মাঠ যে আখ্যানের প্রাণসর্বস্ব
পুরুষোত্তম সিংহ
ঔপন্যাসিক দায়বদ্ধ সময়ের কাছে, ইতিহাসের কাছে, অতীতের কাছে, বর্তমানের কাছে। সময়ের অজস্র চোরাস্রোতকে তিনি যেমন ধবমান করবেন তেমনি কেউ কেউ শিল্পের দায়কে অস্বীকার করে সময়কে প্রত্যাখ্যানও করেন। আবার নিটোল বাস্তব, প্রত্যক্ষ বাস্তবকে শিল্পের বাস্তবে পরিণত করার যে পর্যবেক্ষণ শক্তি, অভিজ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন তা অনেক বাঙালি লেখকেরই নেই। তাই বাস্তবতার নামে কখনো তা ফোটোগ্রাফি হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে তথ্যের বিবরণ, ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি করার দোষে দুষ্ট। ইতিহাসের সত্য, সময়ের সত্য, বাস্তব সত্যকে সাহিত্যের আঙিনায় প্রতিফলিত করতে জরুরি শিল্পদর্শন, নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান, সমাজতাত্ত্বিক প্রজ্ঞা। জমি নিয়ে লিখতে গেলে জানা জরুরি জমির চরিত্র, জমির দেহ, জমির ব্যাস-ব্যাসার্ধ, জমি-মানুষের সম্পার্য ও বিরোধের বিন্দু। বাংলা সাহিত্যে যথার্থ বাস্তবকে চেনার অভাবে না হয় বাস্তবসম্মত লেখা, না হয় শিল্পের সত্যে উত্তরণ। প্রফুল্ল রায়, অমর মিত্র, আনসারউদ্দিন, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, কল্যাণ মণ্ডল, সোহারাব হোসেন, অমিতকুমার বিশ্বাস জমি, ভূগোলকে চিনিয়েছেন গভীর পর্যবেক্ষণে, অভিজ্ঞতার দর্পণে, জমি মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘরবসতের সূত্রে। ফলে সেসব লেখায় কোনো ফাঁকি নেই, আলগা চালাকি নেই। সোহারাব হোসেন দীর্ঘ সময়ের পটভূমিকায় লিখেছেন ‘মাঠ জাদু জানে’ (২০১১) আখ্যান। তেভাগা আন্দোলন, অপারেশন বর্গা প্রথা থেকে নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে কৃষি-শিল্পের লড়াই পর্যন্ত। জমি সংলগ্ন মানুষের ঘরগেরস্তি, বদলিবসত, চাষবাস, জমিহারা, জমিদখল, কৃষিসংবাদ, গোষ্ঠীজীবন ও জীবনের সাধারণ নাট্য নিয়ে তিনি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অতল শিকড়ে পৌঁছেছেন।
জমি ও মানুষ এখানে মিশে গেছে একসুরে। জমি চিন্তা জমি ধ্যান জমি শিরোমণি মানুষের কাছে জমি বাঁচার ইঙ্গিত, বাঁচার প্রত্যাশা, জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও ভূত ভবিষ্যৎ। কওছারের নব বিবাহিত স্ত্রী সাবেরা বিবাহের পরের দিনই ভাগ রেকর্ড করাতে বলে। সামান্য জমি মানেই ভবিষ্যতের সুখের ইঙ্গিত। আর এ মানুষগুলো জমি সম্পৃক্ত, জমির সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে আলাদা করা যায় না। কওছার ইট ভাটার মুটে বটে কিন্তু সামান্য চাষ আবাদও করে। পটল খেতে এবার উৎপাদন ভালো হয়নি। পার্শ্ববর্তী আলে ভিন্ন মানুষের আম গাছ লাগানোয়। যা জমিকে ছায়া করে দিয়েছে। মেম্বারকে বলেও লাভ হয়নি। এই ইতিবৃত্তকে ধরে লেখক জমিনির্ভর মানুষের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, জীবন সমীকরণে বিশ্লেষণের আলো ফেলেন। সাবেরার সঙ্গে শ্বশুর আমির আলির মূল্যবোধ মেলে না। সময়ের বিবর্তনে জটিলতা, জীবনের স্বর ও মূল্যবোধের বদল ঘটেছে। আমির আলির কাছে অন্যের জমিভাগ রেকর্ড করা অন্যায়। যার জমি এতদিন চাষ আবাদ করে সংসার চলেছে সেই জমি নিজের নামে বর্গা রেকর্ড করলে আল্লা ক্ষমা করবে না। সাবেরা আজকের মেয়ে. জীবনের দাবি ও সময়ের দাবি তাঁর কাছে অনেকখানি বেশি। ফলত কওছার উভয় সংকট পড়েছে। পিতার মূল্যবোধ, নীতিনির্দেশ, স্ত্রীর ভোগদখল। কোনো পথই নির্ধারণ করতে পারেনি। দ্বিধা থরথর চিত্তে, দ্বিমুখী দ্বন্দ্বে ভেসে গেছে। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব বড় হয়ে ওঠে। পিতা আমির আলি বর্গা রেকর্ডের বিরুদ্ধে, পুত্র কওছার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বর্গা রেকর্ডের। পুরাতন মেম্বর-নতুন মেম্বরের দ্বন্দ্ব আছে। আছে রাজনীতির দ্বন্দ্ব। পরাজিত কংগ্রেস একদা ছিল জমিদার, মহাজনের পক্ষে, ক্ষমতায় এসে সিপিএম শ্রেণি সংগ্রাম শক্তিশালী করতে, সর্বহারা মানুষকে পার্টিতে রাখতে বর্গা রেকর্ড শুরু করেছে। লেখক বড় জটিল ভাষ্যে, সংকটের বিবিধ পরম্পরাকে চিহ্নিত করতে করতে সময়ের আর্তনাদকে পাক খাওয়ান।
অমর মিত্র লিখেছিলেন—চাষার জমি চাষার হৃদয়। আবার তিনিই দেখিয়েছিলেন জমি প্রকৃতপক্ষে মালিকানা বদলের ইতিহাস। সোহারাব হোসেন জমিকে কেন্দ্র করে, জমিকে সামনে রেখে মানুষের আকাঙ্ক্ষা, মোহ, সংগ্রাম লড়াই কতভাবে ছড়িয়ে পরে, জমির প্রতি আকর্ষণ ব্যক্তিকে কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়, মাঠের রহস্য মেঠো মানুষকে কীভাবে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়াশীল প্রাণবন্ত উত্তেজনায় ভাসিয়ে দেয় তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। একদিকে পুত্র কওছারের বর্গা রেকর্ড করে জমিতে আত্মপ্রতিষ্ঠার আইনি লড়াই, রাজনৈতিক লড়াই অন্যদিকে দীর্ঘদিনের চাষাবাদের জমিতে বর্গা করা অন্যায় নিয়ে পিতা আমির আলির মূল্যবোধের লড়াই। জমির উপর ব্যক্তি মালিকানা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, দাদু জামির আলির অথর্ব দেহ তত জেগে উঠছে। চরিত্রগুলি জমি, সময়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। জামির আলি তেভাগা, আমির আলি ভাগচাষি, কওছার বর্গাদার। জমির প্রতি মায়া মমতা, ভালোবাসা শ্রদ্ধা যেন জাদু স্বরূপ। জমি মানুষকে জাগাচ্ছে, নিভিয়ে দিচ্ছে। সোহারাব হোসেনের এ লেখায় কোনো ফাঁকি নেই। তা কৃত্রিম নয়। আন্তরিক সহানুভূতি ও জমি-মানুষকে নিবিড়ভাবে জানার প্রত্যক্ষযোগ এবং উপস্থাপনের অভিনব ভঙ্গি যা একেবারেই জমি সম্পৃক্ত তার রসদ উপন্যাসকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
জমি বিবাদের অতলপ্রদেশে নেমেছেন লেখক। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্তরে স্তরে জমি মানুষের জীবনচিন্তা, দখলনামা, গ্রাম্য কেচ্ছাকে নির্মাণ করেছেন। জমি, বর্গা, কোর্ট, জে.এল.আর.ও, উকিল, সিজ, আদালত, মিথ্যা সাক্ষী, পুরাতন মেম্বার-নতুন মেম্বারের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে লড়াই, আইনের শলা পরামর্শ নিয়ে মাটি মানুষের সামগ্রিক ইতিবৃত্ত যে দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেন তা যথার্থ সমাজবাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠা করে। জমি-মানুষকে কেন্দ্র করে ভূমিসর্বস্ব মানুষের যত জটিলতা আছে, জমি মানুষ জীবনের পাকে পাকে কৃষিকে কেন্দ্র করে কত বৃহত্তর চক্রান্তে ক্রমেই লিপ্ত হতে পারে, সেই সঙ্গে সময়ের রাজনীতি, ক্ষমতা দখলের লড়াই কত প্রকারন্তে মানুষকে নাচিয়ে তুলতে দক্ষ—তার একাধিক বয়ান আখ্যানের শক্তিকে প্রমাণিত করেছে দক্ষ লেখনীতে।
