বাবু,আমি একজন গরিব সাঁওতাল বটি। আমার কথাতে কিছু মনে লিস না। আমরা বন-জঙ্গলের মানুষরা বার বার তো হেরেই গেলমl। খেটেখেকো মানুষ। না আছে আমাদের ভালো ঘর-দুয়োর,না আছে লিজেদের চাষের জমিন।
বনের ভিতর রাঙাকুল, কুসুমকানালী, নবীনডাঙা, মহুলবনী সব ছোটু ছোটু আদিবাসী গাঁ-গিরাম। ধারেপাশে চাষাভুষো, ঘোষ, মাহাতো, সিংদের বাস। জমিগুলান তো উয়াদেরই। আকাশের পানে চাঞে চাঞে একবার চাষ। কেউ কেউ কাঠের ব্যাবসায় ফুলেফেঁপে কলাগাছ। তাদের চাষবাসে মন থাকবেক ক্যানে! আমরাই মুখিয়ে থাকি চাষ করার লেগে। তিনভাগের একভাগ, লয়তো টাকা চুক্তি। গরিব মানুষ, লগদ টাকা কুথাকে পাব! ভাগেই লিয়ে লি। তাতে কি সারাবছর চালানো যায়? হাঁড়িতে টান পড়লে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় সব পিচ রাস্তার ধারে, আর হাত দেখিয়ে চেপে পড়ি পুব মুখো যে কুনু বাসে। উধারে তো কাজের কুনু অভাব নাই। মারাং বুরুর কৃপায় শরীলে খেটে খেতে পারলেই হল। ক্যানেলের জলে দু'বার সোনা ফলে মাঠে। বনধারে যেমন জলের টান,খাদ্যের আকাল হবেকই এমন লতুন কথা কী!
সিংবাবু ইখানের বড় আড়তদার। কাঠের ব্যবসা। বাড়ি বন ঘেঁষে রেললাইনের উ পাশে। বাড়ি তো লয়, যেন একটো দুর্গ। ছেলেপুলে লিয়ে কারবারে ভালই উন্নতি করেচে। আমাদের মেয়ে-মরদরা বনের শুকনো কাঠ কুড়ায়ে লিয়ে যায় রেলের পুল পেরিয়ে বাবুর আড়তে। বোঝা সহ উজন করে কিনে লেয়। বাজারে দাম বেশি হলেও হাতের কাছে পেলে কে আর যেতে চাই!
বাবুর বিঘে-দেড়েক জমি চাষ করি আমি। লখার মা উয়ার আড়তেই কাঠ দিয়ে আসে। তো ইবছর বেদম খরা হলেক। মাঠ-ঘাট,পুকুর সব শুকাইয়ে কাঠ! জলের জন্যি খাঁ খাঁ করতে লাগলেক। ধানের ফলন ভাল হলনি। ছোট ছোট গাছ। খেতে না পেলে মায়ের বুকের দুধ যেমন শুকায়ে যায়, শিষগুলাও তেমন পারা। সারাবছর খাব কী! পেছুনে আ-ঝুঁরা বাঁশ! কী করে যে বাবুর কাছে গিয়ে কথাটো বলি!
তো সুযোগটো পাইয়ে গেলম। লখা কুথা থিক্যা ফাঁদ পেতে একটো ডাহুক পাখি ধরে এনেচে। বইল্লম,পাখিটো দে বাপ। বাবুকে দিয়ে আসি।
লখা তো দিতেই চায় না। বইল্ল,শুদু শুদু দুব ক্যানে?
আমি বইল্লম, শুদু শুদু লয় রে বাপ। বাবুকে খুশি কইরতে হবেক, পাখির মাংস খেতে ভালোবাসে। আমরা যে উয়ার জমি চাষ করে খাই।
লখা কী বুঝল কে জানে।কথা বাড়াল না।
সাঁজের বেলা পাখিটো লিয়ে গেলম। আড়তের সামনে আমগাছের তলায় তক্তার উপরে সিংবাবু বসে বসে ছেলের সঙ্গে কীসের যেন হিসেব লিকেস করছিল। আমাকে দিখেই বইল্ল,আরে হাঁসদা যে! হাতে কী ওটা?
