এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পুজোর পালাগান - শিবায়ন 

    Sarbani Ray লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২১ বার পঠিত
  • ( অনেক বছর আগে গুরুর পাতায় লিখেছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়ির পুজোর গল্প, মানে ঠিক গল্প নয়, সত্যি কাহিনী। সেই বর্ণনায় যদিও আমি ছিলাম ছোট্ট আমি, তবু অনেককিছুই তখনো, নিয়মরীতি, আচার সবকিছু আগের মতই ছিল, লেখার সময়কালে, আমার বড়বেলাতেও। তাই আমার খুব অবাক লেগেছিল তখন যখন অনেকে এরকম পুজোবাড়ি যে তখনো হয় বাংলার গ্রামে তা কল্পনা করতে পারেনি, ছোটবেলার নষ্টলজির কল্পকাহিনী ভেবেছিল।পরে ভেবে দেখেছি, আমার বয়স বেড়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়া যা হয়ত আমাদের পরিবারের প্রতি জেনারেশনেই হয়েছে, এবং কিঞ্চিত জাঁকজমকের স্কেলের হেরফের ছাড়া, পুজোতে খুব বদল কিছু হয়নি।হয়ত ব্যক্তিগতভাবে বাড়িগুলোর আয়োজনের রকমফের কিছু হয়েছে। যেমন আমাদের বাড়িতে আগে মা বাবার আমলে বাড়িতে রান্নাবান্না, আত্মীয় নিমন্ত্রিতর আনাগোনা, নাড়ু মুড়কি মিষ্টি তৈরির সরঞ্জামে যেরকম সরগরম থাকত, সেসব আর ছিলনা, কিন্তু অন্যান্য বাড়িতে যাদের আগে হয়ত এতটা ছিলনা, এখন হয়েছে। সেসব বাদ দিলে, মূল পুজো ও তার আনুসাঙ্গিক সমস্ত কিছুতে, একইরকম ছিল সব। কর্তাদের মুখে শোনা যেত যে একমাত্র বর্গী হাঙ্গামার বছরে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে ঘটে পুজো হয়। এছাড়া এত শত বছরে একবারের জন্যেও মা দুর্গার পুজো বন্ধ হয়নি।
    কোভিড সেই রেকর্ড প্রায় ভেঙ্গে দেওয়ার জোগাড় করেছিল, তবুও এখনকার এরা কোনোমতে ২০২০ সামলে দিয়েছিল, বাইরে থাকা লোকেরা সবাই না পৌঁছতে পারলেও, ঢাকঢোল সহকারে সব নিয়ম মেনেই হয়েছিল পুজো। কিন্তু তা হলেও আমাদের পুজো, যা আমাদের প্রত্যেকের সত্ত্বায় প্রাণের অনেকটা জুড়ে থাকে তা আমরা যেখানেই থাকি না কেন, কোভিডের কারণে সেই পুজোর আয়োজনে নেমে এল এক শূন্যতা, বন্ধ হয়ে গেল পুজোর চারদিনের শিবায়ন পালাগান!
    এই পালাগান এ দেশে সাধারণত চাষিরাই গাইত সাময়িক দল বেঁধে । তখনকার এক ফসলী ধানের আমলে, বর্ষার শেষে যখন তেমন কিছু কাজ আর থাকত না, তখন এরা মহড়া দিত শিবায়ন পালার, যার আসর বসত বাবুদের বাড়ির দুর্গাপুজার আটচালায়।অনেক বছর ধরেই, সে আমাদের ছোটবেলাতেই শুরু.........সার্বজনীন পুজো এসে, আর তার মেলা ম্যাজিক সিনেমা যাত্রার রমরমায়, শিবায়ন পালার আর বিশেষ কদর ছিলনা। তবু এ ঐতিহ্যেরই অঙ্গ হিসেবে, এতদিন ধরে আমাদের বাড়িতে চলেছিল। বয়স্ক কিছু গরীব প্রান্তিক চাষিদের একরকমের উৎসাহ, বচ্ছরকার কাটানো একটু অন্যরকম সময়, ঠাকুরের নামগান, দেখাশোনার প্রাপ্তি অনেক না হলেও তা কমও ছিলনা।এতদিন আমাদের কাছে যা জীবন্ত ছিল, পুরুষানুক্রমে, বছরের পর বছর, গ্রামবাংলার ইতিহাসের এক ধারা তা টিমটিম করে জ্বলে এতদিনে নিভে গেল।কুশীলবদের অনেকেরই যারা বয়স্ক ছিল, কোভিড তাদের সয়নি। কমবয়সীরা অনেকে সেই ক্ষতি পুরোতে অন্যভূমে পাড়ি দিয়েছে, মোটকথা দল ভেঙ্গে গেছে। রুজিরোজগারের কঠিন বাস্তবে, এই অল্প আয়ের শখের পালাগানের ঠাঁই আর হয়নি।
    আমাদের বাড়ির ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের আর দুর্গামামার রূপকথা দুচোখে নিয়ে প্রতি পুজোর সকালে ঘুম ভাঙবে না। এইসব স্বপ্নভরা ছোটবেলা যার জন্যেই হয়ত কঠিন বাস্তব কখনো সেভাবে আমাদের ভেঙ্গে ফেলতে পারেনি কারণ দিনের শেষে জানতাম আমাদের জন্যে পৃথিবীর এক কোণে অনেক মায়া নিয়ে রয়ে গেছে দিকশুন্যপুর, যেখানে স্বপ্নরা একইরকম থাকে, জামদানি পাখনা মেলে রোদে উড়ে বেড়ায়, ধানের ক্ষেতে, হলুদ বনে কলকে মধু খেয়ে।
    হারিয়ে যাওয়া শিবায়নের কিছু টুকরো রেখে যাচ্ছি এখানে। টুকরো টুকরো তে অনেক জায়গাতেই হয়ত আগেও লিখেছি, পুনরাবৃত্তি, তবু থাক।)        

     (১)
    দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে, সময় আঁকড়ে ধরতে চায় দিনকে আরো বেশী করে, দুরে সরে যায় যত আঁধার কালো। নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি,তবু সে যে রাত, গহীন অন্ধকারে ছায়া জড়ানো এক সময়। রাতের ক্যানভাসে দিনকে দেখলে,উজ্জ্বল লাগে, সবকিছু বড় মায়াময় মনে হয়।তাই শুধু এই ফিরে যাওয়া, ফিরে ফিরে দেখা!
     
