এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  ইতিহাস

  • আলোক পাঠ - পর্ব দুই

    হীরেন সিংহরায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | ইতিহাস | ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ৪৮ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
    মোজেস ও একেশ্বরবাদ : জিগমুণ্ড ফ্রয়েড দ্বিতীয় পর্ব

    মোজেস যদি মিশরীয়

    ফ্রয়েড মেনে নিচ্ছেন এ অবধি তাঁর অনুমানের সমর্থনে কোন  শিলালিপি  অথবা লৌহ স্তম্ভ খুঁজে পাওয়া যায় নি । যাকে আমরা সম্ভাবনা মনে করি সেটা যেমন সব সময় সত্য নয় তেমনি যেটা সত্য সেটাকে  কখনো সম্ভাবনা মাত্র মনে করা হয়ে থাকে।  তোরার পাঁচটি বই ( পেন্তেতয়খ )-জেনেসিস , একসোডাস, লেভিতিকুস, নাম্বারস , দয়ত্রনোমি – প্রথম পাঁচশ বছরে একাধিকবার সম্পাদকের টেবিল ঘুরে  হিব্রু বাইবেলে স্থান পেয়েছে।  তালমুদের প্রণেতাদের মধ্যে সত্যিকারের ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসা ছিলে কিনা সে প্রশ্নও ফ্রয়েড তোলেন।

    পৃথিবীর ইতিহাসে এমন  অগুনতি উদাহরণ আছে যেখানে কোন জাতি বা জনতার  বিশাল উদ্যোগের পুরোভাগে দেখা দিয়েছেন একজন বিশেষ মানুষ যাকে সকলে মান্য করেছেন। আমরা ধরে নিচ্ছি মিশরীয় মোজেস সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন- একটি জাতিকে  নেতৃত্ব দেবেন বলে ।

    প্রশ্ন উঠতেই পারে।

    এক মিশরীয় রাজকুমার, যিনি এক  প্রাদেশিক গভর্নর এবং সেই সূত্রে পুরোহিতের আসনেও  সম্মানিত মানুষ, তিনি  কেন এক দঙ্গল ছিন্নমূল বিদেশিকে   নিয়ে আপন রাজপাট,  ধনদৌলত এবং দেশ ছেড়ে মরুভূমিতে ঘোরাঘুরি করতে যাবেন? মিশরীয় সভ্যতা তখন তুঙ্গে পৌঁছেছে ;  বিদেশিদের প্রতি আত্ম অহংকারে গর্বিত মিশরের মানুষের অবজ্ঞা  ঐতিহাসিক ভাবে সুপরিচিত। তাঁরা মনে করেন এ দেশের বাইরে কেবল বর্বর মানুষের বাস । যে জনতাকে মোজেস দিশা দেখাবেন বলে পথে নামলেন তারা  কানান  থেকে আগত হত দরিদ্র উদ্বাস্তু মাত্র। আপন  দেশে খাবারের অনটন হয়েছিল,  প্রাণ ধারণের জন্য প্রথমে ইওসেফ মিশরে এলেন, পরে আপন গুষ্টিকে ডেকে আনলেন ( হিব্রু বাইবেলে এ তত্ত্ব সমর্থিত)। সেই যে খুঁটি গাড়লেন তারপর ফেরার নামটি করলেন না।

    এই পথ চলায় , নতুন জীবনে, নতুন অধ্যায়ে মোজেসের ভূমিকা কি শুধু এক দলপতির? না, তার চেয়ে অনেক বেশি । এই ছন্নছাড়া মানুষদের তিনি  কেবল একটি নতুন ধর্ম নয়, তার সঙ্গে দিলেন জীবন যাপনের আইন, শিক্ষা এবং নব চেতনা। সেই কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তী ধর্মগুলি ( ক্রিস্টিয়ানিটি , ইসলাম ) মোজেইক ধর্ম নামে খ্যাত হয়েছে।