আমি বাবুর আরও কাছে এগিয়ে গেলম। বাবু ভালো করে দিখে বইল্ল, বা বা বা! ডাহুক পাখি এনেছিস!
বাবু আমাকে কুনুদিন সনাতন হাঁসদা বলে না, শুদুই হাঁসদা। বুঝলাম ডাউক পেইয়ে বাবু গদগদ খুশি। মেজো ছেলে হারু আমার হাত থিক্যা পাখিটো লিয়ে চলে গেল। আড়তের পেছুনেই প্রাচীর ঘেরা বাড়ি। আমি তক্তার নিচটতে বসলম।
বাবু বইল্ল, ধান ঝাঁড়া হল?
— হ বাবু, তুকে উ কুথাটোই তো বইলতে এলম রে। খরায় ধান তো ইবার সব শ্যাষ! পুঁয়াল-টুয়াল ঝেঁড়ে মুটেই ছ-বস্তা।
বাবুর মুখটো গম্ভীর হয়ে গেল। রেগে বইল্ল,বলিস কী রে হারামজাদা! ছ-বস্তা? মাঠে গিয়ে দেখে এসেছি,লকলকে গাছ।
—তেখন তো বাবু হইয়েছিল। ম্যাগে জল নাই। গাছগুলান তাপ্পর কেমন লেতিয়ে পড়ল যে! মিনতি করে বইল্লম বাবুকে।
—ওসব ধানাই পানাই ছাড়। কাল হারু গিয়ে দেখে আসবে কেমন ছ-বস্তা। চালাকি মারার জায়গা পাসনি!
— হ বাবু, তাই পাঠাবি ক্যানে। তুকে মিছে কথা বলিনি রে!
হারু এলেক নাই। পরের দিন সকালে সিংবাবু লিজেই গটগট করে হাজির। আমাদের পরব পালায় মাঝেসাঝে আসে। তেখন কুথায় যে বসতে দিই, কীই বা খাওয়ায় চিন্তায় পড়ি। আমরা হাঁড়িয়া খেয়ে মেয়ে-মরদ লাচালাচি করি। ছোট গাঁ। ধামসা মাদল কেনার ট্যাকা নাই। আগে সবই ছিল,কুনদিন ভেঙে গ্যাছে। গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে ডাগর হলে,বিয়ে বাপলার সুময় ভাড়া করে লিয়ে আসি। পরবে পালায় ছেলে-ছুকরারা কেলাবে বাজনা দিয়া মাইকের গান লাগায়। তাতেই লাচি। সিংবাবু আমাদের লাচগান দিখে পরে,ফিসফিস করে বলে,আমাকেও হাঁড়িয়া দে এক গ্লাস। চেখে দেখি। হারুকে আবার বলিস না যেন!
না না বাবু। তুই চিন্তা করিস না। যতঅ পারিস খিয়ে লে ক্যানে। মিটিমিটি হাসি আমি। ছেলের কাছে বাপ লুকাইতে চায়। আমাদের তো উসব নাই। বাপে ছেলে একসাথেই দমে খিয়ে লি।
সেই সিংবাবুর চোখগুলান আজ ইমন লাল ক্যানে গো! আমার ভয় লাগে। বইল্লম,আয়,আয় বাবু। ভিতর বাগে পেরিয়ে বস ক্যানে।
বাবু মিজাজ দিখাইয়ে বইল্ল,বসতে আসিনি হাঁসদা। সুর সুর করে ধানগুলো দেখা।
তো ধানগুলান দিখালম বাবুকে। বাবু চোখ পাকাইয়ে বইল্ল,কোথাও লুকিয়ে রাখিসনি তো?
— না না বাবু। ইমন কাজ আমি জীবনে করবুনি। বলে দুই হাতে কান মললাম,—কাউকে শুধায়ে দিখ ক্যানে।
— চাঁদমনি,গণা মূর্মু ওদের যে ধান ভাল হয়েছে। কী করে চাষ করছিস?
—ওরা বাবু কুথা থিক্যা পাম্প এনে সিঁচে ছিল দু'বার। উখানের মাঠে তো শ্যালো আছে।
বাবু মুখ গোঁজ করে চলে যাচ্ছিল। বইল্লম,ইবারের মতন আমাদেরই খেতে দে বাবু। ই ক'টা ধান। বউ ছেলে লিয়ে খাই ক'টা দিন। পরের বারে শুধ করে দুব।
বাবু থমকে দাঁড়াল। গলা নামিয়ে বইল্ল,তোর আবার খাবার অভাব! ঘরেতে জোয়ান বউ। সাঁজেরবেলা পাঠিয়ে দিবি আড়তে। আমি তো আছি নাকি! লোকজনের কাছে তো আর দেওয়া যায় না! বলে বাবু আর দাঁড়াল না। মুখে এক কেমন যেন হাসি। ইমন হাসি দিখে বুকটা আমার ছ্যাঁত করে উঠল। বাবু ই কী কুথাটো বলে গেল গো! লখার মা'কে ইবার আড়তে কাঠ দিতেই পাঠাব কুন সাহসে!
পাশের গাঁ মহুলবনীতে মেলা বসেছে। শালুই পরবে আমাদের গাঁয়ে তেমন ধুমধাম হয় না। উখানেই সব সাঁজুগুজু করে যাই। ই সুময় প্রতি বছর মোরগ লড়াই হয়। ইবছর আমিও 'হাউসি' হইচি। যে মোরগ লড়াই লাগায় সেই হল হাউসি। আমি তো কখনও লড়াই লাগাইনি। ইবছর পরবে শখ হইচে খুব।
মোরগটাকে সেই ইতটুকুন ছানা বয়সে লখার মা এনেছিলেক উয়ার বাপের গাঁ থিক্যা। মরার লেউল, খঁটাশের মুখ থিক্যা কতবার যে মরতে মরতে বাঁচেছে! ইখন ধেড়ে হইছে। লাল টুকটুকে রঙ। ভোরের বেলা ঝুঁঝকি আঁধার থাইকতে,কঁক ক্কঁকর কঁক করে বাঁক দেয়। উয়ার বাঁক শুনে গাছের পাখপাখালিরা ডাকতে শুরু করে। ইকাই সারা গাঁয়ের মুরগীগুলার পেছু পেছু ঘুরে। বনের রাজার মতন ঘাড়ের পালক ফুলায়ে হাঁটে। ইমন মোরগ যদি না লড়বেক,তাইলে কীসের লেগে উয়ার জন্ম?
লখা আমার লুঙির কোঁচায় টান মেরে বায়না ধরল,আমুও যাব বাবা। আমাকে তুর সাথে মিলা দিখাতে লি' চল।
লখার মা বইল্ল,তাই লিইয়ে যাও ক্যানে গো। ছোটু ছেলে আমার। পরবের দিন মিলা দিখবে,ঝিলাপি খাবে,তা না—এ কেমুন বাপ গো তুমি!
তো বইল্লম,চ' তাইলে।
মাঠে মাঠে সরষের ফুল এসেচে। উঁচু,নিচু টিলা জমি। সব ইখন হলুদ। ইখন তো ফুলেরই পরব। সরু লিকলিকে আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে মেলা দিখতে যাচ্ছে বুড়ো,বুড়ি,ছেলে-ছুকরা। কেউ কেউ লাল মোরাম রাস্তা ধরে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে সাইকেল চালিয়ে ছুটচে। বনের পাশেই ডাঙা টিলা মাঠ,উখানেই মেলা বসেছে। মনোহারি জিনিসের দুকান,বাচ্চাদের বাঁশি,ডুগডুগি খেলনা। কত রকমের খাবার দাবার,তেলে ভাঁজা,ঝিলাপি। কুথাও বা গাছের তলায় মাটির হাঁড়ি-কুড়ি বিচছে। এক জায়গায় সাইকেল,পিক-আপ ভ্যান দাঁড় করানো সারি সারি। ইকটো সাঁওতাল বুড়হা ঘুরে ঘুরে আড়বাঁশি বিচছে। লিজেই সুর তুলচে মন গেলে। লাল ধুলো উড়ছে আকাশে। সেই ধুলো মেখেই মেয়ে মরদ হাত ধরাধরি করে ঘুরছে। আশপাশের সব গিরাম থিকেই ভিড় জমিয়েছে। শুধু কি সাঁওতাল? বাবুরাও মজা লুটতে আইচে। সবাই লতুন লতুন জামাকাপড় পরে,সাজুগুজু করে আইচে। মেয়েরা মাথায় কচড়ার তেল দিয়ে সিঁথি ফেঁড়েচে,খোঁপায় গুঁজেছে বুনোফুল।
মেলা থিক্যা অনেকটো আড়ালে বনের ভিতরে ইকটো ফাঁকা জায়গায় অ্যানেক মানুষের ভিড়। সিখানেই মোরগ লড়াইটো হচ্চে। আগে মেলার মাঠেই হতুক। পুলিশের গাড়ি এসে ক'বার সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলেক। সেই থিক্যা বনের ভিতর। লখাকে লিয়ে উখানেই গেলম। শালের খুটি পিটিয়ে দড়ি দিয়ে গোল করে ঘেরা হইচে জায়গাটা। দড়ির চারিধারে সব দাঁড়িয়ে আছে। কেউ বা হাউসি,হাতে মোরগ। কেউ বা শুদুই দিখতে আইচে।
লখাকে একটো ক্যাঁন্দ গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে বইল্লম,কুথাও লড়িস না বাপ। এই ঠাঁই দাঁড়া। দাঁড়িই দাঁড়িই লড়াই দিখ। আমাকে মোরগটার জুটি খুঁজতে হবেক যে।
মোরগটা লিয়ে আমি ঘুরেফিরে জুটি খুঁজছি,ইমন সুময় কাঁধে ফটোক তুলার মেশিন লিয়ে একটো স্যুট বুট পরা বাবু লোক ভিড় ঠেলে ঢুকল। সবাই লোকটোকে চাঞে চাঞে দিখল।
কয়েকজন 'কাতকার' দড়ির ভিতরে ঢুকে মোরগের পায়ে ছুরি বাঁধছিল। উয়ারা বাবুটোকে দিখে বইল্ল,এই বাবু,তুই ইখানে কী ধান্দায়? লড়াইটোকে বাজারে ছাড়ে দিতে চাস? ফটোক তুলা বন্ধ কর বলচি।
বাবু লোকটো হুমকি খেয়ে মেশিনটোকে ব্যাগের ভিতর পুরে দিল।
খুঁজতে খুঁজতে পড়বি পড় সিংবাবুর ছামুতেই! শৌখিন মানুষ। শখ করে পেরায় মোরগের লড়াই লাগায়। হাটবারে টাকার বাজি ধরেও খেলে মাঝেসাঝে। বাবুর হাতে একটো তেজি মোরগ। আমাকে দিখে বইল্ল,কী রে হাঁসদা,তুইও আনলি?
মাথা হেট করে বইল্লম,হ বাবু। শখ করে আনিচি।
—তোর যে এবার অসময় রে! তাহলে এতো শখ কী করে মিটোচ্ছিস ?
আমার হাতের মোরগটোকে দিখে বাবুর মোরগটো গলা খিঁচে, ঘাড়ের পালক ফু্লায়ে ফুঁসছে। বাবুকে যেখন ছ'বস্তা ধানের কথা বলেছিলম,বাবুও তেখন অমন করে তাকিয়েছিলেক। আমার মোরগটারও চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। জুটি দুটো ভালো,তা বলে বাবুকে বলা যায়! নামী মানুষ, আমার মোরগের সাথে উয়ার মোরগের লড়াই লাগাবেক ক্যানে!
পাশেই মোরগের পায়ে ছুরি বাঁধছিল পাঁচালের 'কাতকার' হীরালাল। হঠাৎ মোরগ দুটোকে দিখে ফস করে বলে দিল,দুটোটে বেশ মানাবেক ভালো। লাগিই দাও ক্যানে।
হীরালালের মাথাটো খারাপ হয়ে গেল নাকি! বলে কী! সিংবাবুর মতন মানুষ আমার মোরগের সাথে লড়াই লাগাবেক! গরীব সাঁওতাল আমি,বাবুর জমি চাষ করে খাই। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলম বাবুর কথাটো শুনে।
— কী রে হাঁসদা,রাজি আছিস তো?
আমি কাঁচুমাচু করে বইল্লম,তুর যা ইচ্ছা বাবু।
হীরালাল মোরগদুটোর পায়ে ছুরি বাঁধতে লাগল। ছুরি তো বলি না। হেতের বলি। আরও বেশ কিছু মোরগের পায়ে হেতের বাঁধার কাতকার এসেচে। এত মোরগের খেলা! একজনে বাঁধলে খেলা শেষ হতে রাত হয়ে যাবেক।
হরিণডাঙার ডিলার বুধন ঘোষের সঙ্গে পাঁচালের ফটিক ঘোষের মোরগের খেলা হচ্ছে ইখন। দড়ির ভিতর চুনের গোল গন্ডি দিয়া। তার ভিতরেই মুখোমুখি ছাড়া হইচে মোরগ দুটো। হাউসিদের হাতে ধরা মোরগ গুলান টুঁটি ফাঁড়ে বাঁক দিচ্চে। জমে উঠেছে মোরগ লড়াই।
আর উদিকে মেলার মাঠ থিক্যা ভেসে আসচে ধামসা মাদলের বোল। মহুয়া,হাঁড়িয়ার নিশায় মত্ত হয়ে আমাদের মেয়ে মরদরা হাতে হাত ধরে গোল হয়ে লাচছে। টিলা,ডুংরিতে খুশির জোয়ার। সারা বন-জঙ্গল দ্রিম দ্রিমা দ্রিম বোলে মাতে উঠেচে।
বুধন ঘোষ জিতে গেলেক। দর্শকরা হাত তালি দিয়ে,সিঁটি মেরে উয়াকে সম্মান জানালেক। ফটিকের হারা মোরগটো পাইয়ে গেলেক সে। ইবার আমাদের পালা।
সিংবাবু আর আমি ঢুকে পড়লম দড়ির ভিতরে। চুনের গন্ডির মাঝে মোরগদুটোর লেজ ধরে মুখোমুখি দাঁড় করালম। আমরাও মুখোমুখি। মোরগ তো লয়। ই যেন চম্বুক আর লুহা। ধরে রাখা যায় নাই,খালি সামনের দিকে টান মারে। ফুঁড়-র-র করে বাঁশি বেজে উঠতেই আমরা মোরগদুটো ছাড়ে দিলম। লেগে গেল লড়াই। ঝটপট ডানা ঝাপটিয়ে, পালক-ফালক ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড়েনি।
বাবুর মোরগ যেখন আমারটোকে কাবু করে দিচ্ছে,তেখন দর্শকরা হাত তালি দিয়ে,সিংবাবু! সিংবাবু! বলে চিৎকার করে উঠচে। আবার আমার মোরগ যেখন বাবুর মোরগটোকে হারিয়ে দিচ্ছে ,তেখন আমার পেছুন থিক্যা কিছু দর্শক উচ্ছাসে বলে উঠচে,হাঁসদা! হাঁসদা!
