আমি দন্ডীরহাট থেকে এক বর্ষার দিনে কাউকে না বলে কলকাতা চলে এসেছিলাম। তখন মা, আমার বোনকে নিয়ে কলকাতায়, আমি কাকিমাদের কাছে ওখানে। ক্লাসে উঠলে কলকাতায় নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু মাকে ছেড়ে কি থাকা যায় ? তখন আমার ক্লাস সিক্স। বাসের ভাড়া যোগাড় করে আমার খুড়তুতো ভাই পবনের ( নিরঞ্জন ) হাতে একটা চিঠি দিয়ে চলে এসেছিলাম। পবন সব জানত। পরে ও খুব বকুনি খেয়েছিল আগে বলেনি বলে। একা আসছি। হাফ প্যান্ট, শাদা জামা, পায়ে বুট জুতো। মাথায় খাড়া খাড়া চুল। ৭৯-সি নম্বর বাসের শিখ কন্ডাকটর সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। আকেলা হো? বসিরহাট গেল, খোলাপোতা, সিঙাড়া রসগোল্লার বেড়াচাঁপা। বেড়াচাঁপা ছিল এই দণ্ডীরহাট যাত্রায় সব চেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। বাস একটু বিশ্রাম নিত। আমরা শালপাতার বাটিতে রসগোল্লা পেতাম। সেদিন আমি সতৃষ্ণ নয়নে বাইরে তাকিয়ে আছি। কিনে খাওয়ার পয়সা ছিল না মনে হয়। বেড়াচাঁপায় সেই ছেলেবেলায় বাসের জানালায় যেমন মিষ্টির দোকানের কর্মচারীদের মধুর হাঁকডাক দেখতাম, শুনতাম, তেমনি দেখতাম অন্ধ নাচার ভিখারিদের। তারা জানালার সামনে এসে গান গাইত, সেই গান মুসলিম গান। আল্লা আমার ভালো করবেন যদি অন্ধকে দুটি পয়সা দি। দিয়েছি মায়ের কাছ থেকে নিয়ে। সেদিন মানে যেদিন আসছিলাম আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে, চৌকো পাঁচ নয়া পয়সা দিয়েছিলাম এইটুকু মনে আছে। তখন আমার ভিতরে উদ্বেগ আর ভয় চাগিয়ে বসেছে। যদি হারিয়ে যাই। যদি ধরা পড়ে যাই। পুলিশ এসে ধরে। তারপর দণ্ডীরহাট পাঠিয়ে দেয়। আল্লা আমায় রক্ষা করুন। পরে বেড়াচাঁপায় আমি চাকরি করেছি। বেড়াচাঁপায় চন্দ্রকেতুগড়, গঙ্গাহৃদি সভ্যতা, বেড়াচাঁপা থেকে দক্ষিণে হাড়োয়া, পীর গোরাচাঁদের মাজার। বেড়াচাঁপায় বোধহয় এক প্রাচীন নদী আছে। টাকি রোডের গায়ে তার খাত দেখা যায়। আলে আলে ভাগ করা জলাশয়। দেখলেই ধরা যায় নদী ছিল একদিন, বহুদিন আগে। বেড়াচাঁপার পর দেগঙ্গা, বিদ্যাধরীর এক শাখা, তারপর গোলাবাড়ি, কাজিপাড়া হয়ে বারাসত। বারাসত এসে গেলে কলকাতা প্রায় এসে গেল। গোলাবাড়ি, দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা সব প্রাচীন জায়গা। নিম্নবর্গের মানুষের বসতি বেশি। মুসলমানের সংখ্যা খুব বেশি। তারা কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, আরো কত কাজ করে। বহুশত বৎসর ধরে আছে। আমি ওই অঞ্চল নিবিড়ভাবে ঘুরেছি। গ্রামে গ্রামে। গোলাবাড়ি দিয়ে একটা বাস যেত, বারাসত আমিনপুর। বাসের নম্বর ২৩। সেই বাসে করে আমিনপুর নেমে বিদ্যেধরী গাঙ পার হয়ে বাস ধরেছি ৯১ নম্বর। শ্যামবাজার খালপাড়, কলকাতা।