আমাদের পিতৃপুরুষ চাষীই ছিল চার প্রজন্ম আগে। চাষবাসেই ছিল জীবন ধারণ। ছোটবেলায়, ধরা যাক আমার বছর তিন হবে, আমার বাবার জেঠতুতো দাদা অমুক জেঠাকে দেখেছি মালকোচা মারা ধুতি, খালি গা, কাঁধে লাঙল নিয়ে জমিতে চলেছেন। সাতক্ষীরের গায়ে ধূলিহর গ্রামের কথা বলছি। যাতায়াত ছিল এপারের দণ্ডীরহাট থেকে। সকলে চলে আসেননি তখন। পান্তা কাগজি লেবু পাতা, লবন, শুকনো লঙ্কা পোড়া এই ছিল প্রাতঃরাশ। সেই পান্তা গরমে আমিও খেয়েছি। আর শীতের দিনে ফেনা ভাত। এসব চাষার অভ্যাস। বর্ষা নামবে, নামবে করছে, জমিতে লাঙল ঠেলা, সে ছিল দুঃসাধ্য কাজ। পান্তা ভাত শরীর ঠান্ডা রাখত। চাষবাসই ছিল জীবিকা। লেখা পড়া শিখে চাষবাস ত্যাগ করে আমরা বাবু হয়েছি। কিন্তু এ হলো রায়তের কথা। জমিদার ছিল পরান্ন এবং পলান্ন ভোজী। আমরা জমিদার ছিলাম না, তালুকও ছিল না তাই তালুকদারও ছিলাম না। আমাদের জমি অবশ্য অন্য চাষী চষে দিত। কেননা পিতামহ অন্নদাচরণ অসুস্থ, আর তাঁর তিন পুত্রের একজন সরকারী চাকুরিয়া, অন্যজন এল এম এফ ডাক্তার, মধ্যমপুত্র ব্যবসা করে। লোকসান করে ব্যবসায়, আবার ব্যবসা করে। জমি নিশ্চয় ভাগে দেওয়া ছিল। যা ধান হবে, তার অর্ধেক চাষীর অর্ধেক মালিকের। আমরা চৌধুরী জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতাম। চৈত্রে কাছারিতে খুব ভীড়। আমাদের বাড়িতে ধানের গোলা ছিল। ধানের গোলার ভিতরে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আমি একবার নেমেছিলাম কার সঙ্গে যেন। ধামায় ধান ভরেছিলাম কচি হাতে। এখনো সেই গোলার অন্ধকার দেখতে পাই। ইঁদুর ঢুকত ধান খেতে। ধামা ভরে ধান বের করে ঢেকি শালে নিয়ে ধান ভানা হত। ঢেকিতে পাড় দিত মা কাকিমারা। আবার একজন দাসী ছিল, সেও। দাসীই ছিল তার নাম। সে ঢেকির গর্ত থেকে চাল বের করে আনত উপরে। খুব ভয় করত। দাসীর হাতের উপর না ঢেকির মুখ নেমে আসে। থেঁতলে যাবে হাত। দাসীর কথা খুব মনে পড়ে। সে এক একবার উধাও হয়ে যেত। মাস খানেক কি মাস দুই বাদে ফিরে আসত। বিধবা নারী। জমিজমা সব দেওর ভাসুরে নিয়ে নিয়েছে। সন্তান নেই। কিন্তু অন্নের সংস্থান নেই। তখন হিন্দু নারী স্বামীর সম্পত্তির অংশ পেত না। সম্পত্তি মানেই চাষবাস। ভাতের গন্ধ। যাই হোক চাষা থেকে বাবু হওয়া আমাদের দণ্ডীরহাটের বাড়ির জমিতে চাষ করত মেজকাকা। শীতে আলু, ফুলকপি, বাঁধা কপি। মাচায় শিম, লাউ। দণ্ডীরহাটের বাড়িতে সব্জি কিনে খেতে হত না। একবার পাট চাষ করা হয়েছিল। খুব মশা হয়েছিল সে বছর। বাড়ির লাগোয়া খানায় পাট পচানো হয়েছিল, বাতাসে সেই গন্ধ ভাসত।
