ধুলিহরের কথা মনে নেই। তবে এইটুকু মনে পড়ে মাটির বাড়ির একটি কামরায় থিয়েটারের সিন থাকত। সেই সময় নাটক বা যাত্রায় সিন থাকত। নদী, গ্রাম, শহর, তাজমহল, দুর্গ ইত্যাদি। যাত্রা কিংবা থিয়েটার হতো সমস্ত রাত ধরে। শেষ রাত বা মধ্যরাতে সকলে বাড়ি ফিরত। কাজকম্মো সেরে, গৃহবধূ সমেত পরিবার গিয়ে বসত থিয়েটার বা যাত্রার আসরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে আমোদ। সেই গল্পে ভূমিহীন চাষাটি একদম পেছনে দাঁড়িয়ে, ডিঙি মেরে মেরে কী দেখল, কী দেখল না, সমস্ত রাত কাটিয়ে, বাজনা আবছা শুনে, ডায়ালগ একটু শুনে শুনে রাত পার করে দিল। দেখুক না দেখুক, আমোদ তো হলো। থিয়েটার শেষ হতে ভোর। সে চলল জমিতে। নিড়েন দেবে। সেই দেখা নিয়ে সে কতদিন বুঁদ হয়ে থাকবে। এই অল্পতে খুশি হওয়াই সাধারণের জীবন দর্শন। আর এও মনে হয়, থিয়েটারের দর্শনও তাই। থিয়েটারে মোটর রেসিং, নেই, হেলিকপ্টারে করে খল নায়কের পালানো নেই, শতবার পোশাক বদলে নৃত্যগীত নেই, কিন্তু থিয়েটার হাউসফুল। হ্যাঁ, অনেক থিয়েটার দর্শক আনুকূল্য পায় না, সে তো বহু সিনেমাও লোকে দ্যাখে না। না, আমি সিনেমা থিয়েটারের তুলনামূলক আলোচনা করতে বসিনি। থিয়েটার সম্পর্কে আমার জ্ঞান তেমন নয়, সিনেমাও তেমন জানি না। দুটোই নিজের মতো করে দেখেছি অনেক। মনের টানে, নিজের প্রয়োজনে দেখেছি। দেখে ঋদ্ধ হয়েছি। আমার কাছে বই আর থিয়েটার, সিনেমা শ্রেষ্ঠ বিনোদন। বিনোদন শব্দে কোনো আপত্তি দেখি না। কেন না ভিন্ন ভিন্ন রুচির মানুষের কাছে বিনোদনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। মারীচ সংবাদ, রাজরক্ত বা চাকভাঙা মধু আমাকে মোহিত করেছিল প্রায় বছর ৫০ আগে, প্রযোজনা অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল বলেই না বার বার দেখেছিলাম। আমার মনের অনেক চাহিদা আছে। সেই চাহিদা পূরণ করে থিয়েটার ও বই, এবং সিনেমাও। থিয়েটার হলো দৃশ্য কাব্য। আমি তার কথা বলতে চেষ্টা করব। বাল্যকালের কথা বলতে গিয়ে থিয়েটার এল কেন ? এল এই কারণে আমার ছোটবেলা কেটেছে থিয়েটার নিয়ে অনেকটা। হোক সে ছোটদের থিয়েটার, থিয়েটার তো।
আমাদের দন্ডীরহাট গ্রামটি ছিল থিয়েটার আর খেলা, দুয়েই পাগল। ইস্কুলের উত্তরে একটি বিলজমি, মানে ধানজমি, বেশ নিচু, তা পেরিয়ে ধলতিথা। বিভূতিবাবুর পথের পাঁচালী উপন্যাসে ধলতিথার কথা আছে। ধলতিথা পেরিয়ে পানিতরে তাঁর প্রথম বিবাহ। থাক, দণ্ডীরহাট গ্রামের থিয়েটারের কথা বলি। আমার তখন কত হবে, বছর সাত-আট, মা-কাকিমাদের সঙ্গে গিয়ে প্রথম অসামান্য এক থিয়েটার দেখি, ডি,এল, রায়ের শাজাহান। শাজাহানের ভূমিকায় ছিলেন