    বর্তমান ইরাকের উর অঞ্চলে ( বাগদাদ থেকে বিকেলবেলা বাসরা পানে যে ট্রেনটি ছাড়ে , মধ্যরাতে সেটি  উর অতিক্রম করে  ) ঈশ্বরের সঙ্গে আব্রাহামের সাক্ষাৎকার হয়েছিল  । ঈশ্বর  বললেন তিনি আব্রাহাম এবং তাঁর ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য আবাসভূমি নির্ণয় করে রেখেছেন । আপাতত সিধে উত্তরে হারান (বর্তমান তুরস্ক) , সেখান থেকে বাঁয়ে মুড়ে আবার দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলে কানান -  হেবরন,  শেখেম। ঈশ্বরের  আদেশ অনুযায়ী আব্রাহাম এসেছিলেন জুদিয়াতে ( পরে রোমান পালাসতিনা ), সেখানে ঠিক গুছিয়ে বসার আগেই দেখা দিল দুর্ভিক্ষ অনটন।  তাঁর বংশধরেরা  পরিযায়ী মানুষ হয়ে গেলেন মিশরে , সেখানে কয়েকশ বছর বাস করেছেন।  এই পর্যায়ে  তাঁরা কোনো  একটা ধর্ম  আচরণ করেছিলেন- সেটি কি নিছক একেশ্বরবাদ ছিল ? হিব্রু বাইবেল এখানে স্পষ্ট করে সেই ধর্মাচরণের পদ্ধতি জানায় না।

    মোজেসের মনে যদি এক পাল মানুষের ধর্মগুরু হবার বাসনা জেগে থাকে তিনি তো মিশরেই একটা আখড়া বা ডেরা খুলে  প্রচলিত মিশরীয় ধর্মে দীক্ষা দিতে পারতেন, পরিচয় করাতে পারতেন আমোন,অসিরিসের সঙ্গে । তিনি তা করলেন না ।  মোজেস যা  শেখালেন  সেখানে জন্তু জানোয়ারের মাথা বসানো দেবতার  প্রতিকৃতি নেই । ঈশ্বর এক ,তাঁকে দেখা যায় না,  তাঁর মূর্তি গড়া, এমনকি তাঁর নাম নেওয়া মানা ( আমার ইহুদি বেয়াই তাঁর ই মেলে লেখেন thank G-d)। মিশরের মন্দিরে সূর্য , চন্দ্র,  পৃথিবীর দেবতা , তাঁদের বর্ণনায় গাওয়া হয় গাথা , কোন দেবতার সঙ্গে অন্য দেবতার বিরোধ বা লড়াই নেই । থিবসের মহা মন্দিরে অধিষ্ঠিত আমন- রে ( Amon-re) তিনি শহরের দেবতা , বাজপাখির মাথা ওলা সূর্য দেবতা , অন। তাঁদের বন্দনা হয় ঘটা করে, পুরোহিতরা ব্রেসলেট পরেন , জাদুর খেলা হয় । সে ধর্মে যমরাজের বিশাল বোল বোলাও , তাঁর নাম ওসিরিস।  জীবনে যদি দীপ জ্বালা না হয়ে থাকে ক্ষতি নেই, মৃত্যুর পরে কি হবে তার ঢালাও বন্দোবস্ত: দেহ সংরক্ষণ (মামি ) তার সঙ্গে জাগতিক ধন সম্পদ পাঠানো।

    ইহুদি চিন্তায় অমৃত পরলোকের  কোন চর্চা নেই।

    ফ্রয়েড বলেন মানুষ যার কণামাত্র দেখেনি সে রকম কিছু  সে কল্পনা করতে পারে না ( বোধহয় অলডাস হাক্সলি  বলেছিলেন, মানুষ ঘোড়া দেখেছে , পাখিও দেখেছে , দুটোকে জুড়ে একদিন বানিয়েছে পক্ষীরাজ, উড়ন্ত ঘোড়া ) । মোজেস ইহুদিদের কানে  যে ধর্মের মন্ত্র দিলেন সেটি  মন্দির, দেব মূর্তি, সুসজ্জিত পুরোহিত , বিশাল মন্দিরে অর্চনা সম্বলিত  ফারাওদের ধর্ম তো নয়!  তৎকালে  থিবস,  লুক্সরের বিধান যদি তিনি না মানবেন তাহলে মোজেস তাঁর নতুন ধর্মের পুঁথি বা ব্যাকরণ পেলেন কোথায়?  