    জীবনের সকালে,আমার শৈশবের পুজোও ছিল এমনি দিনের দিনের কাহিনী, সন্ধ্যে রাতে প্রায় শেষ হলেই হয়। বিদ্যুত তখনো পৌঁছয়নি গ্রামদেশের অভ্যন্তরে।ম্যাজিক আলোর রোশনাইয়ের চকমকি স্পর্শ করেনি পুজোবাড়িকে। সারাদিনের জমজমাটি, ঝিঁঝিঁ ডাকা আঁধার রাতে, টিমটিমে প্রদীপের আলোয়,অনেকখানিই ম্লান হয়ে যেতে পারত, যদি না বসত পালাগানের আসর। সে এক অন্য রূপকথা, যার স্মৃতি, মনে আজও আলোঝরা সকাল ফিরিয়ে আনে। শিশুমনে রাজা, রানী, ঠাকুরমার ঝুলির পাশে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয় গানের শিব দুর্গারা।
    পুজোর দিনের সকাল দুপুর কোথা দিয়ে যে কেটে যেত! ঘুম ভাঙত নহবতের সানাইয়ের সুরে, চিনি আমগাছে বাঁধা নহবত। উঁচু মগডাল থেকে সুরের সমুদ্রসফেন, ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়ে সারা পাড়ায়, পাড়ার সীমানা ছাড়িয়ে দুরে রাস্তায়।
    মন্দিরের পাট শুরু হয়ে গেছে কখন,সেই রাত থাকতে, ভোর হতে হতে ব্যস্ততা চরমে। ঝাড়াপোঁছা পরিস্কার সব সারা হয়ে পুজোর আয়োজন চলছে। দালানে একদিকে বেলডাল থেকে পাতা ছাড়ানো হচ্ছে, ভেতরে ফল কুচোনো, নৈবেদ্য সাজানো, প্রদীপের তেলসলতে তৈরী রাখা, পুঁথি পেতে বসে তৈরী তন্ত্রধারক।
    নিদ্রায় অচেতন তখনো পুজোপাড়া,সাধারণ লোকের উপস্থিতি আশপাশে তখনো তেমন চোখে পড়ে না, শুধু ব্রাহ্মণের দলের হাঁকডাক ছুটোছুটিতে সরগরম মন্দিরচত্বর। কর্তারা দু একজন নিমের দাঁতন হাতে, অলস পদচারণে, আলগা তদারকিতে। কিছু কাজের লোক ঘুমচোখে ঝোড়াকোদাল নিয়ে মন্থর গতিতে,দিনের সদ্যজাত আগাছা সন্ধানে। যাদের দিনের পালা, তাদের বাড়ির দুএকটি সদস্য স্নান সেরে শুদ্ধাচারে ব্রাহ্মণদের সাহায্যে রত।
    তারই মধ্যে সব কাজ হচ্ছে ঘড়ি ধরে আর পাঁজি দেখে। পুজোয় ঠিক কখন বসতে হবে ও কখন পুজো শেষ করতে হবে সেই তিথি ক্ষণের হিসেবে। এ কদিন মূল ব্রাহ্মন কে পুজো বা আরতির সময় ছাড়া অন্য সময়ে দেখা যায় মন্দির দুয়ারে, কম্বলে আসীন, পরনে গরদ ধুতি, গায়ে গেরুয়া উড়নি বা নামাবলী জড়ানো, পাঁজিপুঁথি হাতে বা পাশে রেখে একযোগে হাতঘড়ি ও একটু দুরে রাখা অ্যালার্ম ঘড়ির দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করতে।
    প্রথমে বাজে নহবত, ভোরের সানাই, ভৈরবীতে, ওঠ ওঠ রে........জাগে গৃহবাসী। পুজোর প্রস্তুতি শেষ হলে বেজে ওঠে ঢাকের বোল। মন্দিরে ঘড়ি দেখেন ঠাকুরমশাই আর সেই এক ঘড়ির সময়ে সারা পাড়াকে বাঁধে ঢাকের তাক দুম তাক দুম......।
     
