প্রাচীন ভারতে ক্ষাত্র ও ব্রাহ্মণের সম্মিলিত আধিপত্যে ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্ত্যজ মানুষজনের প্রান্তিক হয়ে পড়ার টুকরো ছবি আমরা পাই পুরাণ এবং মহাকাব্যগুলিতে। রামায়ণে শম্বুক হত্যা যেমন একটি অধ্যায়। শূদ্রের তপস্যার অধিকার নিয়ে রামের যে ক্ষোভ তা আসলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রেরই আমদানি। সত্যযুগ থেকে তপের অধিকার কেবল ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের, ত্রেতাযুগে বৈশ্যরা সেই অধিকার পায় তাও মান্য কিন্তু দ্বাপরে এসে শূদ্রের তপস্যা ব্রাহ্মণদের কাছে বিনাশক দিক হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে। এক ব্রাহ্মণসন্তানের অকালমৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় শূদ্রদের তপস্যা। ঋষিদের প্ররোচনায় রাম সেই ‘পাপাচার’ বন্ধ করতে পরিক্রমায় বের হন এবং শম্বুকের সন্ধান পান, দেবত্বলাভের চেষ্টায় শম্বুক কঠোর সাধনায় নিমগ্ন।
তপস্বী বলেন আমি হই শূদ্রজাতি।
শম্বুক নাম ধরি আমি শুন মহামতি।।
করিব কঠোর তপ দুর্লভ সংসারে।
তপস্যার ফলে যাবো বৈকুণ্ঠনগরে।।
শূদ্রের দেবতার স্থান দাবি করার মতো অনাচার আর কীসে!
তপস্বীর বাক্যে কোপে কাঁপে রামতুণ্ড।
খড়গহাতে কাটিলেন তপস্বীর মুণ্ড।।
দেবতারা এই ঘটনায় উল্লাসে পুষ্পবর্ষণ করেন রামের শিরে। আবার সেই রাম অন্যত্র হয়ে ওঠেন অচ্ছুত শবরীর ত্রাতা। রামদর্শনে তার মুক্তি লাভ হয়। অর্থাৎ যতক্ষণ না শূদ্রের ক্ষমতায়নের প্রশ্ন দেখা দেয়, সে বিপদের কারণ নয়। অস্পৃশ্য করে রাখা মানুষকে স্পর্শ ধন্য করে দেবত্বের মহিমা বিস্তার। যে করুণার পাত্র তাকে সমকক্ষ হতে দেখা মহাবিড়ম্বনার।
আবার মহাভারতে জতুগৃহের কাহিনি পাই, নিষাদজননীর পুত্র সহ দগ্ধ হওয়ার বেদনাতুর আখ্যান। রাজকুল বংশরক্ষার্থে অন্ত্যজ প্রাণ বড়ো সহজলভ্য! দ্রোণাচার্য চরিত্রটিকেও বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে একটা সময়। নিষাদজাত একলব্যের প্রতি তাঁর সেই অদ্ভুত আচরণ। সামান্য নিষাদ বালক ক্ষমতাবলে অর্জুনের সমকক্ষ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তার অঙ্গুলিচ্ছেদ! ক্ষাত্রদের আনুকূল্যে গড়ে ওঠা তাঁর উচ্চবর্গীয় অবস্থান বিপন্ন করে তুলতে পারে একলব্য, সেই অশনিসংকেত পেয়ে যান দ্রোণ, ফলে মহাগুরুর অন্যায় চাতুরী বিশেষ। এক-একসময় মনে হয়েছে, রাজকাহিনির স্বর্ণাভ গৌরবগাথা বর্ণন করতে করতে মহাভারতকার এই অহেতুক প্রান্তজনেদের নিয়ে টানাটানি করেছেন কেন? সেই আদিযুগ থেকে সামাজিক বৈষম্যের রূপ আদিকবিদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। এবং কবি বলেই রণরক্তসফলতার সুবিশালব্যপ্তির ফাঁকে-ফোঁকরে সুকৌশলে রেখে গেছেন অন্য, অপাঙ্ক্তেয় মনুষ্যজীবন।
এইসমস্ত কাব্যকাহিনির অবতারণা একারণে যে যুগলালিত মানসিক গঠনটি থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারিনি। সভ্যতা এগিয়েছে, আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটেছে দ্রুতবেগে আবার আমাদের পশ্চাদ্দেশে ঝুলে থেকেছে হনুমানের লেজের মতো দীর্ঘ পূর্বজ ধ্যানধারণা, সুপ্ত উচ্চবর্ণীয় জাত্যভিমান, যাকে আমরা সনাতনী ঐতিহ্যের নাম দিয়ে গর্ব করে যাই। আর সেই দর্প অহরহ ছিন্ন করে যায় নিষাদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। সাম্প্রতিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মেরুনা মুর্মুর প্রসঙ্গটিই ধরা যাক। বেথুন কলেজের এক চপলমতি ছাত্রী সরাসরি তাঁকে তাঁর জাত, পদবি পরিচয়ে কদর্য আক্রমণ করে বসে! শিক্ষিকার অ্যাকাডেমিক ইতিহাস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল না থেকে তাঁকে ‘কোটা’-র শিক্ষক ইত্যাদি চিহ্নিত করে এবং বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নাগরিক সমাজ ভাগ হয়ে যায় স্পষ্টত দুটি শ্রেণিতে। এমনকি যাঁরা ছাত্রীটির এমন সম্ভাষণ সমর্থন করেন না তাঁরাও জেনারেল ক্যাটেগরির চাকরি এবং শিক্ষাজনিত হতাশাকে চিহ্নিত করেন। ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে দেন, এই সংরক্ষণ ব্যাপারটি তুলে দিলেই বুঝি এমন বিভাজনমুক্ত হতে পারে সমাজ!
এই প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন মেরুনা। সম্প্রতি জেনারেল ক্যাটেগরিতে এক ওবিসি মহিলার সিলেকশনের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট মহিলাটির নিয়োগ আটকে দেয়। পরে যদিও উচ্চআদালত হাইকোর্টের এই রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় কিন্তু বিষয়টি এখনও বিচারাধীন। অথচ ২০০৪ সালে সুপ্রিমকোর্টের রুলিংয়েই অনগ্রসর শ্রেণির জেনারেল ক্যাটেগরির আসনে চলে আসার প্রতিবিধান রয়েছে! দ্বিতীয় ঘটনাটি মেরুনার নিজের। কলকাতা সংলগ্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংরক্ষিত জেনারেল ক্যাটেগরির মেধাতালিকায় প্রথম নির্বাচিত হন তিনি। এই নির্বাচন মেনে নিতে পারেনি জনৈক ব্রাহ্মণ অধ্যাপক এবং মেরুনা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন, অভ্যাগত সদস্য হিসেবে সমস্ত মিটিং এড়িয়ে গিয়েছেন অধ্যাপক মহাশয়। মেরুনা সেখান থেকে স্থানান্তরিত হবার পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের সম্পর্ক সহজ হয়! একদিকে বিচারব্যবস্থার একাংশ যেমন মনে করছে যে জেনারেল ক্যাটেগরিতে অনগ্রসর শ্রেণির নির্বাচন সঠিক নয়, অপরদিকে সাধারণ মেধাতালিকায় পিছড়ে বর্গের প্রথম হওয়া মেনে নিতে পারে না ব্রাহ্মণ্যবাদী মনন। অর্থাৎ মুর্মু, হেমব্রম, হাঁসদা, কোটাল প্রভৃতি পদবিধারী মানেই মেধার দিক থেকে পিছিয়ে, এই মানসিকতা একটা স্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করে আছে সর্বত্র। একদিকে জেনারেল ক্যাটেগরিভুক্ত আমি মেনে নিতে পারছি না চাকরি বা শিক্ষার লাভের যেটুকু গুড় কেন অনগ্রসর শ্রেণির পিঁপড়েরা খেয়ে যাবে, তাই সংরক্ষণ তুলে দাও। আবার সেই শ্রেণি থেকে যখন কেউ ‘কোটা’-র অপনাম ঘোচাতে সাধারণ নির্বাচনপদ্ধতিতে অংশ নিতে চায়, সেখানে দক্ষতা প্রমাণ করে, সেটাও সাধারণ্যের শিরঃপীড়ার কারণ হয়। পরিসংখ্যানগত দিক দিয়েও যদি দেখা যায়, সংরক্ষণজনিত কারণে সাধারণ গরিব মেধাবীদের চাকরিক্ষেত্রে বঞ্চনার অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। মেরুনা তাঁর বিভিন্ন লেখায় সেসব তুলে ধরেছেন। তথ্যের অধিকার আইনেও সম্ভব হচ্ছে পরিসংখ্যানের সত্যতা। ২০১৪-১৫ সালে এই রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তপশিলি নিয়োগ ছিল ৬% এবং জনজাতি নিয়োগ ছিল এক শতাংশেরও কম, দশমিক নয় এক (.৯১) শতাংশ মাত্র। মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে জেনারেলের ৯৫% নিয়োগ হয়, সমস্ত মন্ত্রক, প্রশাসনিক দপ্তর, নীতি আয়োগ, রেল, এবং নানা শ্রেণির কর্মচারীর পদগুলিতে কেবল জেনারেল ক্যাটেগরির আধিক্য। এমনকি বিধানসভার সদস্যপদগুলিতেও অনগ্রসর শ্রেণির শতকরা হার ১৯৭৭ সালে যা ছিল এখনও বিস্ময়কর ভাবে তাই! চাকরির এমন ভয়াবহ আকালের দিনে যেখানে শূন্য পদবিলোপ প্রতিদিনের সরকারি সূচি, কোটি কোটি মানুষ কর্মচ্যুত, এমন একটা সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার দিক থেকে অঙ্গুলি সরিয়ে সংরক্ষণকে দায়ী করা কেবল বিভ্রান্তি নয় অভিসন্ধি বিশেষ। শিক্ষিত মানুষজন দাবিটি তোলার সময় ভুলে যান যে চাকরির মহামারিতে কেবল জেনারেল ক্যাটেগরি ঘায়েল হয় না, অনগ্রসর শ্রেণিও ধরাশায়ী হয় যতই সংবিধান তাদের সুরক্ষার গল্প লিখুক। তথ্যপ্রমাণে তাদের নিয়োগের হার দেখলেই সেটা বোঝা যায়।
লোধা-শবর উন্নয়ন নিয়ে দুই-দশক ধরে লড়াই চালাচ্ছেন মৃণাল কোটাল। বর্তমানে তিনি লোধা-শবর উন্নয়ন সমিতির রাজ্যসভাপতি। সংগঠন বিস্তৃত হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে। তাঁর আর-একটি বড়ো পরিচয়, তিনি প্রয়াত চুনি কোটালের ভাইপো। চুনি কোটাল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গড়েছেন, সেই ট্রাস্ট প্রতিবছর একজন কবিকে চুনি কোটাল স্মারক সম্মান দেয়। মৃণাল নিজেও একজন কবি। লিখছেন জনজাতির উদ্ভবের ইতিহাস। একদিকে সাংগঠনিক কাজ অন্যদিকে লেখালেখি। কথা বলতে গিয়ে বোঝা যায় নিছক কবিতাচর্চায় আগ্রহ নেই তাঁর। লোধা-শবর সম্প্রদায় থেকে যদি একটি দুটি মানুষ তৈরি করে যেতে পারেন, যাঁরা এই সমাজের বঞ্চনাগুলির আখ্যান বাকি সমাজের কাছে পৌঁছে দেবেন, সেও এক সৃজনের সাফল্য মনে করেন তিনি। কুর্মী, সাঁওতাল সহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় অনেকটাই সংগঠিত। রাজনৈতিক প্রতিনিধিও তাদের রয়েছে, কথা বলবার জায়গা সামান্য হলেও তৈরি করছে তারা। কিন্তু লোধা-শবরদের অবস্থাটি এমন যে কী কেন্দ্র সরকার, কী রাজ্য, এখনও পর্যন্ত লোধা-শবর জনজাতির প্রকৃত সংখ্যাই নির্ণয় করে উঠতে পারেনি। নবগঠিত ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড় অঞ্চলের দশটি গ্রামে এখনও লোধারা সার্টিফায়েড নয়, আক্ষেপ তাঁর। ফলত মৃণালরা ব্লক অঞ্চল ধরে ধরে নিজেরাই সার্ভেতে নেমেছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য মায়েদের, শিশুদের পুষ্টির মতো জরুরি বিষয়গুলির সম্ভাবনার খোঁজ করে চলেছেন।
কিছুদিন আগেই শালবনীর পাথর কুমকুমিতে স্থাপন হয় চুনি কোটালের মূর্তি। লোধা-শবর জনজাতির কাছে তিনি এক স্বপ্নের নাম। এই জনজাতির প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। ছোটোবেলায় পিসির স্নেহের স্মৃতিচারণের সঙ্গে মনে আসে তাঁর লড়াইয়ের প্রসঙ্গ, গ্রামের মানুষদের স্কুলের যেতে উৎসাহ দেওয়া, কিশোর ভাইপোকে বোঝানো শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নেই তাদের। সেই লড়াকু মেয়েও একদিন বিপর্যস্ত হয়, আসে মর্মান্তিক পরিণতির কথা, তাঁর আত্মহননের খবর। সেই মৃত্যু প্রতিবাদের জ্বলন্ত শিখা হয়ে ওঠে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত পিসিকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে সে আসলে কে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃত নম্বর কম দেওয়া হয়েছে, ক্লাসে নিয়ত অপমান পিসিকে ভেতর থেকে তছনছ করে দেয়। মৃণাল থামেন। হয়তো সেই অসম্পূর্ণ উড়ানের কথা মনে হয়। নিজে শেষ করতে না পারলেও বাকিদের কাছে সেই অসম্ভব আশা রেখে যান, এই বিভেদের আকাশেও ডানা মেলার স্বপ্ন সম্ভব।
কেমন আছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলার লোধা-শবররা? একপ্রকারের বুনো আলু, বামলা আলু তেড়ে, গেঁড়ি গুগলি শামুক বেচে, হরেক বনছাতু, কুরকুরে অর্থে পিঁপড়ের ডিম, বাঁদরকলা লতার ফল, নানা লতাগুল্ম বিক্রি করে, বনমুরগি, এখানে বলে কয়ে ধরে, জলজঙ্গল আঁকড়ে দিনানিপাত। ছেঁড়া কাঁথা মুড়ে শুয়ে থাকে এক-একটা পরিবার। অরণ্যের সেই অধিকারও এখন কেড়ে নেবার প্রক্রিয়ায়। বনদপ্তর যখন তখন এসে বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে যায়, চাষের জমিতে বনসৃজন প্রকল্প। ফরেস্ট অ্যাক্টকে কেন্দ্র সরকার নিয়ত দলে মুচড়ে ফেলছে। আমলারা আসেন। উন্নয়নের খতিয়ান দেওয়া হয়। গত অর্থবর্ষে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর এবং আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর থেকে ৯ কোটি ২ লক্ষ বরাদ্দের কথা জানানো হয়। এদিকে গ্রামগুলির স্ব-সহায়ক মহিলাদল মাসের পর মাস টাকা পান না। ৭৫ টি জনজাতি গোষ্ঠীকে নিয়ে যে PVTG (particularly vulnerable tribal group) গঠিত হয়েছিল তার আর্থিক বরাদ্দ এখন মিশে গেছে আবাস যোজনার সঙ্গে। লোধাদের জোটে সামান্যই। আর তাই দেখিয়ে আদিবাসী মানোন্নয়নের খবরে দৃপ্ত হয় সংবাদপত্র, সান্ধ্য টেলিভিশন আসর।
লোধা-শবরদের নিজস্ব স্বর গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন মৃণাল কোটালের মতো যুবকেরা। নাগরিক সমাজ সরকারি ঘোষণায় বিবেক শান্ত করে। বাস্তবের অভিজ্ঞান তাঁদের কাছে অধরা। লেখক এসে লেখার রসদ খোঁজেন, অ্যানথ্রোপলজির ছাত্ররা আসে রিসার্চের ডাটা সন্ধানে। তাঁদের সাহিত্যক্ষেত্রে সুনাম হয়, পুরস্কার হয়। গবেষকের পেপার রেডি হয়। তারপর অরণ্যের পথ ভুল হয়ে যায়। আদিবাসী মানুষের জীবনের সঙ্গে আসলে তাদের কোনো কালেই প্রকৃতি যোগ নেই, ভাবনা নেই। প্রশাসনের লোকেরা চাকরির দায়ে এক-দুটো ভিজিট দেন, ভোটের সময় মন্ত্রী, সান্ত্রী। আড়ালে জংলি মানুষদের জীবনচারণ নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়। অরণ্যের মানুষেরা বাইরের বাবুদের কাছে নত থাকতেই পছন্দ করে, মুখে একটা গোবেচারা হাসি ঝুলে থাকে সারাক্ষণ। তাদের উচ্চস্বর বাবুদের পছন্দ নয়। সভাসমিতিতে দুই-একজনকে প্রতিনিধি করে খাবারের প্যাকেট আর মিনেরাল ওয়াটারের বোতল ধরিয়ে দিলেই পরিবারের কাছে গর্ব করে বলার মতো ঘটনা হয়ে যায়। এই হীনতাকে সহ্য করতে পারেন না মৃণাল। নাগরিক সমাজের সঙ্গে প্রান্তিকের কোনো আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয় না এভাবেই। কী সাধারণ্যে কী রাজনৈতিকতায়। তাই সহজেই সংরক্ষণের যৌক্তিক দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশ। অবলীলায় নিম্নশ্রেণি বলে ব্যঙ্গ, উপহাস ছুড়ে দিতে পারেন। বহুযুগ সঞ্চিত এই উদাসীনতা মজ্জায় বহন করে চলেছে অরণ্যচারী মানুষেরা। আবার এখান থেকে ছিটকে যাদের কয়েকজন এসে পড়ে নাগরিক বিশুদ্ধতায়, আর্থিক ভাবে কিছুটা এগিয়ে থাকে, যাদের ‘ক্রিমি লেয়ার’ নামে গালভারী অভিধা দেওয়া হয়ে থাকে, প্রতিপদে তাদের ভুগতে হয় জাতের হীনম্মন্যতায়, আবডালের তাচ্ছিল্যে। অরণ্য থেকে তারা দূরে সরে যায় আর সভ্য সমাজ তাদের দূর করে রাখে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা কী সংরক্ষণের সুবিধে নিয়ে যাবে? প্রশ্ন ওঠে। বাম আন্দোলনে যুক্ত বহু মানুষ মনে করেন আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন, তাই এই অধিকার থাকাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, আর্থিক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা মানেই আর্থিক ভাবে সুরক্ষিত এমন বলা যায় না। এই লিনিয়ার বোধ থেকে বাইরে এসে বৃহত্তর সমাজের আরও গভীর অনুধাবন প্রয়োজন। সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো, একজন অভাবী জেনারেল ক্যাটেগরির সঙ্গে একজন অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রের দারিদ্র্যের ফারাক বিস্তর। দুটির মাপকাঠি কোনোদিনই এক হতে পারে না। আর নম্বর দিয়ে মেধার বিচার তো একেবারেই নয়। তাদের ৪৫% একজন সাধারণ ছাত্রের ৮০% নম্বরের সমান বলেই স্পষ্ট ব্যাখ্যা তাঁর।
মেরুনার বাবা আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের অফিসার ছিলেন। ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। অরণ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন, নিজের জনজাতির মানুষদের অনুপ্রাণিত করেছেন সভায় সভায়। আপসহীন উচ্চশির এক মানুষ। কঠিন সংগ্রামে মেরুনা গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজের অবস্থান। পর্যায়ক্রমিক জাতিগত আক্রমণে বিধ্বস্ত হন, ক্লান্ত হন কিন্তু লড়াই থামাবার কথা তিনি বলেন না। বছরের পর বছর লিখে চলেন জনজাতির অধিকার নিয়ে। অপরদিকে মৃণাল কোটাল সেই লেখার সঙ্গে যোগ করতে চান সাংগঠনিক ক্ষমতাকে, শৃঙ্খলাকে।
একটা উঁচু স্বরের প্রতীক্ষায় থাকেন মৃণাল কোটাল, মেরুনা মুর্মুরা, অন্য এক স্বর। যা এই জনজাতির সম্মিলিত স্বর হয়ে আছড়ে পড়বে। ব্রাহ্মণ্যবাদী নাগরিক সমাজ তথা রাষ্ট্র চমকে উঠে একদিন যা কান পেতে শুনতে বাধ্য হবে।
"চাকরির এমন ভয়াবহ আকালের দিনে যেখানে শূন্য পদবিলোপ প্রতিদিনের সরকারি সূচি, কোটি কোটি মানুষ কর্মচ্যুত, এমন একটা সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার দিক থেকে অঙ্গুলি সরিয়ে সংরক্ষণকে দায়ী করা কেবল বিভ্রান্তি নয় অভিসন্ধি বিশেষ। শিক্ষিত মানুষজন দাবিটি তোলার সময় ভুলে যান যে চাকরির মহামারিতে কেবল জেনারেল ক্যাটেগরি ঘায়েল হয় না, অনগ্রসর শ্রেণিও ধরাশায়ী হয় যতই সংবিধান তাদের সুরক্ষার গল্প লিখুক।"
লাখ কথার এক কথা। এটাই আসল সমস্যা। মনে করুন খাবারের প্রার্থী আছে ১০০০০০(১ লক্ষ ) আর খাবারের পাত আছে ১০০ টি। যদি সব ঠিক ঠাক থাকে তাহলে এস সি পাবে ৭টি, এস টি পাবে ১৫টি , ও বি সি পাবে ২৭টি এবং জেনারেল পাবে ৫১টি পাতের খাবার।
প্রশ্ন হল বাকি ৯৯ হাজার ৯০০ প্রার্থী কী করবে? তাঁদের কি কম খিদে পায় না কি পায় না ? খিদেরও কি জাত ধর্ম আছে ? সমস্যাটা এই জায়গায়। ঝগড়া ঝাটি পরেও করা যাবে। আগে এক লক্ষ পাতের ব্যবস্থা কর। সবার খিদে মিটে গেলে সংরক্ষণ নিয়ে এত কথাই উঠবে না। এমন আশা কি আমরা করতে পারি না ?