    এর উত্তর পেতে হলে যেতে হবে  মিশরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অষ্টাদশ বংশের ( এইটথ ডিনাসটি ) কালে ,  আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭৫ সালে । মিশর তখন বিশ্বশক্তি , তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছে  নুবিয়া (সুদান),  সিরিয়া, লেবানন এমনকি মেসোপটেমিয়া অবধি । তাঁদের সৈন্য বাহিনী হেলিওপোলিস ( আক্ষরিক অর্থে সূর্যনগরী আজকের কাইরোর উপকণ্ঠ , আল মাতারেয়া ) থেকে মার্চ করে সমুদ্রের উপকূল ধরে আশদদ,  গাজা হয়ে  যে পথে  লেবাননের বিবলস পৌঁছেছেন , সেটি আজ ভিয়া মারিস নামে আমরা চিনি – এশিয়ার সঙ্গে  আফ্রিকাকে জুড়বার প্রথম হাইওয়ে( কয়েক বছর আগে তেল আভিভ থেকে যে পথে হাইফা গিয়েছি  সেটি ভিয়া মারিসের স্মৃতি বহন করে )।

    প্রসঙ্গত মিশরে তেমন গাছ গজায় না ,  লেবানন থেকে আসতো  সেদার কাঠ যা দিয়ে সকল মামির বাকসো বানানো হয়েছে।

    অন্যান্য দেব দেবীর পাশা পাশি  একটি সর্বশক্তি ও কল্যাণময় দেবতার সঙ্গে  ফারাওদের  পরিচয় ছিল , তাঁর নাম আতন। তৃতীয় আমেনহোতেপের শাসনকালে সূর্য দেবতার খাতির বিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছিল যদিও তিনি অন্য দেবতাদের বাতিল করেন নি ।

    পিতা তৃতীয় আমেনহোতেপের মৃত্যুর পরে ফারাওয়ের আসনে বসলেন আমেনহোতেপ চতুর্থ । অবিলম্বে তিনি কেবল সে নাম পরিবর্তন করে ইখনাতন  হলেন তাই নয়, মাত্র সতেরো বছরের রাজ্যকালে মিশরীয় দেব দেবীদের  এবং পুরোহিতদের নির্বাসন দিয়ে জানা ইতিহাসে প্রচলন করলেন প্রথম এবং কঠোর একেশ্বরবাদ । আজকের তেল আল আমারনায় পাই তাঁর শিলালিপি ।

    ব্রেসটেড তাঁকে বলেছেন দি ফার্স্ট ইনডিভিজুয়াল ইন হিউম্যান হিস্ট্রি ।*

    নতুন ফারাও নাম নিলেন ইখনাতন, ঈশ্বর প্রসন্ন । ইখনাতনের একমাত্র ঈশ্বর -  সূর্য দেবতা আতন।  থিবসের দেবতা আমোন বা আমুন – সে নাম নিতেন ফারাওরা , যেমন টুট আনখ -আমুন   তেমনি আমোনহাতেপ । ইখনাতন  নিজের নাম থেকে আমোনকে বাতিল করলেন না শুধু , থিবস এবং আমোনের ছায়া অবধি পরিত্যাগ করে  নতুন রাজধানী তৈরি বানালেন, তার নাম আখেনাতন , সূর্যের দিগন্ত। সেখানে বর্জিত হল যাবতীয় দেব দেবীর পূজা আচ্চা, ম্যাজিক , যমরাজ ওসিরিসের পরাক্রম। নেক্রোপোলিস বা  মৃতের নগরীর কোন ভূমিকা নেই ।

