দেশ চেনা মানে দেশের মানুষ চেনা। দেশের মানুষ চিনতে গ্রাম ভারতবর্ষে যেতেই হবে। কিন্তু সকলের পক্ষে কি তা সম্ভব হয় ? হয় না। মতি নন্দী কত বড় গল্পকার। তিনি উত্তর কলকাতার কানা গলি নিয়েই লিখে গেলেন তাঁর সমস্ত গল্প। সেই সব গল্প কি ভোলা যায়, শবাগার, বেহুলার ভেলা, নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান, টুপু কখন আসবে, একটি পিকনিকের অপমৃত্যু, গুণ্ডাদ্বয়...।
গ্রাম ভারতবর্ষে আমি যেতে পেরেছিলাম, তাই জীবনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। করণ্ডা হল্কা ক্যাম্পেই যেন আর এক জীবন আরম্ভ হলো। তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণ পাঠে, প্রেমচন্দ পাঠে যে দেশ চেনা, তাকে দেখলাম সামনে এসে দাড়িয়েছে। নিরন্ন অভুক্ত দেশ। ‘মেলার দিকে ঘর’, ‘পার্বতীর বোশেখ মাস’ দুই গল্পই নিদারুণ বৈশাখ আর অন্নহীন মানুষের কাহিনি। যা দেখছি, বিস্ময়, কষ্ট, দুঃখ গ্রাস করছে আমাকে। আমার ভবিষ্যত নির্ধারণ হয়ে গেল। শুধু মা করতেন চিন্তা। কী খাচ্ছে ছেলেটা, কীভাবে থাকছে, মায়ের ঘুম হত না। দণ্ডীরহাট স্কুলের অঙ্কের স্যার, লেখক দীপক চন্দ্রের বাবা কেশব চন্দ্র আমার ভিতরে অঙ্কের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কলকাতায় একবার আমাদের বাসা বাড়িতে এসেছিলেন। দুঃখিত হয়েছিলেন আমার চাকরিতে চলে যাওয়া নিয়ে, বলেছিলেন, সব চেয়ে ভালো ছেলেটিকে ঠিক করে মানুষ করতে পারলেন না, গাঁ-গঞ্জে চাকরি করতে গেল ! মা কিছু বলেননি। বলার কিছু ছিল না। বাড়ি ফিরলে আমার দিকে তাকিয়ে দেখতেন। তারপর বলতেন, কেমন জায়গা বল দেখি। মায়ের কথা বলিনি কিছুই, এবার বলব এসব থামিয়ে।
আমি ২২ বছর বয়সে চাকরি করতে গেলে মা রাধারানি খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। কষ্টও পেয়েছিলেন। বাবুজি ( আমার ডাক নাম )-র যশ হবে, বড় কিছু হবে, তার জীবনে সফলতা আসবে, সেই আশা ছিল তাঁর। বাবার সহকর্মী প্রকাশবাবুর যে পুত্রটি আমার বয়সী, সে ডব্লিউ বি সি এস এ গ্রুপ পেয়ে বিডিও হয়ে উত্তরবঙ্গে গেছে। ডেপুটি, ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা শাসক থেকে জেলা শাসক পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তখনকার দিনে জীবনের বড় সফলতা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, তা না হলে উচ্চপদের সরকারি চাকুরি। আমার তা নয়। যতই গালভরা গেজেটেড অফিসার হোক, এক ঘন্টা -দেড় ঘন্টা হেঁটে অফিসে পৌঁছতে হয়, অফিসারের জিপ গাড়ি নেই, অফিসে ইলেক্ট্রিক নেই, অফিসের মাথায় টালির চাল, কাদা-মাটিতে গাঁথা ইটের দেওয়াল। ছেলেটার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একটাও মানুষের মতো মানুষ হলো না, বড়র যে কলেজে মাস্টারি, তাতে ক’টাকা মাইনে। আমাদের পূর্ববঙ্গের গ্রাম ধূলিহরের মধুবাবুর এক পুত্র আমেরিকায় গেছে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, সে তার পরের ভাই যে আমার বয়সী ছিল, থার্ড ডিভিশনে এইচ এস, পাসকোর্সে বি এস সি, সেও চলে গেল মার্কিন