If people feel lost and alone and helpless and broken and hopeless today, what will it be like if the world really begins to come apart at the hinges?
― Brandon Andress
আমরা কাকের ডাক শুনছি। আমি আর ঝুনু। আর কোনো পাখি নেই, একটাই কাক কেবল কাঁটা কুলগাছের ডালে। ছাদের কার্নিসে বসে দু’জন তাকিয়ে আছি পশ্চিম আকাশের দিকে। গাঁথনি করা দুটো ফ্ল্যাটবাড়ির তরতর উঠে যাওয়ার ফাঁকে খণ্ড আকাশ, কয়েকটা লাল আঁচড় তার গায়ে। এত মন দিয়ে আমরা শেষ কবে কাকের ডাক শুনেছি? কাকটা একবার করে ডাকছে, পরের ডাকের আগে এক দীর্ঘ নিশ্চুপ। সেই স্তব্ধতা আমাদের ভেতর অস্থির করছে। আমি একটা খুন করতে যাচ্ছি।
‘হ্যাঁ গো, কীভাবে?’
ঝুনুর গলা সামান্য কেঁপে যায়। তারপর কেউ বহুক্ষণ কথা বলি না। এক সময় ঝুনু অস্থির হয়েই বলে ওঠে, আজ সব এত চুপ কেন? আমারও মনে হয়, তাই তো, পাড়া আজ বড়ো নিঝুম। চারপাশে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বাড়িঘর কেমন ঝিম মেরে আছে। বাথরুমে কল থেকে অনর্গল জল পড়ার শব্দ, ফ্লাস টানার, স্টিলের বাসন ধোয়ার। শিশুর ঘুমের ভেতর কেঁদে ওঠা। ফোনে কথা বলতে বলতে কেউ হেসে ওঠে হা হা করে। দাম্পত্যের অহর্নিশ কলহ ছুটে আসে, কী পেয়েছি, কী কী দিয়েছ তুমি সারাটা জীবন ধরে! নারীকন্ঠের চাপা আর্তনাদ চাপা পড়ে যায় টিভি সিরিয়ালের গানে। কারও বাড়ির জানালার পর্দা একা একা উড়ছে। ঘরের ভেতর ফ্যান চালিয়ে রেখে কেউ চলে গেছে অন্য কোথাও। এক কিশোরী কন্ঠ, তুই এটা জানিস না, এ মা, সত্যি! তার তুচ্ছ বিস্ময় হাওয়ায় ভেসে যায় দূর ফোন টাওয়ারের দিকে। এই জাগতিক টুকিটাকি শব্দময়তা কয়েকদিন ধরে আমরা প্রাণে মনে শুষে নিই, প্রতিটি শব্দকণাকে মনে হয় নতুন, বড়ো দামি। আমি আর ঝুনু ছাদে বসে সেই অদেখা মানুষদের নানারকম স্বর শুনি। বলি, মানুষেরা নয়, বাড়িরা কথা বলে। বাড়িরা আজ হৈ হৈ করছে, বাড়িরা আজ ঝগড়া করছে, প্রেম করছে বাড়িরা, তাদের সঙ্গমের ধ্বনি সমাপ্ত করে পরিশ্রান্ত বাড়িরা এখন তৃপ্তির ঘুমে! আজ কেমন নিঃসাড় সব। যেন পৃথিবীতে আর একটা মানুষ বেঁচে নেই, মানুষহীন রিক্ত বাড়িগুলো আজ মরা, কঙ্কাল! কাকটা আরেকবার ডেকে উঠতেই মন স্থির হয় আমাদের। দূরে দোতলা বাড়ির খোলা ছাদে দড়িতে মেলা শিশুর নিরীহ একটি জামা, ছোট্ট হাতাটা মৃদু বাতাসে উড়ছে অল্প। কিছু একটা বলতে হবে তাই আমি বলি, ‘বাচ্চার জামাটা থেকে গেছে, তোলেনি।’
কিছু একটা বলতে হবে তাই ঝুনু বলে, ‘সামান্য ভেজা ছিল হয়তো, পরে তুলবে ভেবে ভুলে গেছে।’
‘রাতেও থেকে যায়, তুমি দেখেছ?’
‘দেখেছি। এমন রাত-বিরেতে বাচ্চার জামা বাইরে পড়ে থাকা ভালো নয়।’
‘কেন?’
