প্রচণ্ড দাবদাহে, গরমে ইফতারের জন্য ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা দই ও পানি বার করছিলাম শরবত করবো বলে, আমার দুগ্ধজাত সন্তানের জন্য আমি এবছর রোজা রাখিনি, হঠাৎ মনে এলো সেই ছেলেবেলার কথা,আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়লাম।
ইদ চলে গেল।
ছেলেবেলায়,আবছা যতটা মনে পড়ে, তখন শীতকালে রোজা হতো,গরমে রোজা হয় জানতাম না, শীতকাল মানেই রোজা ও ইদ!
বাড়িতে ফ্রিজ ছিলনা, গ্রামে কারো বাড়িতে কোথাও ছিল না, যতটুকু ছিল ঐ মিষ্টি দোকানে বোধহয়।
শীতকালীন রোজা তাই ঠান্ডা পানির দরকার পড়তো না, ঠান্ডা পানি পাওয়াও যেতো না।
ভোরবেলা মা সেহেরি খেতে উঠতো রসকরা দিয়ে পানি ঢালা ভাত, আমি সকালে উঠে কাঁদতাম ডাকলে না কেন?
সন্ধ্যা মানেই ফল নুন লেবু চিনির শরবত ছোলা ভুনা মুড়ি। আহ্।অমৃত। দই দিয়ে শরবত তখন ভাবনাতেই আসেনি।
রোজার শেষের দিকে আব্বার সঙ্গে জামা কিনতে যাওয়ার কী অসাধারণ উত্তেজনা ছিল প্রকাশ করার মতো সে ভাষা আজ আর নেই। আর সব চাচাদের ছেলে মেয়েরা কী কী কাপড় কিনেছে এই দেখা নিয়ে হৈচৈ হতো। আর সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসতে ইচ্ছে করতো না। আমরা মাটির দোতলায় থাকতাম, নিচের কোলাহল আমাদের এমন টানতো যে মা আর পড়ার জন্য জোর করতো না।
ইদের দিন সকালে মা গরম পানি করে কাকিমার ঘরের ছাদে সাবান শ্যাম্পু মাখিয়ে গা ধোয়াতো, তারপর নতুন জামা পরিয়ে, চুলে ক্লিপ বেড়ি (হেয়ার ব্যান্ড) লাগিয়ে, পন্ডস বডি লোশন গায়ে ও মুখে পন্ডস ক্রিম লাগিয়ে, লিপস্টিক কাজল টিপ দিয়ে সাজিয়ে এমনকি জুতো পরিয়ে দিতো, তারপর দুই ভাইকে পাঞ্জাবি পায়জামা পরিয়ে আব্বার সঙ্গে আমাদের পাঠাতো ইদগাহে।
তখনো মেয়েরা তৈরি হইনি, মেয়েদের ইদগাহে যেতে নেই, মেয়েরা ছেলেরা একসঙ্গে তৈরি হয়ে কী হবে? আগে ছেলেরা স্নান করে তৈরি হয়ে চলে যাক। তারপর ঝট করে স্নান করে রান্নাঘরে রকমারি রান্না করতে বসে পড়ার মত মেয়ে হইনি।
মা কোন কাকভোরে সিমুই করতো জানি না, ইদগাহ থেকে এসে দেখতাম মা সুতির ছাপা শাড়ি সম্ভবত মিনু শাড়ি পরে চোখে সুরমা পরে আমাদের দলিজে দাদির জায়ের তত্ত্বাবধানে নামাজ পড়তো,তারপর সিমুই খেতে দিত।
মাকে ওইভাবে এত সুন্দর লাগতো পৃথিবীতে কাউকে তখন এত সুন্দর লাগেনি!
সিমুই তখন বড়বাবু (জেঠু), মেজ চাচা ও আর চাচারা এবং বাস্তব চাচা সবাইকে দেওয়া হতো, তারাও আমাদের দিতেন, কাদেরটা কতটা ভালো এই নিয়ে খোশমেজাজে কথা হতো। সবাই তখন এক বাড়িতে থাকতো। চাস্ত চাচারা যে চাস্ত তাও জানতাম না, সবাই নিজের!
সমবয়সী চাস্ত বোন (জাঠতুতো/খুড়তুতো) রুকিয়া ছিল সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। তার সঙ্গে পাড়াতে দুটো খামার ছিল সেখানে সেজেগুজে একটু ঘোরা হতো।
দুপুরে মাংস-ভাত, বিরিয়ানি তখনো দুষ্প্রাপ্য। বিকালে আব্বার সঙ্গে নানিমাদের বাড়ি যাওয়া।
এখন বড় হয়েছি, নিজে মায়ের ইফতারের ব্যবস্থা করি, ইদে এখন আর মা রেডি করে দেয় না, রেডি হওয়ার তাড়া থাকে না। শুধু নতুন একটা নাইটি,তাও আব্বা ভায়েরা ইদগাহে যাওয়ার পর স্নান করি, রান্না ঘরে বিরিয়ানি করতে মাকে সাহায্য করি।
মা এখন আর ছাপা মিনু শাড়ি পরে না। চোখে সুরমা দেয় না। নতুন একটা নাইটি এই গরমের ইদের দিন তারও পোশাক।
বিকালে নানিমাদের বাড়ি আর যাই না। ওই ফোনে নানিমার সঙ্গে কথা। ভায়েরা বাইকে করে বেড়াতে যায়। মা আব্বা আমি বাড়ি থাকি।
সিমুই আর কাউকে দেওয়া হয় না।সবার আলাদা বাড়ি কি না! সব চাচাদের একজায়গায় বসে খোশগপ্পো হয় না, মাঝে বছর তিনেক হলো মেজ চাচাকে হারিয়েছি।
কিন্তু আমরা চাস্ত ভাইবোন নয়, এখনো ভাইবোন বলি সবাই সবাইকে, সবার বাড়ি বাড়ি যাওয়া হয় ইদের দিন। কে জানে, হয়তো এই মধুময় স্মৃতিটাও একসময় আর থাকবে না।