আমাদের গ্রামের অতিমান্য এবং শ্রদ্ধেয়জন, সুধীর বসু, সহপাঠী রক্তিমের জেঠামশায়, হেড মাস্টার মশায় সুরথ বসুর অগ্রজ। সুরথবাবু ছিলেন বাংলার মাস্টার মশায়, সম্ভ্রান্ত পরিবার তাঁদের। থিয়েটার সাহিত্যে উৎসাহী। সুধীরবাবু ওই গ্রামের পোস্ট মাস্টার ছিলেন। সেই শাজাহান নাটকে জাহানারার ভূমিকায় ছিলেন মমতা চট্টোপাধ্যায়, সেই আমলের এক বিখ্যাত অভিনেত্রী। দারার ভূমিকায় নক্ষত্র নাট্যদলের শ্যামল ঘোষ, দিলদার মনোজ মিত্র। মনোজ মিত্রই হয় তো এই আয়োজন করেছিলেন। মনে আছে শাজাহান এবং জাহানারার হাহাকারের কথা, দূরে তাজমহলের মাথায় পূর্ণচন্দ্র। সিন আর গ্লোব আলো দিয়ে তা ফোটানো হয়েছিল। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে কয়েকদিন কেটেছিল। যাঁকে নিত্য দেখি তিনি কীভাবে মঞ্চে শাজাহান হয়ে গেলেন। সেই প্রথম দেখা এখনো অবিকল মনে আছে। তরুণদা ও থিয়েটারের কথা তো আগেরবারে বলেছি। আমি ক্লাস সিক্স এবং সেভেন ওই গ্রামের ইস্কুলে পড়েছিলাম। ঐ দুবছরেই তরুনদা আমাকে থিয়েটার আর বই পড়ায় দীক্ষিত করেন। দণ্ডীরহাট গ্রামের বসু জমিদারদের রেখে যাওয়া বাড়িতে ছিল বড় এক পাঠাগার। সেই পাঠাগার ছিল তরুণদার দায়িত্বে। এ ব্যতীত তিনি ছিলেন পোস্ট অফিসের ডাক পিয়ন। চিঠি বিলি করতেন। সাব পোস্ট অফিসের অনেক কাজই করতেন। চিঠিতে সিল মারা, ডাকের থলেতে ভর্তি করা। হরকরার চিঠি রিসিভ করা...সব। বেলা আড়াইটে অবধি হয়তো তাঁর কাজ, তারপর লাইব্রেরি। আমাকে হেমেন্দ্রকুমার রায় থেকে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক, অনুবাদে অলিভার টুইস্ট, এ টেল অফ টু সিটিজ, হ্যাঞ্চব্যাক অফ নতরদম...।কত বই দিয়েছেন। তাঁর উচ্চাশা ছিল বড় অভিনেতা কিংবা থিয়েটার পরিচালক হবেন। হতে পারেননি। গ্রামের বালকদের নিয়ে প্রায়ই তিনি থিয়েটারের আয়োজন করতেন। বলেইছি তো আমার প্রথম অভিনয় সুনির্মল বসুর কিপ্টে ঠাকুরদা নাটকে। ঠাকুরদা হয়েছিলেন তরুণদা। .........। নিজেরাই স্টেজ বেঁধেছি হরিতলায়, হ্যাজাক ভাড়া করা হয়েছে চাঁদা তুলে। রাত আটটায় অভিনয় আরম্ভ। মা-কাকিরা হেরিকেন নিয়ে থিয়েটার দেখতে হাজির। হঠাৎ হঠাৎ থিয়েটারের নেশা জাগত। পাঠ্য পুস্তক কিশলয় বা পাঠসঞ্চয়নের নাট্যাংশ নিয়ে নিজেরা রিহার্সাল আরম্ভ করতাম। অমল ও দইওয়ালা, হলদিঘাটের যুদ্ধ এসব আমরা বালকেরাই করতাম। দুটি পরপর অভিনয় হচ্ছে। এমন নাটক পাগল গ্রাম আর দেখিনি। আমি তো সমস্ত জীবনে কম গ্রাম ঘুরিনি। কোথাও দেখিনি। কিশোর বালকেরা থিয়েটার করছে, তা দেখতে রাতের বেলা গাঁ ভেঙে পড়ছে প্রায়, আশ্চর্য লাগে এখন। আমিও ছেলেবেলায় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। প্রায়ই