সাহিত্য সম্মেলনের কথা বলি। গল্পপাঠ, কবিতাপাঠ-- এসব সাহিত্য চর্চার অঙ্গ। আমাদের একটি গল্পপাঠের আড্ডা ছিল। সেই আড্ডায় সমকালের সমস্ত লেখকরা আসতেন। আড্ডাটির নাম ছিল গল্পচক্র। এই আড্ডার কুলপতি ছিলেন রাধানাথ মণ্ডল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্নজনের বাড়িতে এক এক রোববার গল্পপাঠের আসর বসত। সকলেই নতুন গল্প পড়তেন। সেখানে কে না আসতেন। সুচিত্রা ভট্টাচার্য, শিবতোষ ঘোষ, নবকুমার বসু, কানাই কুণ্ডু, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুতপন চট্টোপাধ্যায়, মালবী গুপ্ত, শ্যামল মজুমদার, অতি তরুণ তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, দেবসাস কুণ্ডু, দেবনারায়ণরা। সুব্রত মুখোপাধ্যায় আসতেন কখনোসখনো। বছরে একবার সন্তোষকুমার ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ আসতেন আমন্ত্রিত হয়ে। সমরেশ বসুও এসেছেন। এইসব আড্ডার খুব প্রয়োজন আছে গল্প লেখকদের কাছে। সাহিত্যের কর্মশালার চেয়ে সাহিত্যের নির্মল আড্ডার গুরুত্ব অনেক বেশি।
এরপরে আর একটি আড্ডা হতো। তার মূল আহ্বায়ক ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত। গল্পের আড্ডা। সেখানেও যেতাম তরুণ লেখকরা কী লিখছেন তা শুনতে। সেখানে নতুন গল্প পড়া হতো এবং কাটাছেঁড়া করা হতো।
প্রথম এক কর্মশালায় যাই ভোপালে। ভোপালের ভারত ভবনে অন্তরভারতী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ১৯৮৯ কিংবা ৮৮ সালে। সেখানে কবি, কথাসাহিত্যিক, সমালোচক সকলেই আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সারা ভারতের লেখক, নানা ভাষার। ফার্স্ট ক্লাস ট্রেন ভাড়া দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই আমার প্রথম একাকী দূরপাল্লার ট্রেন যাত্রা। তার আগে যা গিয়েছি সকলের সঙ্গে। আমি তো ফার্স্ট ক্লাসে আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসে চললাম ভোপাল। বিলাসপুর থেকে ট্রেন বদল করতে হবে। সেখান থেকে বিলাসপুর ইন্দোর প্যাসেঞ্জারে যেতে হবে। ঐ ট্রেনেই সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত গিয়েছিলেন। তাঁরা ইন্দোর বগিতে ছিলেন। সেই বগি বিলাসপুর কিংবা নাগপুর থেকে বিলাসপুর ইন্দোর প্যাসেঞ্জারে জুড়ে দেওয়া হত। তাঁরা ভোপালে নামবেন। আমার প্রথম শ্রেণীর টিকিট বিপত্তি ঘটাল। অথচ প্রথম শ্রেণীর সুবিধে কী ছিল ? তখন ট্রেনের কামরায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগানো হয়নি। প্রথম শ্রেণীতে যে গরম দ্বিতীয় শ্রেণীতে তাই। শুধু আলাদা ক্যুপ ছিল। সেখানে চারজন করে থাকতেন। এসি বাদ দিয়ে এখনকার টু টায়ার। আমাকে বিলাসপুরে নামতে হলো বিলাসপুর ইন্দোর প্যাসেঞ্জার ধরার জন্য। সেই ট্রেনে প্রথম শ্রেণির বগি আমার আশ্রয়। নেমে শুনি ট্রেন চলে গেছে আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস দেরিতে আসায়। আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসের ইন্দোর বগি নাগপুরে নিয়ে গিয়ে সেই প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। নাগপুরে আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করবে বিলাসপুর ইন্দোর প্যাসেঞ্জার। আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস সেখানে পৌঁছলে ইন্দোর বগি কেটে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সঙ্গে জুতে দেবে। কিন্তু আমি কী করব ? আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস চলে গেলে আমি যাব কী করে? একটা ট্রেন আছে বোম্বে মেল ভায়া জব্বলপুর। সেই ট্রেনে গিয়ে ইটারসি নেমে ভোপালের জন্য ট্রেন ধরতে হবে। কিন্তু আমি তাতে যেতে পারব না, কেন না আমার টিকিট ভায়া জব্বলপুর নয়। ষ্টেশন মাস্টার সব শুনে আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসেই নাগপুর অবধি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন নাগপুর অবধি। সমস্যা মিটল। নাগপুর গিয়ে বিলাসপুর ইন্দোর প্যাসেঞ্জারে প্রথম শ্রেণী পেলাম। একদিন পুরো গেল। পরদিন ভোরে ভোপাল। জ্বলন্ত মে মাস। দাবদাহ চলছে। সমস্ত দিন আগুনের ভিতর দিয়ে ট্রেন ছুটতে লাগল। আপার বার্থে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে ভয়ানক উত্তাপ। সঙ্গে হাসান আজিজুল হকের গল্পের বই ছিল। পড়ছি। প্রথম শ্রেণীতে চাপার বিপত্তি সেদিন বুঝলাম। আমার কুপে এসেছেন এক এম পি। নিচে, বিপরীতে লোয়ার বার্থ। নাদুস নুদুশ চেহারা। কপালে সিঁদুরের টিপ। একটা করে ষ্টেশন আসে আর তাঁর অনুগামীরা আসেন ফুলের স্তবক নিয়ে। জি, নমস্তে। নমস্তে জি। অনুগামীদের সব মস্ত চেহারা। মোটা গোঁফ। শাদা চোস্তা পায়জামা আর পাঞ্জাবি। মস্ত বুকের ছাতি। এম পি সায়েব সব সময় গুটখা কিংবা পানপরাগ মুখে দিয়ে আছেন। আমি আপার বার্থে গরমে পুড়ছি। ঠিক আমার নিচে লোয়ার বার্থ খালি থাকলেও আমার ভয় লাগছিল। অনুগামীরা সেখানে এসেই বসছেন। এক ষ্টেশন গিয়ে পরের স্টেশনে নেমে যাচ্ছেন। একবার এম পি সায়েব কৌতুহলে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে, বললাম। তিনি হেসে বললেন, রাইটার! করুণা করলেন যেন। অদ্ভুত চোখে দেখতে লাগলেন আমাকে। এত কম বয়সী রাইটার তিনি আগে দেখেননি। শরচ্চন্দ্র বা প্রেমচন্দ তো কত বেশি বয়সের ছিলেন। তাঁর অনুগামীরা রোগা প্যাংলা আমাকে কৃপার চোখে দেখতে লাগলেন। আমি এত কাছাকাছি কোনো সাংসদ, মন্ত্রী বা বিধানসভার সদস্যকে আগে দেখিনি। সকলকেই আমার দূর আকাশের তারা মনে হতো। ফলে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখছিলাম। বিস্ময়ও কম ছিল না। এম পি মহোদয় আমার সঙ্গেই ভোপালে নেমেছিলেন। ভোপাল মধ্যপ্রদেশের রাজধানী। তখন ছত্তিশগড়ের জন্ম হয়নি। এখন বিলাসপুর ছত্তিশগড় রাজ্যে।
ভোপাল পৌঁছলাম ভোরে। ভারত ভবনে অনুষ্ঠান। রেখেছিল ইউথ হোস্টেল কিংবা ভালো এক হোটেলে। তখন এসির রমরমা ছিল না কোথাও। আমরা কী করে যে দিন কাটাইতাম। বিলাসী হয়েই মানুষ নিজের সর্বনাশ করেছে। বায়ু দূষিত করেছে। প্রকৃতি ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। ভারত ভবনে রাজারাম নামে এক কন্নড় ভাষার কবির সঙ্গে আলাপ হয়। রাজারাম উটকামন্ডের এক কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। আমারই বয়সী। এই সম্মেলনে তামিল এবং কন্নড় লেখকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বেশি। বাংলা গদ্য সাহিত্যে আমি একা গিয়েছিলাম। কবি কৃষ্ণা বসু, অঞ্জন সেন, মল্লিকা সেনগুপ্ত গিয়েছিলেন। কৃষ্ণা বসুর সঙ্গে তাঁর স্বামী অপরাজিত বসু গিয়েছিলেন। অপরাজিতদা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় পথিকৃৎ। মল্লিকার সঙ্গে গিয়েছিলেন সুবোধ। ওঁদের বয়স তখন কত কম। দুজনেই ছাপ ফেলেছিলেন সেই সম্মেলনে। সে ছিল আমার প্রথম সাহিত্য সম্মেলনে যাওয়া। ভারত ভবনে আলাপ হয়েছিল ইংরেজি ভাষার লেখক অতি প্রবীণ কৃষ্ণবলদেব বৈদের সঙ্গে। তিনি একজন সুভদ্র স্নেহশীল মানুষ ছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন কবি অশোক বাজপেয়ী। তিনি তখন ভারত সরকারের শিক্ষা সচিব। আই এ এস। পদ মর্যাদার কারণে আত্মম্ভরি মনে হয়েছিল। মানুষটিকে আমার তত পছন্দ হয়নি। আমার ইংরেজি বলা খুব সুবিধের নয়, তাই। ধীরে ধীরে কথা বলতাম। তিনি অবশ্য হিন্দি ব্যতীত ইংরেজি বলতেন না। আমার অভ্যাস, যা মতে মিলবে না, তা নিয়ে কথা বলা। এ ব্যাপারে আমি সেই পাগল, গাঙ পার হতে হতে নড়বড়ে সাঁকো নাড়াতে কিসের ভয়।। আপোষের কোনো জায়গাই নেই। আর বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস আমি ভালোই জানি। বাংলা ভাষার অখ্যাত লেখককেও পড়েছি যদি তিনি ভালো লিখে থাকেন। আমার কথাবার্তা খুব পছন্দ হয়েছিল রাজারামের। সে দুপুরে আমাদের ঘরে এল। সেই ঘরে আমি ও অঞ্জন সেন ছিলাম। অঞ্জন সেন এক পরিশীলিত মানুষ। রুচিমান মানুষ। ভালো কবি এবং চিত্রকলা বোদ্ধা। রাজারাম আমাকে বলল, মিত্র তোমার গল্পটি আমাকে পড়াবে। টাইপ করা কপি নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেল। বিকেলে বলল, তোমার উচ্চারণে জড়তা আছে, যদি অনুমতি দাও আমি তোমার গল্পটি কাল সকালে পাঠ করব দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে। ওয়ান্ডারফুল স্টোরি। গাঁওবুড়ো। ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন আমার বন্ধু অনীশ গুপ্ত। সেই গল্প পরদিন পাঠ করল রাজারাম। হল নিস্তব্ধ। কৃষ্ণবলদেব বৈদ উচ্ছ্বসিত হয়ে অনেকটা বললেন। অশোক বাজপেয়ী চুপ করেই ছিলেন। তাঁর ভালো লেগেছিল মনে হয়। সেই দিন ডিনার পার্টিতে বৈদজি আলাদা করে ডেকে নিয়ে কড়ির পাত্রে কনিয়াক অফার করলেন। খেয়েছিলাম। তারপর আমি আমার হেঁড়ে গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়েছিলাম বৈদজিকে। তিনি শুনেছিলেন। গল্প পাঠের পর অশোক বাজপেয়ীর সমীহ আদায় করতে পেরেছিলাম। বৈদজির কথা আমি ভুলব না। তাঁর সঙ্গে কয়েকবার চিঠি বিনিময় হয়েছিল। ভোপালে আর এক লেখকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, দিলীপকুমার। গুজরাতি যুবক তামিলে লেখেন। খুব ভালো একটি গল্প পড়েছিলেন। তাঁর গল্পটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলাম আমি। বিমল কর সম্পাদিত গল্পপত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেবার ভারত ভবন কর্তৃপক্ষ আমাদের ভীম বৈঠকা গুহা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই প্রথম গুহাচিত্র দর্শন। ভোপালে আমি আগেও গিয়েছি। মিতালির মাসি থাকতেন সেই শহরে। সেখানে গিয়ে গুহাচিত্রের একটি নকল প্রদর্শনী দেখেছিলাম। তা দেখে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম শৈশব। আসল গুহাচিত্র দেখে বুঝলাম কল্পনায় ঠিকই লিখেছিলাম। এবং ভারত ভবনের সাহিত্য অনুষ্ঠানের প্রথম দিন লেখকরা নিজের কথা বলেছিলেন। আমি সেই বলার ভিতরে ‘শৈশব’ গল্পের কথা উল্লেখ করেছিলাম। আমিই যেন সে, আমিই যেন এঁকেছিলাম সেই গুহাচিত্র। সেই কল্পনার কথায় অশোক বাজপেয়ী বিদ্রূপাত্মক সুরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, না গিয়ে, এক্সিবিশন দেখে লিখতে পারলে ?