দেশে। দাদা এম এ পাশ করার পর আমার বাবা বিদেশে পি এইচ ডি করার জন্য ফর্ম নিয়ে এসেছিলেন দাদার জন্য। দাদা তা ছুঁয়েও দেখেননি। আই এ এস দেওয়ার ফর্ম এনেছিলেন। দাদা তাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মেজ ভাই উদয়ন তো এক ইতিহাস, গবেষণা এসবেই আছে। চাকরির কোনো পরীক্ষায় বসে না। উদ্বেগের নাম গন্ধ নেই তার কথাবার্তায়। আমি চলে গেলাম অজ গাঁয়ে। মায়ের তিন পুত্রই বলার মতো কিছু হয়নি। অধ্যাপনা আর কী সফলতা! মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি চিকিৎসক হই। কিন্তু বাদ সাধল আমার সার্টিফিকেট এজ। ১৬ বছর হয়নি। ১৫ বছর সবে। দেড় বছর বয়স কমান ছিল। ব্যর্থতা, অসফলতা আমাকে ঘিরেই রেখেছিল। ফার্স্ট ডিভিশনে এইচ এস পাশ করে লাভ হয়নি বিশেষ। তখন প্রথম বিভাগ রীতিমতো ঈর্ষণীয় ছিল। কোনো পুত্রের কিছু হলো না। বড়র তবু অল্প বিস্তর নাম হচ্ছে নাটকে। চাকভাঙা মধু বেরিয়েছিল এক্ষণ সাহিত্যপত্রে। তারপর থিয়েটার ওয়ারকশপ আবার নরক গুলজার, অশ্বত্থামা। কিন্তু নাটক টাকা দেয় না। তবুও মায়ের মুখ আলো হত বড়জনকে নিয়ে। কিন্তু আত্মীয়স্বজন কি নাটক বোঝে না সাহিত্য বোঝে, সুতরাং তাদের বিদ্রূপ মিশ্রিত হাসি মাকে ব্যথিত করত। আর পরের দুটির কী হবে ? মেজটি কলকাতায় আছে, থিসিস লেখার গাইড খুঁজছে, ছোটর সেসব কিছুই হলো না। আমার মামাত ভাই একজন হয়েছে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, সিন্ধ্রিতে থাকে। অনেক টাকা তার বেতন। তার জীবন সুখের হয়েছে। সে গর্বিত করেছে সকলকে। আমি তো ডব্লিউ বি সি এস অফিসার হতে পারতাম। ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হতে পারতাম ( ছোট্মামা শিবু তাই ছিল)। ব্যাঙ্কের চাকুরিয়া হতে পারতাম। হলাম সেটেলমেন্ট কানুনগো, যে ডিপার্টমেন্টে নাকি ঘুষের রমরমা। মা ওইসবকে ভয় পেতেন। অসততাকে ঘৃণা করতেন। বাবা তো নিশ্চয়। মনে পড়ে, যখন বালক আমি, এক ধনী ব্যক্তির পাসপোর্ট কী ভাবে আটকে যায়। তিনি একটি মস্ত গ্রামোফোন সমেত আমাদের বাড়ি হাজির। বড় সোনালি চোঙ, বেশ সুন্দর দেখতে। বাবা অপমানিত বোধ করেছিলেন। হাত জোড় করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই গ্রামোফোন। আমাদের ছেলেবেলায় গ্রামোফোন ছিল স্বপ্নের মতো। পরে আমার ‘পাসিং শো’ গল্পে ছিল না থাকা গ্রামোফোন। কেউ কেউ, অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়জন বলে যেত মাকে, ছোট ছেলেটাই ভালো চাকরি পেয়েছে। টাকার শেষ নেই। টাকার বান্ডিল নিয়ে লোকে ওর পিছনে ঘুরবে। শিগগির জমি কিনবে, বাড়ি করবে, গাড়িও কিনবে। আসলে ঘুষ নেওয়া যে অপরাধ যে এই ধারণাই ছিল না সাধারণ মানুষের ভিতর। মেয়ের বিয়ের সময় পাত্রের গুণ হিসেবে চিহ্নিত হত, চাকরিতে উপরি আছে কি নেই।