    মন্দিরের সূচী ঘোষণায় বা আরতি, বলি, অঞ্জলি ইত্যাদি বিশেষে লোকজনকে আগাম তাড়া দিয়ে প্রস্তুত করতে যে বোল বাজে, তার সঙ্গে আদত অনুষ্ঠানগুলি চলাকালীন বাজনার তফাত আছে।
    পুজোবাড়ির লোক সে তফাত সহজে ধরতে পারলেও,বাইরের লোক কখনো কখনো ধন্দে পড়ে। অন্য পাড়া থেকে ঝিলের পাড় পেরিয়ে, মোরামের রাস্তায় খালি পায়ে, কুরুশের ঢাকনি ঢাকা পুজোর থাল হাতে সন্তর্পনে চলা বউ মেয়েরা হঠাৎ বেজে ওঠা ঢাকের শব্দে ঘাবড়ে, পুজো শেষ হয়ে আরতি শুরু হয়ে গেল ভেবে, পা চালাতে গিয়ে তাই টাল খেয়ে কোনোমতে সামলায়। যদি এ বাড়ির লোক হত বা আসাযাওয়ার মেয়াদে পুরনো, তাহলে বুঝত যে এ ঢাকের বোল নেহাতই গৌরচন্দ্রিকা!
    দিনের প্রথম ঢাকের আওয়াজ শুনে কাজ হল বাড়ি বাড়ি সকালের চায়ের পাট গুটিয়ে ফেলা। পুজোর দিনগুলোতে এই পাট চলে অনেকক্ষণ ধরে,এবাড়ি ওবাড়িতে। একে তো অনাবিল ছুটি,তায় অনেকে আসে বাইরে থেকে, অনেক গল্প অনেক কথা সারা বছরের, জমা হয়ে থাকে, যা হয়ত এই চারদিনেও শেষ হওয়ার নয়, তবু প্রয়াস থাকে সব তরফেই। অন্য আর সব সময় মন্দিরে হাজিরা দিতে হয়,তাই শুধু সকালের ফাঁকা আলসে সময়টায় এর ওর বাড়ি চায়ের আসরের গল্পে ঢুকে পড়ে এ ও।
    বাড়ির গিন্নীদের অবশ্য এ নিয়মে চললে চলেনা, তাদের স্নান সেরে মন্দিরের পুজোতে দেওয়ার জন্যে সামগ্রী সাজাতে হয়, মন্দিরের যোগাড়েরা ধামা ধুচুনি নিয়ে বাড়ি বাড়ি পুজো নিতে আসার আগে তৈরী থাকতে হয়।
    অন্যদেরও এক না এক সময় উঠতে হয়, চা ও গল্পের আসর ছেড়ে, ঢাকের ডাকে। স্নান সেরে তৈরী হয়ে, যেতে হয় মন্দিরে। বাড়ি আসার উদ্দেশ্য শুধু তো পুজো নয়, এই কটা দিন সকাল বিকেল মন্দির সংলগ্ন এলাকায় পাড়ার সকলের সঙ্গে হইহই সময় কাটানো। এরকমটাই এবাড়ির রীতি, এই আমাদের পুজো!
     
    পাঁঠাবলি, আরতি, অঞ্জলি, প্রত্যেক অনুষ্ঠানের শেষেই হইহই আড্ডার পালা, নানাবয়সীদের নানাজায়গায়, আটচালায়, বেলতলায় বা মন্দির লাগোয়া বৈঠকখানায়। তার সাথে তাল দিয়ে চলে সকাল থেকে বহিরাগতদের আনাগোণা। আত্মীয় কুটুম,এপাড়া, ওগ্রামের লোক আসে পুজো দিতে, ঠাকুর দেখতে, লোকলৌকিকতা সারতে। তারাও সামিল হয় গল্পগুজবে আড্ডায়,বাসিন্দাদের সাথে......খুশী দ্বিগুণ চারগুন শতগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মাঠে ঘাটে, হাওয়ায হাওয়ায়, কাশের বনে।
    বিনা কারণে বেলা গিয়ে দুপুর হয়। খাওয়াদাওয়ায় প্রতিবাড়িতে সাধ্যমত সাধারণের চেয়ে অতিরিক্ত আয়োজন থাকে এদিনগুলোতে।
    মন্দিরচত্বরে ধুলো ওড়ে, ধুপ, ধুনো, ঘি পোড়ার গন্ধ, হঠাত হাওয়ায় উড়ে যায় শুকিয়ে আসা বেলপাতা ফুল, দালানে বাতাসা সন্দেশের গুঁড়োর লোভে লাল পিঁপড়েদের নিয়মে বাঁধা সার, বড় কালো কালো ডেঁয়ো পিঁপড়ের বেনিয়মের এদিক ওদিক দস্যুবৃত্তি ........বাড়িবাড়ি এঁটোকাঁটার ভোজ খেয়ে মাটিতে কুন্ডলী পাকিয়ে বিশ্রামরত লালু ভুলু ছাড়া, আশেপাশে তেমন আর কেউ চোখে পড়েনা। দালানে অবশ্য কম্বল আসনে অবিচল বামুনদামশাই, উপোসের ক্লান্তি ভুলতেই বোধহয় গোল গোল চশমা চোখে লাল শালু মোড়া পুঁথি পড়ে যায় একমনে!
    হুটোপাটিতে ক্লান্ত, দিনের শেষে আমাদেরও চোখ ঢুলুঢুলু, জোর করে বিছানায় চেপে ধরে বালিশে মাথা ঠেকানো গেছে কোনমতে, তখনই আবার বেজে ওঠে ঘুম ভাঙানীয়া নহবতের সানাই। ব্যস, ওঠ ওঠ, আর কে ঘুমোয়!
    ঘরে ঘরে শুরু হয় বিকেলের প্রস্তুতি। নতুন শাড়ি জামার খসখসানি, বালা চুড়ির রিনঝিন, পাউডার পমেটমের সুরভিতে মেশে পুজো স্পেশ্যাল সুগন্ধি। পায়ে নতুন জুতো, মাথায় বাহারে রিবন, রাবারব্যান্ড। নতুন সাজে প্রথম বাইরে বেরিয়ে, মুহুর্তের জন্যে থমকানো .....ওর জামা আমার জামার থেকে সুন্দর কী?......সে আর কতক্ষন....ক্ষণিকের সন্দেহের মেঘ ভেসে যায়, ঢাক ঢোল হট্টগোলের আওয়াজে...হাতে হাত ধরে ছুটে যাই দলে, মন্দিরপাড়া আবার সরগরম!
     