হ্যাঁ, লেখক যদি কল্পনা করতে পারেন। আমি জবাব দিয়েছিলেন, বলেছিলাম, কীভাবে কী হয়, তার কোনো নিয়ম আছে কি ?
তিনি এক সাধারণ যুবকের এই উত্তর আশা করেননি। পরে দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ভারত আমেরিকা সাহিত্যের কর্মশালায়। সৌজন্য বিনিময় হয়েছিল। ছোটখাট মানুষটি ছিলেন প্রবল ক্ষমতাবান। সেই কারণে সকলের আনুগত্য আশা করতেন। ভারতের সাহিত্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতেন তিনি। বিদেশ ভ্রমণ। কিন্তু লেখক কেন আনুগত্য প্রকাশ করতে যাবেন ? নবীন প্রবীণে বন্ধুতা হবে। প্রবীণ হন গুরুঠাকুর, নবীন হন শিষ্য। আমাদের দেশে সাহিত্যের আমলাতান্ত্রিকতা এই প্রকার।
তর্ক করা আমার স্বভাব। ১৯৯০-৯১ সালে ইন্দো আমেরিকান রাইটার্স ওয়ারকশপের শেষ দিন। সাহিত্য অকাদেমি ছিল এর আয়োজক। সারা ভারতের লেখকরা এসেছিলেন। বাংলা ভাষা থেকে, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, অনিল ঘড়াই, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি তুষার চৌধুরী, রণজিৎ দাস গিয়েছিলেন। এই কর্মশালার শেষ দিনে নবীন প্রবীণ এক সেসন হয়েছিল। এক একজন নবীন লেখকের সঙ্গে প্রবীণ লেখক বসবেন মিনিট কুড়ি পঁচিশের জন্য। আলাপ করবেন। আমাকে নিয়ে বসলেন প্রবীণ মরাঠী লেখক গঙ্গাধর গ্যাডগিল। তিনি ছিলেন সদাহাস্য মানুষ। ভালো। কিন্তু আমার সঙ্গে মতে মেলেনি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখন তুমি কী লিখছ ?
বললাম, উপন্যাস।
তার ছক কষে নিয়েছ , ফ্রেম করে ফেলেছ ?
বললাম, না, ফ্রেম আমি করি না, ছক কষে লিখি না, তবে কিছু পয়েন্ট থাকে, মুহূর্ত থাকে, একটা আন্দাজ থাকে কী লিখব, তা নিয়ে এগোতে থাকি, আস্তে আস্তে গল্প তৈরি হতে থাকে।
তিনি বললেন, না মনে হয়, উপন্যাস লিখতে হলে একটা ছক করে নিতে হয়।
আমি বললাম, আমি ওভাবে লিখি না, আপনার পরামর্শ মনে থাকবে।
তিনি একটু বিরক্ত হয়েছিলেন হয়ত। গঙ্গাধর গ্যাডগিল মরাঠী সাহিত্যে ছোট গল্পের জন্য খ্যাতনামা। সেদিন তাঁর সঙ্গে আলাপের পর বেরিয়ে এসে বন্ধুদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে, তুষার বলল, কেঁচিয়ে দিয়েছিস, এখান থেকে আমেরিকায় যাওয়ার সাহিত্য প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, তোর হলো না। হাসাহাসি হলো। সেদিন ছিল শেষ দিন। ইউথ হোস্টেলে ফেরার বাসে সঙ্গে ছিলেন তামিল ভাষার প্রবীণ লেখক অশোক মিত্রণ। এটি তাঁর লেখার নাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গ্যাডগিলের সঙ্গে কী কথা হলো ? আমি বলতে, তিনি পরামর্শ দিলেন, “তোমার লেখার পদ্ধতি তোমার, তা নিশ্চয় মিঃ গ্যাডগিল দেখতে যাবেন না, কিন্তু এই সমস্ত মানুষের কথাকে সাময়িক সমর্থন করতে হয়, উনি তো তোমাকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে থাকলেন।” সেইবার দিল্লিতে কত লেখকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। দিলীপ কুমার এসেছিলেন চেন্নাই থেকে। সুদীপ সেন নামে এক বাঙালি কবির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল যিনি