ইদের দিনের সবচেয়ে জরুরি কাজ যেটা, মানে নামাজটা পড়ার পরে যখন ইদের আর কোন আইনকানুন থাকে না তখন যা থেকে যায় তা হচ্ছে খাওয়া দাওয়া! এক মাস রোজা রাখার পরে মুখ খুলে গেল, এবার খাও। এই খাওয়ার নানা তরিকা আছে, নানা রঙের আছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গেলেই চেহারা ভিন্ন হয়ে যায়। সার্বজনীন একটা বিষয় থাকেই পাশাপাশি অঞ্চলভেদে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন চেহারা। আমি যেহেতু পুরো বাংলাদেশের গল্প জানি না তাই সেই চেষ্টায় যাব না। আমি বরং আমার আশেপাশের গল্পই বলি আর বলি যাদের গল্প জানি তাঁদের কথা।
আমাদের বাড়ির ইদের খাবারের গল্প বলতে গেলে মূলত আমার মায়ের কথাই বলা হবে বেশি করে। ছোটবেলায় আম্মাকে দেখতাম আমাদের ঘুম ভাঙার আগেই কোন জাদুবলে সেমাই, নুডলস, দুই এক রকমের পিঠা একদম 'রেডি টু ইট' বানায় বসে আছে। আমরা তখন এটাকে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে করতাম। আমরা বুঝতেই পারতাম না কীভাবে সম্ভব হল এই জিনিস। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে গ্যাসের কোন বালাই ছিল না। মাটির চুলা, কাঠ খড়ি কিংবা গাছের শুকনো পাতা হচ্ছে জ্বালানির একমাত্র ভরসা। এই দিয়ে কী দারুণ করে তৈরি করে ফেলতেন সব কিছু।
সেমাই মুখে দিয়ে, দুই একটা তেলের পিঠা পেটে চালান করে, এক মাস পরে সকালে চা খাওয়ার সুযোগ পেয়ে আর তা না হারিয়ে পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দৌড় নামাজের জন্য। আব্বা চলে যেত আমাদের অনেক আগেই। আমরা নানা অছিলায় সময় ব্যয় করে শেষ মুহূর্তে দৌড়ে কোনমতে ইদগাহের শেষের দিকে কোন জায়গায় কিংবা রাস্তায়, পাশের টেনিস কোর্টে বসে যেতাম। নামাজ আদায় হতেই, আবার দৌড় বাড়ির পানে। আমরা বাড়ি পৌঁছে যেতাম, আব্বা আসত একটু দেরি করে। আব্বা আসলে জেঠতুতো ভাইদের সঙ্গে আমরা গোরস্থানে দাদা, দাদির, জেঠার কবর জিয়ারত করে ইদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতাম।
আবার আম্মার জাদু! এর মধ্যেই আরও কত কিছু তৈরি করে ফেলেছেন। খিচুড়ি, ডিমভাজি সকালের খাবার হিসাবে তৈরি। আবার সাথে চটপটিও কখন যেন তৈরি করে ফেলেছেন, হয়ত জর্দাও বানানো হয়ে গেছে। আমরা খেয়েই দৌড়। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে সালামির টাকা জোগাড় করা হলে তবে শান্তি। দুপুরে আমাদের বাড়িতে অবশ্যই পোলাও রান্না হত। আর আম্মা কোনদিন পোলাও ঘি ছাড়া রান্না করতেন না। যার কারণে তৈরি হত এক অসাধারণ স্বাদের পোলাও, সঙ্গে গরুর মাংস, মুরগি! আমরা স্বর্গে। এখানে আরও একটু বলে রাখি ব্যক্তিগত আলাপ। আব্বা এই পোলাও রান্না করাটাকে আইনে পরিনত করে ছিলেন। আম্মা চলে যাওয়ার পরে যখন ভাবির হাতে রান্নাবান্নার ঢাল তলোয়ার আসল। তখন একবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যেহেতু আপারা সবাই পরেরদিন আসবে বাড়িতে, তাই পোলাও পরেরদিনই রান্না হবে। আমরা ইদের দিন আর পোলাও মাংস খাব না। ভাত মাংসই চলবে! আমার খুব অস্বাভাবিক লাগে নি এই সিদ্ধান্ত। আর ইদের দিন এমনিও আমার বাড়িতে খাওয়া খুব কমই হত। তাই আমি অত চিন্তাই করি নি। কত বড় ভুল হয়ে গেছে তা বুঝলাম বাড়িতে ফিরবার পর। আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, শরীফ, ইদের দিন পোলাও রান্না করে নাই! ইদের একটা দিন বাড়িতে পোলাও রান্না হবে না? আব্বা প্রচণ্ড শক খেয়ে বসে আছেন। আমি মিনমিন করে বললাম কালকে বড়পা, মেজোপারা আসবে, তখন রান্না করবেই তাই আজকে আর করে নাই। আব্বা অবাক হয়ে বললেন, এর সাথে ইদের দিন পোলাও রান্না না করার কী সম্পর্ক? আমি মাথা চুলকালাম, ঘাড় ডলাডলি করলাম কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারলাম। যাই হোক, আব্বা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন আর এই ভুল হয় নাই।
আগেরদিনের আলাপ হল এতক্ষণ। সময় আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবারের বৈচিত্র্য আসা শুরু হল। সকালের নাস্তায় চলে আসল নুডলসের সাথে পাস্তা, পুডিং, কাস্টার্ড, ফালুদা, কয়েক পদের সেমাই। লাচ্ছি সেমাই, শুকনা সেমাই, নবাবি সেমাই! দুপুরের খাবারে মাংস ভুনা হল, রেজালা হল, সাদা গরু হল, সাদা মুরগি হল, কোপ্তা হল, টিকিয়া হল! কাচ্চি বা শুধু পোলাও কিংবা মোরগ পোলাও, গরুর তেহেরি! দই, মিষ্টির সাথে বোরহানি যোগ হল। আর আমরা খেয়েই মরব বলে তৈরি হয়ে বসে যেতে লাগলাম! এই শেষ, ইদের পরেই মুখে লাগাম লাগব বলে কসম কেটে খেতে বসতে লাগলাম!
গ্রামের নানা রকমের পিঠা তৈরি হয় এখনও। তেলের পিঠা বা যাকে পোয়া পিঠাও বলা হয় তা প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি হয়। সাজ পিঠা নামের একটা পিঠা আম্মা তৈরি করত। আব্বা আর আমার দুজনেরই অতি পছন্দের পিঠা এইটা। ইদের দিন আম্মা এইটাও বানাত। গ্রামের দিকে এখনও বানানো হয় এই জিনিস। আউলাকেশি বা এলোকেশী নামের একটা পিঠা আছে। চালের গুঁড়ো পাতলা করে গুলে নিয়ে হাতের আঙুল দিয়ে কী এক কৌশলে ফেলা হয়, সুতার মত একটা আরেকটার উপরে জমা হয়ে যায়। চালের গুঁড়ো গুলে সিরিঞ্জের ভিতরে ঢুকিয়েও পিঠা তৈরি