আমার বেশ কয়েকটি গল্প ওই অঞ্চল নিয়ে আছে, আগুনের দিন, হস্তান্তর, হারাধন, কেউ ফেরেনি, আবহমান। আগুনের দিন, হারাধন দেশ পত্রিকায়, হস্তান্তর, আবহমান প্রতিক্ষণ পত্রিকায় লিখেছিলাম। সেসব কথা পরে আসবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বাড়ি আসার কথা শেষ করি। বারাসতের পর মধ্যমগ্রাম, দোলতলা, নিউ ব্যারাকপুর…...এয়ার পোর্ট পার হচ্ছে যখন বাস, কলকাতা এসে গেল। এয়ারপোর্ট নিয়ে কত কৌতুহল, দণ্ডীরহাট যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া যেত বিমান দাঁড়িয়ে আছে। ‘উড়ো কল’ এই নাম শুনেছিলাম মেদিনীপুরে অনেক বছর বাদে। দমদম বিমান বন্দরে বিমান উড়তেও দেখেছিলাম। আবার নামতে দেখেও কী উত্তেজনা। সেই কলকাতা যাত্রা ছিল মায়ের কাছে ফেরা। বাসে ঘুমোন অভ্যেস। সেদিন চোখের পাতা ফেলতে পারিনি। বর্ষার দিন। সন্ধের পর বেলগাছিয়া এল। বেলগাছিয়া নেমে ফ্ল্যাটে ঢুকে মা আমি এসে গেছি বলতে সকলে স্তম্ভিত। একা একা। বাড়ি থেকে পালিয়ে ? ছ’মাস বাদে আবার পাকাপাকি ভাবে কলকাতা।
দণ্ডীরহাটের একটা বড় উৎসব, সব চেয়ে বড় উৎসব হলো চৈত্র সংক্রান্তির গাজন। সে একেবারে হৈ হৈ। একমাস ধরে গাজনের সন্ন্যসীরা গ্রুয়া বসনে মহাদেবের নামে ডাক দিয়ে বেড়াত সকাল থেকে। গাজনে ভোটো কাহারও সন্ন্যাসী হত, অলোক চৌধুরী, অচিন্ত্য চৌধুরীও সন্ন্যাসী হত। তখন তো কোনো বর্ণ ভেদ দেখিনি। একসঙ্গেই তারা শিবের ভক্ত। মালসায় ভাত রান্না করে খায়। গাজনের দিন খেজুর গাছ মোড়া থেকে বাণফোঁড়া সব এক সঙ্গে করে। তাহলে ? হিশেব মেলে না। কলকাতা চলে আসার পরও আমি গাজনের সময় দণ্ডীরহাটে গিয়েছি। সে এক বর্ণাঢ্য উৎসব। শিবের মাথার ফুল পড়া না পড়া নিয়ে কী উত্তেজনা। মেলা বসত বড় সুন্দর। এখনো হয় নিশ্চয়। যাওয়া হয় না।
কলকাতা আমার নিজের শহর। বেলগাছিয়া-পাইকপাড়া আমার নিজের পল্লী। আমরা ওপার থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষ। কলকাতা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। এই পাইকপাড়া বেলগাছিয়া অঞ্চল হল কলকাতার সেরা জায়গার একটি। এমন অবারিত সবুজ মাঠ, গাছগাছালি, মস্ত জলাশয় এমন নির্জন পথ আর ভালমানুষের বাস আর কোথায় আছে ? এমন বড় বড় মানুষ কলকাতার কোথায় বাস করতেন ? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য..আমি কতজনের কথা বলব। কাজি নজরুল ইসলামের পায়ের ধূলিতে ধন্য হয়েছে এই এলাকা। আমি তাঁকে দেখি নি, কিন্তু তাঁর পাশের মস্ত ফ্ল্যাট বাড়িটিতে পরম শ্রদ্ধেয় শিল্পী অন্নদা মুন্সি মশায়ের বাড়ির দরজায় এক সকালে কড়া নেড়েযলাম। বালকদের দেখে তিনি অবাক। হাসি মুখে ডেকে নিলেন ভিতরে। সেই প্রথম চিত্রকরের ঘরে প্রবেশ। রঙের ভিতরে প্রবেশ। তাঁর সেই ঘরখানিতে ছিল যেন রঙিন বাতাস। আমাদের বন্ধুর দাদা শ্যামল বরণ বালক লাল্টু ওই