এরপর কলকাতায় বড় হয়ে গ্রামে গেলাম চাকরি করতে। কোন চাকরি, না জমিজমার চাকরি। জমির স্বত্বলিখন, জমির বর্গাদারের নাম নথিভুক্ত করা। সেটেলমেন্ট কানুনগো। আমরা কলকাতায় বসে জানিই না, রাজ্য দেশ চলে জমি আর চাষবাস নিয়ে। যিনি জেলার মাথা, জেলা সমাহর্তা, আসলে তিনি কালেক্টর। খাজনা আদায়ের ক্ষমতা তার হাতে ন্যস্ত। হাইকোর্ট বলি, সুপ্রিম কোর্ট বলি সেখানে যত মামলা তার সিংহভাগ জমি নিয়ে। দূর ডেবরা থানার শ্যামসুন্দরপুর পাটনা কিংবা করণ্ডা গ্রামে তো জমিতে হাইরাইজ প্রমোটিং হয় না, মাঠের পরে মাঠ কার্তিক অঘ্রানে হলুদ ধানে ভরে থাকে। সেই যে জমি, যে জমিতে ধান হয়, সেই জমি নিয়েই মামলা হয়। চাষার জমি চাষার প্রাণ, সেই জমিতে হলুদ ধান, জমি গেলে চাষা পাগল হয়ে যায়। জমি তো যায়। জমির ধানে যদি সম্বৎসর না চলে, তবে ঋণগ্রস্ত চাষা করবে কী ? জমি বন্ধক, জমি বিক্রি। এইসব জমি মানে ধান, গম, সর্ষে, মুসুর, শীতের সকল সব্জি, আলু, কুমড়ো। সমস্যা হলো চাষে যদি খরচ হলো ১০০ টাকা, ফসল বেচে হাতে এল নব্বই টাকা, আশী টাকা, সত্তর টাকা। তখন ? যে চাল আপনি কিনছেন পঞ্চাশ টাকায়, সেই চাল মানে ধান সে বেচে পনের টাকায়। ৩৫ টাকা উধাও। সরকার ধানের দাম ঠিক করে করে কিনলে চাষী পয়সা পায়। কিন্তু চাষীর জমি আর কতটুকু, চাষ আর কতটুকু। ক’বস্তা ধান ঘরে ওঠে ?
চাষী কে ? যিনি চাষ করেন স্বহস্তে। আর এক রকম কৃষক আছে, যিনি চাষ করেন না, কিন্তু ফসল পান কিংবা ফসলের দাম পান। সিঙ্গুরে কী হয়েছিল। অনেকে অধিগৃহীত জমির ক্ষতিপূরণ নিয়ে ছিলেন। অধিগ্রহণে আপত্তি নেই। কেন নেই, না তিনি অকৃষক রায়ত। অনুপস্থিত রায়ত। থাকেন কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, এমন কি সিডনি, নিউইয়র্কেও। জমির ধান দিয়ে তাঁর কী হবে? ভাগের ভাগ নিয়ে কী হবে। তার চেয়ে জমি চলে যাক। অনেকটা টাকা এক সঙ্গে পাই। জমিতে মায়া নেই। চার পুরুষ আগে চাষা ছিল বড় ঠাকুরদা, কিংবা তাঁর বাবা। তারপর লেখাপড়া শিখে আমরা বাবু হয়ে গ্রাম ত্যাগ করেছি। জমির স্বত্ব তো আমাদের। ক্ষতিপূরণ আমরা পাব। যে চাষা সে পাবে না। বড়জোর তিন বছরের ফসলের দাম পাবে। তা সামান্য। জমির স্বত্বাধিকারী যদি পায় একশো টাকা, বর্গাদার পাঁচ টাকা কি সাত টাকা। ফসলের দাম। তাহলে বোঝা গেল যে চাষা, যে হাড়মাস দেয় জমিতে তার কিছু নেই। আছে যে জমি চেনে না তার। ফলে চাষারা রুখে দাঁড়িয়েছিল অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। গেলে তো তাদের যাবে। তারা এক ফসলি জমিকে তিন ফসলি করে তুলেছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, তারা খরার সময় আকাশে তাকিয়ে থেকেছে মেঘের জন্য, তাদের ধানের থোড়ে দুধ আসার সময় মাজরা পোকা লেগেছে, ধান চিটে