হয়। পরে সিরিঞ্জ চাপ দিয়ে হাতের কৌশলে নানা রকমের ফুল তৈরি করা হয়। রঙ মিশিয়ে রঙিনও তৈরি হয় এই ফুল। আউলাকেশি বা সিরিঞ্জ পিঠা দুইটাই পরে রোদে শুকিয়ে রেখে দেওয়া হয়। খাওয়ার সময় তেলে ভেজে চিনি ছিটিয়ে দিয়ে খাওয়া হয়। এই জিনিস সিরিঞ্জ ছাড়াও আরও নানা কৌশলে তৈরি হয়। পরে রোদে শুকিয়ে একই প্রক্রিয়ায় খাওয়া হয়। ইদের দিনের খাবারের মধ্যে অনেক বাড়িতেই এই জিনিস অবধারিত।
আমি এবার একটু বাইরের দিকে তাকাই। যদিও খুব বেশি জানার সুযোগ হয় নি আমার। বিভিন্ন এলাকার ইদের খাবার সম্পর্কে জানতে হলে সেই এলাকার ইদের খাবার খেতে হয়। এতখানি ডাঙ্গর হয়েছি, আজ পর্যন্ত ঘরের বাইরে ইদ করা হয় নি। তাই অভিজ্ঞতা থেকে লিখব সেই সম্ভাবনা শূন্য। নানা সময় শোনা, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে জানা বিদ্যাই যে এখানে প্রসব হবে তা ধরে নিতে পারেন নিশ্চিন্তেই।
ইদের দিনের খাবার মূলত একই সব দিকে। তবে কিছু কিছু জায়গায় আলাদা কিছু ব্যাপার আছে। যেমন আমাদের পাশের জেলা জামালপুর। তাদের খুব পছন্দের খাবার হচ্ছে মিল্লি! মিল্লি কি জিনিস? মিল্লি হচ্ছে চালের গুঁড়োর পিঠালি দিয়ে গরুর বা মহিষের মাংস রান্না। মানুষ পাগলের মত খায় এই জিনিস। শুধু ইদ না। বড় কোন আয়োজনেও তাদের প্রথম পছন্দ হচ্ছে মিল্লি। আমার দুই একবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে এই জিনিস। অতুলনীয় এক খাবার এই মিল্লি। চালের গুঁড়ার সাথে মাংস! শুনে চোখ কপালে আমারও উঠেছিল। কিন্তু এর স্বাদ সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। শেরপুরের চরের দিকেও এই জিনিস খাওয়ার চল আছে। আগে থেকে মাইক মেরে ঘোষণা দিয়ে মহিষের মিল্লি তৈরি করে বাজারে বিক্রি হয়। মানুষ কেজি দরে কিনে নিয়ে খায়!
সৈয়দপুরের দিকে শুনেছি লুচি তৈরি করে ইদের দিন। সাথে কলিজা ভুনা কিংবা হালিম। তবে এই খাবার যার কাছ থেকে শোনা তাদের নিজস্বও হতে পারে। সৈয়দপুর অঞ্চলের খাবার দাবি করার কোন চেষ্টা আমি করছি না। তবে বিক্রমপুরের লোকজন যে নারিকেলের চিঁড়া তৈরি করে ইদে খায় তা কিন্তু সত্য। নারিকেলের দুধে তৈরি পোলাও খায়, শোনা কথা, খেয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। ইদ বা নন ইদ, বিক্রমপুরের মানুষ খুদের ভাত খায়, যাকে তারা বলে বউয়া ভাত! এই জিনিস ভর্তা দিয়ে খায়। এর জন্য কয়েক রকমের ভর্তা তৈরি করা হয়। বিক্রমপুরের মানুষ পদ্মার কাছাকাছি থাকে বলে হয়ত ইলিশ তাদের পদ থেকে বাদ যায় না। তৈরি করে ইলিশের পিঠা, ইলিশের পোলাও!