    বিকেলের অনুষ্ঠান বলতে সপ্তমীতে শুধু আরতি, অষ্টমীতে আরতি শেষ হয়ে রাতে সন্ধি পুজো, নবমীতে আরতির পরে হোম,শান্তিজল, হোমের ফোঁটা ইত্যাদি। দূর্গার আরতির আগে হয় বাড়ির নারায়ণ মন্দিরের বারোমাসের নিত্য সন্ধ্যারতি। দুর্গার দৌলতে ব্রজরাজের দৈনন্দিন টিমটিমে কাঁসর ঘন্টার সাথে যোগ দেয় ঢাক ঢোল সানাই নিয়ে বাজনার দল। দুয়ারে হ্যাজাকের উজ্জ্বল আলোয় দেখলে, তোলা গয়না, বেনারসী কাপড়ে, নওলকিশোর ঠাকুরের সাজে আলাদা জাঁকজমক তখন। আরতি শেষে শীতলে রোজের লুচিবাতাসার জায়গায় এ কদিন লুচি সন্দেশ, ক্ষীরভোগ। বাইরের লোকেরাও পাড়ায় একটু আগে আগে, হাতে সময় নিয়ে ঢোকে, যাতে দুর্গার আরতির সঙ্গে ব্রজরাজের আরতিও দেখা হয়।
    সেইসব দিনরাত্রিতে বিদ্যুত, বড় পিচের রাস্তা অবধি এসেই থেমে গেছে, গ্রামের মোরামের পথে তখনো ঢোকেনি। বড় রাস্তাতে পোল থাকলেও রাস্তার আলোর ব্যবস্থা ছিলনা শহরের মত। অষ্টমীর দিন ছিল বাইরের পুজো দেখতে যাওয়ার দিন, অন্যবাড়ির পুজো, সার্বজনীন পুজো।
    বাড়ির বড়রা যেতনা, নিজেদের পুজো ছেড়ে যাওয়ার সময় কোথায় তাদের? এক আধজন যাদের অকাজের বা বিনাকাজের কাজী হিসাবে সুনাম ছিল বেশ,তারা কেউ যেত ছোটদের বা মেয়েদের দলের সঙ্গে, হেঁটে বা সার সার রিকশাতে।ছেলেছোকরাদের অবশ্য রোজই অষ্টমী, তারা যেত আলাদা দলবেঁধে, হেঁটে বা সাইকেলে।
    রাস্তায় আলো না থাকার দরুন পুজোবেরুনী দলের সবার ঠাকুর দেখে বেলাবেলি পাড়ায় ফেরার চল ছিল। তবু কোনো কারণে ফিরতে যদি দেরী হয়ে যায়,তাই দলের মাথাদের হাতে থাকত বড় বড় দুসেল তিনসেলী টর্চ। সেসব টর্চ দরকারে হাতিয়ারের কাজও করতে পারত, মাথায় এক ঘা পড়লে ঘন্টাকয়েকের বেহুঁশী গ্যারান্টেড!
    পুজোর দিনে সেরকম দরকার কখনো পড়েছে বলে অবিশ্যি কেউ কখনো শোনেনি।
    তাড়াতাড়ি ফেরার আরেকটা কারণ ছিল,অষ্টমীর সন্ধ্যেয় আরতির সময় মন্দির দালানে উপস্থিত থাকা বাড়ীর রীতি, এদিন বাইরের লোকজন আসে, সকলের বন্ধুবান্ধব, চেনা জানা, দেখাশোনা মিলমিশের সেই পালার আগ্রহও কম ছিল না।
     
    সন্ধ্যে হলে প্রতিবাড়ীতে জ্বালানো হত হ্যাজাক, কমপক্ষে একটা, কোনো কোনো বাড়ীতে একাধিক। তাদের পোশাকী নাম বোধহয় ছিল পেট্রোম্যাক্স। মন্দির আর আটচালায় জ্বালা থাকত এই আলোরই একটু বড় বড় মডেল।হ্যাজাকের চলতি নাম ছিল হ্যারিকেন লাইট, কেন জিজ্ঞেস করলে উত্তর জানা নেই। দেশী জিভে তার উচ্চারণ হত হারকিন লাইট!অন্ধকারকে আরো ঘন করে দেওয়া এই আলোকে ঘিরে বসতাম আমরা কখনো। চকচকে স্টীলবডিতে এর ওর মুখের অদ্ভুত আকারের লম্বা টানাবাঁকা প্রতিচ্ছবি দেখে হেসে গড়িয়ে পড়া!
    বসে বসে হ্যাজাক বা হ্যারিকেন লাইট জ্বালানো দেখা বাড়ির ছোটদের খুব প্রিয় কাজ ছিল। ম্যান্টলটায় একটু স্পিরিট ছিটিয়ে দেশলাই কাঠি ছোঁয়ালে দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গিয়ে কেমন নীলচে সবুজ হয়ে যেত আর সেই মুহূর্তে প্রাণপনে পাম্প করতে হত, কেরোসিন তুলতে। ঠিকঠাক সময়ে ঠিকমত পাম্প করলে ম্যান্টলটা আস্তে আস্তে সাদা হয়ে গিয়ে উজ্জ্বল আলো ছড়াত চারিধারে। তখন দুরুদুরু বক্ষে, পঞ্চাদাদা একবার পাম্প করতে যদি দেয়, সেই আশায় বসে থাকা।
    কোনোদিন দিত, কখনো আবার ভুলেও যেত। দিলেই বা কী? প্রাণপন চেষ্টা করে একবারও পাম্প নড়াতে পারতাম কিনা সন্দেহ, তবু তাতেই আনন্দ। এ আলো জ্বালাতে সবাই পারতনা, কুশলীর ডাক পড়ত তাই একাজে। না বুঝে দরকারের বেশী আনতাবড়ি পাম্প করলে আবার প্রেশার বাড়তি হয়ে ফেটে যেতে পারে লাইট, তাই সেও এক বোঝার ব্যাপার ছিল, কখন দ্রুত থেকে ধীরলয়ে এসে থামতে হবে!
     
    তখনো গ্রামে টেলিভিশন আসেনি, এখনকারের মত সন্ধ্যেয় লোকে আড্ডায় বেমনা হয়ে, পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে বোকাবাক্সের খবর, সিরিয়ালে মন দিতনা। তখন মন খারাপ হত, সন্ধ্যারতির শেষে, ইস, বচ্ছরকারের এমন দামী দিনগুলোর একটা প্রায় শেষ হয়ে গেল!
    তাই গানের দলের হাঁকেডাকে তোড়জোড়,লোকেদের মিয়োনো আড্ডায় অক্সিজেনের কাজ করত, শেষ হইয়াও হয় না তো শেষ দিন। ইচ্ছেখুশী মত দিনটা আরো একটু টেনে বাড়ানো, পালাগানের বাহানায়।
     
     ******************
     
    আটচালায় মাটির এবড়োখেবড়ো মেঝেতে বড় বড় শতরঞ্চি পাতা হচ্ছে, আর বৈঠকখানায়, সামনের বাড়ির সদরে, মাদুর পড়ছে, বড়দের, মেয়েদের, বসার জন্যে। বাড়ির ছোটদের জায়গা আসরের মাঝখানে, গানের দলের পেছনের সারিতে।
    হাতে হ্যারিকেন লন্ঠন বা টর্চ নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এসে পৌঁছয় বেপাড়ার লোকেও, বয়স্করাই বেশী। ঠাকুরের গান, শুনলেও পুণ্যি।
    গ্রামের একটু কমবয়সী তরুন ছেলে ছোকরাদের বিনোদনের জন্যে দুরে সার্বজনীন পুজোর যাত্রার আসর থাকত, সামাজিক পালা। বুড়োদের দল সেসব "সিঁদুর দিওনা মুছে,শাঁখা দিও না ভেঙে"পালার নাম শুনলেই কানে আঙুল দিত। এদের কাছে রায়পাড়ার শিবায়ন গানের কদর ওসব যাত্রাপালার চেয়ে অনেকগুন বেশী ছিল।
     
    আসরের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে,গানের দল গোল হয়ে বসে।হারমোনিয়াম,খোল, তবলা আর খঞ্জনি নিয়ে,দুগ্গামামার হাতে থাকত চামর। যে দূর্গা সাজে সে কোন হিসেবে যুগে যুগে বংশপরম্পরায় এবাড়ির ছোটদের দুগ্গামামা হয় তার ইতিবৃত্ত কারোর জানা নেই।
    বাবার দুগ্গামামা ছিল, আমারও, আবার এখনের ছোটদেরও দুগ্গামামা আছে। চরিত্র এক থাকলেও কুশীলব যে পাল্টে যায় সে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে নামটা আজ অবধি চলে আসছে সবার মুখে মুখে। আমি নিশ্চিত, মনপবনের নাওয়ে জীবনের সকালে ফিরে যেতে পারলে দেখব, সেই হৃদয়ে আমাদের সবার দুগ্গামামা আসলে অভিন্ন!
     
    অতি সাধারণ পোশাক সব, ঘরে কাচা হলদেটে ফরসা ধুতি, গেঞ্জির ওপর উড়নি, গলায় কন্ঠী আর কপালে তিলক, মাত্র এইটুকুই সাজ দলের সবার। শুধু দুগ্গামামার পরণে শাড়ি,পাউডারের প্রলেপে সাদা খড়ি ফোটা মুখ,পায়ে আর ঠোঁটে আলতা, মাথায় পরচুলো আর পরচুলোর ওপর সুতো দিয়ে মুকুট বাঁধা। বর্ণনায় কিম্ভুত শোনালেও, ছোটদের মুগ্ধ চোখে সে এক অদ্ভুত অপরূপ সাজ।
    শাড়ি, পাউডার আলতা এসব দুগ্গামামা যোগাড় করত এবাড়ির মেয়ে বউদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে। বছরের এই সময় ছাড়া শিবায়ন গানের চাহিদা ছিলনা এ অঞ্চলে, অন্যসময় গানের দলের লোকেরা চাষবাস সংক্রান্ত নানা পেশায় যুক্ত থাকত। গান করে খুব কিছু রোজগারও নয়, তাই সাজপোশাকের যোগাড় চেয়েই করতে হত দুগ্গামামাকে। মুকুটটা বহুব্যবহারে কালচে হয়ে গেছে, রাংতার সোনারঙ মলিন, তাও বেশ রানীর মত দেখাত, অন্তত আমাদের তো তাই মনে হত!
    এই কদিন এদের খাওয়াদাওয়া হত পালা ভাগ করে নানা বাড়িতে, শুধু গানের দলের নয়, বাজনদার, পুজোর যোগাড়ে, মজুর সবারই। গানের দলের লোক এসে খেতে বসলে আমরা সামনে থেকে নড়তামনা, আসরের নক্ষত্ররা আমাদের আর পাঁচজনের মত ভাত মেখে গরাস তুলে চিবিয়ে খাচ্ছে, সাধারণের মধ্যেও ছোট্ট চোখের দৃষ্টিতে তার অভিনবত্ব খুঁজে বেড়ানো!
     

    ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যেয় দুগ্গামামা দলবল নিয়ে বেলতলায় বেলবরণের কাছে বসত, সেদিন সে সাজতনা। অন্য আর পাঁচটা দেশঘরের পুরুষের মত ধুতি শার্ট পরনে, গলায় কন্ঠী। দলের লোকেরা সবাই এ অঞ্চলের নিম্নবর্ণের, ধর্মে বৈষ্ণব ছিল।
    সেই প্রথম দিনে আসরে না সাজা দুগ্গামামাকে অবাক হয়ে দেখা, সন্দিগ্ধনয়নে, এই আসল দুগ্গামামা তো? একটা চাপা অস্বস্তি, যতক্ষণ না পরদিন সেজেগুজে চামর দুলিয়ে আবার আসরে আসছে !
    ষষ্ঠীর দিন হত শুধু আগমনী গান,
     
    যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা মা আমার কাঁদিছে
    এবং
    এবার হর এলে পরে বলব উমা ঘরে নাই,
          ------------------------
    শুনি নাকি পরস্পরে, জামাই আমার ভিক্ষা করে, -----ইত্যাদি।
     
    উমা ঘরে নেই বলে হরকে ফিরিয়ে দেওয়া ছিল সবচেয়ে পছন্দের গান। এ গানে উমাকে চিরকাল বাপের বাড়ি রেখে দেওয়ার আভাস, তার মানে দশমীর দিনে সদলবলে দুর্গার কৈলাস ফেরার বালাই নেই,তার মানে সারাবছর দুর্গাপুজা, আনন্দ আর ছুটি।
     
    সপ্তমী - শিবদুর্গার ঝগড়া ও শিবের চাষ করতে যাওয়া। 

    আরতির পরে আটচালাতে বসে আসর। ঝনঝন বাজনা বেজে ওঠে, সাথে কোরাসে নানা স্বরে শোনা যায়,
     
    “ভবের ভৈরবী ভবানী বানী বানী স্মরণে --------
    চন্দ্রচূড় চরণ ও হোহো হো
    চিন্তিয়া নিরন্তর অ অ অর
    ভবভাব্যে ভদ্রকাব্য ভনে রামেশ্বর
    ভবের ভৈরবী ভবানী বানী বানী স্মরণে।“
     
    এ পালাগানের মূল কাহিনী অঞ্চলের প্রাচীন কাব্যকার রামেশ্বর চক্রবর্তীর (ভট্টাচার্য?) লেখা শিবায়ন। তবে কান করে শুনলে গানে সময়ের প্রভাব ও উৎসাহী নবতর কবিদের অতিরিক্ত সংযোজন টের পাওয়া যায়, হাল আমলের ঘটনা ও ব্যবহৃত শব্দের উল্লেখে।গল্পেও রদবদল ঘটে,পরিবেশনের সময়সুযোগ বুঝে।
    যেমন কখনো বাগদিনীবেশী দুর্গা জমিতে মাছ ধরার বাহানায় ফসল নষ্ট করে আবার কখনো শোনা যায় শিবই বাগদিনীকে ডেকেছে জমিতে জল ছেঁচতে। আগে গানের মাঝে কথায় টেক্সি আসত (যে কোনো অ্যামব্যাসাডর গাড়িকেই গাঁয়ের লোক টেক্সি বলে যে গো),ইদানীং মারুতি আসে!
    নায়িকা এখানে আদতে হিমালয়কন্যা পার্বতী হলেও, দুর্গার নানা নামের উল্লেখ করা হয় এই গল্পে, গানে গানে, নানা অবসরে।
     
    শ্যামের বাঁশীর মত,গান কানে যাওয়া মাত্র আমাদের আলুথালু রাধাপরাণ, রইল পড়ে খাবার, কোনোরকমে ধুয়ে আঁচিয়ে আবার পড়িমরি দৌড়, এবার মন্দিরপানে। চারদিকে চালের বাঁশ থেকে ঝোলানো চার হ্যাজাকের আলোয় আর লোকের ভীড়ে আসর গরম। আলোর ঠিক নীচে থেকে মাটির মেঝে বরাবর,একটা নলাকৃতি সাদা ধোঁয়ার মেঘজমাট,তাকে ঘিরে নানান পোকার চরকি কাটা, লেপটে থাকা। বেখেয়াল ক্ষুদের দল, পোকারা উড়ে এসে মুখে বসলে তাদের হাত নাড়িয়ে ওড়াতেও ভুলে যায়,কারন মাঝখানের গোলে তখন দাঁড়িয়ে বিভুতিবাবুর সাথে হাতে চামর দুলিয়ে স্বয়ং দুগ্গামামা ।
    অপরূপ ভঙ্গিমাতে পায়ের বুড়ো আঙুলটা একটু তুলে ঘুরপাক খাচ্ছে, এক একটা ডায়ালগ শেষে, মুখে পান দোক্তা খাওয়া, কালো আতাবীচির ন্যয় দাঁতের সারির আভাস, ঠোঁটে মধুর ফাজিল হাসি।ঐ মনোমোহিনী রূপে গম্ভীর শিববাবুর একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। দুগ্গামামার মুখের থেকে মুগ্ধ দৃষ্টি সরেনা আমাদের,আহা কী দারুন ভাব, কী বাচনভঙ্গি, প্রতি কথায় জব্দ করছে শিববেশী বিভুতিবাবুকে।
    দুগ্গা মামা হলেও শিবকে সবাই সসম্ভ্রমে বিভুতিবাবুই বলে, একটু দুরত্ব বজায় রেখে......আমার মত ছোটরা কেউ কেউ জেঠু ডাকে, তবে শিবজেঠু নয়।
    নামে দুগ্গামামার খ্যাতি হলে কী হবে আসলে দলের মালিক শিব বা বিভুতিজেঠুই। তবে এসব তো আর ছোটদের জানার কথা নয়, তাদের হিরো বা হিরোয়িন হল দুগ্গামামা!