ঝিলের জলে ডুবে গিয়েছিল ক’বছর আগে, তার নামে একটি পাঠগার করব, শুধু ছোটদের বই থাকবে সেখানে, তিনি যদি একটি ছবি এঁকে দেন বা পোস্টার। তিনি তো এঁকে দিলেন, পয়লা বৈশাখের সকালে এসে উদ্বোধন করলেন সেই পাঠাগার। আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন বালকের মতো। সেই আমার প্রথম আড্ডা বড় মানুষের সঙ্গে। হ্যাঁ, আমি এঁদের দেখতে দেখতে বড় হয়েছি আমার ছেলেবেলার এই কলকাতায় এই বেলগাছিয়ায়। ইস্কুলের বন্ধুরা গিয়েছিলাম অরবিন্দর সঙ্গে তার দাদা অনুপকুমারকে দেখতে। জানালা দিয়ে দেখছি তিনি বসে আছেন ভিতরে। এ হল মহার্ঘ স্মৃতি। সিনেমার মানুষ পর্দা আর পোস্টার থেকে ঘরের ভিতর। বিস্ময় যে যায় না। হ্যাঁ সুখ্যাত নট প্রেমাংশু বসুকে দেখতাম ফোলিও ব্যাগ হাতে মাঠ পার হয়ে যাচ্ছেন এক নির্দিষ্ট সময়ে। তিনি হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁকেও তো সিনেমায় দেখেছি কত। আর একজনকে দেখতাম, আমাদের বাসাবাড়ি থেকে একটু ওপাশে থাকতেন। মস্ত দেহের অমর বিশ্বাস মশায়। তিনি উত্তম-সুচিত্রার সব ছবিতে থাকতেন ছোট একটি দৃশ্যে। এদিকে থাকতেন অজয় গাঙ্গুলী, তিনি ছিলেন সুখ্যাত অভিনেতা, তাঁকেও দেখেছি কতবার। আর আমাদের বাসাবাড়িতে যখন দাদার সঙ্গে কলেজের বন্ধু পার্থপ্রতিম চৌধুরী এলেন, অবাক হয়ে দেখেছি। তিনি তখন বোধয় সিনেমায় অভিনয় করেছেন। রাস্তায় পোস্টার দেখেছি। শ্রীকান্ত, অন্নদাদি ও ইন্দ্রনাথ ছিল ছবির নাম। তিনি ইন্দ্র। পার্থদা তখন ছায়াসূর্য পরিচালনা করেছেন কি না জানি না। অসিত সেনের সহকারী ছিলেন। অত্যন্ত গুণী এক পরিচালক। ছায়াসূর্যের মতো ছবি করা সহজ নয়। মনে করা যাক উত্তম সুচিত্রার সেই প্রবল দাপটের দিনে, একটি কালো মেয়েকে নিয়ে ছবি। নায়িকা নয় সে, প্রতি নায়িকা। ছায়াসূর্য আমার দেখা সেরা ছবিগুলির ভিতরে একটি। মহৎ ছবি। অথচ তিনি উচ্চারিতই হন না। কেন তা জানি না। দোলনা সিনেমার কথা ভাবি। কুমারী মেয়েটি একটি বাচ্চা নিয়ে আসে বাড়িতে। সেই ষাটের দশকে কত আধুনিক। এ ছাড়াও শুভা ও দেবতার কিংবা যদু বংশ ছবির কথাও ভুলিনি। গত তিরিশ বছরে সিনেমা মহলে পার্থপ্রতিম একেবারেই অনুচ্চারিত কেন ছিলেন তা আমি জানি না। চেপেই দেওয়া হয়েছিল যেন। থিয়েটার করতে এসে পার্থদা সিনেমায় চলে গেলেন । ওঁর নাটক খাঁচা আমি দেখেছি সুন্দরমের প্রযোজনায়। দেখেছিলাম নীলকন্ঠের বিষ নাটক। পরের নাটকটি মনোজ মিত্রর। সমারসেট মম অবলম্বনে। ছায়াবিহীন নামে একটি নাটক রংমহল থিয়েটারে করেছিলেন। অভিনয়ও করতেন। পার্থপ্রতিমের জন্য মন খারাপ লাগে। এমন গুণীকে সম্মান দিইনি আমরা। নির্গুণকে গুণী বলে প্রতিষ্টা দিয়েছি।
কলকাতায় তখন রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ইস্কুলে, পাড়ায় রবীন্দ্র নাটক করার রেওয়াজ ছিল। বাড়ির ছাদেও মঞ্চ বেঁধে অভিনয় হতো ছাত্রের পরীক্ষা, পেটেও পিঠে...। মনোহর একাডেমী স্কুলে আমি মুকুট নাটকে হয়েছিলাম ধুরন্ধর। প্রাইজ পেতে পেতে পাইনি। রাজধর যে হয়েছিল, সে পেয়েছিল। পরিবারে দেখেছি অগ্রজ নাটক নিয়ে থাকেন। ঠাকুরদাকে নিয়ে ‘মৃত্যুর চোখে জল’ নাটক লিখে তাঁর নাম হয়েছে। তখন ক্লাস ফাইব, আনন্দবাজারে নবনাট্য আন্দোলন নিয়ে লিখতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারি। দাদাকে নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। ছবি সমেত সেই লেখা বেরিয়েছিল, পরম বিস্ময়। সুতরাং আমি নাটক লিখব এবং অভিনেতাও হবো, এই ছিল সুপ্ত বাসনা। ক্লাস এইটে যখন, দাদা রানীগঞ্জ থেকে ফিরে এসেছেন। নতুন নাট্যদল ঋতায়ন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঋতায়নের ‘নীলা’ নাটকে আমি বড় একটা রোল করেছিলাম। বালক পুত্র আনন্দ। আনন্দবাজারে নাট্য সমালোচক লিখেছিলেন, ‘বাবুজি মিত্রের আনন্দ নিরানন্দ নয়।‘ বাবুজি আমার ডাক নাম। নীলার দুটি অভিনয়ে আমি ছিলাম, মিনারভা ও থিয়েটার সেন্টারে। মিনারভায় অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছিলাম কল্লোল নাটকের জাহাজের সেট। এখন মনে পড়লে শিহরিত হই। আমি কল্লোল দেখিনি। কত নাটক দেখিনি, কত বই পড়িনি, এমন তো হয়েই থাকে। ক্লাস ইলেভেনে ‘বিনি পয়সার ভোজ’ –অক্ষয়বাবুর সেই স্বগত কথনে আমি চরিত্র বসিয়ে নাটক বানিয়ে মঞ্চায়িত করলাম বন্ধুদের নিয়ে। আমিই অক্ষয়বাবু। পাড়া ভেঙে পড়েছিল সেই নাটক দেখতে। তখন এমনি হত। নীলু করেছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কে নীলু? বস্তিবাসী দরিদ্র শ্রমিক পরিবারের সন্তান। বস্তিতে যাঁরা বাস করে, তারা আমাদের মতো নয় এইটা মাথায় কে ঢুকিয়ে দিয়েছিল কম বয়সে। একবার এক খেলুড়ে সাথীর সঙ্গে ঝগড়ায় তাকে বলেছিলাম, তুই তো বস্তির ছেলে। এখনো মনে পড়ে তার ম্লান মুখখানি। সেই মুখ আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল। সমস্ত জীবনের শিক্ষা। মানুষের মুখই কথা বলে। মানুষের মুখ দেখে গল্প লিখেছি অনেক। একটি লোককে আমি দেখতাম আলিপুর কালেক্টরেট থেকে অফিস করে বাড়ি ফেরার সময়। এই ক’বছর আগের কথা বলছি। লোকটিকে দেখলেই বোঝা যায় কোনো এক কারখানার শ্রমিক। দুঃস্থ। বাসের ড্রাইভার, কন্ডাকটরকে শুধু উত্যক্ত করত বাস জোরে চালাবার জন্য। সে বেহালার দিক থেকে বেলগাছিয়া ফিরত। বাসের ভাড়া দিত না খুব সহজে। আগে বাসটা চালাও, তারপর ভাড়া। এই শুয়ারের বাচ্চা বাস চালা, নইলে ভাড়া পাবিনে। তার যাবতীয় ক্ষোভ বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টরের উপর বমি করে দিত। সেই লোকটা আমাকে সহ্য করতে পারত না। কারণ আমি একদিন বলেছিলাম ড্রাইভারকে এভাবে উত্যক্ত করবেন না। গালাগালি দিচ্ছেন কেন ?
