বিগত কয়েকঘন্টা ধরে ঘরটা ছেয়ে আছে অগুরু ধূপের চড়া গন্ধে। আত্মীয়স্বজনদের মৃদুগুঞ্জন চলছে, দোতলা বাড়িটার শ্যাওলা ধরা বারান্দায় কিছু মানুষের আনাগোনা, হাঁকডাক। একটি মৃদু ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার সুর যেন ধূপের পাকানো ধোঁয়ার মতো কেঁপে কেঁপে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। খুব সন্তর্পণে ওঠা সেই কান্নার সুরটা কাজের মেয়ে ঝর্ণার। কমলাদেবীকে শেষযাত্রায় চন্দন দিয়ে সাজানোর সময়ে ঝর্ণা কেঁদে উঠেছিলো, "এবার থিকে আমি কাকে মা বলে ডাকবো গো?"
তারপর যথাবিহিত নিয়ম চলাকালীন চান্দেরী শাড়ি পরিহিতা এক আত্মীয়া ঠোঁট টিপে হাসলেন,
"আহা, যাদের মা তেনাদের সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পার থেকে আসার সময় হয় না, এটার ঢং দেখো!"
তার পাশের মহিলা চাপাস্বরে ধুয়ো তুললেন, "দেখছি কতো দেখবো আর / ছুঁচোর গলায় চন্দ্রহার।"
বাড়িটা দোতলা। পুরোনো ধাঁচের সবুজ রঙ করা লোহার ঝুলবারান্দা। নীচের তলার ভাড়াটেদের পুরুষটি বেশ করিৎকর্মা। তাছাড়া কমলা ও রজতবাবুর ছেলে অনন্যর বন্ধুর সম্পর্কিত কাকা। ভাড়া নেওয়ার সময় অনন্য তখনো দিল্লী যায়নি। রজতবাবুর চলে যেতেও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন এরাই। বৈধব্য ধারণের সময় থেকে কমলাদেবী একরকম 'ভাই' বলে সম্বোধন করতেন ওনাকে। সেটা মানসিক ও লোকবলগত অসহায়তার কারণে হতে পারে, আবার কৃতজ্ঞতার জন্যও হতে পারে। কারণ বাবার কাজ মিটিয়েই নিজের কাজের চাপে ছুটতে হয়েছিলো অনন্যকে। দিনপাঁচেক দেরী হওয়াতে অফিসের এক সিনিয়র বলেছিলেন ফোন করে
-"কী ব্যাপারে এতোদিন কামাই অনন্য?"
-"স্যার, বাবার মারা যাওয়ার বিষয়টা জানেন তো সবই...'
ওপ্রান্তের ভদ্রলোক বলেছিলেন, "সেইসঙ্গে আমাদের বাবাদেরও মারার অধিকার তোমাকে কে দিলো? কাজের চাপে তো আমরা লাটে উঠতে চললাম। অবশ্য এভাবে চললে..."
বাকিকথা বলার আগে অনন্য মুন্ডিতমস্তকেই ফিরে গিয়েছিলো দিল্লীতে। আর ঝুমুর! মেয়েটা বিপুল ঐশ্বর্যের শ্বশুরবাড়ি আর সৌরেন্দ্রর মতো ছেলেকে পেয়েও কীকরে এতো রুক্ষ হয়ে উঠলো সেটাই শেষের দিকে ভাবাতো কমলাকে। অথচ এইবাড়ি অসমবিবাহের জন্য কী করেননি রজতবাবু? প্রভিডেন্ড ফান্ড, ব্যাঙ্কের যাবতীয় সঞ্চয় উজাড় করে দিয়েও বাজারে ধারবাকি হয়েছিলো তাঁর। বনেদী ব্যাবসা, একমাত্র ছেলে সৌরেন্দ্র বিদেশে উচ্চশিক্ষিত, গা - মোড়া হীরে জহরত আর বছরে দু-তিনবার ইউরোপ ভ্রমণ তো ওদের নিত্যকার ব্যাপার। ঝুমুরের চেহারাটাও আরো সুন্দর হয়েছে আজকাল, চামড়া যেন এই পুরোনো টিউবলাইটের আলোতেও মসৃণ হয়ে চকচক করে। তবে হৃদয়ে কেন এই রুক্ষতা দানা বেঁধেছে? এসে ইস্তক অনন্যর স্ত্রী মায়ার সঙ্গে খিটিমিটি লেগেছিলো। মায়ার দিক থেকে অবশ্য নীরবতার নীতিই পালিত হয়ে এসেছে বরাবর। সে একটি কলেজের অ্যাসিট্যান্ট লেকচারার ও বর্তমানে নিজের রিসার্চ, সংসার সব নিয়েই ব্যস্ত। শোকের আবহে কমলাদেবী বলেছিলেন
"তবে তোমরা কবে ফিরছো?"
--"আমার থাকার কোনো ফুরসৎ নেই মা। ওর আগামী মাসেই ফ্লাইট রয়েছে ফ্রান্সের। নেহাৎ তোমার কপাল খারাপ যে পুত্রবধূ থেকেও নেই, তাই..." বরের দেওয়া গহনায় ঝংকার তুলে বলেছিলো ঝুমুর।
কমলাদেবী পুজোর ফুলটা থালায় রেখে চোখ বন্ধ করেছিলেন উত্তেজনায়, " আমার আর ভালো লাগছে না ঝুমুর, হয় তোমরা শান্তিতে থাকো নয়তো ফিরে যাও সবাই। আমাকে এ অবস্থায় আর যাতনা দিও না মা।"
তা অবশ্য অনন্যদের চলে যাওয়ার দিন তিনেকের মধ্যেই ওরাও ফিরে গেছিলো।
-- "এই যে, দিদিভাই এসেছেন। " ভারী পুরুষকন্ঠের ডাকে ঝর্ণা কান্না থামায়। ঝুমুরকে সুসজ্জিতা হয়ে ঘরে আসতে দেখে সসম্ভ্রমে সরে যায়। কান্নাকাটির রোলটা হঠাৎ বেড়ে ওঠে। পলেস্তারা খসা দেয়াল আর স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে যেন তার দমক রাখতে পারবে না ভেবে কাঠ হয় যায় ভয়ে।
নীচের পরিবারের মহিলা বলেন, "তোমার কাকু ফোন করেছিলো। অনন্য বিশেষ কাজে কলকাতাতেই আছে। বিকেলের মধ্যে আসতে পারবে। ভগবানের দয়া। তা কেঁদে আর কী করবে? জন্মিলে মরিতে হবে..."
কাকিমার মধুসূদন আবৃত্তি ঝুমুরের কানে যায় না। সে মায়ের বিছানার পাশের আয়নাটায় তাকিয়ে দেখে। নিজের পৃথুলা দেহের ঘর্মাক্ত মুখের স্বেদবিন্দুগুলি মুছে নেয়। আয়নায় দু-একটা খয়েরি টিপ এখনো আটকানো রয়েছে। একটার সঙ্গে লম্বা একটি চুল এঁটে আছে আয়নায় কাঁচে। মায়ের নরম মেডিকেটেড জুতো খাটের নীচে। শীর্ণ হাত, শিরাজালের আবরণে আজ বরফশীতল। একদিন কী নিবিড় উষ্ণতায় পুরো সংসার আর তাদের দুই ভাইবোনকে স্নেহের জালে জড়িয়েছিলো ওই হাত। অনন্য এলো। মায়া আসতে পারেনি।
তারপর শেষযাত্রা। গাড়িতে কয়েকবার ভাইয়ের বুকে ভেঙে পড়েছিলো ঝুমুর। অস্থি বিসর্জনের মুহূর্তে অনন্যর মনে পড়লো ছোটোবেলার কতো স্মৃতি, খেলাঘরের প্রথম সঙ্গিনী, গল্পের কথক --মা! কী আশ্চর্য ! শারীরিক যন্ত্রণা পেরিয়ে যিনি তাকে পৃথিবীর আলোয় আনলেন, আজ মানসিক যন্ত্রণা পেরিয়ে তাঁকে জীবনের ওপারে রাখতে এসেছে অনন্য! যার স্তন্যপান করেছিলো শিশুকালে, আজ সে তাকে গঙ্গোদক পান করানোর অধিকারী! বহুকাল আগে পড়া হাংরি আন্দোলনের একটি কবিতার লাইন মনে পড়লো তার।
শেষ বিকালের আলোয় গঙ্গার ঘোলাটে আঁচলের সামনে পৃথিবী ঝাপসা হয়ে উঠছে তার। তবু এখন অনন্যর এক চোখে শব, অন্য চোখে প্রসব। মায়া আসতে পারেনি আজ যেকারণে।
-- "ভাই, আমাকে তোরা খুব ঘৃণা করিস না?" একটি চুড়িবালায় ঠাসা হাত পিঠে ভারী ঠেকতে অনন্য ফিরে তাকালো।
-- "না --না কেন ওকথা?"
ঝুমুরের কর্কশ কন্ঠ বলে উঠলো, "ন্যাকামি করিস না। মায়ের শেষদিনগুলো পর্যাপ্ত চিকিৎসা হয়নি। কীভাবে চলতো আমি জানি সব! হবে না? এই অপোগন্ড মেয়েসন্তানকে পার করতে বাবা তো সব উজাড় করে দিয়েছিলো? সব--সব! হ্যাঁরে, আমি কি এতোই অপদার্থ ? বি.এ. তে কিন্তুতে আমার মার্কস কোনো অংশে কম ছিলো না।"
অনন্য তার অহংকারী ও অভিমানী দিদিটাকে তাকিয়ে দেখে।চাঁদরঙের জারদৌসীর আঁচল জড়িয়ে বিকেলের আলোয় তার ক্রন্দনরত দেহ কেঁপে উঠছে কান্নার দমকে। ঝুমুর লেখাপড়ায় ভালো ছিলো, একটু বেশীই ছিলো। কিন্তু ওর রেজাল্টগুলো যে বড়ো করে বিয়ের বিজ্ঞাপন কেন হলো! বাবা কেন ভাবলেন তার স্বাবলম্বী বৃক্ষ না হয়ে মহালতা হওয়া উচিত? তাই অর্থবান বনস্পতির গলায় জড়িয়ে দিয়ে গেলেন নিজের সর্বস্ব দিয়ে? আত্মপ্রকাশের অভাব আর নিজেকে দায়ভার ভাবার ক্রোধ তাকে এমন রুক্ষ করেছে। তাই মায়ার তীব্র যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিত্বময়ী আবহের মধ্যে ঝুমুর নিজের হারিয়ে যাওয়া কলেজবেলা আবিষ্কার করে। অথচ নিজের সেই ভাঙা টুকরোটির কাছে ফিরে নিজেকে গড়ে নেবার আর দিন নেই। ক্ষোভ তখন অক্ষম হয়ে ফেটে পড়ে। অনন্য ভাবে, সেকেলেপনা বড্ড বেশী ছিলো বাড়িতে। দিদিকে একটু বিশ্বাস করাই যেতো, নির্ভর করা যেতো তার উপরেও।
--"ঠান্ডা পড়ছে। বাড়ি চল।"
সেই ছোটোবেলার মতো যত্ন নিয়ে ঝুমুর অনন্যর হাত ধরে।
|| ২ ||
--- "দ্যাখো দেখি, এতো লৌকিকতার কি কোনো দরকার ছিলো?" ক্যাটারিং-এর ছেলেটার ধাক্কা বাঁচিয়ে ঘোষালবাড়ির মোহনকাকু বলেন। কমলাদেবীর শেষ কাজের পরদিন আজ নিয়মভঙ্গ। পাঁচরকমের মাছ সহ ভোজনের বিলাসিতা দুঃখকে ভুলিয়ে দিতে চেষ্টার কসুর করছে না। অবশ্য শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও কম কিছু হয়নি, তবে সে তো নিরামিষ। অনন্য যখন ক্যাটারিং-এর তদারকিতে ব্যস্ত, শোনা গেলো ঝুমুরের গলা
"এদিকে একটা পাবদা দিন। দু-পিস লুচি। হ্যাঁ, এইদিকে.."
অনন্য এসে দাঁড়াতে সে বলে, "মা একবার ফোনে বলেছিলো, পাবদা খেতে বড়ো ইচ্ছে করে। তখন পেরে উঠিনি সময়ের অভাবে। আজ সেটা পূর্ণ করে নিলাম।"
এনলার্জ করা ছবিতে কি কমলাদেবীর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে?
মিত্রজেঠু বলেন আরো কিছু কালোজাম মিষ্টি দিয়ে যেতে। পাশ থেকে জেঠিমার তাড়না, "ভুলে যেও না, তোমার কাল সুগার টেস্ট হয়েছে।"
--"আরে, আমার জিভের টেস্ট তো কেউ নিতে পারবে না।"
হাসির রোল ওঠে। সুরসিক বলে মিত্রজেঠুর খ্যাতি আছে।
--"শেষসময়টা কাছে থাকা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা কোনো ত্রুটি রাখলাম না, বুঝলেন?" কথাটা অনন্য বলার সময়েই মিষ্টি দইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো।কানে বেজে উঠলো ফোনের ওপ্রান্তের একটি গলা, যা হারিয়ে গেছে অনন্তলোকে।
-"ইন্দ্রধনু সুইটস্ থেকে এনে দিবি? বাবুন, সত্যি দিবি?"
যেন এক বালিকার উচ্ছলতাকে ধমকে থামিয়ে সে বলেছিলো, "দিনরাত মিষ্টি মিষ্টি কোরো না তো, শেষে আবার ডায়াবেটিস বাড়বে, আবার এক কান্ড!"
থাক, আত্মা গ্রহণ করবে। কিন্তু দর্শনকে অগ্রাহ্য করে কিছু বিদ্রোহী জলকণা চোখে ভিড় জমাচ্ছে কেন?
--"খুব ভালো খেলাম, ভাই।" এক মধ্যবয়স্কা মহিলা ঝুমুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যান।
--"আসি তাহলে।"
ভিড়ের জট কাটিয়ে হঠাৎ তার সঙ্গের অল্পবয়সী মেয়েটি চেয়ে প্রশ্ন করে, "ঝুমুরদি, তোমার শাড়িটা কি আগেকার? নাকি এই অকেশনে কিনলে?"