ঝুনু চুপ করে থাকে। ও বাড়ির ছাদে একটা কাঁটা কুলের ডাল নেমেছে। সেই ডাল ধরে রোজ সন্ধে নামে পাড়ায়। পূর্ণিমার চাঁদ কুলগাছের উপরে উঠে এলে পাড়ার বাড়িগুলোর ছাদ তকতকে দেখা যায়। দড়িতে মেলা শিশুর জামা জ্যোৎস্নায় ভেজে।
‘অশুভ কিছু মধ্যরাতে ঘোরে, ছায়ার মতন।’
‘কারা?’
‘বাচ্চাদের ছায়া, যারা জন্মেই কয়েকদিন পর ঘুমের ভেতর মরে যায়। ছোটো ছোটো ছায়াগুলো ছাদে ছাদে খেলে বেড়ায়, এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফায়, কাপড় মেলা দড়িতে ঝুলে দোল খায়। কেউ কেউ মেলে রাখা জামা ছায়া শরীরে গলিয়ে নেয়।’
‘তুমি দেখেছো?’
‘প্রায় রাতে আমি ঘুমোতে পারি না। ছাদে উঠে আসি। ছোটো ছোটো জামারা দেখি ভেসে বেড়ায়, লাফিয়ে যায় ছাদ থেকে ছাদে। এর বাড়ির বাচ্চার জামা অন্য বাড়ির ছাদে পাওয়া যায় পরদিন সকালে।’
‘ভয় করে না?’
‘ভয় কিসের, শিশু তো।’
দুজনেরই মনে হয় নিচের ঘরে আমাদের আড়াই বছরের মেয়ে ঘুমোচ্ছে এই ভর সন্ধেবেলা। একা। মশার ঝাঁক ঘিরে ধরেছে তাকে ঘুমের ভেতর। তাকে তুলতে হবে। ঝুনু তবু কার্নিসে বসে থাকে আরও কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়ায়। সারা ছাদ ঘোরে নেশাগ্রস্তের মতো। একেকবার কার্নিসের গায়ে হাত রাখে পরম মমতায়, এমনভাবে, বাড়িটার বুঝি মানবিক সত্তা আছে, নিছক নিষ্প্রাণ নয়, বৃষ্টির জল সোক করা দুটি কামরা, চিলতে রান্নাঘর নিয়ে, রংচটা দেয়ালগুলি নিয়ে শোকমগ্ন এক মানুষের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। কুলগাছের ডালে বসা কাকটা আরেকবার ডেকে উঠুক চাইছি। দুঃখের খবর বয়ে নিয়ে আসা মানুষ যেমন সংবাদটুকু দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, সইয়ে নিতে সময় দেয়, নীরবতা দেয়, বড়ো অধীর সেই সময়, তবু দিতে হয়। ঝুনু কার্নিস খামচে ধরে। শক্ত ইটের আধা দেয়াল এখন তরলের মতো কোহেসিভ। ডুবন্ত মানুষ কিছু না পেয়ে শেষ চেষ্টায় প্রাণঘাতী জলকেও যেভাবে আঁকড়ে ধরে!
‘বাড়িটা থাকবে না! এ যে আমাদের গো আমাদের! বলো, আমাদের নয়?’