আপনার কী মশায়, আপনার কী? হাতে বহুত সময়। গরমেন্ট সারবিস মনে হয়। কত ঘুষ। আমার শালা বেতনই নেই।
আমাকে ঘুষখোর বলে দিল। বাসের লোক আমার দিকে তাকাতে লাগল। কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর তার সঙ্গে বাসে দেখা না হোক, বাজারে দেখা হত। ক্রুদ্ধ চাহনি। তাকে নিয়ে একটি ছোট উপন্যাস লিখেছি আমি, ‘এক বসন্তের জন্ম’। তার সঙ্গে যেন শীতকালেই দেখা হয় আমার। তার মুখই আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেছিল। জীবনে মান অপমান কিছুই ফেলা যায় না।
কলকাতার ছেলেবেলা কম বর্ণাঢ্য নয়। সন তারিখ নিয়ে নয়, সব মিলিয়ে কলকাতা আমার কাছে এক ব্যপ্ত শহর, ব্যপ্ত জীবন।
১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনের কথা বেশ মনে আছে। সেই কথা বলি। তখন, সেই ৬৬- সালের আগে পরে ফ্যান দাও মা ডাক শুনেছি আমাদের বাড়ির গলিতে। আর সেই সময়ই মায়ের কাছে ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের কথা শুনেছি। মায়ের কাছে ১৯৪৩( ১৩৫০ বঙ্গাব্দ ) -এর স্মৃতি ফিরে এসেছিল। কলকাতায় তখন ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়। রেশন দোকানে খুব ভীড়। রেশন দোকানে একবার শ্যাম দেশীয় চাল দিয়েছিল, তার ভাতের গন্ধ খুব খারাপ ছিল। তখন ক্লাস সেভেন। তখন প্রায়ই হরতাল ডাকত বিরোধীরা। হরতাল ঘোষণা করতেন আর এস পি দলের যতীন চক্রবর্তী। তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল হরতালদা। তিনি ছিলেন বর্ণময় মানুষ। পরে শুনেছি ক্ষমতার শীর্ষর সঙ্গে বিবাদে বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীত্ব খুইয়ে ছিলেন। সেই হরতাল শব্দটি এখন উঠে গেছে। এখন তা ‘বন্ধ’। ‘বন্ধ’ আর ‘হরতাল’-য়ে পার্থক্য কী ? সেই সময় ক্ষমতায় কংগ্রেস। প্রফুল্ল সেন মুখ্যমন্ত্রী। খাদ্যের অভাবের জন্য তিনি কাঁচকলার পুষ্টিগুন উল্লেখ করে কাঁচকলা খেতে বলেছিলেন। তা নিয়ে কত বিদ্রুপ এবং ব্যঙ্গ। অতুল্য ঘোষ ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে পুলিশের লাঠিতে একটি চক্ষু হারিয়েছিলেন। তাঁকে কানা অতুল্য বলত বিরোধীরা। ইস্কুলে থাকতে আমরা কিশোর বালকরাও বলতাম। ভোটে কংগ্রেস হেরে গেল ১৯৬৭-তে।
তখনকার ২৮০ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস ১২৭টি আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দল হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না এবং সরকারও গড়তে পারেনি৷ নির্বাচনে ভোটে দুই ফ্রন্ট আলাদা আলাদা ভাবেই লড়েছিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ৷
এই দুই ফ্রন্টের মধ্যে একটি ছিল - সিপিএমের নেতৃত্বাধীন এসএস পি, আরএসপি, এস ইউ সি, আর সি পি আই, ওয়ার্কাস পার্টি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ( মার্ক্সবাদী) নিয়ে গঠিত হয়েছিল সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্ট (ইউএলএফ)৷ অন্যদিকে বাংলা কংগ্রেস, সি পি আই, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং বলশেভিক পার্টি গঠন করেছিল বামপন্থী গণ ফ্রন্ট (পিইউএলএফ)৷ তাছাড়া পি এস পি, জনসংঘ , স্বতন্ত্র পার্টি এবং গোর্খা লিগ একাই লড়েছিল ভোটে৷ লোকসেবক সংঘ কোন ফ্রন্টে না থাকলেও পুরুলিয়ায় তাদের সমর্থন করেছিল দুই ফ্রন্টই৷
১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনের সময় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় সম্পাদনা করতেন বসুমতী পত্রিকা। তাঁর সম্পাদকীয় লেখা ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়। মনে আছে ভোর বেলায় বেলগাছিয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম বসুমতী কেনার জন্য। বসুমতী নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। এই খাদ্য আন্দোলনে শহীদ হয়েছিল বসিরহাটের নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইত। খাদ্য আন্দোলন, খাদ্যের অভাব নিয়ে সেই সময়ে লেখা দুটি গল্পের কথা মনে পড়ে, ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখক বাসুদেব দাশগুপ্ত লিখেছিলেন রন্ধনশালা এবং অবনী ধর ‘ ভাতের জন্য শ্বশুর বাড়ি’। অবনী ধরের লেখা ষাটের দশকে না সত্তর দশকে তা আমি জানি না। বাসুদেব ষাটের দশকে খাদ্য আন্দোলনের আগেই এই ক্ষুধার্ত মানুষের গল্প লিখেছিলেন। পরে অনেকেই লিখেছেন। আমি ১৯৭৪-এর এপ্রিল এবং মে মাসে দুটি গল্প লিখেছিলাম, মেলার দিকে ঘর ও পার্বতীর বোশেখ মাস। তখনো ক্ষুধার্ত মানুষ দেখেছি। এখনো দেখছি। দীর্ঘ বাম ফ্রন্ট শাসনেও দেখেছি আমলাশোলে অনাহারি মানুষ। অন্ন এবং না খেয়ে বাঁচা, এই গল্প লিখেছিলাম ২০০৫-০৬ এ মনে হয়।
প্রথম যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো। পাড়ায় বালবের চেন ঝোলান হয়েছিল, তার গায়ে লাল সেলোফেন পেপার মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। সব লাল। দীপেন মুখোপাধ্যায় নামে এক প্যারডি গায়ক শিব রাত্তিরের সারা রাতের জলসায় গান ধরেছিলেন, ‘‘দেখে লাল দেওয়ালি, বুঝি বাবারা পালালি, বনে জঙ্গলে অবশেষে…’ মনে আছে আমাদের ইস্কুলে কানা বেগুন এবং কাঁচকলা ঝোলান হয়েছিল। তখন আমি ক্লাস ইলেভেন, পরের বছর, ১৯৬৮ সালে হায়ার সেকেন্ডারি দেব। এখন মনে হয় বড়রা কী শিক্ষা দিয়েছিলেন আমাদের? কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলতে নেই তা আমাদের ঠাকুমা হেমনলিনী আমাদের শিখিয়েছিলেন। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির মানুষজনের ভাষাজ্ঞান এবং সৌজন্য বোধ খুব কম। সারা ভারতের কথা জানি না। পশ্চিমবঙ্গে তো এমন দেখছি এতটা বয়স পর্যন্ত।
১৯৬৭ সালের ২৫শে মে, সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তফ্রন্ট সরকার, উত্তরবঙ্গের দারজিলিং জেলার শিলিগুড়ি শহরের অদূরে নক্সালবাড়ি গ্রামে কৃষক বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে এগারজনকে হত্যা করা হয়। তাদের ভিতরে দুজন শিশুও ছিল। জোতদারের সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধারেই গিয়েছিল কৃষকরা। নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার, কানু সান্যালরা। শুরু হলো নক্সালবাড়ি আন্দোলন। সেই সময়ের ইতিহাস লিখিত হয়েছে অনেক। পুজোর পর ইস্কুলে গিয়ে দেখি, ইস্কুলের শাদা দেওয়ালে লাল রং দিয়ে লেখা, ‘ উই ওয়ান্ট ইউনিয়ন রাইট’।
এর ভিতরে এক শনিবারে ইস্কুলের বাইরে মিটিং, কে আসবেন, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় ? তিনি তখনই আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েছিলেন কি না জানি না। কাকা বক্তৃতা দিলেন। গালে দাড়ি, পায়জামা পাঞ্জাবি, মুখের অস্বাভাবিক গঠন দেখলাম। উদ্দীপ্ত করলেন তিনি। নক্সালবাড়িতে কী হচ্ছে বললেন। আমাদের ক্লাসের দেবাশিসদা, তারক... এরাই তাঁকে নিয়ে এসেছিল। দেবাশিসদা আমার মেজদার সহপাঠী ছিলেন। ্পরে আমার সহপাঠী হন। ডিসেম্বর মাসে টেস্ট পরীক্ষা যেদিন আরম্ভ, সেদিন দেবাশিসদা বললেন, ‘বাইরে পেটো বোমা ফাটলেই সকলে বলবি, ভয় করছে, পরীক্ষা দিতে পারব না’ । টেস্ট পরীক্ষা ভণ্ডুল হলো। পরীক্ষা দিতে হলে দেবাশিস, তারকরা অ্যালাউ হত না। সেই দেবাশিস কত রাজনীতি পরে করল। কত দল। এখন দেখা হলে বলে, বুঝলে তো, ওই ওদের জন্য কোথাও যাওয়া যাবে না, না ব্যাঙ্ক, না পোস্ট অফিস, এরপরে আমরা থাকব না, ওরা থাকবে...। তারক সম্প্রতি মারা গেছে। সে মধ্যমগ্রামে থাকত। তারা অনেকে তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’ সিনেমায় একটি দৃশ্যে ছিল। সেই যে গান, ‘আজি এসেছি, আজি এসেছি, এসেছি বধূ হে…,’-গানে তারা মাথা ঝাঁকিয়ে লিপ দিয়েছিল। একজন দাদাকে দেখতাম খুব সেজেগুজে, চুলে শ্যাম্পু ব্রিল ক্রিম লাগিয়ে চলাফেরা করতে। সিনেমায় নামবে। নেমেও ছিল এক ছবিতে এক দৃশ্যে। এক্সট্রা। তখন সিনেমায় নামবে বলে কতজন গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে অপেক্ষা করত, যদি বাংলা বা হিন্দি সিনেমার কোনো পরিচালক বা নায়ক কিংবা নায়িকার চোখে পড়ে যায়। স্টুডিও পাড়া সকলে চিনত না। এমনিতে রটে গিয়েছিল বালিকা বধূর মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় বা পার্থ মুখোপাধ্যায়কে নাকি ওই ভাবে পেয়েছিলেন পরিচালকরা। তরুণ মজুমদার এবং তপন সিংহ। কোন রাস্তায় গেলে তাঁদের চোখে পড়া যাবে তা কেউ জানত না। আমার খোলতাই চেহারা। সিনেমায় নামার শখ হয়নি কখনো। হায়ার সেকেন্ডারির পর আমাদের বন্ধু নিমাই ভাবত সে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো দেখতে। সেও অমন ভাবে পাড়ার রাস্তায় পায়চারি করত। সে কথা যাক। মানুষের কৈশোর আর যৌবন অমল। কত রকম না কল্পনায় সে ভেসে যায়। এসবই জীবনের ঐশ্বর্য। আমি নাটক লেখায় হাত পাকাতাম ক্লাস সেভেন এইট থেকে। কলকাতায় ফিরে ইস্কুলজীবন ইস্কুলের ভিতরে ততো মধুর নয়, বাইরেটা যেমন। তবে অম্লও নয়। এ জীবন অম্ল মধুর।
এ লেখা জীবনের এক উত্তরণ পর্বের। এক বালকের শহরে আসা, বড় হওয়া ইত্যাদির মধ্যে যে গভীর পর্যবেক্ষণ চারপাশের তা'র অনবদ্য ভাষারুপ। উত্তর কোলকাতার টালা বেলগাছিয়া পাইকপাড়ার এবং ষাট,সত্তর দশকের সালতামামি পড়তে পড়তে কখন যেন সময় যানে চেপে হারিয়ে যাওয়া ঐ সময়ের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে..এর আঁচ আমিও তো পেয়েছিলাম অনতিদূরের বাগবাজার শ্যামবাজার থেকে।