নেমে পড়তাম নাটক নিয়ে। ১৯৬১ সালে আমি ক্লাস সিক্স, রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের প্রহসন ‘ছাত্রের পরীক্ষা’-য় ছাত্র হয়েছি। আরো কী কী নাটক যেন অভিনয় হয়েছিল ওই দুই বছরে, সব মনে নেই। হ্যাঁ, তরুণদাকে নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখেছিলাম, মালতী মাধব। ডাকপিয়ন তরুণদা ছিলেন সেখানে অলৌকিক হয়ে। বেনামে চিঠি লিখে ডাকপিয়ন ডাকঘরের সিল মেরে সেই চিঠি যাকে গোপনে ভালবাসতেন, তার কাছে পৌঁছে দিতেন।
দণ্ডীরহাটের বন্ধুদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। রক্তিম বসু খুব ভালো ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলত। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছিল জানি। শিক্ষকদের কথা ভুলিনি। পড়াতেন শচীনবাবু, বরেণ্যবাবু, মোনাজাত স্যার, চারুবাবু। চারুবাবুর বাড়ি ছিল ধলতিথা। অঙ্কের মাস্টার মশাই ছিলেন। তিনি আমাদের আতঙ্কে রাখতেন। ক্লাসের শাস্তি বলতে মধুমোড়া। দু’আঙুলের ফাঁকে পেনসিল রেখে চাপ। ভয়ানক ছিল সেই মুহূর্তের ব্যথা। নির্মলের কথা বলি। সে এল ক্লাস ফাইভেই। দণ্ডীরহাটের বাসিন্দা নয়। নির্মলের বাবা ছিলেন গোলপুকুর-মধ্যমপুর স্টেশনের মাস্টারবাবু। দণ্ডীরহাট থেকে অনেকটা দূরে। নির্মল আসত সাইকেলে করে। নির্মলের মুখেই শুনি সপ্তপদীর বিখ্যাত গান, ‘ এই পথ যদি না শেষ হয়’...। নির্মল সাইকেলে আমাকে নিয়ে ঘুরত। আর গান গাইত। ভারি ফুর্তিবাজ ছেলে ছিল। আমাদের নগেন্দ্রকুমার উচ্চ শিক্ষা নিকেতন ছিল সহশিক্ষার। মেয়েরা সামনের বেঞ্চে বসত, ছেলেরা পিছনের বেঞ্চে। নির্মল আমাদের বড় করে তুলেছিল সপ্তপদীর গান গেয়ে গেয়ে। ...তুমি বলো, না তুমি বলো, না তুমি, তুমি তুমি...। ক্লাসের সেই সব বালিকাদের গান শোনাত নির্মল গুনগুন করে। বালিকাদের মুখ মনে পড়ে না আর। নাম ছিল সে আমলের যেমন হয়, ঝর্না, কল্যাণী, রেখা, গৌরী--এমনি। তবে একটি কথা এখন মনে হয়, সকলেই আসত প্রায় দুঃস্থ পরিবার থেকে। সম্ভ্রান্ত কিন্তু দুঃস্থ। ইস্কুলের ইউনিফরম ছিল না। ফ্রকের রঙ ফ্যাকাসে, ঝুলঝুলে। এক ফ্রক দুতিনদিন ধরে পরত। ফ্রকের পিঠের দিকে সেফটি পিন। যার যেমন ছিল সে তেমন পোশাক পরে আসত। বালিকারা ফ্রকের ফিতে দাঁতে চিবোত, মনে আছে। নির্মলের কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ত। নির্মল একদিন বলল, অমুক স্যারের সঙ্গে অমুকদির লাভ হয়েছে। তুমি বলো, না না তুমি বলো। স্যারকে দেখাল। টিফিন পিরিয়ডে ক্লাস নাইনের দিদির সঙ্গে খুব গল্প করতে। সবদিনই। দিদি তখন যুবতী হয়ে উঠেছেন। যুবক শিক্ষক সুন্দর, দিদিও সুন্দর। নির্মল আমাদের বলল, লাভ হতেই হবে। তাইই। সে ছিল এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে কিংবা রবিবার ছিল। হঠাৎ দুপুরে হৈ হৈ শব্দ শুনলাম। অনেক মানুষের কন্ঠস্বর। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি স্যারের কোমরে দড়ি। স্যার মাথা নামিয়ে হাঁটছেন। ষণ্ডাগণ্ডা লোক সব হৈ হৈ করতে করতে চলেছে। স্যারকে তারা ধরেছিল গোলপুকুরের শর বনের ধারে গাছতলায়। স্যার আর সেই দিদি। স্যারের পরণে ধুতি, শার্ট। কী অপমান। পরদিন নির্মল সব বলেছিল। স্যার আর স্কুলে আসতেন না মনে হয়। সেই দিদির বিয়ে হয়ে গেল দূরে। তাঁরা এই দণ্ডীরহাটের বাসিন্দা। দণ্ডীরহাটের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না তা এখন বুঝতে পারি। সহপাঠীদের কেউ কেউ ছেঁড়া প্যান্ট পরে ইস্কুলে আসত, মনে পড়ে। জুতো থাকত না অনেকের পায়েই । তখন জামা কাপড় এখনকার মতো সহজ লভ্য ছিল না। সস্তা ছিল না। টেরিলিন টেরিকটন বাজারে আসতে দেরি আছে। বা এসেছে। কিন্তু খুব দামী। সাধ্য ছিল না কারো তা কিনে পরে। অন্তত সেই গ্রামে। সুতির জামা প্যান্ট সস্তা ছিল। দড়ি দেওয়া প্যান্ট ছিল, আর বোতাম দেওয়া ইংলিশ প্যান্ট। কর্ড উঠেছে সবে। আমি কলকাতায় আমাদের উপরের ফ্ল্যাটের ছেলেটির কর্ডের প্যান্ট দেখে খুব বায়না করেছিলাম। পাইনি। দাদার বিয়ের সময় আকাশী নীল টেরিলিনের হাওয়াই শার্ট এবং টেরিলিনের হাফ প্যান্ট পেয়েছিলাম। টেরিলিনের পর পোশাকের বাজারে আসে ডেকরন। মেয়েদের ফ্রক হত ডেকরনের। একটি ফ্রক খুব জনপ্রিয় হয়েছিল বালিকাদের জন্য, হলি ডে অন আইস। কোনো বিলিতি সিনেমার নায়িকার ফ্রক। ঘুরে ব্যালে নৃত্যশিল্পীদের মতো বড় ঘের হয়ে যেত তার। সেইসব গরিবিয়ানার কটন গারমেন্ট এখন মহার্ঘ হয়েছে। সুতির দাম বেশি। কোমরে দড়ি দেওয়া সস্তার প্যান্ট এখন বারমুডা। দিব্যি তা পরে প্রবীণরা বাজারে যান। ক্যারিব্যাগে আলু পটল মাছ মাংস কিনে বাড়ি ফেরেন। নির্মল ইস্কুলে আসত দড়ি দেওয়া পায়জামা কিংবা হাফ প্যান্ট পরে। ইংলিশ প্যান্ট তার ছিল না। সে আমাদের সকলকে ট্রেনে করে হাসনাবাদ নিয়ে গিয়েছিল। সেই প্রথম বন্ধুরা মিলে বেরোন। ওর বাবা ষ্টেশন মাস্টার, সুতরাং টিকিট দরকার নেই। এই ভ্রমণে আমরা ক্লাস সিক্সের ছেলেরা প্রথম সিগারেট খাই। আর বাড়ি ফিরে সিগারেটের গন্ধ আঙুল থেকে কিছুতেই মুছতে পারি না। আমি চলে এলাম ক্লাস সিক্সের পরই। নির্মলের বাবাও পরের বছর নাকি বদলি হয়ে বারাসত চলে এসেছিলেন শুনেছি। বহু বছর বাদে নির্মল এক সন্ধ্যায় আমাদের বেলগাছিয়ার ফ্ল্যাট খুঁজে খুঁজে চলে এসেছিল। আমি তখন বাড়ি