হয়ে যাবে ( ঈশ্বরীতলার রুপোকথা--শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসে আছে এক মর্মস্পর্শী বিবরণ ), ভাদ্রের বানে ফসল শেষ হয়ে গেছে, সুন্দরবনে বাধ ভেঙে নোনা গাঙের পানি জমিতে ঢুকে তার উৎপাদন ক্ষমতা শেষ করে দিয়েছে----এইসব উদ্বেগ নিয়েই তো চাষার জীবন। গ্রীষ্মের দিনে সরকার ক্যানেলে জল দেয়, সেই জলে চাষ হয়, কিন্তু ক্যানেলে এবার জল নেই, অথচ তারা সেচ কর দিয়েই আসছে। জল নেই কেন, মহকুমা শাসক বলছেন, ফারাক্কা ব্যারেজে জল নেই, গ্রীষ্মে বাংলাদেশে জল পাঠাতে হচ্ছে। গাঁয়ের চাষা আচ্ছা মিঞা, মতিন মিঞা শুনছে, কোথায় ফারাক্কা বাঁধ, সেখানে জল বেধেছে বলে নাকি গঙ্গায় জলের জোগান কম। তারা হাঁ করে তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে। সে সমস্যা কবে মিটবে ? আমাদের কী হবে? এত যে খরচ করলাম চাষে, সেচের জল না এলে ফসল শেষ। জল নেই, কিন্তু টাকা জলে গেল। সম্বৎসর খাব কী ? মহাজনের ঋণ শোধ হবে কী করে ? চাষের টাকা মহাজনই দিয়েছিলেন তো। ব্যাঙ্ক জমির মালিককে ঋণ দিলেও দিতে পারে, চাষা যার আইনত অধিকার নেই জমিতে, তাকে ঋণ দেবে কেন?
আমি পশ্চিমবঙ্গে থাকি, সেখানকার অভিজ্ঞতার কথা বলি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল ১৯৭৭-এ। ১৯৭১ সালের বঙ্গীয় ভূমি সংস্কার আইনের ক্ষমতায় যে ভূমির স্বত্ব লিখন শুরু হয়েছিল, সেই আইনেই জমির চাষা, বর্গাদারের নাম নথিভূক্ত করতে বিশেষ পাইলট প্রজেকট নেয় মন্ত্রী শ্রদ্ধেয় বিনয় চৌধুরীর নেতৃত্বে। এই বিশেষ ভাবে বর্গা লিখনের পরিকল্পনা ভূমি সংস্কার কমিশনার দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে হয়েছিল। যেখানে যেখানে নক্সালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়েছিল সেখানে বর্গা নথিভূক্তির কাজ আরম্ভ হয় আগে। গোপীবল্লভপুরে ডেবরায়, উত্তরবঙ্গে...সর্বত্র। জমির চাষী কে ? খুঁজে বের কর, নাম নথিভুক্ত করে তাদের চাষের অধিকার পোক্ত কর। অপারেশন বর্গা। আমিও সান্ধ্য মিটিং করেছি গোপীবল্লভপুরের গ্রামে। সারাদিন চাষীর তাদের কাজে ব্যস্ত। তাদের তখন সময় কোথায় ? সন্ধ্যায় ইস্কুলবাড়ি কিংবা অমনি কোথায়, এমন কি গাছতলায় হেজাক জ্বেলে মিটিং। ভয় নেই। তুমি কোন দাগের চাষী বলো, জমির রেকর্ড হাজির। তার নাম লিখে নিয়ে পরদিন জমিতে গিয়ে দাগ দেখিয়ে দিতে বললে তবে সে সাহস পেল। দুয়ারে সরকারকে যেতেই হয়। না গেলে অপারেশন বর্গা সফল হত না। কিন্তু ইতিমধ্যে বাবুরা, আমরা বুঝে গেছি কী করতে হবে। দলবদল করলাম নিঃশব্দে। সরকারি দলের ছত্রছায়ায় এসে বর্গাদারকে নিবৃত্ত করলাম নথিভুক্ত হতে। অনেক বছর বাদে, একুশ শতকের আরম্ভে মেমারি পেরিয়ে এক গঞ্জে গিয়েছিলাম পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। অমুক সামন্তবাবুর বদান্যে সেই অনুষ্ঠান। সারাদিন সব হয়ে গেলে তাঁর বাড়িতে মধ্যাহ্নের আহার শেষ বেলায়। তিনিও কানুনগো ছিলেন। পরে প্রমোশনে উপরে উঠেছিলেন অনেক। তাঁর পুত্র এম এ পাশ। মোটর সাইকেলে চেপে চাষবাস দেখে। বর্গাদার নেই জমিতে। দেখছিলাম আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা চাষারা মাথায় করে ধানের বস্তা এনে রাখছেন তাঁর উঠনের খামারে। তারাই চাষা। কিন্তু জমিতে অধিকার নেই। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে অনাবাদী জমিকে যিনি আবাদী করেছেন, তিনি জমির কেউ না। বর্গা রেকর্ডিঙের সাহস হয়নি। বাবু নিজে সরকারি অফিসার। থানা পঞ্চায়েত সব বাবুর হাতে। বাবুর শিক্ষিত পুত্র পার্টি করে আর চাষবাস দেখে। বছর বছর চাষার জমি বদল করে দেয়। এক জমিতে তুমি বেশিদিন থাকলে অধিকারবোধ জন্মে যাবে। মায়া জন্মে যাবে। এই বছর ২০১ নং দাগ চাষ করেছ, পরেরবার ২২২ নং। তারপরের বার ৩০১ নং দাগে, এমনি এমনি।
অপারেশন বর্গায় যে নাম নথিভুক্ত হয়েছিল, তা এখনো আছে কি না, তাদের উত্তরাধিকারিরা চাষ করে কি না খুঁজে দেখতে হয়। আর অপারেশন বর্গার পর সমবায় চাষের যে পরিকল্পনা ছিল তা হয়নি। পাঞ্জাব সমবায় চাষের জন্য কৃষককে সুখের মুখ দেখিয়েছে। জমির দিকে তাকান। মোটা আইল, সরু আইল--আইলে আইলে কত জমি নষ্ট হয়। সমবায় চাষ করতে পারলে আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ বেড়ে যেত, জমির চাষার ঘরে ফসল উঠত বেশি। আমাদের চাষীরা নিরন্ন, কপালে হাত নিরন্তর। আমাদের চাষীরা ফড়ের হাতের পুতুল। আলু উঠলে বেচেই দেনা শোধ করতে হবে। তখন দাম নেই। ছ’মাস পরে দাম চার ডবল। চাষার কোমরে জোর নেই যে অপেক্ষা করে। সমবায় চাষে গেলে এমন হত না। নতুন কৃষি আইনে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য যা ঠিক করে দিত সরকার, তা থাকবে না। আর কী আছে কী নেই সেসব আলাপে না গিয়েও যা শুনেছি, আমার চেনা আচ্ছা মিঞা মতিন মিঞা কি দরাদরি করতে পারবে সুট বুট পরা কর্পোরেট এজেন্টদের সঙ্গে ? লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধু চাষা হাজরা, বজরা নস্কর ভয়েই মরবে। তারপর কী হবে, সময়ই বলবে কী হবে, হতে পারে। কত ধানে কত চাল হবে তা জানে মুনাফাখোর প্রজাতি। চাষেবাস অধিবাস। আশ্রয়। সেই আশ্রয়ের কী হবে কে বলতে পারে। আমাদের চাষীরা খাস জমির পাট্টা পায় ১০ শতক, ঐ পরিমাপে জমিতে লাঙল ঘুরতেই পারে না ভালো করে। সব কিছু নতুন করে ভাবা দরকার। যারা ভাবেন, তাঁরা ভাবছেন কই ?