পদ্মার আশেপাশের জেলাগুলোতে সম্ভবত সবাই ইলিশকে প্রাধন্য দেয় ইদের খাবারের বিষয়ে। যেমন শরিয়তপুরের মানুষজন ইদে ইলিশ খায়। তবে একটু ভিন্ন রকম করে। তারা শুধু হলুদ আর লবণ দিয়ে ভেজে খাবে ইদের দিন! অন্য সময়ও এই জিনিস খায় তবে ইদে জরুরি একদম।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার হচ্ছে বাখরখানি। ইদে তারা এই বাখরখানি খায় তবে একটু ভিন্ন তরিকায়। ঘন দুধে ভিজিয়ে সেমাই তৈরি করে খায় ইদের দিন। নেত্রকোনার দিকের মানুষ আবার হাতে তৈরি সেমাই খায়। রাজ্যের পিঠা তৈরি করে আর এই হাতের সেমাই। ইদের দিন চলে সেমাই খাওয়া আর পিঠা খাওয়া। পিঠা আসলেই প্রায় সব এলাকার প্রধান অনুষঙ্গ ইদের খাবারের। ময়মনসিংহের ত্রিশালের দিকে বিশাল আয়োজন করে চলে পিঠা বানানো। ইদের বেশ আগে থেকেই শুরু করে তারা পিঠার প্রস্তুতি। চলে চান রাত পর্যন্ত। এই দিকে আবার নতুন একটা জিনিস খাওয়া হয়। জর্দা তৈরি করা হয় চাল দিয়ে আবার সেমাই দিয়ে! সেমাইয়ের জর্দা সম্পূর্ণ নতুন এক জিনিস, তা অন্য এলাকায় খাওয়া হয় কি না আমার জানা নাই। এদিকের মানুষ কোরমাও করে, ইলিশের কোরমা, খাসির কোরমা, গরুর মাংসের টিকিয়া! লুচিও চলে তার সঙ্গে।
মাংসের ক্ষেত্রে সব দিকে প্রায় একই রেসিপি অনুসরণ করা হয়। তবে কিছু এলাকার আলাদা বৈশিষ্ট্য থেকেই যায়। খুলনা বাগেরহাটের লোকজন অবধারিত ভাবেই চুই ব্যবহার করে তাঁদের মাংস রান্নায়। তারা পারলে মাছের সাথেই চুই খায়। অন্যদিকে একই রকম ভাবে সিলেটের লোকজন গরুর মাংসে ব্যবহার করে সাতকড়া। সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস এক অনবদ্য জিনিস। আমার অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে চুইঝালের গরুর সঙ্গে অন্য কোন কিছুরই তুলনীয় মনে হয় না।
মানচিত্রের এপার থেকে ওপার, সব জায়গায় একটা জিনিস দারুণ ভাবে মিলে যায়। তা হচ্ছে ইদের পরেরদিন চালের গুঁড়ার রুটি আর আগেরদিনের মাংস! কোনো কোনো জায়গায় চালের গুঁড়োর পরিবর্তে আটার তৈরি পরোটাও খাওয়া হয়। আমাদের বাড়িতেও পরোটা খাওয়া হয়। আগেরদিনের মাংস জ্বালে জ্বালে অন্যরকম একটা স্বাদ তৈরি করে। মাংস না ঝোল বোঝার উপায় নেই এমন পরিস্থিতি, তাতে রুটি বা পরোটা ডুবিয়ে খাও!
এইটা জমে বেশি কুরবানির ইদের পরেরদিন। মাংসকে আর মাংস বলে চেনা যায় না, স্বাদ গিয়ে ঠেকে আকাশে! উম্ম...
যেহেতু ইদের নামাজের পরে আর কোন ধর্মীয় আচার নাই ইদের তাই ইদ হয়ে যায় খাওয়া, আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানো। এর মধ্যে খাওয়াটা মানুষ নিজের মত করে, যা দিয়ে তিনি তৃপ্তি পান তা দিয়েই আপ্যায়ন করেন, নিজেরা খান। মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ছে তত নানা বৈচিত্র্য আসছে ইদের খাবারে। এখন অনেকই নানা পদের কাবাব, নানান ধরণের বারবিকিউ, ফ্রাইড রাইস, নানা ধরণের সালাদ, কেক, মৌসুমি নানা ধরণের ফল ইত্যাদি নিজেদের ইদ খাবারের মেনুতে রাখছে। আমি মোটামুটি পেটুক মানুষ আর সুযোগ পেলেই নানা মানুষের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেই, সুযোগ বুঝে তাঁদের রসুই ঘরের সন্ধান মোটামুটি জেনে যাই, জেনে যাই অবশ্যই নিজস্বার্থে। আশা রাখি একদিন হানা দেব এমন সব বিচিত্র খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে!
এই ইদে মন খুলে পেটপুজো করুন, কারণ এর চেয়ে বড় আরাধনা আর নাই। সবাইকে ইদ মোবারক।