ফিরিনি। মায়ের সঙ্গে গল্প করে চিঠি লিখে চলে গিয়েছিল। সে নাকি দক্ষিণ কলকাতার এক বিখ্যাত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীর ঘরে বিয়ে করেছে। আমাকে যেতে বলেছিল। আমার যাওয়া হয়নি। রক্তিম কিন্তু মনে রেখেছিল। রক্তিম একবার আমার দাদা এবং আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বসিরহাট। টাউন হলে বিক্রমজিত দেবনাথ এবং আরো বিশিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে সংবর্ধনা দিয়েছিল। আমার কন্যার বিবাহে রক্তিমকে নেমতন্ন করেছিলাম। বসিরহাট দণ্ডীরহাট ছিল নাটক এবং খেলাধুলোয় জীবন্ত। বসিরহাট অনেক বড় বড় ফুটবল খেলোয়াড়ের জন্ম দিয়েছে, বিক্রমজিৎ দেবনাথের কথা বললাম, মিহির বসু, এবং দীপেন্দু বিশ্বাসের নাম তো সকলেই জানেন। বসিরহাট যেতে খুব ভালো লাগে। দণ্ডীরহাট টানে। কিন্তু সেই বাড়ি অন্যের হাতে চলে গেছে। আমাদের অংশ বিক্রি হয়নি, কিন্তু একজন তাঁর পরিবার নিয়ে বাস করেন। বাড়ি দেখলে চোখে জল এসে যায়। মানুষটিও দুঃস্থ। তাঁকে দেখলেও চোখে জল আসে। আমাদের বাড়িটি ছিল চোখ জুড়োন। তিন বিঘে জমির মধ্যিখানে পাকা দালান। ধূলিহরে আমাদের ছিল মাটির বাড়ি। দণ্ডীরহাটের অন্নদা নিবাস পাকা দালান। লাল মসৃণ মেঝে। সামনে বড় উঠোন। তা পার হয়ে ঢোকার মুখে দুদিকে কামিনী ফুলের ঝাড়। তারপর খোয়া বিছান পথ ছিল। বারান্দার সিঁড়ির দু’পাশে দুটি কাঁটা ঝাউ গাছ। গোলাপ দোপাটির বাগান, তরুলতার বাহার নিয়ে বাড়িটি ছিল দর্শনীয়। অমন সাজানো বাড়ি ওই অঞ্চলে ছিল না। কলকাতার গ্লোব নার্সারি থেকে নাকি ফুলচারা নিয়ে ওখানে বসানো হয়েছিল। বাড়িতে ছিল হিমসাগর আমের বেশ কিছু গাছ, জামরুল গাছ, জাম, কাঁটাল গাছ। গরমের সময় যেন ফলের উৎসব হত। পুকুর ছিল। শান বাঁধান ঘাট ছিল। পুকুরে মাছ ছিল রুই কাতলা, পুঁটি। আমাদের ছিল পুঁটিমাছ ধরার ছোট কঞ্চির ছিপ। খানা-খন্দে বর্ষাকালে পুঁটিমাছ ধরেছি কম না। সেই পুঁটির পেটে লাল দাগ।এখন চোখেই পড়ে না।
অনেক ছোটবেলায় সাপের মৈথুন দেখেছি ভীড় করে। তখন বামুনপাড়ার কেউ খবর পেয়ে নতুন কাপড় বা গামছা নিয়ে হাজির। কাহার পাড়ার ভোটো কাওরাও এসেছে নতুন গামছা হাতে, অপেক্ষা করছে বামুন এবং অচ্ছুতপ্রায় কাওরা, সর্প যুগল কার গামছার উপর মৈথুন করতে করতে উঠে আসে। বামুন ভটচায্যি মশায় খুব রেগে গেছেন ভোটো কাওরা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠায়। যার গামছায় সাপ দুটিতে উঠে আসবে, তার ভাগ্য খুলে যাবে, বিশ্বাস এমন। কারো গামছায় না উঠে তারা মৈথুন শেষ করে যে যার আস্তানার দিকে রওনা দিল। এসব গ্রাম ছাড়া দেখা যায় না। আমাদের পুকুরে গোধিকা ছিল। কালো। স্বর্ণগোধিকা বহুবছর বাদে আমি মেদিনীপুরের গ্রামে দেখেছি। সে কথা পরে আসবে। আমাদের বাড়ির কোথায় তক্ষক ছিল জানি না। সন্ধে হতেই ডাকত। হেরিকেনের আলো। গরমের দিনে বারান্দায় ঘুমোতাম ভাই-বোনেরা। শুয়ে আকাশের তারা গুণতাম। চাঁদ উঠে আসত আকাশের মধ্যিখানে। চাঁদের কলঙ্ক কলঙ্ক বলে মনে হত না। মনে হত চাঁদের ভিতরে দুর্গা প্রতিমা। কেন মনে হত বলতে পারব না।
দুর্গোৎসব দণ্ডীরহাটে একটিই। ইস্কুলের পাশে চণ্ডীমণ্ডপে তা হত। অতবড় গ্রামে একটিই পুজো। আর পুজো ছিল নলকোড়ার কর জমিদার বাড়িতে। পুজোর সময় খুড়তুতো ভাইরা মিলিয়ে দশ, এক জামা এক প্যান্ট। ছিট কিনে দর্জির কাছে মাপ দিয়ে জামা তৈরি হত। আর ইংলিশ প্যান্ট বা দড়ি দেওয়া প্যান্ট। দর্জির কাছে মাপ দিয়ে জামা-কাপড়ের চল উঠে গেছে অনেক দিন। ছোট ছোট দর্জির দোকান উঠে গেছে শহরে, গঞ্জে। দণ্ডীরহাট ইস্কুলের একটি স্মৃতি অমলিন। শীত চলে যাবে যাবে করছে তখন। মাস্টার মশায়ের পেছনে বড় জানালা দিয়ে রোদ সরে এসেছে তাঁর পিঠে। সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়ে গেছে। উত্তরেই ধলতিথা। নির্মল দেখতে পেয়েছিল। ধলতিথার ধান-মাঠ বিল পেরিয়ে দূরে আগুনের হল্কা। আগুন লেগেছে কোনো বাড়িতে। ইস্কুল থেকে ছেলেরা ছুটল ধান-মাঠ পেরিয়ে ধলতিথার দিকে। আগুনের লেলিহান শিখা সেই প্রথম দেখেছিলাম। ছেলেরা পরপর দাঁড়িয়ে পড়ে রিলে রেসের ব্যাটনের মতো জলভরা কলসি পাঠিয়ে দিচ্ছিল সেই জ্বলন্ত কুটিরের দিকে। জল তারা নিভিয়েছিল। পুরস্কার স্বরূপ পরদিন ছুটি। এই যে মানুষের বিপন্নতায় ঝাঁপিয়ে পড়া, এই মন তৈরি করে দিয়েছিল ওই ইস্কুল। ইস্কুলে বিতর্ক সভা হত ক্লাসের শেষে। আমি সেই বিতর্কে যোগ দিতাম। বিজ্ঞান না সাহিত্য, খেলাধুলো না পড়াশোনা, এই সব ছিল বিতর্কের বিষয়। মাস্টার মশায় থাকতেন সভার পরিচালক। কলকাতায় আমি তা পাইনি। কলকাতায় তা হয়েছিল ক্লাস টেন ইলেভেনে। না হলে কলকাতায় আমি নিষ্প্রভ ব্যাক বেঞ্চার। দণ্ডীরহাটে আমাদের বাড়ির পাশে রিফিউজি কলোনি ছিল। তারা সব তাঁত বুনত। সারাদিন খটাখট তাঁতকল চলত। কাহার বা কাওরা পাড়ায় আমার যাতায়াত ছিল। বাড়ির পাশেই কয়েকঘর, তার ভিতরে ভোটো কাওরা রিকশা চালাত। তার রিকশা সে চমৎকার করে সাজিয়ে তুলেছিল। হ্যান্ডেলের দু-দিকে ছোট বড় করে দুটি দুটি চারটি আয়না। রঙিন ঝালর। হর্নের খুব জোর। সেই রিকশায় করে মা কাকিমা বসিরহাট মিলনি সিনেমা হলে দুপুরের শোয়ে সিনেমা দেখতে যেত। কাহার পাড়ায় লালু কাহার ছিলেন অতি বৃদ্ধ। তিনি দাওয়ায় বসে জাল বুনতেন। আমি গেলেই ডাকতেন, ও খোকা, মিত্তিরবাবুর বাড়ির ছেলে না ?
হ্যাঁ, বলতে তাঁর একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসত আমার দিকে। “ভাত খেয়েচ? কী দিয়ে ভাত খেলে ? মাছ খেইলে ? কী মাছ। মাছের কালিয়ায় কি ফুলকপি ছিল। টমটমের চাটনি ছিল কি ? ক্ষীর খেয়েচ কাঁটাল দিয়ে। মাংস কবে খেয়েচ খোকা…”
এখন বুঝতে পারি ক্ষুধার্ত মানুষের জিজ্ঞাসা ওসব। গরিব কাহার পাড়ার মানুষের না ছিল জমি, না ছিল কাজ। অন্ন সংস্থান হবে কী করে ? ভোটো কাহার রিকশা করেছিল, তা তার নিজের না অন্য কারোর টাকায় কেনা তা জানতাম না। গ্রামের বাঁড়ুজ্যে বামুনের সঙ্গে ভোটো কাওরার খুব বিবাদ ছিল। রিকশায় চেপে তিনি এক টাকা ভাড়া হলে আট আনা দিতেন। আট আনা বাকি থাকল। বাকিটা শোধ দিতেন না। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের ছেলেদের নাম ছিল, ধরুন, অমলকিশোর, বিমলকিশোর, কমলকিশোর, কুনালকিশোর...। ভোটো কাহার কী করল, তার ছেলেদের নাম সব বদলে অমলকিশোর, বিমলকিশোর...। করে দিল। সেই নামে ডাকা শুরু করল। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায় রেগে কাঁই। একদিন বেজায় খাপ্পা হয়ে রাস্তায় ঝগড়া, তাঁর ছেলের নামে নিজের ছেলের নাম রেখেছে কেন ভোটো ? ভোটো উদাসীন হয়ে জবাব দিয়েছিল, নাম কি কারোর নিজের সম্পত্তি। মেয়ের নামও বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের মেয়ের নামে রেখেছিল, ছায়া, মায়া...।
আহা। অসাধারণ।
লেখা তো নয় ছবি ।জীবন্ত আর সচল ।মান খোয়ানো মাষ্টারমশাই,ভালো মন্দ খেতে ইচ্ছে করে যার সেই করুণ মূর্তি বৃদ্ধ
ছবির মতো যেন চোখের সামনে ভাসছে সব ঘটনা প্রবাহ।
অপূর্ব শৈশব! বসিরহাট, দণ্ডীরহাট যেন রংগিন সিনেমার স্লাইড। আরও লিখুন
চতুর্থ পর্ব।
বাঁড়ুজ্যে বাবু আর ভোটো কাহারের পুত্র কন্যার নাম ছিল এই রকম
অরুণ বরুণ তরুণ তপন স্বপন স্বাধন মায়া দয়া জয়া।
এর মধ্যে স্বপন দা এক অসাধারণ শিল্পী । স্পষ্ট মনে আছে এক রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে স্কুলের কেউ "মন মোর মেঘের " এই গান গাইছিলেন আর স্বপন দা বোর্ডে সেই ছবিটি আঁকছিলেন গানের সঙ্গে সঙ্গে।
স্বাধন আত্মহত্যা করেছিল। কেশব বাবুর পাঞ্জাবির পিছনে কালিমালিপ্ত করার জন্য ওকে কান ধরে পাড়ায় ঘোরানোর অসম্মান ও নিতে পারিনি।
চারুবাবুর বাড়ি ছিল বসিরহাটের সাঁইপালায়। ছাত্রঅন্ত প্রান ছিলেন।
এখনো পড়া শেষ হয়নি । সবে ৩য় পর্ব শেষ করলাম । খুব ভাল লাগছে । পরে আরো বিস্তারিত ভাবে মতামত ব্যাক্ত করব ।