    গান শুরু হয় শিবের অকর্মণ্যতা নিয়ে দুর্গার দোষারোপে। কাজ করেনা, রোজগারপাতি নেই, নেশাভাং করে শ্মশানেমশানে ঘোরে, সংসারের দিকে খেয়ালই নেই। ভাবে ভোলা মহেশ্বর হলেও মা দূর্গার নিত্য গঞ্জনায় শেষে একদিন তারও চৈতন্যোদয় হয়। অথবা হয়ত নিরন্তর খোঁটা আর সহ্য করতে পারেনা। যে কারণেই হোক, শিব আসে মর্ত্যে, দেবীচকে, চাষ করতে, সঙ্গে ভাগনে ভীমা। মামা ভাগনে মিলে খুব খেটে চাষ করে। লাঙলে মাটি কেটে, বীজ বুনে, ধান রুয়েছে নিজেরা, এখন সুন্দর সবুজ ফসলে ভরে গেছে মাঠ।
     
    “ধরণী সুধন্যা হৈল ধান্য আইল ফুলে
    ভোলানাথ রহিলেন ভবানীকে ভুলে
    ----------------
    ভবের ভৈরবী ভবানী বানী বানী স্মরনে----“
     
    এইসময় দুর্গামামা আসরের একপাশে বসে থাকে,মামা ভাগনার চাষবাড়িতে তার কোনো ভূমিকা নেই। আমরা উসখুস করি, দুগ্গামামা না এলে জমেনা। বুঝিনা এই ফাঁকটুকু কত দামী দুগ্গামামার কাছে, রোজের আসরে প্রায় সারাক্ষণই তার মুখে কথা বা গান,গলা বিশ্রাম পায় শুধু এমনি এক আধ টুকরো অবসরে। তাই একেবারে পিছনে গিয়ে চামর পাশে মাটিতে নামিয়ে রেখে, ঘোমটার আড়ালে, সে বিড়িতে সুখটান দেয়। আমরা সামনে বসে থাকি, তাই পেছনে কী হচ্ছে দেখতে পাই না। অনেকেই দেখে, সদরে বসা বাড়ির মেয়ে বউদের মধ্যে হাসির হুল্লোড় ওঠে, বিড়ি খাওয়া দুগ্গামামা দেখে!
     
    দূর্গা ভাবেনি যে শিব তার কথা শুনে চাষ করতে যাবে এবং সেখানে কাজে এমনধারা মগ্ন হয়ে শিবানীকে পর্যন্ত ভুলে যাবে। এতদিন স্বামীকে ছেড়ে থেকে বিরহব্যথায় কাতর মা দূর্গাও অবশেষে কৈলাস থেকে মর্ত্যে আসে। এসে পৌঁছয় দেবীচকে, শিবের ক্ষেতে, ছদ্মবেশে, বাগদিনীর সাজে।
    আমরা উৎসাহে নড়েচড়ে বসি, আসরের কেন্দ্রে আবার দূর্গামামা, তবে এবারে মুখে কোনো কথা নেই। মাথা নীচু করে জমিতে জল ছেঁচার ভঙ্গীতে কিছু একটা করছে। আসরেও সবাই চুপ, শুধু ঢোল আর খঞ্জনি একসুরে বেজে যায় ঝনঝন,তবে নীচুগ্রামে বাঁধা স্বর।
    এই গানের আসরে মঞ্চে প্রবেশ মানে উঠে মাঝখানের ঐ গোল ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ানো আর প্রস্থান মানে সকলের সঙ্গে একসারিতে বসে পড়া।
     
    কিছুক্ষণ বাগদিনী বেশী দুগ্গার একা ঘুরে ঘুরে জল ছেঁচার মত অভিনয়ের পর উঠে দাঁড়ায় ভীমা। ভীমার কথায় আমরা জানতে পারি যে জল ছেঁচা নয়, বাগদিনী আসলে মাছ ধরছে, জমির মোয়ানে। মোয়ান হচ্ছে সেই পথ যেখান দিয়ে প্রয়োজনে পুকুর থেকে চাষের জল নিয়ে আসে জমিতে, পুকুর আর জমির সংযোগস্থল। সমস্যা হল বাগদীর মেয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু মোয়ানের মুখে মাছ ধরছে না, সারা মাঠ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার পায়ের চাপে নষ্ট হচ্ছে মামা ভাগনের সাধের ধান।
    মাঠের ফসল তছনছ করছে কোথাকার কোন বাগদিনী এসে, এ দৃশ্য দুই চক্ষে দেখে ভীমা তো রেগে আগুন। এগিয়ে এসে সে বাগদিনীকে বারণ করে মহা হম্বিতম্বি জুড়ে দেয়, বাগদিনী ভীমার কথায় কর্ণপাত করেনা, দুগ্গামামা আসরে ঘুরেই যায়। আমরা তখন বুঝতে পারি ভীমাকে পাত্তা না দিয়ে দুগ্গামামা জিওল মাছ ধরতে অমন সারা আসর ঘুরছে, মানে বেশী বেশী ধান নষ্ট হচ্ছে, দুগ্গামামার জিত।
    এবার ভীমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়,এগিয়ে আসে মারমুখী হয়ে,এই সময়ে উল্টে বাগদিনী অর্থাৎ মা দূর্গা তাকে সজোরে একখানা চপেটাঘাত এমন করে, যে সে প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ে মামা শিবের কাছে।
     
