কয়েক বছর এগিয়ে গেছি। ফিরে আসি। আসলে ১৯৬৮-তে স্কটিশচার্চ কলেজে প্রবেশ, তিন বছরের সাম্মানিক কোর্স চার বছরের হয়ে ১৯৭২-এ রেজাল্ট বেরিয়েছিল। পরীক্ষা বারবার পেছত। আর গণ-টোকাটুকি সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল প্রায়। যুবদলের দাপট বাড়ছিল। নকশালপন্থী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। বহু ছেলে নগর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা হবে। একটা স্লোগান ছিল কত মধুর—গ্রামে গ্রামে ডাক পাঠাও, জোট বাঁধো তৈরি হও। মনে পড়ে পরীক্ষার দাবিতে না কি হোম সেন্টারের দাবিতে বিধান সরণিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলারের অফিস থেকে মিছিল গেল বিশ্ববিদ্যালয় অবধি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পুলিশের ব্যারিকেড, ব্যারিকেড ভেঙে ছাত্ররা ঢুকে গেল ভিতরে। ভাঙচুর হচ্ছিল। কারা করল, কেন হল বুঝিনি। পুলিশের ভ্যান দেখে পালিয়ে এলাম। আমাদের সঙ্গে পড়ত নীলাঞ্জন। তার বাবা আর এন চ্যাটার্জি তখন পুলিশ কমিশনার। স্কটিশে একদিন পুলিশ কমিশনার এসেছিলেন কী যেন গোলমাল থামাতে। এই ভাবে কলেজজীবন পার হচ্ছিল।
সেই সময়টা ছিল ভয়ের, সময় ছিল বিভ্রান্তির। কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো কিছু মেলাতে পারছিলাম না। বিদ্রোহী যুবশক্তির প্রতিবাদ থামাতে কত কিছু না এসেছিল শহরে। পর্নোগ্রাফি ম্যাগাজিনে ছেয়ে গিয়েছিল কলকাতার সমস্ত বুকস্ট্যান্ড। ইংরেজি এবং বাংলা। বাংলাই বেশি। সেই সব পত্রিকা ছিল পিন আঁটা ম্যাগাজিন। নামগুলি মনে পড়ে, সুন্দর জীবন, জীবন যৌবন, সুন্দরী, নরনারী, এমনি। চকচকে আর্ট পেপারে নগ্ন ছবি ছাপা হত। আর কলকাতার মঞ্চে এল ক্যাবারে ডান্স। প্রতিষ্ঠিত মঞ্চ নয় এমন সব জায়গায় থিয়েটার আরম্ভ হল। সেই সব থিয়েটারে নগ্ন নৃত্য, নগ্নতাই ছিল প্রধান উপকরণ। বয়েজ ওন লাইব্রেরি হল, রেলওয়ে ইন্সটিটিউট হল এমনই সব মঞ্চ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর কলকাতার সিনেমা হলে আমেরিকা বাই নাইট, ওরিয়েন্ট বাই নাইট ইত্যাদি ছবিতে ছেয়ে গিয়েছিল। বিপ্লব না ভোগ, যৌনতায় ভেসে যাক যুবসমাজ। ঠিক এই অবস্থা ফিরে এসেছিল বামফ্রন্ট শাসনের বছর দশ-পনেরো পরে। কলকাতার সিনেমাহলগুলি ভেসে গিয়েছিল পর্নো সিনেমায়। মালয়ালাম ছবি এবং ইংরেজি ছবি। তখন কী যুবসমাজে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছিল? শাসক সব সময়েই তার শাসন বজায় রাখতে, যুবসমাজকে আন্দোলন প্রতিবাদ ধ্বংস করতে পরিকল্পিত ভাবে এসব করে থাকে। যৌবরাজ্য ধ্বংস করতে সংস্কৃতিকে সাহিত্যকে আগে নষ্ট করা দরকার। এক এক সময়ে এক এক ভাবে তার স্রোত আসে। যৌনতা, হিংস্রতা, কুসংস্কার, অলৌকিকতা এসবই যুবসমাজ এবং সংস্কৃতিকে নষ্ট করার হাতিয়ার বলে মনে হয় এখন। এসবের চর্চা আচমকা বৃদ্ধি অস্বাভাবিক কিছু নয়। পিছনে পরিকল্পনা থাকে।
