গ্রাজুয়েট হয়ে মন খারাপ হয়েছিল ইউনিভার্সিটি যেতে পারিনি তাই। বাবা বললেন, ডব্লিউ বি সি এস দে। তার জন্য সংবিধান পড়তে হবে, আরো কী কী পড়তে হবে। সংবিধানের নানা আরটিকেল, বই এনে পড়তে গিয়ে রস পেলাম না। চাকরির সাক্ষাৎকার পাই। কখনো পরীক্ষায় বসে, কখনো সরাসরি ডাক। হাওড়ার আমতা থেকে মাইল পাঁচ সাত দূরে রসপুর গ্রামের ইস্কুলের সাক্ষাৎকারের কথা মনে আছে। সেই বোধ হয় প্রথম ইন্টারভিউ। ইস্কুল মাস্টারি, সুতরাং ধুতি পাঞ্জাবি। আমার বন্ধু দেবাশিসের খাদির পাঞ্জাবি আর দাদার ধুতি পরে খুড়তুতো ভাই পবনকে নিয়ে চললাম রসপুর। হাওড়া, হাওড়া থেকে বাসে আমতা। আমতা থেকে দামোদরের বাঁধের পথ ধরে হেঁটে রসপুর। নদীর ওপারে এপারে সর্ষে ক্ষেত। হলুদ হয়ে আছে দুই দিগন্ত। মাথায় নীল আকাশ। শীত চলে যাচ্ছে। পবন বলল, তুমি যদি এই চাকরি পাও, তোমার লেখার খুব সুবিধে হবে। এখানেই থেকে যেও।
ওই যে লেখা। তাই তো। কেমিস্ট্রির টিচার যাচ্ছে গল্প মাথায় নিয়ে। কী করেন ? লিখি। আমি বাংলার ক্লাসও নিতে পারব।
হুঁ, কেমিস্ট্রি পারবেন তো ? চাকরি আমার হয়নি। কত কায়দা করে ধুতি পাঞ্জাবি, শাল নিয়ে গেছিলাম ইস্কুল মাস্টার সেজে। বৃথা গেল ওই সাজ। কিন্তু ইস্কুলে গো অ্যাজ ইউ লাইকে পুরষ্কার তো ছিল বাঁধা। এখানেই হেরে গেলাম।
পরপর ইন্টারভিউ দিচ্ছি, একই যুবকের সার আমরা বসে থাকি আমরা। সকলেই বিভিন্ন কলেজের কেমিস্ট্রি অনার্স। কেউ কেউ এম এস সি চান্স পেয়েছে। পড়তে পড়তে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ পদের জন্য ওষুধ কোম্পানি, কেমিস্ট পদের জন্য, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি সকলেই ডাকে। নেসল কোম্পানির কথা তো বলেইছি আগে, সুখ্যাত রং কোম্পানি ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ডাকল। তখনো পদ অনুযায়ী ইন্টারভিউ দেওয়া শিখিনি। কয়েক জায়গায় গলায় টাই ঝুলিয়ে গিয়েছিলাম। টাই আমার দাদার ছিল। দাদার কোট কাটিয়ে নিয়ে পরতাম ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। তখন কলকাতায় ফেরিওয়ালারা ঘুরত কোট, প্যান্ট সোয়েটার নিয়ে। শুনতাম ওসব মরা সায়েবের কোট। আসলে তা নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রাণে আসা শীত বস্ত্র। সেই সব বস্ত্রই সুযোগ সন্ধানীরা বাজারে বেচে দিয়ে দু’পয়সা উপার্জন করত। আমাদের দেশের বেওসায়ীরা দু’পয়সা নাফার জন্য সব পারে। আর একটা কথা বলি ত্রাণেই সংস্কৃতির অদ্ভুত এক বিনিময় হয়। কুৎসিত অনুপ্রবেশ ঘটে। এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ স্বল্প পোশাকেই অভ্যস্ত। কৃষক, শ্রমিক যতটা না কোট প্যান্টে অভ্যস্ত, তার চেয়ে বেশি একটি মোটা চাদরে, তা দিয়ে মাথা ঢেকেও ফেলে শীতের হাত থেকে বাঁচে। গ্রীষ্মে একটি গামছা কত কাজেই না লাগে। ফলে নাগরিক ত্রাণে রুচি, জীবনশৈলী ঘেঁটে যায়। কৃষক রমণীর জন্য যদি স্কারট, জিনস পাঠাও ত্রাণে সে কেমন হবে ? বহু বছর বাদে ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলার ভূমিকম্প বিধ্বস্ত গ্রাম কিল্লারিতে গিয়ে তা দেখেছিলাম। সেইটিই হয়ে উঠেছিল আমার ‘নিসর্গের শোকগাথা’ উপন্যাসের মূল সূত্র। মুম্বই থেকে সিনেমা তারকারা যে ত্রাণ পাঠিয়েছিল, তার ভিতরে জিন্স, স্কারট, কোট, প্যান্ট ছিল। তারা সব যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। পরিধান করেনি।