    আসরে বিভুতিবাবু উঠে দাঁড়িয়েছে,দুগ্গামামা টুক করে বসে পড়ে। এখানেও কোনো গান নেই, মৃদু বাজনা শুধু। ভীমা হাঁউমাউ করে কাঁদে "মামাগো" বলে। গানে নয় ছন্দে নয় একেবারে আমাদেরি মত ভাষায়, খেলার সাথীদের সঙ্গে বিবাদে হেরে এসে বাড়িতে নালিশের গলা, খুব মজা লাগে।
    “কোথা হতে এক বাগদিনী এসে আমাদের সব ধান নষ্ট করে ফেলল মামা গো। আমি বলতে গেলুম তো আমাকে এমন জোরে মারলে,ও মেয়েমানুষ নয় নির্ঘাত কোনো ডাকিনী।“
    প্রথমটায় শিব তেমন পাত্তা দেয়না ভাগনের কথায়। গরীব মানুষ সব, জমিতে দুটো মাছ ধরছে, ভীমা বারন করেছে বলে হয়ত একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। এ ব্যাটা তাতেই তিল কে তাল করে সাতকাহন নালিশ নিয়ে এসেছে।
    শিব ভাবেভোলা, গাঁজা না খেয়েও বুঁদ হয়ে থাকে, তায় বুড়োমানুষ, গোলমালের মধ্যে বিশেষ যেতে চায়না। কিন্তু ভীমা ছাড়েনা,সারা আসর ঘুরে ঘুরে মামাকে ও শ্রোতাদের বাগদিনীর হাতে তার হেনস্থার কাহিনী শুনিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে গানে গানে। তার অবিরাম শোরগোলে বিরক্ত হয়ে শেষে শিব ঠিক করে সে নিজে সরেজমিনে জমিতে গিয়ে দেখবে ব্যাপারখানা আসলে কী, কে এই বাগদিনী। ভীমা বসে পড়ে,দুগ্গামামা উঠে মাছ ধরতে থাকে,শিব বসে, আবার ওঠে। আমরা উদগ্রীব, এতক্ষণে আবার হিরো হিরোয়িন আমনে সামনে!
     
    বাগদিনীর পরমাসুন্দর কালো রূপের ছটায় বুড়ো শিবের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, সে চোখ ফেরাতে পারেনা। দুগ্গামামার কালো দাঁতের ফিচেল হাসি আবার স্বস্থানে। টাকমাথা হলেও বিভূতিজেঠুর লম্বা চওড়া গমগমে চেহারা, দিব্যি মানায় বুড়োশিবের বেশে। বাজনা জোরে বাজে,
     
    “তোমার পরিচয় দাও ও সুন্দরী, কোথায় তোমার ঘর
    ওগো পরিচয় দাও ও সুন্দরী
    -------------------
    শিবরাম মাধবরাম ও হো হো
    --------------------
    ভবের ভৈরবী ভবানী বানী-------“
     
    বাগদিনী মুচকি হাসিতে শিবকে প্রশ্রয় দেয় কিন্তু নিজেকে শুধু বাগদীদের মেয়ে বলা ছাড়া আর কোনো বিশদ পরিচয় দেয়না। তবে প্রেম কী আর কোনো জাতপাত মানে? অতএব অচিরেই দেবাদিদেবের সাথে ছদ্মবেশী পার্বতীর লীলা জমে ওঠে। আমরা তার ইঙ্গিত পাই গানে, দুগ্গামামা ও বিভূতিবাবু দুজনেই বসে পড়েছে আর গানের দলকে লীড করছে।
    গান শেষ হলে দুজনে উঠে তখন সই সয়া পাতানোর ধুম। একসাথে জমিতে মাছ ধরে, জল ছেঁচে। দুর্গার আঙুলে শিব পরিয়ে দেয় নিজের অমূল্য মাণিক্যের অঙ্গুরী। তারই মাঝে বাগদিনীবেশী দূর্গা শিবকে ভর্ত্সনা করে বলে, যে তার প্রেমে মজে শিবের এমনি হাল, জগতপতি জগতসংসার ভুলেছে।
    এতদিনের পরিশ্রমের ফসল নষ্ট হয়ে গেল তা নিয়েও কোনো আক্ষেপ নেই! তখন বিভূতিবাবু গমগমে গলায় গেয়ে ওঠে,
     
    -"বড়ভাই ব্রহ্মা মোর বেদকর্তা হয়ে
    কন্যাকে করিতে ক্রিয়া আপনি গেল ধেয়ে
    মেজ ভাই বিষ্ণু মোর কৃষ্ণ অবতার
    গোকুলে গোবিন্দ নামে গোপিনী বিহার"।
     
    অর্থাৎ স্ত্রীলোকের প্রেমে দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে মজে যাওয়া তাদের খানদানী স্বভাবরীতি। স্বর্গের দেবদেবী আর মর্ত্যের মানুষের এখানেই তফাত। দেবদেবীদের কথাই সব, কথা সত্য, কর্ম কিছু নয় তাই তারা যা করে তা নিয়ে কেউ তত মাথা ঘামায় না, যত না ঘামায় তারা কী বলছে তাই নিয়ে। আবার মানুষের ক্ষেত্রে কর্মই সত্য, কথা কিছু নয়।
    শিবের কথা কি ছোট্ট মাথাগুলোয় ঢোকে? কী বুঝি কী শিখি আমরা কে জানে! .........আদৌ কিছু কি?
     
    এক্ষণে শিবের সাথে লীলাখেলা করে,তার জমির সব ধান নষ্টকরে, শেষে অছিলা করে শিবকে অপেক্ষায় বসিয়ে রেখে বাগদিনী বেশী দূর্গা কৈলাসে ফিরে যায়। বাগদিনীর প্রতীক্ষায় হতাশ শিবের শেষে নিজের গৃহও গৃহিণীর কথা মনে পড়ে, কৈলাসের জন্যে মন ব্যকুল হয়। সেও ফিরে চলে নিজ আলয়ের উদ্দেশ্যে।শেষ হয় সপ্তমীর পালা, আমরা অধীর প্রতীক্ষায়, কখন আসে অষ্টমীর রাত!

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন