বছর বিশেক আগে লন্ডনের দক্ষিণে নিউ মলডেনে এক পরিচিত জনের বাড়িতে আমি এই বইটি প্রথম দেখি । কয়েক পাতা উলটে চমকাতে হয়েছিল । সেখানে বসে পড়া যায় না, বই ধার নিতে লজ্জা করে। আমাজন তখন অনেক দূরে। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, সময় জোটেনি । এখন আমার হাতে কাল অন্তহীন , আমাজন দু দিনে বই পাঠিয়ে দেয় ।
ভূমিকা
১৯১২ সালে অটো র্যাঙ্ক ও হানস সাখসের সঙ্গে জিগমুণ্ড ফ্রয়েড ভিয়েনাতে ইমাগো ( গ্রিক, ইমেজ ) নামের একটি জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার বিষয় শিল্প , কলা এবং সকল প্রকার মানবিক ক্ষেত্রে সাইকো অ্যানালিসিসের প্রয়োগ ।
১৯৩৭ সালে ইমাগোর তেইশ নম্বর ভলিউমে ফ্রয়েড একটি প্রবন্ধ লেখেন তার নাম “মোজেস মিশরের মানুষ ”। দুটি সংখ্যা বাদে তিনি লেখেন , “ মোজেস যদি মিশরীয় হতেন” ।
মার্চ ১৯৩৮ সালে নাৎসিরা অস্ট্রিয়ার দখল (আনশ্লুস) নিলেন। মাস খানেকের মধ্যেই কোন কারণ ব্যতীত ফ্রয়েডের বাড়ি ও অফিসের খানা তল্লাশি হয় , মেয়ে আনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ দফতরে ডাক পড়ে । আসন্ন ইহুদি নির্যাতনের সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে ফ্রয়েডের এক অনুগত শিষ্য আরনেসট জোনস তাঁকে লন্ডনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন । সাবাথের দিন, শনিবার ৪ জুন ১৯৩৮ তিনি শেষ বারের মতন ভিয়েনা ত্যাগ করলেন । লেখক বন্ধু স্টেফান তসোয়াইগকে এক লাইনের চিঠি লেখেন – “চলে যাচ্ছি , নতুন ঠিকানা ৩৯ এলসওয়ারদি রোড , লন্ডন এন ডব্লিউ ৩”।
এই সময়ে তিনি তৃতীয় প্রবন্ধ লিখেছিলেন “ মোজেস, তাঁর অনুগতজন এবং একেশ্বরবাদ “। ফ্রয়েডের শেষ লেখা। ।তাঁর জীবদ্দশায় এটি ছাপা হয় নি।
মোজেসকে নিয়ে লেখা তিনটি প্রবন্ধ অনুবাদ ও একত্রিত করে এক মলাটের মধ্যে আনেন ক্যাথারিন জোনস। ‘ মোজেস অ্যান্ড মনোথেইজম’ বইটি প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ । এক বছর আগে , ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ ফ্রয়েড তাঁর হ্যাম্পস্টেডের বাড়িতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
প্রথম অধ্যায়
মোজেস মিশরের মানুষ
যে শিশুটিকে গঙ্গার জলে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন মাতা কুন্তী , সে হারিয়ে যায় নি । বাকিটা আমাদের সবার জানা । অধিরথের সংসারে লালিত হয়ে কর্ণ একদিন বীর যোদ্ধা পরিগণিত হবেন ।
রাজা প্রিয়াম স্বপ্ন দেখলেন তাঁর আসন প্রসবা স্ত্রী হেকুবা যে সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন সে একদিন ট্রয় রাজ্যের বিনাশ করবে । পুত্র ভূমিষ্ঠ হলে রাজা তাকে তাঁর প্রধান পশুপালক আগেলাউসের হাতে তুলে দিয়ে তার নিধনের আদেশ দিলেন । আগেলাউস সেটি করতে পারলেন না , শিশুটিকে দূর পাহাড়ে রেখে এলেন । রাজাকে বললেন কর্ম সম্পন্ন । ন দিন বাদে সেখানে গিয়ে আগেলাউস দেখেন শিশুটি জীবিত , মায়া হলো। পিঠে বাঁধা একটি ব্যাগে ( গ্রিক পেরা ) তাকে বাড়ি নিয়ে এলেন, পেরায় আনা শিশুর নাম দিলেন পারিস । একদিন পারিস স্পারটার রানি হেলেনকে অপহরণ করবেন । স্পারটার রাজা মেনেলাউসের প্রতিহিংসার আগুনে ট্রয় বিধ্বস্ত হবে।