অনার্স পড়া কলেজে, সাহিত্যপাঠ নিভৃতে। কেমিস্ট্রির সঙ্গে সাহিত্যপাঠ চলছিল। যেসব পত্রিকা পড়তাম, সেখানে আমার প্রিয় লেখকদের খুব নিন্দা করা হত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়ার পর লেখা হয়েছিল লাখপতি বুর্জোয়া লেখক। না পড়ে, না জেনে লেখা। তিনি সামন্ততন্ত্রের ধারক বাহক। অথচ তিনিই লিখেছেন হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, কবি, আরোগ্য নিকেতন, আর গণদেবতা, ধাত্রীদেবতা...। আমি তাঁকে বাল্যকাল থেকে দেখছি। দেখছি নরেন্দ্রনাথ মিত্র আসছেন টালা পার্ক পেরিয়ে পাইকপাড়া থেকে। তাঁর গল্প পড়ে আমি মুগ্ধ। একদিন আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় টোকা। দরজা খুলতে আমি বিস্ময়ে অভিভূত। নরেন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন। স্নিগ্ধ স্বর, মনোজ আছে? তিনি এসেছেন তাঁর সন্তানপ্রতিম অনুজের সঙ্গে আড্ডা দিতে। ক-দিন আগেই রেডিওতে তাঁর শ্বেতময়ূর গল্পটির নাটক শুনেছি। নাট্যরূপ দাদার। আশ্চর্য অব্যক্ত এক প্রেমের গল্প। এমন গল্প বিশ্বসাহিত্যে কমই লেখা হয়েছে। নরেন্দ্রনাথ ছিলেন জীবনের ধারা ভাষ্যকার। কত মূল্যবান গল্প যে লিখেছেন। রস, পালঙ্ক, রাণু যদি না হত, হেড মাস্টার...। তাঁর গল্প পড়লে গল্পের বয়ন শেখা যায়। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় আমার বাল্যকালে প্রয়াত হয়েছেন, তাঁকে একবার দেখেছিলাম।
১৯৭১-এ ভয়ের বাতাবরণ কেটেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে। বরুণ সেনগুপ্ত লিখলেন সাতক্ষীরে অভিযানের কথা। আমরা সাতক্ষীরের লোক। বাড়ির সকলে হুমড়ি খেয়ে বরুণ সেনগুপ্তর প্রতিবেদন পড়লাম। বাঙালি লড়াই করছে স্বাধীনতার জন্য। ছেড়ে আসা মাটি, দেশ, গ্রাম, ভিটে কেমন ছিল তা আমার অজানা ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর দুই দেশে বৈরিতা আরও বেড়েছিল। পূর্ববঙ্গের খবর আসা ক্রমশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ এবং রেডিও খবর দিতে লাগল। পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু স্রোত আসছে সীমান্ত পার হয়ে। আমি তখন কী করব কী করব ভেবেই দিন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হতে চাই। একটা দেশ স্বাধীন হবে। সেই দেশটি আমার পিতৃকুল, মাতৃকুলের দেশ।
মুক্তিযুদ্ধের আগে সীমান্তের ওপার ছিল আমার কাছে এক অলীক ভূখণ্ড। আমাদের ফেলে আসা গ্রাম, নদী আর আমাদের নেই, মায়ের কাছে এই কথা শুনে আমি তাঁর বেদনাকেই যেন ধারণ করেছি উত্তরাধিকার সূত্রে। পূর্ব পাকিস্তান, আয়ুব খাঁ, ইয়াহিয়া খাঁ, ভারত পাকিস্তানের সেই ১৯৬৫-র যুদ্ধ, ব্ল্যাক আউট, প্যাটন ট্যাংক, মিগ বিমান, স্যাবার জেট, এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি। পূর্ববঙ্গের কোনো খোঁজ তেমন পেতাম না। শুধু আমার মা রেডিও পাকিস্তান শুনতেন, তখন শোনা যেত মনে হয়। মা খবর দিতেন সাতক্ষীরেতে কী হল, কপোতাক্ষ নদে কোথায় ব্রিজ হল। এই সব সংবাদই ছিল তাঁর কাছে আশ্রয়। এইসব সংবাদ কবিতার সুষমায় ভরে উঠত তাঁর কাছে এসে। মুক্তিযুদ্ধই আমাকে প্রথম জানাল বাঙালি যুদ্ধে নেমেছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। আর তাঁর নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিবর রহমান। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পর এক বাঙালি যিনি বলতে পেরেছিলেন, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। নেতাজির সেই ডাক, আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব তা যেন ভাষার জাদুতে অন্য রকমে আমাদের কাছে নিয়ে এলেন শেখ সায়েব। সেই যে ৭ মার্চের ডাক, তোমাদের ঘরে যা যা আছে সব নিয়ে বেরিয়ে পড়ো, আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম...। মনে হয়েছিল শৌলমারির সাধু নন, নেতাজি ফিরেছেন শেখ মুজিবর হয়ে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে, মাঝামাঝি পর্যন্ত সংবাদপত্র এক এক বিশেষ খবর নিয়ে বৈকালিক টেলিগ্রাম সংস্করণ প্রকাশ করত। তার ভিতরে কোনো মন্ত্রী বা নেতার আকস্মিক প্রয়াণে যেমন তা বেরত, তেমনি বেরত নেতাজির খবর নিয়ে। নেতাজি ফিরে এলেন। সংবাদ পাঠের পর বোঝা যেত কিছুই না তা।
আমি কি এই আর্ত বাঙালির কেউ নই? খবরের কাগজ আর রেডিও আমাকে বদলে দিতে লাগল। তখন মুজিবরকে নিয়ে গান বেঁধেছেন অংশুমান রায়, গেয়েছেনও তিনি। আমার তখন কুড়ি। আমার ভিতরে মুক্তিযুদ্ধ প্রবেশ করছে। আমি কয়েকজনকে জোগাড় করে চাঁদা তুলতে বেরলাম পাড়ায়। অবাঙালিরা মুখ ফেরালেন কিছু কিছু, আবার দিলেন যে কেউ কেউ তাও মিথ্যে নয়। বাঙালিরা সবাই যে দিলেন তা নয়, অনেকে দিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী করব আমরা?
বাঙালির মহাযুদ্ধ ওপারে যে শুরু হয়েছে এই কথা বলতে লাগলাম। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর অংশুমান রায় আমাকে উদ্দীপ্ত করছেন। আমি বাঙালি আগে। আমাদের ফেলে আসা মাতৃভূমি আক্রান্ত। মাতৃভূমির কোনো খোঁজই রাখতাম না। স্কটিশচার্চ কলেজে কী অপূর্ব বক্তৃতা শুনলাম কবি, অধ্যাপক তরুণ সান্যালের। যুদ্ধ চলছে। আমি চাঁদা তুলতে লাগলাম। আমার সহপাঠী বন্ধুরা, পাড়ার ভদ্রলোক পরিবারের বন্ধুরা কেউ তেমন এল না, যারা আমার সঙ্গী হল, তারা সব গরিব বস্তিবাসীর সন্তান। তারা বলল, চলো আমরাও যাব যুদ্ধ করতে। কেউ কেউ বলল, পেটো বোমা বানিয়ে নিয়ে যাবে কি না। তারা ভেবেছিল পেটো বোমা দিয়ে খান সেনা মারবে। কলকাতায় সেই ৭১-এ পেটো বোমা প্রায় কুটির শিল্প। যাই হোক সেই টাকায় প্রাথমিক শুশ্রূষার ওষুধ, ডেটল, বেঞ্জিন, তুলো, ব্যান্ডেজ, আর কী কী কেনা হল। বনগাঁ লোকাল ধরে বনগাঁ, ট্রেন চলতে লাগল, পার হতে লাগল বারাসত, অশোক নগর, মসলন্দপুর, হাবড়া, গুমো… ট্রেন ভরতি হয়ে যেতে লাগল। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে উঠতে লাগল যুবক আর মধ্যবয়সীরা। তাঁদের গায়ে যেন ওপারে ফেলে আসা খাল বিল, জন্মভূমির কাদামাটির গন্ধ। সবাই যাচ্ছেন সীমান্তে। পাকিস্তান আর থাকবে না। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এসেছেন একজন। বনগাঁ থেকে সেই পতাকা কাঁধে মিছিল চলল সীমান্ত পর্যন্ত। আমাদের এবার লুকিয়ে যাওয়া। কোনো গ্রাম, খাল বিল পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে এক মুক্তি শিবিরে। জয় বাংলা। বুকে জড়িয়ে ধরলেন মধ্যবয়সী একজন। যা দেওয়ার দিয়ে ফিরে এসেছিলাম কেন না শুনছিলাম পাক বাহিনী যশোরে রয়েছে। এদিকে আসছে। একটু মাটি নিয়ে ফিরেছিলাম। মাটি দেখে মা আর বাবার চোখে জল। কতকাল বাদে মনে পড়ল সেই ফেলে আসা গ্রাম আর নদীর কথা। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল, আমরা এপ্রিলের প্রথমেই সীমান্ত থেকে ঘুরে এলাম। ১৫ এপ্রিল, ১ বৈশাখে একটি সভা করলাম পাড়ার ত্রিকোণ পার্কে। সভার সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। অসামান্য বক্তৃতা করেছিলেন। এসবের উদ্যোক্তা ছিলাম আমি। কিছু একটা করতে চাইছিলাম। খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম একটা রাস্তা। সবই যেন অন্ধগলি। বেশিদূর যাওয়া যায় না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই সময় কয়েকবার কথা বলতে পেরেছিলাম। মনে হয়েছিল পাহাড়ের মতো মানুষ। তাঁর সংগ্রামের কথা তখনও জানি না। তখনও ‘আমার কালের কথা’ পড়িনি। লেখকের পথ একটুও কুসুমাস্তীর্ণ নয় তা তেমন জানি না। কিন্তু তখন নব্য লেখকরা তাঁর বিরুদ্ধে কত কথাই না বলতেন। বামপন্থীরাও ছেড়ে কথা বলেননি।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালেরই ১৪ সেপ্টেম্বর সামান্য ক্ষত থেকে তাঁর মৃত্যু হল। সেই দিন আমি সকাল থেকে তাঁর বাড়ির সামনে বসেছিলাম। দেখছি একে একে বিখ্যাতজনেরা আসছেন। কাউকে চিনি, কাউকে চিনি না। দুপুরে শবযাত্রা শুরু হল। বাড়ি এসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর ধারাবিবরণী শুনলাম। তারপর? মুক্তিযুদ্ধে আমার কিছু করার নেই। সল্টলেক বুজানো বালির মাঠে যে উদ্বাস্তু শিবির হয়েছে, সেখানে যেতে গিয়ে দূর থেকে দেখেছিলাম হোগলার ছাউনি দেওয়া মানুষের ঘরবাড়ি। চেনা কিছু যুবক সেখানে ভলান্টিয়ার হয়েছিল। ত্রাণের সামগ্রী বাড়িও নিয়ে আসত। আমাকে বলেছিল ভলান্টিয়ার হবি। ভলান্টিয়ার হলে চাকরি মিলতে পারে। উঁহু। তখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। গ্র্যাজুয়েট হইনি। ওসব পথ আমার নয়। কিন্তু একটা কিছু করতে হবে তো। কী করব?
১৯৭১-৭২ হবে, গোপনে আন্তন চেখভের একটি গল্প ‘মুখোস’ নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। সেই নাটক পাড়ার এক অভিনেতা বন্ধুকে পড়াই। শখের থিয়েটারের অভিনেতাটির সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে আমার বন্ধুতা। পাড়ার মঞ্চে দুজনে একসঙ্গে অভিনয় করেছি, তার অভিনয়-কুশলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে বেশ কয়েকবার। তখন পাড়ায় পাড়ায় স্টেজ বেঁধে অভিনয় হত খুব। এসব হত ১৯৬৬-৬৭ এই সময়ে। তার রেশ আমাদের পাড়ায় ছিল। সে খুব বলিয়ে কইয়ে ছিল। তার যোগাযোগ ছিল কম না। ছোটো ছোটো নাট্যদলে অভিনয় করে বেড়াত জানি। তখন পাড়ায় পাড়ায় একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা হত। তাকে নিয়ে আমরা সেই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে কিছুই করতে পারিনি, তবুও তার ভিতরে থিয়েটার নিয়ে খুব উৎসাহ ছিল। তো আমার লেখা চেখবের গল্পের সেই নাট্যরূপ শুনে সেই বন্ধু আমাকে নিয়ে যায় পাইকপাড়া ২ নং বাস স্ট্যান্ডের কাছে এক যুবকের কাছে। আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়োই ছিলেন গৌতম লাহিড়ী। বহু রাত অবধি জেগে সাহিত্যপাঠ করতেন, নাটক লেখার চেষ্টা করতেন। থিয়েটারের অভিনেতা এবং নির্দেশক হবেন, এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। তিনি বেলা দশটায় ঘুম থেকে উঠে আমাদের সামনে এসে বসলেন। আমরা সাড়ে ন-টা থেকে অপেক্ষা করছিলাম তাঁর জন্য। সেই মুখ মনে পড়ে আমার। শীর্ণকায়, থুতনির কাছে একটু দাড়ি। সাদা পায়জামা আর ঘন রঙের পাঞ্জাবি, মুখে হাসি। তাঁর বাড়িতে বসে সেই নাটক পাঠ হল। খুব পছন্দ হল তাঁর। একদিনেই আমরা হয়ে গেলাম বন্ধু। নাটকের পাণ্ডুলিপি আর আমাকে নিয়ে গৌতম ঘুরতে লাগল নানা নাট্যদলে, যদি মঞ্চস্থ করা যায়। গৌতম নিজে যুক্ত ছিল প্রবীণ নাট্য প্রযোজক গণেশ মুখোপাধ্যায়ের শ্রীমঞ্চ নাট্য দলের সঙ্গে। নতুন আঙ্গিকে শ্রীমঞ্চ বনফুলের নাটক ‘প্রচ্ছন্ন মহিমা’ মঞ্চস্থ করল। গৌতম অপূর্ব অভিনয় করেছিল। ৭২-ই হবে। কেন না গৌতমই আমাকে ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের খবর দিয়েছিল। প্রসাদ শারদীয়তে প্রকাশিত হয়েছিল সেই উপন্যাস। তখন শারদীয় সংখ্যা নিয়ে বেশ আলোচনা হত। আমরা খুঁজে খুঁজে পড়তাম। লেখকদের চিনি না, কিন্তু কোন্টা কার ভালোলাগল তা নিয়ে রীতিমতো কথাবার্তা হত। ‘হাজার চুরাশির মা’ মহাশ্বেতা দেবীর লেখকজীবনের একটি বাঁক। তিনি যেন গজদন্ত মিনার থেকে পথে নেমে এসেছিলেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর সাহিত্য অকাদেমি প্রাপ্তির বক্তৃতায় তিনি এই আহ্বান দিয়েছিলেন সকল লেখকদের উদ্দেশে—গজদন্ত মিনার থেকে নেমে আসুন লেখকরা। যদিও তা এখন সমুচিত মনে হয় না। নিজের কথা বলো। অন্যে কী করবে সেই সিদ্ধান্ত সে নিজেই নেবে। তখন কোন্ লেখক না পথে নেমেছিলেন তাঁদের লেখার ভিতর দিয়ে। সাধারণ মানুষ, নিরুপায় মানুষের কথা কে না লিখেছেন? সত্তর দশকেই বিমল কর লিখেছিলেন শমীক, ভুবনেশ্বরীর মতো উপন্যাস। গভীর নিমগ্ন লেখকের এ ছিল সময়ের প্রতি দায় প্রদর্শন। সরাসরি নয়। সংকেতে চিরাচরিত মূল্যবোধকে অস্বীকার। তখন সকলেই সাহিত্যের প্রচলিত রীতি ভেঙে দিতে চাইছেন তাঁর মতো করে। লেখায় আসছে নিরূপায় মানুষ। একেবারে হাঘরে মানুষ এসেছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ উপন্যাস, আরও অনেক গল্পে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সকলেই মানুষের কাছাকাছি এসে লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় কিছু গল্প। থাক এসব কথা। গৌতম লাহিড়ী চেষ্টা করেও সেই নাটক অভিনয় করাতে পারেননি। আমিও হতাশ। আমার কিছু হবে না। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কোথাও কিছু সুবিধে করতে পারছি না। নাটক লিখব, সাধ ছিল। কিন্তু নাটক হল সাহিত্যের আলাদা এক ফর্ম। আমি তা আয়ত্তে আনতে পারিনি। এর কিছুদিন বাদে, সন তারিখ মনে নেই, ১৯৭২-এ কংগ্রেস ফিরে এল আবার ক্ষমতায়। সেই নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। ঘটনাটি ১৯৭৩-এর প্রথম দিকেও হতে পারে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী। নকশাল দমন করতে লাগলেন। যুবকদের অস্তিত্বেই প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গিয়েছিল। সন্দেহ করত রাষ্ট্রশক্তি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বদল হয়ে গিয়েছিল। সমাজজীবন বদল হয়ে গিয়েছিল। ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এপাড়া থেকে ওপাড়া যাওয়া যেত না। গুন্ডা মস্তান অতি সক্রিয়। বোমা বাঁধতে গিয়ে আমাদের পাড়ার লখিয়া গুণ্ডা ছিন্নভিন্ন হয়ে মারা গেল। তার জন্য কত বড়ো শহিদবেদি তৈরি হলো। সেই শহিদবেদি আর লখিয়া প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দির এখনও আছে। সেই মন্দিরে ধুমধাম করে শিবরাত্রি, চৈত্র সংক্রান্তির নীলের পুজো এবং দীপাবলি পালন করা হয়। তখন মাস্তান যুবকদের কাছে কানপুরিয়া (কানপুরের ছুরি), কামারের ঘরে তৈরি পিস্তল থাকত। যখন পাড়ায় পাড়ায় ঝামেলা লাগত, খোলা রাস্তায় পিস্তল হাতে লখিয়া, হাবুল, কাবুলরা ঘুরে বেড়াত যে তা দেখেছি। ভয়ে সব জানালা বন্ধ হয়ে যেত। এই সময়ের কলকাতার কথা অপূর্ব লিখেছেন জয়ন্ত দে তাঁর দীর্ঘ উপন্যাস ‘নতজানু’তে। তার পটভূমি ছিল কালীঘাট।
সময়টাই ছিল যেন অভিশপ্ত। বিপ্লবের উদ্দেশে ঘর থেকে বাহিরে যাওয়া যুবকদের লাশ পড়তে লাগল। কবি এবং সাংবাদিক, সিপিআইএমএল রাজনীতি করা দেশব্রতী পত্রিকার সম্পাদক সরোজ দত্ত পড়ে থাকলেন ময়দানে। তাকে পুলিশ নাকি ময়দানে এনে গুলি করে মারে, তা দেখে উত্তমকুমার মুম্বই পালিয়ে গিয়েছিলেন। আসলে তিনি যা দেখেছিলেন প্রাতঃভ্রমণের সময়, তা তাঁকে বলতে বলেছিল বিপ্লবী যুবকেরা। আর পুলিশ নিষেধ করছিল। ভয় দেখিয়েছিল। সত্য মিথ্যা জানি না, কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে দিব্যেন্দু পালিতের একটি অসামান্য উপন্যাস আছে, ‘সহযোদ্ধা’। সেখানে সাহসী সাংবাদিক উপেক্ষা করেছিল পুলিশের নির্দেশ। সেই সময়ে বরানগরে সাফ হল নকশালবাদী বিপ্লবীরা। সেইসব ঘটনার কথা লিখিত আছে অনেক। আমি আর নতুন করে বলছি না। খুব ভয় করত। বাড়িতে লাল বই লুকিয়ে রাখব কোথায়, সেই জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সোভিয়েত বই কম ছিল না। আমি তো রাশিয়ান সাহিত্য পাঠ করে লিখতে শিখেছি। ছিল চৈনিক উপন্যাস চিন চিং মাই রচিত বিপ্লবের গান (সং অফ হোয়াংহো)। পিপলস বুক সোসাইটি প্রকাশিত এই উপন্যাস অনুবাদ করেছিলেন অনীক পত্রিকার সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী। ছিল রেড বুক। মার্কস এঙ্গেলস রচনা সমগ্র। যৌবনে এইসব বইয়ে বুঝে না বুঝে মুগ্ধতা ছিল। কিন্তু বিপ্লবের গান বা গোর্কির মা উপন্যাসের পাশাপাশি চেখভ, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, তারাশঙ্কর, মানিক পাঠ্যের মতো পড়তাম। সেই সময় মুগ্ধ হয়েছিলাম সুবিমল মিশ্রর হারান মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি পড়ে। তখন জেলখানা ভরতি হয়ে গেছে যুবকে যুবকে। থার্ড ডিগ্রি, পুলিশ অফিসার রুণু গুহ নিয়োগী, দেবী রায়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক ঘিরে ধরছে। খবরের কাগজে দেখলাম বারাসত, বেলেঘাটায় গুলিবিদ্ধ লাশের সারি,... তার ভিতরে পাড়ার সেই থিয়েটার করা যুবক বন্ধু যে আমাকে গৌতম লাহিড়ীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল, সে হাই নেক সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরতে লাগল। যুবনেতা হয়ে গেল আমাদের অলক্ষ্যে। আমি রাস্তা খুঁজছিলাম, কিছু একটা করতে চাইছিলাম, কিছুই করা হয়ে উঠছিল না। কিন্তু সেই বন্ধু পেয়ে গিয়েছিল জীবনের মহার্ঘ পথ। সে কবে যুবনেতা হল কী করে হল জানি না। কেন হল তাও জানি না। কী করে সে অমুকবরণ দাসের কাছাকাছি গিয়ে তাঁর অনুগামী হয়ে গেল তাও জানি না। হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারে উৎপল দত্তর ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাটকের একটি শো ছিল এক রবিবার সকালে। হল ভাঙচুর করল যুবদল। মঞ্চস্থ করতে দেবে না ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’। সেই ঘটনা মানে সেই ভাঙচুর কেন জরুরি, না অত্যন্ত খারাপ নাটক! কেন নাটক বন্ধ করা হয়েছে, তা আমার নাটক-প্রিয় বন্ধু আমাকে বোঝাতে লাগল পরদিন সকালে। তার মুখ দেখে আমার ভয় করতে লাগল। মনে মনে বলি, ওরে তুই এমন হয়ে গেলি কবে? কে তোকে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে এমন যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে দিল আমাদের অলক্ষ্যে? কে তোর ভিতরের মি. হাইডের ঘুম ভাঙাল রে? মনে নেই আমরা ডাকঘর করেছিলাম মঞ্চ বেঁধে, মুক্তধারা করে প্রশংসিত হয়েছিলাম। এক সঙ্গে চাকভাঙা মধু, রাজরক্ত দেখেছিলাম। উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার দেখে তোর কী উচ্ছ্বাস! আরে তোকে যে চিনতে পারছি না বন্ধু। হে সময় উত্তাল সময়, এক বন্ধু হয় মুক্তিকামী, বিপ্লবী, পুলিশের গুলিতে তার প্রাণ যায়, আর এক বন্ধু হয় মুক্তিকামীদের ত্রাস। গৌতম লাহিড়ী আমার কাছে সব শুনে বলেছিল, সে জানে সব। স্টার থিয়েটারে হামলার সামনে কারা ছিল সব জানে সে। বলল, গল্প লিখুন, গল্প। এখন আপনার কাজ এই সব নিয়ে লেখা। গল্প আমার লেখা হয়নি। আমার সেই বন্ধু গৌতম শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল। নাট্য-পাগল গৌতম তেমন কিছু করতে পারেনি, আমি, আমরা ভাবতাম সে বড়ো পরিচালক হবে, অভিনেতা হবে, হয়নি। আর পাড়ার সেই বন্ধু এক অলৌকিক উপায়ে ধনী, ক্ষমতাবান, পরবর্তী কালে সংস্কৃতির ধারক। এই পৃথিবী এক অদ্ভুত জায়গা। সারাজীবনেও একে চেনা হল না।
খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। উলটে পালটে দেখছি সময়ের এই দলিল।
চণ্ডাল প্রজন্ম '৭১। তাই এই লেখা আরও বেশি হৃদয় ছুঁয়ে গেল। অদেখা মুক্তিযুদ্ধ, সাতক্ষীরা অভিযান, শরনার্থী শিবির, মুক্তাঞ্চলের মাটি ইত্যাদিতে মন বিষন্ন হলো।
"মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে৷"...
মন দিয়ে পড়ছি এই আত্মজৈবনিক। প্রজন্মের পরিভ্রমণ
অসামান্য।
অপূর্ব বর্ণনা ! স্মৃতি মেদুর !!মা বাবার কাছে শুনেছি দেশ ভাগ আর তার দুঃসহ যন্ত্রণার কথা! আমরা এই প্রজন্ম হয়তো সব ভুলতে বসেছি ।..কিন্তু কিছু লোক এখনো বেঁচে আছি যারা এই স্মৃতি কে বয়ে নিয়ে বেড়াই !!যারা আজকে ওপার বাংলা থেকে আসা লোক জন দের ""উইঘুর বা "উইপোকা "'বলছে তারা কি জানে দেশ ভাগের বেদনার কথা কি ???অসংখ্য ধন্যবাদ , স্যার !!