ইংরেজি ভাষায় লিখতেন, দিল্লিবাসী। এই সুদীপের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ২০১৮-য় ইম্ফলে সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদ পুরস্কার প্রদান এবং সাহিত্যোৎসবে। ইম্ফলে সুদীপের পরিচয়ে জানতে পেরেছিলাম, তিনিই একমাত্র ভারতীয় কবি যিনি নোবেল প্রাইজ প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন আমন্ত্রিত হয়ে। এত বছরে আমার অজ্ঞাতে এইসব ঘটে গিয়েছিল। সুদীপ আমার ছবি তুলেছিলেন বক্তৃতারত অবস্থায়। আমার কথা ভালো লেগেছে বলেই আলাপ করতে এলেন। আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম ইন্দো আমেরিকান রাইটার্স ওয়ার্কশপের কথা। তিনি অবাক। আমাকে তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে মনে রেখেছি শুনে খুব খুশি।
ভোপালে কিংবা দিল্লিতে আমি বাংলা ভাষার ছোট গল্প বা উপন্যাস নিয়ে বলতে বাংলাদেশের গল্প উপন্যাস নিয়ে বলেছি। বাংলাদেশের গল্প উপন্যাস আমি কম পড়িনি। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির থেকে তরুণতম লেখকদেরও। তাঁদের ভিতরে ওয়াসি আহমেদ, ভাস্কর চৌধুরী, প্রশান্ত মৃধা, নাসরিন জাহান, শাহীন আখতারদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ইলিয়াস যেবার কলকাতায় পায়ের অপারেশন করে গেলেন আমি ও আফসার আমেদ তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বহু সময় বহু বিষয়ে কথা হয়েছিল। ভূমি সংস্কার, মানুষের ভূমি ক্ষুধা , সিলিং বহির্ভূত জমি সরকারের অনুকূলে খাস করা এবং ভূমিহীন কৃষকের নিকটে বন্টন এসব নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল সাহিত্য ব্যতীত। দেশে ফিরে কয়েক মাস বাদে তিনি মারা যান। ২০১৫ সালে হাসান আজিজুল হকের ফোন পেয়েছিলাম হঠাৎ। রাজশাহী যেতে ডাকলেন। কবিকুঞ্জের অনুষ্ঠান। গিয়েছিলাম। হাসান ভাইয়ের বাড়ি থেকে পদ্মা খুব কাছে। যেদিন রাজশাহী থেকে ঢাকা যাব বিকেলের ট্রেনে, সেদিন সকালে হাসান ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। পার্টিশন বর্ধমানের মানুষটিকে রাজশাহীতে নিয়ে গেছে। ভাবলে কেমন লাগে। হাসান ভাই তাঁর আত্মজীবনীর একটা খণ্ড আমাকে উৎসর্গ করেছেন। বইয়ের র্যাক দেখিয়ে বলেছিলেন, যে যে বই তোমার পছন্দ, নিয়ে নাও।
নিয়েছিলাম। রাজশাহী থেকে ইন্টার সিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন দাউদ হায়দরের ভাই মফিক হায়দর। কমলাপুর স্টেশনে আমাকে নিতে এসেছিলেন তরুণ লেখক স্বকৃত নোমান এবং অঞ্জন আচার্য। নোমান তার বাড়িতে সে রাত্রে নিয়ে গিয়েছিল। নোমান প্রতিভাবান সাহসী লেখক। স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে। রাজশাহীতে দুই তরুণ লেখকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সীমান্তে আমাকে আনতে গিয়েছিল অতি তরুণ লেখক আনিফ রুবেদ। সে আমাকে নিয়ে সন্ধ্যার সময় রাজশাহীর বাসে উঠেছিল কোন এক গঞ্জ থেকে। গঞ্জে যাওয়ার পথে বড় সোনা মসজিদ দেখেছিলাম। রাজশাহী, মালদহর আম বিখ্যাত। সেখানে আমের বাজার বসে সিজিনে। রাজশাহীতে এক তরুণের