ঘোরতর অবিশ্বাসের মতো ঝুনু প্রশ্নটা ছুঁড়ে মারে আমার মুখে। অতি যত্নে গড়ে তোলা বাড়ি, ওভার ডিউটির ঘামের টাকায়, ঘরের প্রতিটি চেনা কোণ, ঘুম ভাঙা সকালের প্রথম রোদের এসে পড়া বিছানায়, ফ্যানের ব্লেডে লেগে থাকা ঝুল পর্যন্ত এতো প্রিয়! আমাদের নয়? মনে হয় এই কথাটাই কেমন জাদু বাস্তবের মতো, সত্যি না, যার পুরোটা সত্যি নয়! আমার পা টলে যায় না, মাথা অসম্ভব স্থির। মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ এক চাঁই বরফ হয়ে আছে। সেই স্বচ্ছ বরফের ভেতর দেখা যায় মৃত গাছের শিকড়ের মতো রক্তজালিকা বরফের অন্তর ভেদ করে ছড়িয়ে গেছে দিগ্বিদিক। আবার হিসেব কষি। রোজের সহস্রবারের মতো মনে মনে বিড়বিড় করি আরেকবার। ব্যাংকের আউটস্ট্যান্ডিং অ্যামাউন্ট। প্রিন্সিপাল, ইন্টারেস্ট। ডিউ ডেট, ইএমআই। পাহাড়প্রমাণ ঋণ। নব্বই দিন ওভারডিউ। পাঁচ মাসের ওপর চাকরি নেই, ইওর সার্ভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড, ছোট্ট একটা মোবাইল মেসেজ, নিরীহের মতো একদিন আসে। কোনো ব্যাখ্যা নেই, এতো বছরের জীবন ঢেলে কাজ করে যাওয়ার কোনো সহমর্মী স্পন্দন নেই। সেই অতি সাধারণ একটা মেসেজ অবিশ্বাসের মতো জ্বল জ্বল করে। বারবার খুলে খুলে দেখা, ফোন নিভে যায় আবার, আবার! তারপর পাগলের মতো ফোন, কোম্পানির এইচআরএ সংক্ষিপ্ত একটি দুটি কথায় কোম্পানির লসের কথা বলেন, ভদ্র সংযমে অপারগতার কথা জানান। তিনিও শ্রান্ত, দিনভর অনেককে একটাই কথা বলে যেতে হয় তাঁকে। স্যালারি অ্যাকাউন্টে তিন মাসের ইএমআই হুমড়ি খেয়ে পড়ার পর দুমাসের ব্যাংক নোটিস। তারও সময়সীমা দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। তখন বাড়িটা কেবল একটা বিক্রয়যোগ্য অ্যাসেট, অকশনে দাঁড়িয়ে থাকবে মাথা নিচু করে।
বিছানায় শুয়ে গভীর রাতে বাড়িটার শরীর থেকে পলস্তরা খসে পড়ার অদৃশ্য শব্দ শুনতে পাই আমরা এখন। খানিকটা স্বপ্নের মতো। ফেলে আসা শৈশবের নদীপাড়ের ঘর, চাঁদভাটির দেশ। ঘুমের ভেতর পাড় ভাঙা মাটির ঝুপ ঝুপ নদীর জলে পড়ার শব্দ। রাক্ষুসে মেঘনা গিলে ফেলবে মাটির ঘরটাকে হয়তো রাত ফুরোবার আগেই। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে তলিয়ে যাবে খরস্রোতে। হ্যারিকেন হাতে নদীপাড়ে বসে আছে বাবা, নদীর জল মাপছে। অন্ধকারে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, ছ্যাঁদা কাপড়ের একটা বুড়ো ছাতা ধরে আছে মা, মায়ের কোলে ঘুমন্ত আমি। কালিপড়া হ্যারিকেনের কাঁচে বিন্দু জল লেগে আছে। পরদিন সংসারের যা কিছু কাপড়ের বোঁচকায় মুড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাবা বেরিয়ে পড়বে দূর অজানায়। তার আগে এক নিশ্চুপ সময়। জন্মভিটের শেষ মাটিটুকুর স্মৃতি ধুতির কাপড়ে বেঁধে নিচ্ছে বাবা।
পলস্তরা খসার অদেখা শব্দে ঝুনু উঠে বসে প্রতি রাতে, ঘুমের ভেতর এক অশরীরীর মতো সিঁড়ির ধাপে পা ফেলে ফেলে উঠে যায় ছাদে। ছায়া শিশুদের খেলা দেখে।
‘বাড়িটাও মরে যাবে।’ ঝুনু তার অস্থির পায়চারি থামিয়ে এসে বসে আবার।
‘ছায়া হয়ে যাবে।’
‘আমাদের ঘুমের ভেতর বাড়ির ছায়া গেট খুলে কখন হেঁটে চলে যাবে বড়ো রাস্তায়।’
‘কোথায় যাবো গো আমরা?’
প্রতিধ্বনির মতো আছড়ে পড়ে আমার কানে। ফেটে পড়া রোদে দীর্ঘ পথ হেঁটে এই কথাটাই যে কেবল জলোচ্ছ্বাসের মতো পাথর খণ্ডে আছড়ে পড়েছে, কোথায় যাবো আমরা? রাস্তায়, এ গলি সে গলি উদ্দেশ্যহীন বেরিয়ে কেবল মনে পড়েছে সেই চড়ুই পাখিটার গল্প। মহাসমুদ্র এসে প্রতিবার তার বাসা ভেঙে যায়। প্রতিবার সে গড়ে। তারপর আর পারে না। তখন সে পণ করে সমুদ্রকে নিঃশেষ করবার। ছোট্ট পাখি, ছোট্ট ঠোঁটে বিন্দু জল তুলে উড়ে যায়, দূরে ফেলে আসে, আবার একটু জল মুখে উড়ে যায়। এভাবে বারবার। অতলান্ত মহাজল বিদ্রূপে হাসে।... ধ্বস্ত, ক্লান্ত খিদেয় পাগল পাগল আমি বসে পড়ি ফ্লাইওভারের সিঁড়ির ধাপে। বৃদ্ধ ভিখিরি সবার কাছে চাইতে চাইতে যায়, কয়েন, টাকা হাতে তুলে ঝোলায় ভরে, তার দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে চেয়ে থাকি, বড়ো ঈর্ষা হয় তাকে আমার। মেয়ের একটু দুধের জন্য ঝুনু সহস্র চেষ্টাতেও পাশের বাড়িকে বলতে পারেনি মুখ ফুটে, লজ্জা, সে যে কী অপরিসীম লজ্জা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধে থাকে। আমার ইন করা শার্ট, কবজিতে তখনও বাঁধা কোম্পানির দেওয়া এমপ্লোয়ি অফ দ্য ইয়ারের দামি ঘড়ি। বুড়ো ভিখিরি আমার কাছে এসে হাত পেতে দাঁড়ায়।
গেটের একপাশে ঝুনুর নিজের হাতে লাগানো কামিনীগাছ, গাছে ফুল এসেছে ঝেপে। গন্ধে মাতোয়ারা। গাছভর্তি কামিনীফুল এলে বুঝবে দুর্যোগের দিন আসছে, কত ঝড়ের রাতে ঝুনু এভাবে বলেছে, ঝুনু এভাবেই বলে।
‘জানো, আসলে ও-বাড়ির ছাদে বাচ্চার জামাটা মেলা আছে আজ একমাস হল, ওভাবেই পড়ে আছে, কেউ তোলে না।’
‘জানি। কী এক অসুখে মারা গেছে না বাচ্চাটা?’
‘কত শিশুই তো এভাবে মারা যায় তাই না?’
‘কীভাবে?’
ঝুনু শক্ত হয়, শক্ত করে নিজেকে। অমোঘ প্রশ্নটি আমাদের কাছে এসে দাঁড়ায় আরেকবার,
কীভাবে?
চেপে রাখা দম দপ করে ছেড়ে দেয় ঝুনু।
‘আচ্ছা ঘুমের মধ্যেই ওকে মেরে ফ্যালো না হয়, জেগে উঠবার আগেই, আস্তে করে গলাটা টিপে, খুব কি লাগবে? মুখে বালিশ চাপা দিলে কেমন হয়, আচ্ছা তুমি যেভাবে পারো, একটু কষ্ট হবে তার, কচি প্রাণ, বুঝতেই পারবে না যে সে কখন মরে গেছে।’
কিছুটা ঝোঁকের মাথায় আমি সিঁড়ি দিয়ে নামবো বলে যাই, নামতে গিয়ে টের পাই ভয়ানক রকমের ভারী আমার পা দুটো! পেছন থেকে ঝুনু ডাকে, একটু দাঁড়াও! ঝুনু সময় নেয়। যেটুকু সময় এই মহাকাল তার হাতে দিতে পারে, যেটুকু সময় সে ভেবে নিতে পারে বেঁচে আছে শিশুটি তার।
‘আচ্ছা হয়ে গেলে বোলো, তারপর আমি অন্য একটা ঘরে চলে যাবো। হ্যাঁ গো, ওড়নাটা ঠিকমতো ফ্যানে বাঁধতে পারবো তো, প্রথম তো, বেঁধে দেবে তুমি? নাহ থাক, পারব।’
আমি আবার পা বাড়াই। আমার পায়ের নিচ থেকে নেমে গেছে অতল অন্ধকার সিঁড়ি, নিঃসীম সময় ধাপে ধাপে চলে যাচ্ছে মহাশূন্যের দিকে।
‘শোনো!’
থামি আবার। এই থামা অনন্তকাল হয়ে আমার পা জড়িয়ে থাকুক হে জীবন!
‘তুমি? তুমি কীভাবে...’