এ আখ্যান যত এগোবে, তত মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে পাঠককে হাজির থাকতে হবে প্রতিটা পর্বে।
ভালো থাকুন অমর দা।
- প্রবুদ্ধ মিত্র
সেই সময়টা একটু একটু করে রূপ পরিগ্রহ করছে তার সব বর্ণ গন্ধ রূপ সমেত।
খুব ভাল লাগছে পড়তে। ধন্যবাদ অমরদা।
যাপন কালে বোঝা যায় না, ফিরে দেখার সুযোগ পেলে বোঝা যায় জীবন কত মধুর।
"ছেলেবেলার দিকে যখন তাকানো যায় তখন সবচেয়ে এই কথাটা মনে পড়ে যে, তখন জগৎটা এবং জীবনটা রহস্যে পরিপূর্ণ। সর্বত্রই যে একটি অভাবনীয় আছে এবং কখন যে তাহার দেখা পাওয়া যাইবে তাহার ঠিকানা নাই, এই কথাটা প্রতিদিনই মনে জাগিত। প্রকৃতি যেন হাত মুঠা করিয়া হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিত, কী আছে বলো দেখি। কোন্টা থাকা যে অসম্ভব, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারিতাম না।"
এই ব্যাপারটার সামান্য অভাব বোধ করছি।
আর ভাবছিলাম, এই যে শৈশব , বাল্য, কৈশোর পেরিয়ে যৌবন- স্মৃতির ভাষা যদি বদলে বদলে যেত - রবীন্দ্রনাথের উপমা নিলে
ঝর্ণা আর সরোবর কিম্বা কাকলি আর কাহিনীর পার্থক্য- কেমন হত?
অমর মিত্র মশাই য়ের জীবনকথা বলেই আশা করি / করতে পারি আর কী।
আসলে লেখাটি নদীর মত। কখন কোন বাঁক নেবে জানি না। ইন্দ্রাণী যা বলেছেন তা আমাকে ভাবিয়েছ। দেখি কতটা ছেঁকে আনতে পারি জীবনের ঘ্রাণ।
ভাল লাগল আপনার উত্তর।
"স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।
এইরূপে জীবনের বাইরের দিকে ঘটনার ধারা চলিয়াছে, আর ভিতরের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকা চলিতেছে। দুয়ের মধ্যে যোগ আছে অথচ দু'ই ঠিক এক নহে।"
লেখা নদীর মত বয়ে চলবে- একটি বালক তার সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হয়ে উঠছে, লেখক হয়ে উঠছে; কোন বাঁকে দেখা হবে বালক এবং কিশোরের, কখনও কিশোরের সঙ্গে তরুণের অথবা বালকের সঙ্গে প্রৌঢ়ের - এই সব আশ্চর্য সাক্ষাতের অপেক্ষায় রইল পাঠক।
নমস্কার জানবেন।
ইন্দ্রাণী
দাদা ।..যত পড়ছি তত শৈশবে ঢুকে পড়ছি যেন !!জন্ম অসম রাজ্যে ।..লামডিং নামক একটা শহরে !!তখন বাবার কাছে গল্প শুনতাম কলকাতার ।..বাবা কলকাতার ছেলে ।..বাগবাজার অঞ্চলে ।..পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা মানুষ গুলো সবেমাত্র একটু শাঁস নিচ্ছে ।..তখন হয়েছিল বাঙালি খেদাও আন্দোলন ।..তাই ছিন্নমূল আমরা প্রায় সবাই ।...ব্যথা আমাদের বুকেও বাজে।.. অন্য ভাবে ।..অনন্য সুরে !!!..সমৃদ্ধ হচ্ছি , ধন্যবাদ দাদা !!
কলকাতার শ্রেষ্ঠ জায়গা ' বেলগাছিয়া ' হলে তার থেকে গোটা তিন চার স্টপেজের তফাতেই বাস সুতরাং এ সবুজের গন্ধেই আমার কাটানো জীবনের গল্পে তো আমারো। ছাতকের মতো অপেক্ষা করে থাকবো শেষ বিন্দুটির জন্য । দাদা ৬৮তে আমি ৬২র এইচ এস পরিক্ষাত্রী ।
মানস মিত্রর ।