মা লোকের কথায় ভয় পেতেন। স্বপ্নভঙ্গের সেই বিষণ্ণ মুখ এখনো দেখতে পাই। তবে তাঁর মনে জোর ছিল, তাঁর বাবুজি অসৎ হবে না। বাবা বলেছিলেন, খুব সাবধান, জীবনে একবার পদস্খলন হলে সেই দাগ মোছে না। বাবা মেধাবী ছিলেন। পূর্ববঙ্গে আমাদের অবস্থা ছিল অতি সাধারণ। ধূলিহরে আমাদের মাটির বাড়ি, উঁচু পোতায় হাতনে। পিতামহ বহুদিন অসুস্থ। তাঁর এক পুত্র তেমন কিছু করত না, ব্যবসা করতে গিয়ে ফেল মারত। আবার চেষ্টা করত। আর কনিষ্ঠ পুত্রটি, তারাপদ মেধাবী ছিল। এল এম এফ ডাক্তার। সাতক্ষীরে শহর এবং আশপাশের গ্রামে তার ছিল খুবই সুনাম। বাবা ম্যাট্রিকুলেশনে অঙ্কে কোনো রকমে পাশ, বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, সংস্কৃত, ভূগোল, এ লেটার। সাতক্ষীরে প্রাণনাথ ইন্সটিটিউশনের কৃতী ছাত্র। বি এ পাশ করে সরকারি চাকরিতে ঢোকেন। বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন মাকে নিয়ে। তখন আমার জন্ম হয়নি। ফজলুল হক তখন বাংলার প্রধান মন্ত্রী। ঋণ সালিশী বোর্ডের তদন্তকারী আধিকারিক ছিলেন। ঋণগ্রস্ত কৃষকের ঋণ মকুব হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত নিতেন। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, গারো পাহাড়, পূর্বধলা, এসব কথা মায়ের মুখে আমি শুনেছি। মোমেনশাহী উপাখ্যান লেখার বীজ তিনিই বপন করে দিয়েছিলেন আমার ভিতরে সেই বাল্যকালে। ময়মনসিংহ জেলার দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকের কথা বাবাও বলেছেন, মাও। দেশভাগের পর বহরমপুরে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের দায়িত্বে ছিলেন। অপশন দিয়ে তিনি ভারত সরকারে যোগদান করেছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন তখন মুর্শিদাবাদের জেলা শাসক। মা আমাকে গল্প করতেন জেলা শাসকের পুত্র আরদালির ছেলের সঙ্গে ধুলোমাটি মেখে খেলা করত। কে একজন লীলা রায়কে অনুযোগ করেছিল নাকি এই অসমতা নিয়ে। লীলা রায় বলেছিলেন, ওর বাবা জেলা শাসক, ও তো নয়। এই গল্প বলতে বলতে মায়ের মুখ আলোয় ভরে যেত। ক্লাস থ্রি-ফোর অবধি পড়েছিলেন, ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হোক, জীবনে সফল হোক, সৎ হোক, এই ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষ্যা। বাবা বহরমপুর থেকেই বোধয় ঢাকা, তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ভারতীয় হাই কমিশনে লিয়াজঁ অফিসার হন। কিন্তু সেখান থেকে ভারত সরকার অন্য কোনো দেশে তাঁকে বদলি করবে শুনে পিতামহ বলেন কলকাতায় ফিরে আসতে। দেশ ভাগ হয়ে গেছে। পরের দুটি ভাই আছে। সকলকে দেখা জ্যেষ্ঠ পুত্রের কর্তব্য। একান্ন পরিবারের দর্শন ছিল এমনই। এখন আমাদের একান্নবর্তী পরিবার নেই। কিন্তু পরিবারের অভিভাবক বড় ভাই। আমার দাদা।
বাবা পশ্চিমবঙ্গ সরকারে যোগদান করেন ১৯৫০ নাগাদ। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে রাজ্য সরকারে চলে আসেন রাজ্য সরকারে চিঠি লিখে। সবই আমার শোনা কথা। তবে ভারতীয় হাই কমিশনের ছবি আমি দেখেছি বাল্যকালে, শাদাকালো ছবি। বাবা বসে আছেন অনেকের সঙ্গে প্রায় মধ্যমণি হয়ে। এক ব্যক্তির পায়ের কাছে একটি রোমশ কুকুর শুয়ে। কুকুরটি খুব আকর্ষণ করত। বেলগাছিয়ার বাসাবাড়ির বহুজনের কথা মনে আছে। তবে ভোর বেলায় বাবা নেতাজি, গান্ধীজী, নেহরু, বিপ্লবীদের গল্প শোনাতেন যে তা খুব মনে আছে। জন্মদিনে দিয়েছিলেন বিজনবিহারী ভট্টাচার্যর একটি বই, ‘নবীন রবির আলোয়,’। সেই রবীন্দ্রনাথকে জানা শুরু। রবীন্দ্রনাথ, ঠাকুরবাড়ি, নোবেল প্রাইজ-- এসব বাবা শোনাতেন ভোরবেলায়। তিনি ধার্মিক মানুষ ছিলেন, কিন্তু বাড়ির সরস্বতী পুজোয় উপবাসে থেকে অঞ্জলি দেওয়ার বিরোধী ছিলেন। নিজের আত্মাকে কষ্ট দিয়ে পুজো হয় না। জ্যোতিষ চর্চা, আঙটি মাদুলির বিরোধী ছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশনে যোগাযোগ ছিল নিবিড়। পেনশনের টাকায় সাধু মহারাজদের সেবা করতেন। এ নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল। আমার তো ছিলই। কিন্তু আমার দাদা বলতেন ওতে যদি উনি ভালো থাকেন, নীরোগ থাকেন, তাহলে আমাদের অসুবিধা কী ? কিন্তু তখন একান্নবর্তী পরিবারে একদম স্বচ্ছলতা ছিল না। এসব বাবার কথা। বাবাও খুব খুশি ছিলেন না আমার ওই চাকরিতে। আমার স্কুলের এক বন্ধু তপন মণ্ডল যে উত্তর চব্বিশ পরগণার বড় জোতের মালিকের পুত্র তা আমি জানতাম না। রাজারহাটেই তাদের বহু ভূ-সম্পত্তি। আমি ভূমি সংস্কার দপ্তরে রাজারহাট থানা-ব্লক অঞ্চলের দায়িত্বে তখন। ১৯৮৪-৮৫ হবে। সে একদিন আমার অনুপস্থিতিতে আমাদের বাসায় এসে একটি বড় ভেটকি এবং ঝুড়ি ভর্তি চিংড়ি দিয়ে যায়। তাদের মাছের ভেড়ি ছিল উত্তর-দক্ষিণ ২৪ পরগণার লাগোয়া গ্রামে। আমি জানতাম না, সে এই কাজ করবে। তাদের সিলিং বহির্ভূত জমির তালিকা তৈরি হচ্ছিল সেই সময়। সেই দায়িত্ব আমার অফিসের। সে কয়েকবার অফিসে গিয়ে আমার সঙ্গে ভাব জমাতে চেয়েছিল। তো বাবার কথায় সমস্ত মাছ বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয়েছিল আমাদের গারহস্ত কাজের সহায়িকা মেনকাদিকে। বাড়ি ফিরলে তিরস্কৃত হয়েছিলাম আমি। আমার যে কোনো হাত নেই এই ঘটনায় তা বাবাকে বোঝাতে হয়েছিল। এখন কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্ক জালিয়াতি হয়। জালিয়াতরা সমাজের ধারক বাহক, কিন্তু সব অসততা, জালিয়াতি কার্যক্রম শুরু হয় অল্প হইতে। যাক গে সে সব কথা। যাবেই বা কোথায় সেই সব দিন? কথা না লতা। কোথা থেকে কোথায় যে যায়।
মায়ের কথায় ফিরে আসি। এখনো, অতি প্রত্যূষে যখন আমার ঘুম যখন ভেঙে যায়, জানালার বাইরে অন্ধকার, কাকও ডাকেনি তখন, হয়ত মাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই স্বপ্ন আমাকে জাগিয়ে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে, এখন কী করব আমি ? দূর অদূর নভোমণ্ডল তখন হিম নীলাভ, চারদিকে অসীম স্তব্ধতা, সেই নীরবতার ভিতরেই আমি যেন আমার জীবনের আরম্ভে পৌঁছে যেতে থাকি। এক বছর, দুই বছর, সামান্য ক'টি বছর, মহাবিশ্বের আয়ুর কাছে তা তো ধূলিকণা মাত্র। এই সেদিন ছিলাম আমি অন্ধকার মাতৃগর্ভে, জননী সমুদ্রে। মায়ের বাবুজি তার মাতৃগর্ভের স্মৃতির কাছে ফিরে যেতে চায়। সেই যে অনন্ত বিস্তারি সমুদ্রজলে ভেসে থাকা, সেই যে আধো ঘুম আধো জাগরণে অপেক্ষা করা কবে আলো বাতাসের পৃথিবীতে সে ভূমিষ্ট হবে। অপেক্ষার আর শেষ নেই। ন'টি মাস। কত শব্দে চঞ্চল হয়েছে। পাশ ফিরে শুয়েছে। তারপর একদিন সে এল। প্রথম আলো পড়ল চোখে। সূর্যের কাজই তার আলো দিয়ে জীবজগতের প্রাণ তাপিত করা। অন্ধকার থেকে প্রাণকে আলোয় নিয়ে আসা। আমি মায়ের মুখ দেখলাম। মায়ের মূর্তি দেখতে শিখলাম, হাসিমুখখানি দেখলাম আমি। মা রাধারানি আমাকে থাবা দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। মা রাধারানি আমাকে দোল দিচ্ছে কোলে শুইয়ে। মায়ের কোলে শুয়ে কাত হয়ে দেখলাম পাখি উড়ে গেল। মেঘের ছায়া এল। রোদ মুছে গেল, আবার ফিরেও এল। উড়ো মেঘে বৃষ্টি এল। ভাদ্রমাসে জন্ম আমার। হেমন্ত এল, শীত এল। ঋতু বদল হতে লাগল। হারিয়ে যাওয়া ঋতু আবার ফিরে এল। মায়ের কোলে শুয়ে মাকে চিনতে লাগলাম। মায়ের মূর্তি সেই তো চেনা আরম্ভ। সেই তো পেনসিলে এঁকে ফুটিয়ে তোলা আরম্ভ। সেই আমার মায়ের মূর্তি গড়া আরম্ভ। মনের ভ্রমে মাটি দিয়ে মায়ের মূর্তি গড়তে গিয়েছিলেন কবি রামপ্রসাদ সেন। মা বেটি কি মাটির মেয়ে, মিছে খাটি মাটি নিয়ে। মাতৃরূপ কি গড়ে তোলা যায়, সে থাকে মনের ভিতরে, যতই অবয়ব দিই আমি, সে থাকে অসম্পূর্ণ।
মা বলতে আমি যে ছবি আঁকতে পারি পেনসিলে তা কার সঙ্গে মিলবে কার সঙ্গে মিলবে না জানি না। শাস্ত্র সম্মত হবে কি না তা, তাও জানি না। পৃথিবীর নানা ধর্মে ঈশ্বর তো মা নন বাবা। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিত্য হি পরমং তপঃ…, পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। মা কই সেখানে ? আমার মাঁকে আমি আঁকি আঁচলে হলুদ, কপালে ঘাম, কয়লার উনুনের গনগণে তাপে লাল হয়ে যাওয়া মুখে বসে আছেন হেঁসেলে। ভাত ফুটছে, তিনি সব্জি কুটছেন। ধুম জ্বর, জলপটি দিচ্ছে মা। মা আছেন জ্বরতপ্ত সন্তানের কপালে হাত রেখে। সারারাত জেগে আছেন মা। ছেলে কিংবা মেয়ের জ্বর দেখছেন। আগে তো বাঁচা, তারপর তো ধর্ম, স্বর্গ, তপস্যা এবং দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধান। দেবতারা সন্তুষ্ট হলে সব হলো, কিন্তু মায়ের চেয়ে কি দেবতার আসন বড়? দেবতারা বাঁচাতে আসেন না। মা জননী জন্ম দিয়েছেন। তিনিই বাঁচিয়ে রাখবেন। আমি যদি যন্ত্রণায় কষ্ট পাই, আমার ব্যথা উপশম করবেন মা।
বাল্যকালে কী দেখেছি। সক্কালে হেঁসেলে যাওয়ার আগে মা জননী বাড়ির গাছ-গাছালির গায়ে জল দেন। গাছ-গাছালি তাঁর সন্তান। ফ্ল্যাট বাড়িতে বাগান ছিল না। জানালায় টব ছিল। সেই টবে যে ফুলের গাছগুলি ছিল, সেই গাছই যেন তাঁর সন্তান, তাদের স্নিগ্ধ করে তবে স্নানে যেতেন। স্নান সেরে হেঁসেলে ঢোকা। মনে আছে, তখন কত মানুষ আমাদের তিন ঘরের ফ্ল্যাটে। সব পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা। তাঁরা রানিদির বাসায় কিছুদিন থেকে নিজেদের বাসা খুঁজে চলে যাবেন। রানিদি একা বিশটা লোকের মুখে দুবেলা অন্ন জুগিয়েছেন। হাসিমুখ। খাইয়ে আনন্দ। সকলের শেষে তাঁর খেতে বসা। ভাতের পাতের পাশে একটা কাঁসার ঘটি থাকত। আলগোছে সেই ঘটি থেকে জল খাওয়াতেই তাঁর যত সুখ। দুপুরে কাঁথায় ফোঁড় দেওয়া, ছেলেমেয়েদের ছেড়া জামা ছেঁড়া প্যান্ট রিফু করা। আবার সিঙ্গার কোম্পানির সেলাই কলে ফরফর সেলাই করা--এসবেই ফুটত তাঁর রূপ। এই মায়ের সঙ্গে নানা অলঙ্কারে ভূষিতা দেবতাদের দেওয়া শক্তিতে শক্তিরূপেণ মায়ের এক বিন্দু মিলও নেই। গয়না তাঁর নেই। কান গলা খালি। হাতে রুলি আর শাঁখা, আর ব্রোঞ্জের উপর সোনার প্রলেপ লাগানো দু'গাছা চুড়ি। গয়না গেছে একান্নবর্তী সংসারে। গেছে গেছে। গয়না যদি হয়, আবার হবে, না হলে হবে না। আমার মায়েরও মা ছিল। সেই মা আশালতা কলমিলতা অকালে চলে গেলেন যখন, দেশটি দু'খণ্ড হয়নি। রানি, রাধারানি জ্যেষ্ঠা কন্যা। বিবাহ হয়েছে বছর তিন। রানির বাবা চলে গেছেন দু’বছর আগে। মা তার পর পর। কপোতাক্ষ তীরে শ্মশান। সেই শ্মশানের দিকে ছোট ভাই, বছর চারের শিবু ছুটে ছুটে যেত। মাকে পাবে সেখানে। রাধারানিই হলেন তার মা। মা আমার কাছে তাঁর মায়ের কথা বলতেন। বাবার কথা বলতেন। বাবার মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু, আর সেই ছেড়ে আসা কপোতাক্ষ নদ, স্টিমারের ভোঁ। রানির পরের বোন মনু মারা গেলে মা চিঠি লিখেছিলেন তাঁর মা আশালতাকে। ... মনু কষ্ট পেয়েছিল শেষদানিতে। এখন তোমার কাছে গেছে মা। তুমি মনুকে কোল দিও। কপালে হাত বুলিয়ে দিও…’। ডায়েরিতে এসব লিখতেন। অন্তঃপুরবাসিনীরা যদি ভালো লেখাপড়া জানতেন, তবে কত লেখাই না পেতাম আমরা। এই দেখুন কী বলতে কী বলছি। কথা না লতা। রানির কথা বলতে গিয়ে আশালতার কথা কেন ? এই সব অনুষঙ্গ আমার ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ উপন্যাসে এসেছে কিছুটা।
আমি গেছি দূর মফঃস্বলে চাকরি করতে। তখন যা দিন, মোবাইল ফোন কেন সেই মফঃস্বলে ইলেকট্রিকের আলো ছিল না, পোস্ট অফিস ছিল না। চিঠি ফেলতে ভিন গাঁয়ে যেতে হত। চিঠি দিলে একমাস আগে কলকাতা পৌঁছত না। বাস থেকে নেমে এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটতে হত অফিস মানে হল্কা ক্যাম্পে পৌঁছতে, এমনই সে জায়গা। ছোটনাগপুরের মালভূমির লেজা সেই অঞ্চল। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের একটি কন্যা। বয়স তার আড়াই তিন। সে তার ঠাকমাকে বলল, ছেলেধরা নিয়ে গেছে বাবুজিকাকাকে। হারিয়ে গেছে, আর ফিরবে না। শিশু যা শোনে তাই বলে। তাকে যা বলে ভয় দেখান হয়, সেও তাই বলে ভয় দেখায় ঠাকমাকে। মা তখন পিতামহী। মায়ের ঘুম আসে না। ছুটিতে বাড়ি এলে জিজ্ঞেস করে মা রাধারানি, কী খাই, কেমন জায়গা। ডাল আলু সেদ্ধ আর কুঁদরি পোস্ত ? মাছ হয় না? মাংস ? সকাল বিকেল মুড়ি, কেন পরোটা লুচি করে দিতে পারে না ? জানেই না মা ওসব। আমাদের দেশটা আসলে খুব গরিব। গ্রামটা আরো গরিব। শুনতে শুনতে মা চুপ। বুঝতে চাইছিলেন দেশটাকে আমার চোখ দিয়ে। ধরা গলায় বললেন, তুই বরং চাকরি ছেড়ে দিয়ে আয়, অন্য কিছু দেখ।
না, চাকরি আমার কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে, দেশটাকে আমি চিনতে পারছি দিনে দিনে।
মা চুপ করে থাকলেন, অবশেষে বললেন, দেশ সব জায়গা থেকে চেনা যায়।
জমি মাটি মানুষ না চিনলে বড় হওয়া যায় না।
মা বলল, বড় হবি তুই ? কী করে, প্রমোশন কবে হবে ?
প্রমোশন না মা, লিখতে চাই, গল্প লিখছি, শুনবে?
আমি কী বুঝব, কিন্তু তুই যদি নিজে বুঝিস হচ্ছে, তবে ছাড়বিনে, ধরে রাখবি, ছাড়বিনে একদম।
মন্ত্র পেয়ে গিয়েছিলাম।
একবার এসে বললাম, মা আমার জ্বর হয়েছিল খুব, তাই আসতে এবার দেরি হল। জ্বরের ঘোরে আমি দেখেছিলাম তুমি বসে আছ শিয়রে। আমার অফিসের ডি-গ্রুপ স্টাফ মুচিরাম মুরমু খুব সেবা করেছে।
মা বলল, তাকে একবার নিয়ে আসিস, দেখব। তাকে পুজোয় জামা দিস একটা। বিয়ে করেছে, করেনি, তাহলে তার মায়ের জন্য একটা ভালো তাঁতের শাড়ি নিয়ে যা। নিয়ে গেছিলাম, মা কিনে দিয়েছিল ধনেখালির সেই তাঁতি মানুষটির কাছ থেকে। ধারে শাড়ি নিতেন। ধীরে ধীরে শোধ করতেন। মুচিরামের মায়ের শাড়ির দাম মা-ই শোধ করেছিলেন। তাঁর সন্তানের সেবা করেছে মুচিরাম, দেবেন না ?
মায়ের ছিল এমনি মন । দাদার বাড়ি সল্ট লেকে। সেখান থেকে ফোন করলেন আচমকা। আয়, কতদিন আসিসনি তুই। আমি তখন কলকাতার বাইরে বাঁকুড়ায়। পনের দিনে একবার কলকাতায় আসি। দু'দিন থেকে ফিরে যাই। খুব অভিমান হত তখন। আবার গেলে গলে জল। একগাল হাসি। হ্যাঁরে, সেদিন একটা মেয়ে এসেছিল, তার বাবা বড়দল স্টিমার ঘাটার মাস্টারবাবু ছিল। পাইকগাছা বাড়ি। পূর্ব বঙ্গ পেলে আর কিছু চাই না। লেবু পাতা আর নুন শুকনো লঙ্কা বুঝি তা। এক থালা পান্তা ভাত শেষ। মায়ের মুখে তাঁর ছেলেবেলার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। সেই গল্পের কতটা ব্যক্ত, কতটা অব্যক্ত তার হিশেব আমি করতে পারব না। পারব না তাই মায়ের মূর্তি পেনসিলে সবটা আঁকতেও পারব না। তবে যেটুকু লিখতে শিখেছি, তা মায়ের কাছ থেকেই যেন শেখা। মায়ের সেই ডায়েরি থেকেই যেন সব টোকা। আঁকা বাঁকা অক্ষরে লিখতেন যা তার সামান্য আমি দেখেছি। লুকোতেন শুধু লুকোতেন। আমাদের রক্তে যে লেখা, তিন ভাই থেকে ভাইঝি ময়ূরী বা আমার পুত্রের ভিতরে যে লেখা নিয়ে একগুয়েমি, মাথা না নোয়ানোর যে অভ্যাস, সবই যেন মা রাধারানির কাছ থেকে আসা। অথচ মা রাধারানি ক্লাস থ্রি পাশ কিংবা থ্রি পর্যন্ত পড়েছিলেন তিনি। ইংরেজিতে নাম লেখা পারতেন। বাবার কাছে শেখা মনে হয়।
এবারের এই মহামারীর কারণে কত মানুষের কাজ নেই, ভাত নেই। মা রাধারানি দেখেছিলেন তেতাল্লিশের মন্বন্তর। সেও মহামারী। সেই কথাও শুনেছি আমি মায়েরই মুখে। ফ্যান দে মা। ১৯৬৬-৬৭ তে এদেশে খাদ্যের অভাব হয়েছিল খুব। তখন আমাদের দিনের বেলাও ভাতের সঙ্গে রুটি খেতে হত। বাঙালির দুবেলা ভাতের অভ্যাস চলে গেল তখন থেকে। খুঁটিয়ে কত কথা শুনতে চাইতাম আমি। মা বলত। মায়ের জীবৎকালে তাঁর মনের খেদ হয়ত কিছুটা গিয়েছিল। তখন বড় ছেলে সুখ্যাত, ছোটছেলের বই বেরোয়, লেখা বেরোয়। মেজ ছেলে লিখে যায় মন দিয়ে। তারও বই বেরিয়েছে। মা ভেবেছিলেন সব কিছু বৃথা যায়নি এক জন্মের এই জীবনে।
একেবারে আমাদের কথা !! আমরাও এই ভাবে দেশ ..মাটি... ভিটে হারিয়ে চলে এসেছিলাম পার্বতীপুর রেল লাইন ধরে একেবারে অসম এর করিমগঞ্জ ধরে লামডিং শহরে !!বাবা ছিলেন "পাহাড় লাইন এর টি।টি "" মনে আছে ।..অনেক গুলো বস্তা ভরা বাসন পত্র আর সাতরঞ্চি জড়ানো বিছানা ।..আর দু তিন টা বড়ো টিনের বাক্স ।..ওই মনোজ বাবুর "সাজানো বাগান " নাটকে যে "সুখে থাকো " বাক্স টা দেখানো হয়েছিল ।..ওই রকম !! মা আমাদের বলেছিলো আমাদের ঘর ভেঙে গেছে তো ।..তাই বাবা নতুন ঘর বানাবেএখানে !!সেই নতুন ঘর হয়েছিল গিয়ে আমার চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে !! বাবা রেল কোম্পানি তে থেকেও ঘুষ নেন নি কোনো দিন ।..তার ঐতিহ্যে আমিও সত্যবাদী আর ঘুষখোর হীন হয়ে জীবনশেষ করছি !দুঃখ করি না ।..কারণ মেরুদণ্ড টা ভাঙি নি আজও দাদা !! চারপাশে ভাই ,বন্ধু সব বড়োলোক ।..গাড়ি বাড়ি ।..উঁচু পদ নিয়ে ।..ছেলে -মেয়ে দের সুশিক্ষিত করে ""সুখে জীবন যাপন করিতেছে ""।..আমিও ।..হয়তো ওদের মতো নই ।..কিন্তু দু বেলা খেয়ে পরে আছি !!আফসোস করি না দাদা ।..জীবনে কোনো জ্ঞানত অন্যায় কাজ করিনি।.. আর করবও না কোনো নেশা করিনি ।.এক থিয়েটার করা ছাড়া ।..ওই মনোজবাবুর মতোই !!তাই কবির কথায় বলি ।."আশ্রয়ের ঠিকানা জানি না , জানি না কোথায় থাকে আত্মীয় স্বজন ।..জন্ম ভূমি বিদেশের মতো ।..বন্ধুরা সব মুখোশ পরা বুদ্ধিজীবী জীব ।..শত্রু মিত্র চেনা দায় ।..স্বদেশের সংকীর্ণ সীমানায় ..""
কথা না লতা। এই লতার বাড়বাড়ন্ত হোক। ফুল ফুটুক। আমরা গাঢ় সুগন্ধে ভেসে যাই।
মায়ের ছবিটি সর্বজনীন। নিজের সদ্য প্রয়াত মায়ের সঙ্গে কতো মিল খুঁজে পেলাম!
রাধারাণী মা বেঁচে থাকলে আজ পুত্রদের নিয়ে গর্বিত হতেন। বড় চাকুরে অনেক হয়, এমন লেখা ক'জন লেখে, এমন নাটকের সৃষ্টি ক'জন করে। উনি রত্নগর্ভা!
অপূর্ব স্মৃতিকথন। পড়ছি আর জড়িয়ে পড়ছি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ছি। যত পড়ছি পরবর্তী পর্বের আগ্রহ আরও বাড়ছে । এই পর্ব তো মন ভিজিয়ে দিলো। সব মায়ের কাহিনি কোথায় যেন এক ।
অনবদ্য
মানুষ। কত মানুষ কত রকমের। বড় ভেটকি, চিংড়ি ভেট দেওয়া তপন মণ্ডল আর জ্বরের সময় সেবা করা মুচিরাম মুর্মুকে পাশাপাশি রাখলাম। নমুনা হিসেবে।
আমরা দেখিনি , কিন্তু শুনেছি ঠাকুর্দার কাছে। তিনি কিশোর বয়সে দাদার সঙ্গে যশোর অঞ্চলের দেশ ছেড়ে এপারে আসেন প্রায় সম্বলহীন অবস্থায়।আপনার স্বাদু মরমী গদ্যে ঐ সময়টি ধরা পড়ছে - এর ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।