সঙ্গে আলাপ হল, মোজাফফর হোসেন। মোজাফফরের উপর দায়িত্ব ছিল আমাকে সঙ্গ দেওয়ার। সে এক অতি সুভদ্র এবং পরিশীলিত মনের যুবক। আমাকে বলেনি গল্প লেখে। পরে তা জেনেছি। ঢাকায় সেবার বাংলাদেশের নামী সাংবাদিক, সাতক্ষীরের মানুষ আবেদ খানের আতিথেয়তায় ঢাকা ক্লাবের গেস্ট হাউসে ছিলাম ক’দিন। খুব আড্ডা হয়েছিল শাহবাগে, আজিজ মার্কেটে। দেখা হয়েছিল রেজা ঘটকের সঙ্গে। রেজা এক অদ্ভুত যুবক। সিনেমা পরিচালনা করেন। দাড়ির জঙ্গলে ভরা মুখ। যেদিন চলে আসি রাতের বাসে, সেদিন সন্ধ্যায় দেখা করতে এলেন রেজা ও চিত্রপরিচালক মাসুদ পথিক। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা নিয়ে একটি পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি নির্মাণ করেছিলেন মাসুদ পথিক। মোকাব্বরের প্রয়াণ। ভালো ছবি। রেজা একটি ছবি নির্মাণ করেছেন, হরিবোল। আমার দেখা হয়নি।
সাহিত্য সম্মেলনে ভাগলপুর দু’বার গেছি। একবার নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি হবে, কিংবা শেষের দিকে। প্রিয় লেখক, অগ্রজপ্রতিম দিব্যেন্দু পালিতের বাড়ি ছিল ভাগলপুর। সেখান থেকে কলকাতা এসেছিলেন লেখক হবেন বলে। দিব্যেন্দুদার জীবন ছিল খুব সংগ্রামের। ভাগ্যান্বষণে এসে শিয়ালদা স্টেশনের ফুটপথেও শুয়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। অনাহারে কেটেছে। খুবই ্নাগরিক মননের আধুনিক ভাবনার লেখক ছিলেন। বিপ্লবী সাংবাদিক সরোজ দত্তর মৃত্যু নিয়ে তিনি এক অসামান্য উপন্যাসের রচয়িতা, ‘গৃহযুদ্ধ’ সেই উপন্যাস। তো সেবারের ভাগলপুরের সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন ভাগলপুরের অধ্যাপক বিনয় মাহাতা। আমরা ভাগলপুর প্যাসেঞ্জার ধরে গিয়েছিলাম অনেকে মিলে। আমার দাদা মনোজ মিত্র ছিলেন এবং দিব্যেন্দুদা ও কল্যাণী বউদি ছিলেন। ছিলেন ভগীরথ মিশ্র, নলিনী বেরা এবং সপরিবারে আমি। মিতালি ও পুত্র কন্যা ছিল। ভাগল্পুরের সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি এক অসামান্য বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ভুলিনি। ভাগলপুরের সাহিত্য সম্মেলনে গিয়ে লাভ হয়েছিল বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, বনফুল, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিধন্য সেই জনপদকে চিনে নেওয়া। দিব্যেন্দুদা চিনিয়ে দিয়েছিলেন। দিব্যেন্দুদা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন গঙ্গাতীরে বড়বাসায়, যেখানে নায়েবি করতে গিয়ে বিভূতিবাবু থাকতেন। যেখানে বসে তিনি রচনা করেছিলেন পথের পাঁচালী উপন্যাস। দেখেছিলাম সেই বটবৃক্ষ, ঝুরি নেমে গেছে গঙ্গার জলে। শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই গঙ্গা। ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের মামাবাড়ি ছিল। দেবানন্দপুর থেকে পালিয়ে ভাগলপুর চলে যেতেন। প্রতিটি জায়গার গল্প ইতিহাস দিব্যেন্দুদা আমাদের বলেছিলেন। দেখিয়েছিলেন বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই বাংলা মাধ্যম ইস্কুল যেখানে তিনি পড়েছেন। শেষে গিয়েছি বনফুলের বাড়ি। বনফুলকে তিনি জেঠামশায় বলতেন। তিনি চিকিৎসক ছিলেন। বনফুলের সেই বাড়ি তখন বন্ধ পড়ে আছে। সকলে কলকাতাবাসী। বাড়িটির কথা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমার সাহিত্যজীবন ‘ বইয়ে অনেকটা আছে। সেবারে ভাগলপুর থেকে ভগীরথ মিশ্রর সঙ্গে আমরা, মানে সপরিবারে আমি একদিন গিয়েছিলাম সুলতানগঞ্জ। বাসে চেপে। ভাগলপুরের বাসস্ট্যান্ড খুব নোংরা। কত নোংরা যে তা বিবৃত করা যায় না। তখন এমন দেখেছিলাম। এখন নিশ্চয় বদলে গেছে। সুলতানগঞ্জের গঙ্গাতীর, চরের ভিতর এক মন্দির অপূর্ব। ভগীরথ মিশ্র অতি রসিক মানুষ। যে কোনো জমায়েতে তাঁর কথার চাতুর্যে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। তিনি যাদুকর। ফেরার সময় আমার বালক পুত্রকে ম্যাজিক দেখিয়ে বিস্মিত করেছিলেন। ভাগলপুরের সাহিত্য সম্মেলনের উপলক্ষ্য ছিল বনফুল শতবর্ষ। আমি বনফুলের ভুবন সোম এবং ডানা উপন্যাস নিয়ে বলেছিলাম। কিন্তু এই ধরণের সম্মেলনে সব হয়, সাহিত্যই হয় না। শ্রোতাদের গল্পগুজবে দিব্যেন্দুদা খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি খুব সিরিয়স মানুষ ছিলেন।
দ্বিতীয়বার ভাগলপুর যাই ২০০৪ সালে। ধ্রুবপুত্র উপন্যাসকে পুরস্কৃত করেছিল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন-ভাগলপুর শাখা। সেবার বন্ধুদের ভিতর অনিতা অগ্নিহোত্রী গিয়েছিলেন। তিনিও পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সেবার উঠেছিলাম ভাগলপুরের নামী ব্যবসায়ী মধু রায়ের বাড়িতে। সাত মহলা বাড়িই বলা যায়। দুর্গের মতো। ভাগলপুর ছিল বাঙালির এক উপনিবেশ। ভাগলপরে জন্মেছিলেন চিত্রপরিচালক তপন সিংহ, অশোককুমার কিশোরকুমারদের বাড়ি ভাগলপুরেই ছিল। সেখান থেকে তাঁরা মধ্যপ্রদেশের ছিন্দোয়ারায় চলে যান। ২০০৪ সালের সময় ভাগলপুরের বাঙালি সেই উপনিবেশ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলা ইস্কুল বন্ধ। স্থানীয় মানুষ বাঙালিদের ঘরবাড়ি যে করে হোক নিয়ে নিতে চাইছে। ফিরে এসে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম ।’ মধুবাবুর শহর’।
আবার প্রতীক্ষায় থাকি পরবর্তী পর্বের জন্যে ৷
লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে আপনার ভূমি সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে যা কথাবার্তা হয়েছিল, আত্মজীবনীতে কখনো সে সব আসুক। যেহেতু আপনি ঐ বিভাগে ছিলেন, মতামত খুবই মূল্যবান হবে, কারণ দেখেছেন একেবারে ভেতর থেকে।
"স্বাধীনতার পর বহু রাজ্যেই বাঙালির ভাষা সংস্কৃতিতে আঘাত এসেছে। বাঙালির উপনিবেশ ভেঙে গেছে। এখন মনে হয় ব্রিটিশ ভারত যে অখণ্ড ভারত গড়ে তুলেছিল তাদের শাসনের কারণে, আর ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণে যে বৈচিত্রময় ভারত গড়ে উঠেছিল এক হয়ে, তার চেহারায় ক্ষয় এসেছে। বাঙালির আধিপত্য ভেঙেছে অন্য রাজ্যের মানুষের ভিতরে আত্মগরিমা তৈরি হওয়ায়। শিক্ষা বেড়ে যাওয়ায়।" বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদে জানার আগ্রহ তৈরি হল।