তেভাগা আন্দোলন থেকে কৃষকের অধিকার নিয়ে যে ভিত্তিভূমি তৈরি হচ্ছিল তা হরেকেষ্ট কোঙরের ‘লাঙল যার জমি তার/চাষ জমি দখল করে/দখল জমি চাষ কর’ হয়ে নকশাল আন্দোলন পরবর্তীকালে অপরাশেন বর্গার মধ্য দিয়ে যেন পূর্ণতা পেল। যে আইন সিদ্ধার্থশংকর রায় পাশ করেছিলেন তা বাম সরকার ক্ষমতায় থেকেও পার্টি দ্বারা কৃষকের অধিকারকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তেমনি কৃষিকে কেন্দ্র করে, জমি মানুষের অধিকারকে সামনে রেখে কৃষিতে রাজনীতি প্রবেশ করল। চাষিবাসি মানুষ শুধু লালঝাণ্ডার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিল না সে রাজনীতির অংশ হয়ে উঠল। ইতিহাসের পর্বান্তর, মাটি মানুষের ছক বদলের মধ্য দিয়ে এ আখ্যান তার বৃত্ত নির্ধারণ করে চলে। শাসক-শোষণ, খাদ্য-খাদক, মেম্বার-মাতম্বর, জমির চরিত্র, চাষাবাদকে সামনে রেখে লেখক স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন গ্রাম বাংলার মানচিত্র এঁকে চলেন। কেন্দ্রে হাসনবাদ পটভূমি হলেও বৃহত্তর অর্থে তা পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত গ্রাম বাংলার পটচিত্র।
মাঠ, মাঠের মানুষকে লেখক ভাসিয়ে দিয়েছেন লোককথার ঢঙে। সোহারাব হোসেন ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে বারবার জোর দিয়েছেন দেশজ রীতির উপর। তাই মাঠপরি, কথোয়াল, স্মৃতিকথা, ছড়া এসে উপস্থিত হয়। মাঠ, ভূমিজ মানুষের বর্ণনায় ফসলের উপমা, রূপকথা-উপকথার ধাঁচ, গ্রামীণ চিত্রকল্প এনে আখ্যানের সতেজতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছেন। সোহারাব হোসেন মানুষকে এঁকেছেন মাঠের কাব্যে। নকশী কাঁথার মোড়ানো ফসল মাটির চাদরে। সমাজের নিম্নপ্রদেশের ভাষা সংস্কৃতি, জীবনযুদ্ধ, সাংসারিক ভাবকেন্দ্র, অস্তিত্ব সংগ্রামকে তিনি নিখুঁত পর্যবেক্ষণে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্যে সামগ্রিক রূপরেখায় পৌঁছতে চেয়েছেন। প্রথম খণ্ডের সমাপ্তিতে মৃত্যু ঘটেছে দুটি চরিত্রের—জমির আলি, আমির আলি। লেখক কৌশল পরায়ণ বাস্তবতায় দুই সময়ের প্রতিনিধির বিদায় সংকেত ঘোষণা করে দিচ্ছেন। মূল্যবোধের পরাজয়ে, নিজের দীর্ঘদিনের ভাগচাষের অপমানে, নব্য ধারণার কাছে উৎক্ষিপ্ত হবার কারণে আমির আলির মৃত্যু মেনে নেওয়া গেলেও জামির আলির মৃত্যু রহস্যময়। মাঠের জাদুই যেন মাঠপরি সাবেরার অনুপস্থিতিতে অদৃশ্যশিল্পে নিয়ে গেছে। বিভ্রান্ত বাস্তব থেকে লেখক সচেতন বাস্তবে যেমন ফিরেছেন তেমনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি পৌঁছতে চেয়েছেন শিল্পের বাস্তবে। না বাস্তব-হ্যাঁ বাস্তবের সমান্তরাল সীমারেখা ধরে আকাঁড়া বাস্তবের যাবতীয় সত্যকে ছিন্নভিন্ন করে নির্মাণ করেছেন শিল্পের বাস্তব।