    ঈশ্বর এক-  সূর্য , তাঁর রশ্মিতে পৃথিবী সচল,  তাঁর প্রতীক একটি গোল চক্র বা ডিস্ক যে থেকে বিচ্ছুরিত হয় আলোর বল্লম।

    এখানে আমার মনে একটু খটকা লাগে যার  উত্তর এ বইতে পাই নি।  আমরা যাকে আখেনাতন নামে জানি, ফ্রয়েডের কাছে তিনি ইখনাতন কিন্তু শহরের পরিচয় দিলেন  আখেনাতন বলে , যার অর্থ সূর্যের  দিগন্ত।

    আখেনাতন আজকের তেল আল আমারনা।  সেখানে  পাওয়া গেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো সূর্য বন্দনার শিলালিপি- “ তুমি একমাত্র ঈশ্বর তুমি ব্যতীত আর কোন ঈশ্বরের অবস্থিতি নেই “।


    আখেনাতেন ও নেফারতিতি

    রাজকুমার মোজেস রাজপাট ছেড়ে কানান থেকে আসা ইহুদিদের যে  নতুন ধর্মে দীক্ষিত করলেন তার উদ্গাতা ইখনাতন। এবার ফ্রয়েড ইহুদি ধর্মের সঙ্গে ইখনাতনের একেশ্বরবাদের তুলনা করেন। তিনি মেনে নিচ্ছেন ইখনাতনের আতন বা সূর্য দেবতা ভিত্তিক একেশ্বরবাদের বিষয়ে আমরা খুব বিশদ জানি না কারণ তাঁর মৃত্যুর পরে সে ধর্ম সম্পূর্ণ বিবর্জিত হয়েছিল, ফারাও হারেমহাব  ও তাঁর পুরোহিতরা নৃশংসভাবে ইখনাতনের সকল চিহ্ন অগ্নিতে নিক্ষেপ করেন।

    অনেক কাটা ছেঁড়া সম্পাদনা করে যে, ইহুদি বাইবেল লেখা হলো , সেটা তো মোজেসের আটশো বছর পরের কাহিনি , ব্যাবিলনে বনবাসের  ( Exile)  কালে।  অতএব একসোডাস, মিশর ত্যাগ করার সময়ে ইহুদি ধর্মের আচার আচরণ পদ্ধতিও  আমরা সঠিক জানি না । তবে এই দুই ধর্ম একই বিশ্বাস ও আস্থার ওপরে প্রতিষ্ঠিত – ঈশ্বর এক ।

    আর কিছু ?

    মিশরীয় ভাষায় ইখনাতনের  ঈশ্বরের নাম আতন, সিরিয়ান আদোনিস,  হিব্রুতে আদোনাই।

    যে কোন প্রভাতে , পুণ্য কর্মে , মৃত্যু কালে ইহুদি যে  প্রার্থনা করেন সেটি  শেমা ইসরায়েল -

    শেমা ইসরায়েল আদোনাই এলোহেনু আদোনাই এখাদ( Schema Jisroel Adonai Elohenu Adonai Echod)

    শোনো  ইসরায়েল , আমার প্রভু আমার ঈশ্বর , আমার  প্রভু এক

    তেল আল আমারনার শিলালিপিতে আছে , আমার ঈশ্বর আতন , তিনি একমাত্র ঈশ্বর ।

    হিব্রু বাইবেলের বুক অফ সামসের ১০৪ নম্বর সাম বা গীতির ও আতনের বন্দনার সঙ্গে  আশ্চর্য মিল দেখা যায় *