শিশু একদিন পিতৃহন্তা হবে , মাতাকে বিবাহ করবে এমনি দৈববাণী শুনে রাজা লাইউস তাঁর পশুপালককে বললেন এই শিশুকে পাহাড়ের ওপরে রেখে এসো , সেখানেই সে মারা যাবে । অয়েদিপাউস বাঁচলেন, সকল ভবিষ্যতবাণী ফলে গেল ।
মিথোলজিতে এহেন উদাহরণ অনেক।
নাতি একদিন তাঁর রাজত্ব দখল করবে এই দৈববাণী শুনে মেসোপটেমিয়ায় উড়ুকের রাজা অয়কোরোস শিশু গিলগামেশকে প্রাসাদের দেওয়াল থেকে ছুড়ে ফেলেন। এক ঈগল পাখি শিশুকে রক্ষা করে। কালক্রমে ব্যাবিলনের রাজা হলেন গিলগামেস।
শিশু হেরাকলেসকে ( হারকিউলিস ) মারবার জন্য তার বিছানায় সাপ ছেড়ে দেওয়া হয় হেরাকলেস তাকে বধ করেন।
ফ্রয়েড এখানে একটি প্যাটার্ন খুঁজে পান –
এই সব গল্পে দেখা যায় নায়ক উচ্চ বংশীয় অথবা রাজপুত্র , পরিবারের কেউ একটা স্বপ্ন দেখবেন বা ডেলফির ভবিষ্যতবাণী শুনবেন – এই ছেলে বাঁচলে রাজ্যের কলঙ্ক বা অমঙ্গল অথবা ধ্বংস অনিবার্য । রাজা সেই শিশুকে হত্যার নির্দেশ দেবেন কিন্তু সে বাঁচবে হয় ছিন্ন পাতার তরণীতে ভেসে , কোন প্রাণীর কল্যাণে অথবা দরিদ্র কোন মানুষের সেবায় । কালক্রমে আমাদের নায়ক তার প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পাবেন, ব্যক্তিগত সফলতা যেমন অর্জন করবে তেমনি দৈববাণীকে সত্য প্রমাণিত করবে।
নায়ক জন্মাবে ধনী সংসারে , বড়ো হবে দরিদ্র পরিবারে অথবা অরণ্যে ( অয়দিপাউস ব্যতিক্রম , তিনি লালিত হবেন এক রাজ পরিবারে)। সেই দারিদ্র্য থেকে নায়কের ঊর্ধ্বে আরোহণ ।
মোজেসের যে কাহিনি আমাদের শোনানো হয় সেখানে তিনি জন্মেছিলেন দরিদ্র ইহুদি লেভাইট সংসারে, তারা শিশুটির কল্যাণের বাসনায় তাকে ভেলায় তুলে দেন, যদি কোন সহৃদয় পরিবার তাঁর দেখাশোনা করে – সেই ভেলা পৌঁছুল মিশরের রাজ পরিবারে, সে পেল ঘর সম্মান আদর যত্ন। রাজ পরিবার জানতেন না সে ইহুদি।
ফ্রয়েড বলছেন এই শিশু কোন হিব্রু বংশজাত নয় । প্রচলিত পৌরাণিক গল্পটি মানতে তিনি নারাজ। এখানে তিনি জার্মান ঐতিহাসিক এডুয়ার্ড মায়ারের দ্বারস্থ হয়েছেন – মায়ার লিখেছেন ফারাও একদিন স্বপ্ন দেখেন তাঁর নাতি ( কন্যার সন্তান ) বড় হয়ে ফারাওয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবে , সাম্রাজ্যের পতন ঘটাবে; তাই সে শিশু জন্মালে তাকে পাপিরাসের ভেলা বেঁধে নীল নদের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কোন হিব্রু মহিলা তাকে জল থেকে উদ্ধার করেন আরও এক ধাপ এগিয়ে ফ্রয়েড বলেন এ যে নীল নদ তাও মেনে নেওয়া শক্ত। এটা হিব্রু বাইবেলের গ্রহণযোগ্য নয় – তোরা বলে এক ইহুদি মহিলা মোজেসকে জলে ভাসিয়েছিলেন , জল থেকে তুলে আনেন নি। তর্জনী তুলে তাই বলা হয়-খামোশ।
তাহলে এখানে দুটো গল্প পাওয়া গেলো - একটি ইহুদি অ্যাংগল থেকে অন্যটি মিশরীয় । মিশরীয় গল্পে শিশুটিকে বড়ো রোল দেওয়া যায় না, তিনি তাদের কোন কীর্তি বর্ধন করেন নি। কিন্তু ইহুদিদের গল্পে প্রয়োজন ছিল এক মহানায়কের , উদ্ধার কর্তার।
আমরা দেখেছি মিথোলজির শিশু পরিত্যক্ত হয়ে সাধারণ ঘরে বড়ো হন, পরে নিজ শক্তিতে প্রতিকূলতাকে জয় করেন, তাঁর যোগ্য মর্যাদায় পৌঁছান, কোন রাজাকে হত্যা করেন বা রাজ্য জয় করেন। তাঁর স্টেটাস ক্রমশ বাড়তে থাকে। আমাদের কাহিনিতে মোজেসের কেস উলটো – বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী মোজেস যখন আবিষ্কার করলেন তিনি ইহুদি , তৎক্ষণাৎ রাজসুখ পরিত্যাগ করে ইহুদিদের সঙ্গে দারিদ্র্য ও কঠিন জীবন বেছে নিলেন। তাই প্রশ্ন ওঠে - নীল নদে একটি পাপিরাসের ভেলায় চড়ে যে শিশুটি মিশরীয় রাজকুমারীর কাছে পৌঁছুল সেটাও কি এমনি কোন পূর্ব নির্দিষ্ট চিত্রনাট্যের প্রথম দৃশ্য ?
নাম মোশে (হিব্রুতে Mosheh; বাইবেলের গ্রিক অনুবাদে S যোগ হয়; সেই ভার্শন জনপ্রিয় হয়েছে তাই তাই আমরা জানি মোজেস )। হিব্রু বাইবেলে এই নাম করণের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে : হিব্রুতে মোশে মানে ‘ যাকে তোলা হয়েছে বা টেনে আনা হয়েছে’ । এক্ষেত্রে সীমিত অর্থে জল থেকে যাকে তোলা হয়েছে। গল্প অনুযায়ী ভেলা থেকে সেই শিশুকে টেনে তুললেন এক মিশরীয় রাজকুমারী । হিব্রু তিনি শিখলেন কোথায় ? বাইবেল নিশ্চুপ।
কিন্তু বাইবেলের দাপটকে অস্বীকার করে কে ? তাই মোজেসকে হতে হলো হিব্রু বংশোদ্ভূত, প্রতিপালিত হলেন মিশরের রাজ অন্তঃপুরে , একদিন হিব্রু জাতির পাশে দাঁড়ালেন, তাদের বন্দি দশা থেকে মুক্তি দিয়ে লোহিত সাগর পেরিয়ে সিনাই পর্বতে ঈশ্বরের বাণী শোনালেন। হিব্রু বাইবেল যে তাই বলে।
মিশরীয় ভাষায় মোসে শব্দের অর্থ শিশু । কার শিশু বা কেমন শিশু বোঝাতে একটি উপসর্গ যোগ হয় যেমন আমোন-মোসে, রা-মোসে , টুট -মোসে । এখানে সেই উপসর্গটি অনুপস্থিত – ইনি শুধুই মোসে ।
ফ্রয়েডের মতে বাইবেল কিছুতেই মানতে পারে না মোজেস আদতে মিশরীয় রাজকুমার , হিব্রু রক্ত তাঁর ধমনিতে নেই। তাহলে একসোডাসের গল্পটা ধোপে টেকে না । প্রাচীন গল্পের হিরো যেমন কর্ণ হারকিউলিস গিলগামেশ রোমুলাস যাদের কথাই আমরা ভাবি না কেন , সেখানে দুটি পরিবার জুড়ে আছে, এক পরিবার শিশুকে ত্যাগ করে , আরেক পরিবার জ্ঞানে অজ্ঞানে তার প্রতিপালন করে । সেই মানুষটির খ্যাতি প্রতাপ ক্ষয় অবক্ষয় দেখা দেয় সেই দ্বিতীয় পরিবারে । সূত পুত্র কর্ণ মহাভারতের যোদ্ধা।
ফ্রয়েড এই সিদ্ধান্তে এলেন - মোজেস মিশরের উচ্চবংশে জন্মেছেন , তিনি মিশরীয় । ভাসমান ভেলা মাতৃগর্ভের প্রতীক, , জলে ভেসে চলেন নতুন জীবনের সন্ধানে। যে শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল শূন্য, সে এগিয়ে চলে স্বনির্বাচিত কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের পথে।
কি সেই উদ্দেশ্য ?