লেখক বৃহৎ পর্বে জমি মানুষের পর্বান্তরের মধ্য দিয়ে মহাকালের চলমানতা অঙ্কন করেছেন। তেভাগা-বর্গা অপারেশন-সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম হয়ে জমি মানুষের হাতবদল ও রাজনীতির খতিয়ান নির্মাণ করেছেন। যদিও সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের বদলে তা বসিরহাট সংলগ্ন ভিন্ন শিল্পের পটভূমিতে নির্মিত। আখ্যানের সূচিত প্লট যেহেতু বসিরহাট, হাসনবাদ তাই শিল্পকে এই কৃষি জমিতে দাঁড় করিয়েছেন। জমি যে মানুষের প্রাণ, জমির সঙ্গে যার ঘরবসত, জমি যার সন্তান স্বরূপ সে জমির হস্তান্তর চায় না, লাভের অঙ্ক বোঝে না। কওছার-সাবেরার পরবর্তী প্রজন্ম সুবিদ আলি আপাত শিক্ষিত বলেই জমিতে নামেনি, জমির মর্ম বোঝেনি। চাকরি জোটেনি স্বল্প পড়াশোনায়। কর্মসংস্থানের প্রয়াসে শিল্পের দিকে মত প্রদান করেছে। অক্ষম আর্তনাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ সাবেরা। হাসনবাদের বর্গা আন্দোলনের প্রতিবাদী কন্যা, পরবর্তীতে লোকমুখে ঘোষিত সংগ্রাম নেত্রী, জমি অন্তঃপ্রাণ সাবেরা দেখছে জমি হাতছাড়া হতে চলেছে। নবীন-প্রবীণ, কৃষি-শিল্পের দ্বন্দ্ব ঘটে। লাভ-লোকসান নয়, রাজনীতির ভাষ্য নয়, পরিবর্তন-প্রতিক্রিয়াশীলতার ভাষ্য নয়, গ্রহণ-প্রত্যাখ্যানের ভাষ্য। নিজের জীবন থেকেও, স্বামী থেকেও জমিকে ভালোবাসা মানুষ শিল্পকে মেনে নিতে অক্ষম। নিজের সত্তাকে কে বিক্রি করে দিতে চায়? সোহারাব হোসেন এই সমাজ বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে, ব্যক্তি মানুষের গহনকাননে গিয়ে। হ্যাঁ গ্রাম বাংলায় এমন জমি অন্তঃপ্রাণ মানুষ আজও আছেন। বিরাট লাভের সম্মুখেও জমি ছাড়তে নারাজ। আসলে জমি যেন সত্তার অংশ হয়ে আছে, জমি হারানোর অর্থ যেন নিজেকেই বিপন্ন করা।
সোহারাব হোসেন ব্যক্তির মূল্যবোধকে ভাঙতে চাননি। সময়ের অন্তরালে যে নতুন মূল্যবোধ গড়ে ওঠে যার সম্মুখে প্রাচীন ধারণা ধাক্কা খায়—সময়ের শাশ্বত সত্যকেই তিনি নির্মাণ করে চলেন। বাস্তবকে বিকৃত বা অসম্পূর্ণ নয় সম্পূর্ণ বাস্তবকে প্রতিফলিত করেই শিল্পের সত্যে পৌঁছতে চেয়েছেন। ভ্রাতৃঘাতী চোরাটান, কৃষি-শিল্পের দ্বন্দ্বে ভাই ভাইয়ে মতান্তর, প্রবীণ-নবীন প্রজন্মের মতান্তরের মধ্য দিয়ে কালিক সত্যকে নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। একদা পিতা-পুত্র আমির আলি-কওছার আলির মধ্যে জমির দখল নিয়ে মতান্বর ছিল। পিতা আমির আলি প্রাচীন মূল্যবোধ, জমিচিন্তা বিসর্জন দেয়নি কিন্তু নবীন কওছার আলির কাছে পরাজিত হয়েছিল। আজ কওছার আলির জমি চিন্তা পরাজিত হচ্ছে ভাইপো সুবিদ আলির শিল্পচিন্তার কাছে। কালক্রমকে সামনে রেখে কালিক সত্যের বিচূর্ণরাশি, অভিজ্ঞানের নির্যাস ও প্রবণতামুখী মানুষের জীবনধর্ম লেখক প্রতিষ্ঠা করে চলেন।
কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে জমি রাজনৈতিক ইস্তেহার, মসনদ দখলের প্রেক্ষাপটও বটে। জমিকে কেন্দ্র করে সুবিধাবাদী রাজনীতিতে যে অংশগ্রহণ করতে পারবে রাজনৈতিক লাভ তার তত বেশি। সেদিন ক্ষমতায় এসে পুরাতন পার্টি কংগ্রেসকে প্রায় ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল সিপিএম জমি হস্তান্তর করে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কংগ্রেস আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আজ জমিকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে উদ্গ্রীব সিপিএম। কিছু অনিচ্ছুক কৃষককে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে নেমে গিয়েছিল সেদিনের নবাগত পার্টি তৃণমূল। নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্বে মানুষ সেদিনও নতুন পার্টিকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু কৃষি-শিল্প দ্বন্দ্বে নবীন প্রজন্মের সুবিদ শিল্পের পক্ষে থাকলেও প্রবীণ সাবেরা, কওছার কৃষির প্রতিই ছিল। কওছার, সাবেরায় সত্তার সঙ্গে জমি ওতোপ্রেতভাবে জড়িত, তারা উন্নয়ন লাভ লোকসান বোঝে না। জমি ছিল তাদের প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি তাই কোনো প্রক্রিয়াতেই জমি হাতছাড়া করতে নারাজ। তেমনি কালের কাছে যেন কওছার, সাবেরারা হেরে যাচ্ছে। দিনবদলের খেলায় আজ আর তেমন ম্যাজিক নেই—“বর্গা লড়ার দিনি বড়ো—মেজিক ঘটত। বড়ো সোমায় ধোরে ঘটতো। অ্যাখন ছোটো-মেজিকির যুগ! তাই বড়ো ভবিষ্যতের খবর এতোডা আগাম বোলতি পারবো না।” (পৃ. ২৬৭) প্রকৃতপক্ষে বৃত্ত ছোট হয়ে এসেছে। বৃহৎ ঘটনার আঁচ অপেক্ষা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা ব্যক্তি, সময়ের গহ্বরে ঢেউ তুলছে।
দ্বিতীয় খণ্ডের পটভূমি জমিকে শিল্পে পরিণত করার বিবাদ। আর তা পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক আন্দোলনকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছে। বলা ভালো এখানে আখ্যানের শিল্পমূল্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে। প্রথম পর্বে যে উচ্চকিত শিল্পবোধে মাঠ ও মাঠের কাব্য রচনা করেছিলেন তা দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে কৃষি শিল্পের দ্বন্দ্বে, সরকার-বিরোধীপক্ষের লড়াইয়ে এতটাই বাস্তব যে আখ্যানের ন্যারেটিভ দুর্বল হয়ে যায়। মহাকাব্যিক উপন্যাসের জন্য যে দার্শনিক প্রত্যয়, সংবেদনশীল ভাষাযুদ্ধ প্রয়োজন তাও অনুপস্থিত। তবে কৃষি-শিল্পের দ্বন্দ্ব ঘটিয়ে, পক্ষ-বিপক্ষের বাদ বিবাদে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তাদের উদ্দেশ্য যে পুরোটাই অসৎ তা দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেছেন। এ আখ্যানের নায়ক কওছার। সে শেষপর্যন্ত জমিকে বাঁচিয়েছে। জমির জন্য লড়াই দিয়ে, জমিকে আত্মরক্ষার ভূমি করে, নতুন প্রজন্মের চাহিদার হাত থেকে রক্ষা করে সময়ের পাঠকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মাঠ ও মাটির কাব্য হয়ে উঠেছে এ আখ্যান। জমিই রাজনৈতিক পটভূমির ইস্তেহার, এ মাটি জাদু জানে যা মানুষকে কেবলই নাচিয়ে চলে—সেই জীবনভাষ্য এ আখ্যান।
পাঠকরা শুনতে চাইলে ইউটিউব লিংক রইল
পুরুষোত্তম সিংহ। ঘোষপাড়া, সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর। ৭৩৩১২৩।৮৭৫৯১০৪৪৬৭।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।