‘আছে।’
শুকনো হাসি আমি। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় ঝুনু। কী জানি ভাবে। হয়তো সামান্য ভুলচুক হয়ে যাবার কথা তার মনে হয়, অসাবধানে কেউ একজনের হঠাৎ বেঁচে যাওয়ার মতো ভয়াবহ কোনো চিন্তা। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কেবল ঝুনুর নির্দেশ এলেই যেতে পারি এমন এক স্থৈর্য নিয়ে। দীর্ঘ অপেক্ষার মতো। তবু এই পার্থিব শরীর আর মন থেকে বহু দূরে দাঁড়িয়ে এক ছায়া-মন চায় ঝুনু অন্তত একটিবার বলে উঠুক, ইওর সার্ভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড, দপ দপ করা মেসেজের মতো একবার জ্বলে উঠুক!
‘জানো, একটা ডলফিন বায়না করছিল দুদিন ধরে। বলেছি বাবাকে বলব, এনে দেবে। জন্ম থেকে অভাব কী জিনিস জানে না তো। এটা ওটা বায়না করে রোজ আর দেখে তার চাওয়া জিনিসটা আর আগের মতো আসে না। তার শিশু মন অবাক হয়, জেদ করে, কাঁদে, হয়তো ভুলে যায় তারপর।’
ঝুনু থামে, তার শ্বাস দ্রুত হয় কিছুটা, আবার বলে, ‘তুমি ভেবো না, ছায়া শিশুর মতো আমাদের মেয়ে এই বাড়ির ছাদে খেলে বেড়াবে, রাইমস গাইবে নিজের মনে। আমরাও, একটু দূরে কার্নিসে বসে শুনব তার সেই আধো শেখা রাইম, তুমি ছুটে যাবে তাকে কোলে তুলে নিতে।’
‘ডলফিন?’
‘খেলনা।’
ঝুনুকে বলা হয় না ডলফিন খুঁজতে বেরিয়েছি আমি রোজ। রোদ তেতে ওঠা পথে, দোকানে বাজারে ঘুরেছি, জিজ্ঞেস করেছি, কেউ বলতে পারেনি, ভালো করে শোনেইনি আমার কথা কেউ, লোকে এখন বড়ো আনমনা থাকে, একটা সামান্য খেলনার ব্যাপারে কেউ খুব চিন্তিত নয়। বড়ো রাস্তায় উঠে দেখেছি সার দিয়ে মানুষ হেঁটে চলেছে। তাদের পিঠে কাঁধে ব্যাগ, বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে, কারও ঘাড়ের ওপর শিশু পা ঝুলিয়ে বসে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছে, মাথাটা কাত হয়ে আছে তার একপাশে।
‘কোথা থেকে আসছো গো তোমরা, যাবে কোথায়?’
তারা উত্তর দেয়, বহু যোজন পথ পেরিয়ে সবাই ফিরছে তাদের গ্রামে, তাদের বাড়ির পথে। খুব রোদের ঝাঁঝে আমার দু’চোখ জ্বালা করে। তুমি বিশ্বাস করবে না ঝুনু, হ্যালুসিনেসনের মতো দেখি তাদের পাগুলো সব হাতির! সেই পৃথুল পায়ের আশ্চর্য সহন ক্ষমতা! তারা সভ্যতার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে যেতে পারে। অবিশ্বাস্য পথ! তারা আমাকে সঙ্গে যেতে বলে। কী করে তাদের বলি, আমি যেতে পারি না, এমন অসম্ভব পাড়ি দিতে পারে না আমার দুর্বল দুটো পা! আমাদের সন্তানের ক্ষীণ চাওয়া অপূরিত থেকে যায় তাই।
আমার পায়ের শিকড় দ্রুত ছিন্ন হতে থাকে। জাপটে থাকা যতো মায়ার শিকল খুলে যায় ঝনঝন শব্দে। পা দুটো মরিয়া হয়ে ধাপ নামে। নিচে ঘরের কোমল বিছানায় ঘুমিয়ে আছে আমাদের আড়াই বছরের সন্তান, জনক-জননীর প্রতি অগাধ নিশ্চিন্তি আর বিশ্বাসে।
ঝুনু সিঁড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায় ছায়াময় প্রতিমার মতো। অস্থিরতা কেটে ভারি শান্ত সে এখন। ধীর, স্থির তার স্বর, স্পষ্ট উচ্চারণ, বলে, ‘দেখো, তার যেন খুব কষ্ট না হয়।’