চাকরির চেষ্টা করছি। প্রতিদিন ডাকের দিকে চেয়ে থাকি, ঐ বুঝি এল সে। নিয়োগপত্র। কিন্তু সেই সঙ্গে চেষ্টা করছি গল্প লেখা। বাড়ির মানুষ বিরক্ত। বাবার অত খোজখবর রাখা অভ্যাস ছিল না। কিন্তু আরো অনেকে তো আছে। বাবা অবসর নিয়েছেন ১৯৭১-এ। দাদা একা চাকুরিয়া, নিউ আলিপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন।
আমার উপরের দাদা উদয়ণ গবেষণা করবে, কলেজে পড়াবে, এই স্বপ্নে বিভোর। আমি পড়ি না, কোনো জাগতিক স্বপ্ন বাড়ির সামনে উপস্থাপন করতে পারিনি, ঘুরে বেড়াই কাদের সঙ্গে, যারা বয়সে বড়, আমার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে? আমাদের বেলগাছিয়া থেকেই বেরত ‘একাল’ পত্রিকা। সম্পাদক ছিলেন নকুল মৈত্র এবং ভরত সিংহ। নকুল মৈত্র ডাকঘরে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি করতেন। ভরত সিংহও ন্যাশানাল টেস্ট হাউসে অমন পদে। কিন্তু দুজনে ছিলেন সাহিত্য অন্তঃ প্রাণ। আমি তাদের সঙ্গেই ঘুরছি। তাদের সঙ্গেই মিশি। আর মিশি নাটক পাগল গৌতম লাহিড়ীর সঙ্গে। পাড়ার বন্ধুরা তো ছিলই। কিন্তু তাদের থেকে সরে যাচ্ছি। সাহিত্য শিল্প মাথা খেয়েছে আমার। এর ভিতরে একদিন খালাসিটোলা চিনেছি। সে এক মাছের বাজার। কল্যাণী ব্রুয়ারিজের বাংলা মদ খেয়েছি। লেখক হতে গেলে এসব লাগে। ভালোই লেগেছিল। তবে বুঝেছি লেখার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আনন্দের জন্যই খাওয়া। বাড়ির মানুষ উদ্বিগ্ন। লিখবে বলছে, লেখা কি অত সহজ ?
আমি একটি গল্প লিখে নিয়ে নকুলদাদের কাছে গেলাম। নকুলদার বস্তিবাড়িতে রবিবার সকালে সাহিত্যের আড্ডা হত। সেই আড্ডায় একদিন সুবিমল মিশ্র এলেন। দুটি গল্প শোনালেন। আমি শিহরিত। তখন তাঁর হারাণ মাঝির মড়া… প্রকাশিত হয়েছে একাল প্রকাশনীর বই হিশেবে। একালের আড্ডায় আর আসতেন গল্পকার, ডাক্তারির ছাত্র কৃষ্ণ মণ্ডল, দিলীপ সেনগুপ্ত, অজু মুখোপাধ্যায়, যিশু চৌধুরী, আমার স্কুলের বন্ধু রণজিৎ দত্ত এবং অতি নবীন লেখক তপনজ্যোতি মিত্র। রণজিৎ এবং তপনজ্যোতি যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। এই সময়ে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। কিছুই হয়নি এখন বুঝি। সেই গল্প ছাপাও হয়নি। এরপর ‘একটি আত্মহত্যার বিবরণ’। সেই গল্প অনেকের পছন্দ হয়েছিল। ছাপা হলো একাল পত্রিকায়। একটি লোক রাজনৈতিক দলের সভামঞ্চের নিচে আত্মহত্যা করেছিল। আত্মহত্যা এক প্রতিবাদ, এই আমি লিখতে চেয়েছিলাম। সেই গল্প হারিয়ে গেছে। এরপর এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আচমকা একটি গল্প লিখে ফেললাম। ভেবেছিলাম লিখব একটি রহস্য গল্প। লিখতে আরম্ভ করলাম একেবারে শূন্য থেকে। কোনো ছক নেই, কোনো আগাম ভাবা গল্প নেই। যা