    ইহুদি ধর্মে ঈশ্বরের রূপ অজ্ঞাত ,  ইখনাতনের ঈশ্বর , সূর্য দেবতা, একটি গোল চক্র।  আমাদের মনে রাখতে হবে ইখনাতনের একেশ্বরবাদ একটি প্রতিবাদী ধর্ম , এই প্রতিবাদ ছিল তৎকালে প্রতিষ্ঠিত দেব দেবী পুরোহিত অধ্যুষিত এক আচারিক ধর্ম প্রথার বিরুদ্ধে।  ইখনাতন তাঁদের কেবল বর্জন করেন নি, জাগতিক মরণের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্ত জীবন লাভের থিওরির মূলে আঘাত করেছেন যমরাজ অসিরিসকে মৃত্যুলোকে পাঠিয়ে দিয়ে। ইখনাতন সে অর্থে মিশরীয় ধর্মের সংস্কার করলেন। ইহুদি ধর্মের কোন প্রতিবাদী চেহারা ছিল না,  থাকার কথাও নয়। তাঁদের কাছে পরলোকে গয়নাগাঁটি  আসবাবপত্র নিয়ে হাজির হবার প্রশ্ন ছিল না। ফ্রয়েড বলেন একেশ্বরবাদে মৃত্যুর পরে আরেক  জীবন অকল্পনীয়।



    ফারাও আখেনাতেন

    মোজেস ইখনাতনের সমসাময়িক , মনে প্রাণে তিনি একেশ্বরবাদকে গ্রহণ করেছিলেন ।  ইখনাতনের মৃত্যুর পরেই একেশ্বরবাদ ফারাও ও পুরোহিতের দ্বারা বাতিল হল।  কিন্তু  মোজেস তাঁর আস্থাকে   ত্যাগ করলেন না ।  তিনি চাইলেন এই ইখনাতনের শিক্ষা , তাঁর বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে। ইখনাতনের পরে এক ঈশ্বরের বন্দনা গীতি গাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ । তাহলে  মোজেসকে একাই হাঁটতে হবে তাঁর বিশ্বাস নিয়ে ? ধর্ম প্রচারক হতে গেলে  চাই শিষ্য , যারা তাকে অনুসরণ করবে। মিশরের মানুষের কাছে আতন বন্দনা , এক ঈশ্বরের বার্তা পৌঁছুতে গেলে শাস্তির সম্ভাবনা । মিশরীয় সমাজ বিধি অনুশাসনের  বাইরে যে কিছু মানুষ আজকের ভাষায় জবর দখল কলোনিতে বাস করে,  যাদের আমোন অথবা রার মন্দিরে যাবার অধিকার নেই , ইচ্ছেও নেই , সেই  ইহুদিদের ইখনাতনের একেশ্বরবাদে দীক্ষা দেবার সঙ্কল্প নিলেন রাজপুত্র মোজেস।

    ইখনাতন ছিলেন এক নিঃসঙ্গ পথিকৃৎ ( সম্রাট আকবরের দিন-ই-ইলাহি যেমন )  পুরোহিত ও দেব দেবীদের  নির্বাসন দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল কিন্তু প্রজাদের কাছে তাঁর চিন্তা পৌঁছে দিতে তিনি ছিলেন অক্ষম । মোজেস এক রাজকুমার,  সরকারি গভর্নর তিনি যখন  ইহুদি মোড়লদের  সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, তাঁরা প্রথমে সন্দিগ্ধ পরে বিস্মিত হলেন :এক ক্ষমতাবান  মিশরীয় এই দরিদ্র ইহুদিদের সঙ্গ দেবেন ? মোজেস হয়তো বললেন, তোমাদের হারানোর কিছুই  নেই, আস্থা রাখো , আমি তোমাদের লোক, মামেকং শরনং ব্রজ ।, কানানের  গল্প শুনেছ বৃদ্ধদের কাছে, তাঁরাও  সেটা চোখে দেখেন নি । আমার অনুসরণ করো, চলো তোমাদের নিয়ে যাব  সেই দেশে।   
     
    আরেকটি জিনিস লক্ষণীয় ।  

    নতুন ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে মোজেস আবশ্যিক  করলেন সুন্নত প্রথা , যা বহু হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র মিশরেই  দেখা গেছে। যদিও সে দেশে এটি ছিল সামাজিক রেওয়াজ, ধর্মীয় বাধকতা নয়। খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ইতিহাসের পিতা হেরোডোটাস মিশর পরিক্রমার পরে লেখেন , মিশরীয়  ধর্মভীরু , তাঁরা গড়েছেন এক উন্নত সমাজ । সামাজিক ভাবে বরাহকে অপরিচ্ছন্ন ঘোষণা  করা হয়েছে । মাতৃ রূপিণী দেবী ইসিসের  ( আইসিস ) শিরে গরুর শিং – তাই এঁরা গোবলি দেন না , গোমাংস ভক্ষণ করেন না ।  ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার খাতিরে সুন্নত প্রথা প্রচলিত।

    আড়াই হাজার বছর বাদে  মামির বাকসো খোলা হলে  এই তথ্য প্রতিপন্ন হয়েছে।

    বেশী বয়েসে মোজেসকে সুন্নত করানোর যে গল্প চালু আছে তাকে ফ্রয়েড বর্জন করেছেন -হিব্রু বাইবেলে স্পষ্ট বলা আছে জশুয়া কানান পৌঁছে ইহুদিদের জন্য সুন্নত প্রথা প্রচলিত করেন।

    রাজকুমার মোজেস আর ইহুদিদের নেতা  মোজেস কি একই লোক ? ফ্রয়েড তাঁর থিওরির সমর্থনে মোজেসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনুসন্ধান করেছেন । রাজকুমার মোজেস যুদ্ধ বিজয়ী সেনানায়ক কিন্তু তিনি বদমেজাজি,  জেদি,  একরোখা এবং তোতলা। ফারাওয়ের সঙ্গে কোন আলোচনায় বসতে গেলে মোজেস তাঁর ভাই আরনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন ;  তোতলা  মোজেসের কথা শুনে এবং তার অর্থ উদ্ধার করে ফারাওয়ের কাছে তা পেশ করতেন । হিব্রু বাইবেলের মোজেস এই সবগুলি গুণের অধিকারী ! সেখানেও তাঁকে ভাষণ দিতে দেখা যায় না, অন্য কেউ তাঁর কথাগুলি সহজ করে শোনান ( আজকের টেলি প্রমটারের মতন, মোজেসের তোতলামি নিয়ে অজস্র ইহুদি রসিকতা আছে )। এ থেকে ফ্রয়েড অনুমান করেন মোজেস ইহুদিদের সেমিতিক ভাষায় সড়গড় ছিলেন না ।  তাই শুরুতে তাঁর অনুবাদকের প্রয়োজন হয়েছিল ।

    ইখনাতনের মৃত্যুর সঙ্গে কি শেষ হয়ে যাবে তাঁর চিন্তা , তাঁর একেশ্বরবাদ? সেই সময়ে ইখনাতনের ধর্ম চিন্তায় উদ্বুদ্ধ  মোজেস ছিলেন পূর্ব সীমান্তবর্তী গোসেনের গভর্নর । সত্বর তিনি বুঝলেন  নতুন ফারাও ইখনাতনের ভাবনা ও  বিশ্বাসকে নির্মূল করে পুরোহিততন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী ।  মিশরে না হোক , অন্য কোথা অন্য কোন খানে  মোজেস  সেই একেশ্বরবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেন; খুঁজলেন এবং পেলেন এমন কিছু পরিযায়ী সেমিতিক মানুষ যারা তাঁর নেতৃত্বকে মেনে নিলো। ফারাও হারেমহাবের রাজত্বে এই চিন্তার স্থান নেই। মোজেস তাঁর অনুগামীদের নিয়ে পুব মুখে যাত্রা শুরু করলেন। তখনো রাজ দরবারে মোজেসের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল । তাঁকে আটকাবে কে ?

    বাইবেলের নাটকীয় ঘটনাবলি - ফারাওয়ের বাহিনী ধাওয়া করেছে ইহদিদের , লোহিতসাগর ভাগ হয়ে গেলো ইহুদিরা পার হলে আবার জুড়ে গিয়ে ভাসিয়ে দিল ফারাও বাহিনীকে   - এই সব গল্পকে  সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে ফ্রয়েড বললেন ওটা আটশো বছর বাদে বানানো চিত্রনাট্য । মোজেসকে কেউ তাঁর যাত্রায় বাধা দেন নি।

    কতদূরে কোথায় শেষ হবে তাঁর যাত্রা ?
    ক্রমশ

    *
    হিব্রু বাইবেলে জোব এবং প্রোভারবের মাঝমাঝি ,(রাজা ডেভিডের নামাঙ্কিত)  পাওয়া যায় ঈশ্বর বন্দনার ৩৫টি গাথা , সব মিলে সাম ১০৪ ( হিব্রু তেহিলিম )। ফ্রয়েড এর উল্লেখ করেন নি। এটি আমার সংযোজন।

    শুরু হয়

    ঈশ্বর , তুমি আমার প্রাণ , ঈশ্বর তুমি মহান ( আল্লাহু আকবর !)

    কিছু তালমুদ বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেন ১০৪ নম্বর সাম বা প্রার্থনা গীতির সঙ্গে আতন বন্দনা অনেকটাই মিলে যায়।
     
    সাম ১০৪ (২০-২১) তুমি অন্ধকার আনো, রাত আসে, অরণ্যে পশুদের আনাগোনা , খাদ্যের জন্য গর্জন করে সিংহ ।
     
    আতন গাথা (২-৩) সূর্যাস্তে নেমে আসে অন্ধকার । অরণ্যে পশুরা করে বিচরণ ।  আঁধারের কম্বলে ঢাকা বনে সিংহ করে গর্জন ।
     
    সাম ১০৪ (২৫-২৬ )  এই যে সাগর , বিশাল সেখানে খেলে বেড়ায় কত প্রাণী ; জাহাজ আসে যায় তার আশে পাশে ঝাঁপায় , খেলা করে মাছের দল
     
    আতন গাথা (৬) এই জলে বয়ে চলে বজরার সারি, চারিদিকে । তোমার রশ্মি পড়ে জলে , মাছেরা ঝাঁপায় ।
     
    সাম ১০৪ ( ২৪) কি বিচিত্র তোমার সৃষ্টি , পৃথিবীকে ভরিয়ে দিয়েছ অজস্র প্রাণীতে
     
    আতন গাথা ( ৩৭) কত কিছু দিয়ে তুমি ভরিয়ে দিয়েছো পৃথিবীকে ,  কিছু দেখা কিছু ঢাকা, হে আমার একমাত্র ঈশ্বর
     
    সাম ১০৪ ( ২২-২৩ ) সূর্য ওঠে , মানুষ কাজে যায় , কাজে করে সন্ধ্যা অবধি
    আতন গাথা ( ৪-৫) সকাল যখন হয় তুমি দেখা দাও দিগন্তে অন্ধকার ঘুচে যায় ; মানুষ তোমার বন্দনা করে দুটি হাত তুলে ; সমস্ত জগত কর্মে  ব্রতি হয়
     
    সাম ১০৪ ( ২৭) তুমি হাত খুলে দিয়ে দাও সকলের খাদ্য , তারা সকলে সুখী 
     
    আতন গাথা (১২-১৫)  তুমি স্থান দিয়েছ সকলের;  দিয়েছ খাদ্য সকলে সুখী

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • আলোচনা | ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন