‘কাস্ট অ্যাওয়ে’ ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, প্রশান্ত মহাসাগরে বিমান ভেঙে পড়ার পর একমাত্র জীবিত যাত্রী চাক নোলান্ড ( অভিনয়ে টম হ্যাঙ্কস) ভেসে গিয়ে পড়ে এক অমানব দ্বীপে। অসম্ভব জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার রসদ সে জোগাড় করতে পারে কিন্তু মানুষ কেবল দেহে বাঁচে না, সঙ্গী হিসেবে চায় অপর কাউকে। জলে ভেসে আসা একটি ভলিবলকে সে রূপ দেয় মানব মুখের। নিঃসীম একাকিত্বে সেই তার কথা বলার সঙ্গী হয়ে ওঠে। তুচ্ছ বলটিকে ভালোবেসে ফেলে এতটাই, তা একদিন ঢেউয়ে ভেসে হারিয়ে গেলে প্রিয়জন বিচ্ছেদের হাহাকার ডুকরে ওঠে। মানুষ তো আসলে ভালোবাসতেই চায়, প্রকৃতিগত ভাবে এই বিরল অনুভূতির অধিকারী সে এতটাই যে কেবল একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে পারে, এমনকি নির্জীব, জড় কিছুকে ভালোবেসেও ভুলে যেতে পারে দীর্ঘ একাকিত্বের যাপন। ভালোবাসা দিয়ে অপ্রাণে সে প্রতিষ্ঠা করে জীবন।
‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার’ (২০২২) নামে স্বল্প দৈর্ঘ্যের তামিল তথ্যচিত্রটি তেমনই এক ভালোবাসার গল্প বলে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত একই নামে লরেন্স অ্যান্থনির একটি বই আছে। বিপজ্জনক আফ্রিকান হাতিদের যে নৃশংসতায় গুলি করে মারা হত তার কথা, সেই হাতিদের রক্ষা করতে লরেন্স ও তাঁর সহযোগীদের ভূমিকা, এসব নিয়েই বইটি। কিন্তু নাম একই হলেও সদ্য অস্কারপ্রাপ্ত ছবিটি আদ্যন্ত ভারতীয়, মানুষ এবং হাতির পারস্পরিক সম্পর্কের মৌলিক আধারকে ধরে। এ গল্প বোমান ও বেলির, এ গল্প দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত অরণ্যভূমের এক দম্পতির অপত্য স্নেহে বেড়ে ওঠা হস্তিশাবক রঘুর। বোমান নিজের পরিচয় করায় কাট্টুনায়কন বলে, যার অর্থ জঙ্গলের রাজা। দেশজুড়ে অরণ্য ধ্বংসের কালে, যাবতীয় অরণ্য-প্রাণের হত্যালীলার নৃশংস সময়ে, অরণ্যবাসী সরল মানুষ, বনের পশু আর তাদের ঘিরে থাকা অপার সৌন্দর্যময় বনানীকে চিত্রিত করে এ ছবি। যেখানে বন, বন্যপ্রাণ আর মানুষের জীবন অভিন্নতায় গাঁথা।
তামিলনাডুর মুমালাই ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত থেপাকাডু হস্তি শিবির, এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এলিফ্যান্ট ক্যাম্প, প্রায় ১৪০ বছরের পুরনো। খাবার আর জলের সন্ধানে হাতিরা পাড়ি দেয় সুদীর্ঘ পথ যা এলিফ্যান্ট করিডর নামে সুবিদিত। মানুষের লোভ এই করিডরগুলির ক্ষতিসাধন করে যত্রতত্র গড়ে তুলছে হোটেল-রেস্তোরাঁ। হাতিদের স্বাভাবিক চলাচলে যা ক্রমে দুর্লঙ্ঘ বাধা হয়ে উঠছে। নির্দিষ্ট রাস্তা ছেড়ে হাতিরা ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। তামিলনাডুতে প্রবল খরায় জল ও খাবারের সন্ধানে হাতিরা পাড়ি দেয়। চলার গতিতে হস্তিশাবকরা দলছুট হয়ে পড়ে। একা অরণ্যে দিকশূন্য ঘুরে অন্য প্রাণীর আক্রমণে অথবা খিদের জ্বালায় এটা ওটা খেয়ে বিষক্রিয়ায় মরে তারা। তেমনই আহত, বিক্ষত একটি শাবককে বনবিভাগ পাঠায় এই প্রৌঢ় দম্পতির কাছে। অনাথ হস্তিশাবককে বাঁচিয়ে তোলা বড় কঠিন কাজ। বামন আর বেলি হল সেই ‘হুইস্পারার’ যারা তাদের শারীরিক ভাষায় হাতিকে প্রশিক্ষণ দেয়, দেখভাল করে, বড় করে তোলে জনক-জননীর বাৎসল্যে।
জঙ্গল বড় পবিত্র বোমানের কাছে, তাই সে খালি পায়েই হাঁটে অরণ্যের অলিগলি। বেলির আগে একটি বিয়ে হয়েছিল, লোকটি বাঘের হানায় মারা যায়। তাই জঙ্গলে তার বড় ভয়। এখন সে বোমানের সঙ্গে থাকে। দুজনে মিলে বনবিভাগের সহায়তায় হস্তিশাবকদের বাঁচিয়ে তোলার দুরূহ কাজকে সম্ভব করে তোলে। বুঝি মা, বাবা আর তাদের হস্তি শিশুটি, এই পরিবার। সকালে আদরের ডাকে শিশুকে ঘুম থেকে তোলা, তাকে যবের তাল, নারকেল খাওয়াতে সাধিসাধনা, পাইপের জলে স্নান করানো, কখনো জলাশয়ে হাতির জলক্রীড়া, সাবানের ফেনায় ব্রাশ দিয়ে রুক্ষ, মোটা চামড়া ঘষে তাকে পরিষ্কার করা, মাথার স্বল্প চুলে তেল মাখানো। সারাদিনে অবিরাম কথা হয় তাদের রঘুর সঙ্গে, রঘু এটা করিস না, ওটা করিস না, খাবার এভাবে ফেলতে নেই। রঘু আয় আমার পাশটিতে শো একবার, বাধ্য শাবক পা মুড়ে শুয়ে পড়ে ঘাসে। গণেশ পুজোর দিন রঙিন চক খড়িতে দক্ষিণী রীতিতে হাতির মুখমন্ডল চিত্রিত করে বোমান, তার শুঁড়, বিঘত কান, কপাল। ফুলের মালা পরায়, সে মালা রঘু খেয়ে ফেলতে চাইলে ধমক খায়! আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি এলে বাবা যেমন সন্তানের মাথায় ছাতা ধরে, বোমানও নিজে ভিজে ছাতাটি তুলে ধরে হস্তিশাবকের মাথায়। এভাবেই একদিন জঙ্গলের ভয় আর অন্তর্বেদনা জয় করেছে বেলিও। তার আগের পক্ষে্র একটি কন্যা ছিল যার অকালমৃত্যু হয়। পালিত হস্তিশাবকটি শুঁড় দিয়ে সেদিন তার চোখ থেকে কান্নার জল মুছিয়ে দেয়। বেলি তার দুঃখ ভুলেছে। মানুষ আর এক মূক প্রাণী বাঁধা পড়ে কোন সে গভীর আত্মীয়তায়। অস্ফুট ভালোবাসার ভাষা বুঝে নেয় একে অপরকে। যে ভাষাকে ক্যামেরায় ধরা এক অসাধ্য সাধন।
তবু একদিন যাবার সময় হয় রঘুর। বনবিভাগ ফেরত চায় হাতিকে। তারা মিনতি করে হাতিটিকে রেখে দেবার কিন্তু নিষ্ফল সে আবেদন। রঘু চলে যায়। নীরবে চোখের জল ফেলে বোমান আর বেলি। সন্তানকে দূরে পাঠাতে হলে যেভাবে দুমড়ে যায় মন। কিন্তু ততোদিনে এসে গেছে নতুন একটি হস্তিশাবক, তারা নাম দিয়েছে আম্মু। হাতির সেবায় উৎসর্গীকৃত জীবন থেমে থাকে না। দূরের বন থেকে কখনো দেখা করতে আসে রঘু। বোমান হাঁক দেয়, কেমন আছিস রে রঘু? রঘু তার শরীরী ভাষায় জবাব পাঠায়। আশ্চর্য মুহূর্ত ধরে ক্যামেরা।
কার্তিকী গঞ্জালভেস নির্দেশিত ৪০ মিনিটের এই তথ্যচিত্র নিপুণ ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল আর মনোমুগ্ধ ফটোগ্রাফিতে ধরে জঙ্গল জীবন, তার খুঁটিনাটি। দিগন্তময় সবুজ, ঝোরার জলে পড়া সূর্যালোক, পাহাড়ের গায়ে গায়ে মধুচাক। জীবিকার তাগিদে বিপজ্জনক ভাবে সেখানে ঝুলে অরণ্যচারী মানুষ সেগুলি ভেঙে পেড়ে নামায়। অরণ্যের অগণন কীটধ্বনি,সাঁঝ, সকাল, ঘন বাদল, বৃষ্টি, কুয়াশার ভোর, সেই ভোরে হাতির পিঠে চেপে বোমানের চলে যাওয়া। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এ বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস যজ্ঞের কালে, সামগ্রিক ইকোসিস্টেম তছনছ করে আত্মবিনাশের সময়ে এই ছবি প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মধ্যেকার অবিচ্ছেদ্য,অথচ অস্ফুট বন্ধনের ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করে। কোনো পুরস্কার নয়, এটাই এ ছবির একমাত্র সার্থকতা।