দেখিনি তাই নিয়ে লিখতে আরম্ভ করলাম বুঝি। আসলে দেখেছিলাম অবচেতনে। কী লিখলাম যে ঘোরে। অপরিকল্পিত অচিন্তিত ছিল সেই লেখা। হয়ে গেল হয়ে গেল। গল্প কীভাবে আসে টের পেলাম। গল্পটির নাম দিলাম ‘ধূসর ‘কুয়াশায় সমুদ্রের ভাঙন’’। আরে তখন আমি সমুদ্রই দেখিনি। পাহাড়ও না। কিন্তু দেখেছি বিস্তৃত কুয়াশা। কুয়াশাই ছিল সেই লেখার সূত্রখানি হয়ত। লিখে ফেললাম গল্প। পছন্দ হল একাল সম্পাদকের। প্রকাশিত হল। অরুণাভ দাশগুপ্ত ছিলেন কবি অমিতাভ দাশগুপ্তর অনুজ। তিনি খুব প্রশংসা করলেন। এরপর লিখি ‘বিপন্ন সুখের মাঝে’। সেও এক পরাবাস্তব গল্প, ফ্যান্টাসি ছিল তার ভিতরে, প্রশংসিত হল। এই সময় ইঞ্জিনিয়ার রণজিৎ বড় চাকরি পেয়ে গল্প লেখা থামাল। তপনজ্যোতি পড়ছে। আমি টিউশনির টাকার কিছু অংশ একাল পত্রিকায় দিই। ওঁরা কী করে পারবেন ? অতঃপর আমি চাকরি পেলাম। চাকরির জন্য তখন ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দিচ্ছি। সাক্ষাৎকার পাচ্ছি। একজন জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ইজ জুল’স ল। পাশের জন জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ইজ বোহর’স থিওরি...। এই সময়ে আমাদের উপরের ফ্ল্যাটে একটি চেনা যুবক এল। সে আগে বেলগাছিয়ায় থাকত, তারপর তার বাবা বদলি হওয়ায় বসিরহাট চলে গিয়েছিল। তালেবর হয়েই কলকাতা এসেছিল পুরোন সখাদের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে সে বলল, টাকা দিতে পারবি, চাকরি আছে, সরকারি চাকরি।
কত টাকা ?
ধর হাজার বিশ।
চাকরিটা কি ?
সেটেলমেন্ট আরম্ভ হবে, তার চেন ম্যান হলে পনের, মোহরার হলে, বিশ-পঁচিশ।
সে কী চাকরিরে ?
আরে বেতন যা দিক, উপরি আছে, আমি কলকাতায় এসেছি ক্যান্ডিডেট জোগাড় করতে।
আমি বললাম, কী বলেছিলাম মনে নেই। প্রত্যাখ্যান করতেই হবে। ঘুষ দিয়ে চাকরি কেন নেব? আর সে ক্ষমতাও নেই। আজো তার মুখখানি মনে পড়ে। সাহস দেখ। আমাকে বলছে, তোর সাহিত্য-মাহিত্য হবে না। যা বলছি তাই কর। জমিতে নামলেই টাকা। সে সব জেনে এসেছে। অপমানিত লাগছিল। ছিহ।
এবার আমার জ্ঞানোদয় হলো। ভালোভাবে তৈরি হতে লাগলাম। পরীক্ষায় বসলাম। অনার্স আর পোস্ট গ্রাজুয়েট নিচ্ছে ল্যান্ড রিফরমস ডিপার্টমেন্ট। পরীক্ষার পর ইন্টারভিউ পেলাম। কেমিস্ট্রি থেকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল সব সঠিক উত্তর দিয়েছিলাম। সাহিত্যের কথা বলিইনি। তিন বন্ধু পরীক্ষা দিলাম। বিপুল সোম আর আমি, দুজন পেলাম। নিয়োগপত্র এসে গেল পোস্টে। একজন, নিমাই পেল না। তার খুব মন খারাপ। পরে সে ইউ কো ব্যাঙ্কে চাকরি পায়। এই চাকরির পদ হলো সেটেলমেন্ট কানুনগো। সেই যে বসিরহাট থেকে আসা আড়কাঠি যুবক আমাকে বলেছিল চেন ম্যান কিংবা মোহরারের চাকরি দেবে, সেই বিভাগেরই উচ্চপদে। বেতন ভালো মন্দে মেশান। গেজেটেড অফিসার, আইডেন্টিটি কার্ড লাল রঙের। পরে তার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। সে আমার সামনে হাত কচলেছিল, মনে আছে। তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করেছিল, কী করে পেলিরে ?
চাকরির ট্রেনিঙে যেতে হবে মেদিনীপুর। চললাম। ১৯৭৩ সালের ১৪-ই নভেম্বর আমি সকালের খড়্গপুর লোকালে আমার বড় মামিমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। মুক্তি মুক্তি মুক্তি। কলকাতা থেকে বেরোন দরকার ছিল। লিখব। লিখতে হলে দেশ দেখা দরকার। মানুষ দেখা দরকার এই কথা বলেছিল বোধহয় তপনজ্যোতি। অমর তুমি যাও। তুমি পারবে। বড় ভালোবাসত আমাকে। হায়, ভেবেছিলাম এম এস সি করে অধ্যাপক হব। কোন কাজে চললাম। না, আমার ভিতরে এমন কোনো অনুভূতির সঞ্চার হয়নি। আমি উত্তেজিত হয়েছিলাম চাকরির রকম শুনে। খড়্গপুরে আমার মামাত দিদি, খুকুদির বাড়ি। জামাইবাবু রেলে চাকরি করেন। দশটা নাগাদ পৌঁছে ভাত খেয়ে চললাম মেদিনীপুর। আমাকে পৌঁছে দিল আমার মামাত দাদা প্রদীপ। সে খড়্গপুরেই থাকত দিদির কাছে। কাজ কর্মের সন্ধান করছিল। জয়েন করলাম ট্রেনিঙে। মাসোহারা ১৫০ টাকা। আগামী বছরের এপ্রিলের এক তারিখ থেকে চাকরি আরম্ভ হবে। সবেতন ট্রেনিঙ ছিল না। কিন্তু তখন ১৫০ টাকা অনেক। অনেক যুবক, কিছু বয়সে বেশ বড়, বাকিরা আমারই বয়সী, সদ্য গ্রাজুয়েট। পোস্ট গ্রাজুয়েট করতে করতে চাকরি পেয়ে চলে এসেছে। বয়স্করা সকলে ছিলেন ইস্কুল মাস্টার। মাস্টারি ছেড়ে এই চাকরিতে এসেছেন। একজন তো বললেন, সেই কথা, ভালো উপরি হবে। তাঁর বাড়ি ছিল সন্দেশখালি। জমিজমা নিয়ে থাকা বাড়ি থেকে এসেছিলেন সেই নিতাইবাবু। পরিতোষ মণ্ডল এসেছিল ছোট মোল্লাখালি থেকে। দুলদুলিতে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বিবাহিত পুরুষ , শুধু বউ শ্বশুরবাড়ি এইসব কথা বলতেন। পরতেন ধুতি পাঞ্জাবি। দ্রুত তাঁরা বাহারি শার্ট প্যান্ট তৈরি করে ফেললেন। এগ শ্যাম্পুতে কেন চুল ঝরে যায় এইসব সমস্যার সমাধান চাইতেন আমার কাছে। আর বলতেন দুলদুলি দ্বীপ, বিদ্যা গোমর নদীর কথা। অপূর্ব লাগত পরিতোষ মণ্ডলকে। আমি এমন মানুষ আগে দেখিনি। সত্যি বাড়ি থেকে না বেরলে এসব কি দেখা যেত? আমাদের ট্রেনিঙের সময়ই মেদিনীপুর শহরে থিয়েটার ওয়ারকশপ চাক ভাঙা মধু নাটক অভিনয় করতে গেল। আমি কয়েকজনকে নিয়ে দেখা করেছিলাম অশোক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দেখব। দেখলাম। নাটক দেখে নিতাইদা খুব রেগে গিয়েছিলেন। সুন্দরবনের ভূমধ্যাকারী পরিবারের মানুষ ছিলেন নিতাইদা। বড় জোতের মালিক। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, জোতদার খারাপ আর সবাই ভালো...। চাকরি করতি এয়েছ কেন, জোতদারের ঘরেই খেতে হবে। যা ইনকাম তারাই করাবে।
টাকা তারাই দেবে। প্লট ধরবা আর টাকা নেবা, কে দেবে টাকা ? ফালতু নাটক। নিতাই মণ্ডল চাকরি ছেড়ে মাস্টারিতে ফিরে গিয়েছিলেন। হিঙ্গলগঞ্জে ছিল তাঁদের বড় জোত। আমাদের সেই গল্প করতেন। বলেছিলেন নিয়ে যাবেন। যাওয়া হয়নি। একজনের কথা মনে পড়ে, সুব্রত দত্ত মনে হয়, বয়সে আমাদের চেয়ে বড়। নাদুদা বলতাম। নানা বিষয়ে জ্ঞান দিতেন তিনি। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। এখন তাঁর খোঁজ জানি না। মুর্শিদাবাদ, মালদহ এইসব জেলায় ঘুরেছেন। ঘুরতে ঘুরতে মন থেকে সরে গেছেন।
মেদিনীপুর শহরে মেসের জন্য বাড়ি খুঁজে নিয়ে আমি খড়্গপুর থেকে মেদিনীপুর চলে এসেছিলাম। মনে পড়ে খড়গপুরে মামাতো দিদির বাড়ি। রাত্রে একা হতে কেঁদেছিলাম লুকিয়ে। বাড়ির জন্য মন খারাপ, কলকাতার বন্ধুদের জন্য মন খারাপ। মেদিনীপুর তখন অখণ্ড। মেদিনীপুর আমাকে লিখতে শিখিয়েছিল। ধাত্রী মায়ের মতো লালন করেছিল। কংসাবতীর তীর, সুবর্ণরেখার তীর, হলদি নদীর তীর আর সমুদ্র উপকূল, পাহাড় আমাকে দিয়েছে মেদিনীপুর। মেদিনীপুর শহরে মিশন কম্পাউন্ডে অমল সেনগুপ্তর বাড়িতে আমরা ন’জন মেস করে ছিলাম। সেই বাড়ি কি আছে এখন ? ইচ্ছে হয় দেখে আসি। ‘বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি’ উপন্যাসে সেই ইচ্ছার কথা আছে। ওই শহরে এক অলীক ভ্রমণ আছে। বুনো স্ট্রবেরির বনে দেখা হবে পুরোন শহর তোমার সঙ্গে, এই ভাবি মনে।
আমাদের মেসে মিল প্রতি খরচ পড়ত ১ টাকা ৭০ পয়সা। আমি জেলা গ্রন্থাগার, বিদ্যাসাগর লাইব্রেরিতে যেতাম কোনো কোনোদিন সন্ধ্যার থিওরিটিকাল ক্লাস ফাঁকি দিয়ে। ট্রেনিং হত সকাল এবং সন্ধ্যায়। সকালে সার্ভে ট্রেনিং, বিকেলে ভূমি সংস্কার আইনের পাঠ। জেলা গ্রন্থাগারে বসেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অনূদিত পার লাগারকেভিস্ট এর নোবেল জয়ী উপন্যাস ‘বারাব্বাস ‘ পড়েছিলাম। মনে পড়ে বটতলা চক, গোলকুয়া চক, কেরানিটোলা, মহুয়া সিনেমা, রাতের শো-য়ে সিনেমা দেখা। গোপগড়ের অপূর্ব প্রকৃতি। শীতের এক দুপুরে বেরিয়ে বাসে করে ভাদুতলা নেমে ঝাঁটি জঙ্গল ভেদ করে চলে গেলাম কর্ণগড়, রানি শিরোমণির মন্দিরে। কর্ণগড় ছিল চোয়াড় বিদ্রোহের পীঠস্থান। ১৭৯৯ নামে একটি নাটক দেখেছিলাম কলকাতায় ঐ বিদ্রোহ নিয়ে। সেই মেদিনীপুর ছিল এক শান্ত শহর। অবশ্য নক্সাল আন্দোলনের পীঠস্থান ছিল মেদিনীপুরই। ডেবরা এবং গোপীবল্লভপুর দুই থানা এলাকা তখন দুই বিখ্যাত উপদ্রুত এলাকা। জেলে আছে যুবকেরা। ট্রেনিঙে এসেছি, কিন্তু নিয়োগ পাকা হয়নি তো। পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছিল আমার অজ্ঞাতেই। খারাপ কিছু রিপোর্ট হয়নি।
এপ্রিল ১৯৭৪-এর ৩১শে মার্চ ট্রেনিঙ শেষ হলো। পোস্টিং হলো ডেবরা থানার এক গ্রামে। পাঁশকুড়া রেল স্টেশনে নেমে এক ঝরঝরে বাসে করে লোয়াদা নামের এক গঞ্জে নেমেছি। সঙ্গে বেডিং, সুটকেস। সেখানে গরুর গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন করণ্ডা গ্রামের খাজনা আদায়ের ত'সিলদার ধ্রুব মাঝি, সার্কেল অফিস থেকে তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছিল, সায়েব আসবেন। সার্কেল অফিস ছিল থানা বা ব্লক কেন্দ্রিক অফিস। সেই অফিসের অধীনে কয়েকটি হল্কা ক্যাম্প। এক এক হল্কা ক্যাম্পের অধীনে পনের বিশ কি তারও বেশি, মৌজা থাকত। ১৯৭১ সালের ভূমি সংস্কার আইনে ভূমির স্বত্ব পুনর্লিখন হবে। বর্গাদারের নাম নথিবদ্ধ হবে। কিন্তু মৌজা নথি আসতে ছমাস লাগায় কাজ আরম্ভ হতে নভেম্বর হয়ে গিয়েছিল। বর্ষায় সেটেলমেন্টের কাজ হয় না। বর্ষায় চেন টানা যায় না, কাদায় তা আটকে যায়, মাপে ভুল হয়। কেউ যদি লেখেন তা, অবাস্তব।
প্রথম দিন গরুর গাড়িতে চেপে সন্ধেবেলায় পৌছেছিলাম। ক্যাম্প অফিসে একজন অপেক্ষা করছিলেন। তিনি চেন ম্যান সন্তোষ। বাড়ি তমলুক। আমার বয়সের যুবক। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। কদিন তিনি রান্না করে খাওয়ালেন। ডাল আলুসেদ্ধ, ঝিঙে পোস্ত। আলু সেদ্ধ হলো আলু মলা। সেদ্ধ আলু, শুকনো লঙ্কা পোড়া, পিঁয়াজ দিয়ে এমন ভাবে তা প্রস্তুত করা হত মেসে, যে তা দিয়েই এক থালা ভাত হয়ে যেত। মুসুরির ডাল সেদ্ধ, তার ভিতরে কাগজি লেবুর রস, অমৃত।
প্রথম দিন গোরুর গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল করণ্ডা হল্কা ক্যাম্পে, পরে তো হাঁটাই হত। কংসাবতী পার হয়ে এক ঘন্টা পনের মিনিট । লোয়াদায় বাসের চলন শেষ। সেই গঞ্জে মুড়ি বোঁদে কিংবা মুড়ি রসগোল্লা খেয়ে নদী পার হয়ে হাঁটা, এই ছিল যাওয়া আসা। নদীতে গ্রীষ্মে জল থাকত না। বর্ষায় খেয়া চালু হতো কদিনের জন্য। তখন নদীতে জল আসত উপর থেকে। হাটা পথ পাঁচ কিলোমিটার। এক ঘন্টা পনের মিনিট। প্রথমে পড়ত গোলগ্রাম। তা ছাড়িয়ে অনেক দূর করণ্ডা নামের সেই গ্রাম। চওড়া মাটির রাস্তা, গ্রীষ্মের হাওয়ায় ধুলো উড়ছে, ধুলোমাটির রাস্তায় সাপের চলনের দাগ, একটু আগে গিয়ে গর্তে সেঁধিয়েছে। ধ্রুব মাজির বাড়িতে হল্কা ক্যাম্প। সে ছিল প্রায় জনবিরল একটি আধ-পাকা বাড়ি। মূল গ্রামের বাইরেই ছিল আমাদের হল্কা অফিস। কাদামাটি আর ইটে গাথা দেওয়াল আর টালির চাল। ওইটি আসলে তহসিলদারের খাজনা আদায়ের কাছারি। দুটি ঘর আমার অফিসের জন্য। একটি ঘরে ধ্রুব মাজির কাছারি। তিনি ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রাতে সেই ঘরে থাকতেন। ভোরে নামগান করতেন। সেই নামগানেই আমার ঘুম ভাঙত। ভালোই লাগত। দুটি ঘরের একটিতে অফিস, অন্যটি বাসস্থান। অফিসের ফোল্ডিং টিনের চেয়ার এবং ফোল্ডিং কাঠের টেবিল ছিল। পরে এসেছিল ট্রাঙ্ক ভর্তি মৌজা-নথি। ল্যান্ড রেকর্ডস। সে আসতে ক’মাস সময় লেগেছিল। আমার জন্য একটি তক্তপোষের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ধ্রুব মাজি। আর সকলে দড়ির খাটিয়ায় অভ্যস্থ ছিল। মশারি টাঙাতেই হত। মশার ভয়ে নয়, সাপের ভয়ে। কত রকম সাপের কথা শুনতাম, শিয়রচাঁদা কেউটে, গোখরো ব্যতীত আর এক সাপ চিতি সাপ। চেটে দিয়ে যায় নাকি। তাতেই ঘা হয়ে যায়। শুকোয় না। কলকাতার পাড়ার বন্ধু বিপুল সোমের পোস্টিং হয়েছিল এক মাস বাদে। মে মাসে সে ব্যান্ডেল কিংবা অন্য কোনো ট্রেনিং সেন্টার থেকে সে ডেবরা থানার বন পাটনা হল্কা ক্যাম্পের কানুনগো হয়ে যোগদান করে। এক মাসের ভিতরে সন্ধ্যায় এক গোখরো না কেউটের হাত থেকে বেঁচে কলকাতা ফিরে আর যায়নি। চাকরি ছেড়েই দিল। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় হাওয়া উঠলে সাপ রাস্তায় বেরিয়ে আসে খাদ্যের সন্ধানে। আমাদের ক্যাম্প অফিসের সামনের রাস্তায় টর্চের আলোয় তিনি ধরা পড়ে গেলেন। পিটিয়ে মারল লোকজন। তারপর পুড়িয়ে দিল। এভারেডি টর্চ ছিল সঙ্গী। অন্ধকারে টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে পথ চলতে হত।
আমার সেই অফিস, সেই নির্জনতা, অধীনস্ত কর্মচারীদের সঙ্গে মেস করে থাকা, সকাল আর সন্ধেয় অফুরন্ত অবসর নিয়ে আমি করব কী ? গ্রামের মানুষের সঙ্গে বন্ধুতা হচ্ছে। খুব গরিব গ্রাম। আর খুব সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকা সেই সব মানুষের। আমি এই জীবনের সঙ্গে পরিচিত নই। বিস্ময় আর বিস্ময়। কৌতূহলে কত কিছু জেনেছি। ধান আর মানুষ। আকাশের মেঘ আর মানুষ। ভয়ঙ্কর গ্রীষ্ম আর মানুষ। বর্গা চাষী, খেতমজুর, ভূমিহীন চাষী, খাজনা আদায়ের ত’সিলদার। জমির প্রতি মায়া আর ভূমি-লিপ্সা, ভূমিক্ষুধা। আর নানা রকম বিপন্নতা।
জরিপের কানুনগো আমি। বুঝলাম এই নির্বাসন আমাকে লিখতে ডাকছে। সকালে, সন্ধ্যায়। তাস-পাশায় মন নাই। করব কী, লন্ঠন জ্বেলে লিখতাম সন্ধে থেকে। ১৯৭৪-এর এপ্রিল মাসেই 'মেলার দিকে ঘর' লিখেছিলাম। পরের মাসে ‘পার্বতীর বোশেখ মাস’। করণ্ডায় এসেই ভারতবর্ষের সঙ্গে দেখা হলো। কংসাবতীর বাঁধ ভেঙে
বন্যা দেখলাম। একজন চিৎকার করে বলল, বান আসছে, বান। জল। ক্যাম্প অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সবুজ ধানের ক্ষেত শাদা হয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত জলরাশিতে। গ্রামের পর গ্রাম ডুবে গেল জলে। স্থানীয় এক ব্যক্তির জোড়া তালডোঙায় চেপে আমি বন্যার্ত মানুষের ঘরে গিয়েছিলাম। একটি গল্প লিখেছিলাম মনে হয় অনেক পরে। সমুদ্র মন্থন। হারিয়ে গেছে। সেই বছর পৌষ সংক্রান্তির দিনে ছুটি থাকা সত্বেও আমি করণ্ডায় ফিরে এসেছিলাম কলকাতা। থেকে। নেমতন্ন ছিল তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা দেখার। সাঁওতাল জনজাতিরাই করবে তা। আমি নাকি সভাপতি হব। জীবনে প্রথম। কিন্তু সেই কারণে নয়, দেখার কৌতুহলে আসা। সকালে যখন পৌঁছেছি লোয়াদায়, তখনো টুসু ভাসান হচ্ছে। সেই প্রথম টুসু ভাসান দেখা আর মেয়েদের মুখে টুসু গান শোনা। বিকেলে তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা করণ্ডায়। যে জিতবে সে কাঁসার কলস পাবে, নতুন ধুতি, নতুন গামছা পাবে। আর তাকে কাঁধে করে গ্রাম পরিক্রমা হবে। আমি হলাম সভাপতি, পেয়েছিলাম একটি নতুন গামছা এবং এক বোতল মহুয়ার মদ। সেই তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা দেখেই গল্প লিখেছিলাম ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’। ওই নামেই আমার প্রথম বই। মাঠ ভাঙে কালপুরুষ ১৯৭৬ সালে কবিপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আদিবাসী যুবক ছিল প্রধান চরিত্র। নিখুঁত ছিল তার তীরন্দাজি। লক্ষ্যভেদে অব্যর্থ। আর লক্ষ্যের সময় চোখে ভাসে সেই মানুষগুলির মুখ যারা তাকে ভূমিহীন করেছে। সেই তীর আর ভূমিহীন আদিবাসী যুবক ছিল গল্পের দুই চরিত্র। এসব লিখতে বসে চোখের সামনে সেই গ্রামটিকে দেখতে পাচ্ছি। জীবনে কিছুই হারায় না। লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে করণ্ডার পথে হাঁটছি। সেই লোয়াদার কংসাবতী পার হয়ে গ্রীষ্মের রোদে মাঠ ভাঙা। তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছিল মনে হয়। বড় ভালো বেসেছিলাম করণ্ডা নামের সেই গ্রামটিকে। এখনো সেই ভালোবাসা মরেনি। বরং জ্বাল পড়ে ঘন ক্ষীর হয়েছে। আমি এক বিরহী যক্ষ, হে বাতাস, ঘুম লাগানো বাতাস, আমার কথা নিয়ে যাও সেই বিন্দুর মত গ্রামটিতে, মানচিত্রে যার কোনো চিহ্নই নেই।
আত্মজীবনী আমার আগ্রহের জায়গা। কিন্তু এতো অকপট আত্মজীবনী আমি কমই পড়েছি।
আত্মজীবনী স্মৃতিকথা আমারও আগ্রহের বিষয়। ভাল লাগছে খুব। আগে অপমান করে পরে ভোল বদলে হাত কচলানো পড়তে পড়তে নিজের গল্পগুলো মনে পড়ে গেল।
যথারীতি চমৎকার।
আবার পনেরো দিনের অপেক্ষা !
শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক শ্রী অমর মিত্রের জীবন দর্শন, জীবন উপলব্ধির আখ্যান 'পেন্সিলে লেখা জীবন' গভীর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে ।
ল্যান্ড রিফর্ম ডিপার্টমেন্টে কাজ করার সূত্রে প্রত্যন্ত গ্রামে, মফস্বলে গিয়ে থাকতে হয়েছে লেখককে । খূব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন প্রান্তিক মানুষের জীবন, সাধারণ মানুষের দিনযাপনের অনুভূতিগুলি । সেইসব স্মৃতি গল্প এবং উপন্যাস হয়ে এসেছে তাঁর লেখায় |
জীবনকে নিবিড় পাঠের মধ্যে দিয়েই অমর তাঁর লেখার উপাদানের সম্পদ সংগ্রহ করেছেন, তাঁর লেখা এসেছে প্রকৃতি, মানুষ, সাহিত্য সবকিছুর হাত ধরে ।
সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকেই অমরের সঙ্গে আমার এক সময় আলাপ হয়েছিল, তাই সাহিত্য বিষয়ক আলোচনাগুলি আমাকে পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে দিল । অমর 'পেন্সিলে লেখা জীবন' আরো পর্ব লিখবেন এই গভীর প্রত্যাশা রইল ।
এইরকম একটি প্লাটফর্ম করে দেওয়ার জন্য গুরুচন্ডালীকেও অনেক ধন্যবাদ ।
সুন্দর হচ্ছে
দারুণ সময় ।দারুণ লেখা ।
মুগ্ধ । কিল্লারীর কথা শুনতে চাইছিলাম। পেলাম না। যা পেলাম তাতে মুক্ত ছড়ানো।