার ইচ্ছেতেই এসব করি, নাহলে আমার মতো এক মাটির ঢেলার সামর্থ্য কি?”
মণিপুরের মাঠে আজ লোকে লোকারণ্য, তিলধারনের ঠাঁই নেই ; মোহিম আজ কবরে যাবে, কিন্তু তার দমের কষ্টটা আজ খুব বেড়েছে। কবরে যাবার আগে সে একটা ছোট্ট বক্তৃতা দেয় – “ভাইসকল আমার মা-বাপেরা! তোমাদের এই মোহিম খুব গরিব; বাড়িতে তিন মেয়ে, বড়টা কলেজে পড়ে আর ছোট দুটো হাইস্কুলে তোমাদের দয়ায়। ওদের মা পরের বাড়িতে এঁটো বাসন মাজে; দু-টাকা, পাঁচ-টাকা যা আপনারা দেন তাই দিয়ে আমার অভাবের সংসারে দু’বেলা ভাত জোটে। আগামীকাল আমি যদি বেঁচে উঠি, তখন আমাকে কেউ খালি হাতে ফেরাবেন না। আমি আপনাদের ছোট ভাই, আপনাদেরই সন্তান, আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন ও আপনারা নিজেদের ঈশ্বরের কাছেও দোয়া করুন যাতে আমি আবার আমার পরিবারের মুখ দেখতে পাই। আপনাদের সময় আর নষ্ট না করে আমি আমার ওস্তাদের নাম স্মরণ করে এই শেষ খেলাটা দেখাচ্ছি।”
কবর খুঁড়ে ওষুধ মাখানো কাপড়ের মধ্যে জড়িয়ে মোহিমকে কবরে শোয়ানো হল; অর্ধচেতন অবস্থায় মোহিমের কত বছর আগেকার কথা আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল; সেবার বাকিপুরে এক সপ্তাহ খেলা দেখাতে গিয়েছিল ওস্তাদ সুনীল মনোহরের সঙ্গে। মোহিম প্রথম দিনেই সাইকেলের খেলা দেখিয়ে ওস্তাদ ও দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল। সেই সঙ্গে কিশোরী তাসলিমারও। পাঁচ দিনের মাথায় যখন সে কবরে যাবে! সেই সন্ধ্যায় মোহিম তাসলিমাকে বলে – “আজ আমি জীবিত অবস্থায় কবরে যাব; আবার দু’দিন পর জীবিত অবস্থায় কবর থেকে উঠব।”
মোহিমের কথা শুনে কিশোরী তাসলিমার বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল।
তারপর কতবার ওর পাড়ায় মোহিম সেই অদ্ভুত সাইকেলটা নিয়ে সকাল সন্ধে দুপুরে টোটো কোম্পানি করে ঘুরেছে। একদিন তাসলিমাকে নিয়ে ফুড়ুত করে উড়ে শেষে এই রেল সাইডিঙের খালের ধারে এসে সংসার পেতেছে। আজ প্রায় অনেক দিনের কথা; মনটা খুশিতে ভরে ওঠে মোহিমের ।
মোহিমের কবরে এবার মাটি কোদাল দিয়ে ঢালতে থাকে; ততই মোহিমের দমের কষ্ট বাড়তে লাগল। দম ফুরিয়ে আসছে তার; কবরটাকে পুরো ঢেকে দেওয়া হল মাটি দিয়ে।