আমি দেখছি এক অন্য লড়াই। মোরগ দুটো তো মোরগ লয়। উ দুটো সিংবাবু আর আমি। হাত-পাগুলো মাটিতে গেদে,মোরগ হয়ে গেছি দু'জন। মুখোমুখি লড়াইয়ে মাতে উঠেচি। আমার পেছুনে সারি সারি সাঁওতাল মেয়ে-মরদ,মা,ভাই,বুন হাতে তীর- ধনুক,টাঁঙ্গি,বল্লম লিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাবুর পেছুনে সারি সারি 'দিকু'।
হঠাৎ শুনলম সাঁওতালরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে,সনাতন! সনাতন! আমার ধ্যান ভাঙে গেল। চাঞে দেখলম আমার মোরগটো বাবুর মোরগের বুকে ছুরি মেরে ধড়াস করে ফেলে দিইচে। আমি জিতে গেছি!
ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে আনলম বাবুর মোরগটো। লিয়ম মতো আমিই পাইয়ে গেলম। কাতকারকে হেতের বাঁধার পাওনা মিটোতে হলেক। লখার খুশি আর দিখে কে! ততক্ষণে শুরু হয়ে গ্যাছে অন্য মোরগের লড়াই। লখার মা আমাকে পঁই পঁই করে বারণ করেছিল,হ্যাঁ রে,ইমন ধেড়ে মুরোগটো যদি হেরে যাস? তার থিক্যা ইটাই শখ করে পরবে খিয়ে লে ক্যানে। আমি উয়ার কুথা শুনিনি। ইবার লখার মা কী যে খুশি হবেক!
সিংবাবুর দিকে চোখ পড়তেই কেমন যেন হয়ে গেল মনটা। বাবুর মুখটো ইমন পাংশু হয়ে গেছে ক্যানে! লড়াই তো মোরগে মোরগে!
বাবুর অমন মুখ দিখে জিতে গিয়েও মনে আনন্দ নাই। এ কী করলম গো আমি! বাবুকে হারিয়ে দিলম! এ মোরগ আমি ঘরে লিয়ে গিয়ে খাব কী করে?
লখাকে বইল্লম,যা বাপ। বাবুকে মোরগটো দিয়ে আয়।
লখা বইল্ল,তুমি কি খেপে গেছ? জিতেছি আমরা! দুব ক্যানে?
লখা বলে কী! আমরা জিতেছি? আমরা তো বার বার হেরে গো হারা! সেই কুন কাল থিক্যা। সিধু,কানহু,চাঁন্দ,ভৈরব তীর-ধনুক লিয়ে,বুকের রক্ত দিয়ে লড়াই করে পায়েছিল যে বন-জঙ্গল,পাহাড়,ডুংরির দ্যাশ—সে দ্যাশটো তো ইখন আমাদের হাতে নাই! ছুটতে ছুটতে,পালাতে পালাতে আমরা বার বার হেরে গেছি। গলায় আড় বাঁশির সুর উঠে না আর। সব সুময় পালানোর ভয়! কুনুদিন তো আমরা জিততে পারি নাই! আজ বাবুকে হারিয়ে এ কী করলম গো! চোখগুলো ছল ছল করে উঠল আমার। মোরগটো লিয়ে বাবুর কাছে গেলম।
বাবু আমার সাথে একটোও কথা বইল্ল না। মুখটা কেমন আঁধার পারা হয়ে গেছে।
আমি বইল্লম,এই বাবু! মোরগটো তুই লি' যা ক্যানে। খোকাদের লিয়ে শখ করে খাগা। আমার তো ইকটো আছে রে!
বাবু বইল্ল,না হাঁসদা। হারা মোরগ আমি ঘরে ঢুকবনি।
শুনে আমি মাথা নুয়ে দিলম। বাবু আমার কাঁধ চাপড়ে বলে গেল,দেখা যাক,আসছে বছর।