রামুয়া চেঁচিয়ে ডাক দেয়, দাদা ও হারুদা, গেন্দার মালাটা এনেচো নাকি পয়সা হাপিস করে দিইয়েচো গো ?
রোদ্দুরে পা শুকাচ্ছিল হারু। লিকলিকে সরু পা। শুকিয়ে মরা কচুরিপানার রঙ ধরেছে। দু গোড়ালি আর হাঁটুর কাছে রবারের কতগুলো কালোরঙের ব্যান্ড। বাতের ব্যথা কমানোর বিনা পয়সার নিরাময়ী। অধিকাংশ গরিব দুখী নারীপুরুষদের হাতে পায়ে এগুলো পরতে দেখা যায়।
আজকাল জলে নামলে এমন রিগরিগে টান ধরে ওর পা দুটোতে, একেবারে সহ্যের অতীত হয়ে যায়। হারু তখন অপার হয়ে পড়ে। চাইলেও কিছু করতে পারে না। রামুয়াই যা যা করার সব করে দেয়। এ দু বছরে রামুয়া বেশ শিখে গেছে কখন কি করতে হবে সে সব কাজের অন্দিসন্ধিগুলো।
চন্দনবাবুর গোহাল ঘরে তিরিশটা গরুর সাথে ওরা থাকে। বর্ডারের কাছাকাছি এক গ্রামে ওদের গোহাল। সেখানে একটা টিভি টাঙ্গিয়ে দিয়ে গেছে বাবু। বাংলাদেশ থেকে মাঝে মাঝে বড় পার্টি আসে। দু একজন বেআইনিও থাকে। তারা ঘাপটি মেরে এ গোহালে থাকে এক বা দুদিন। তখন টিভি দেখে। দেদার খায়। বড্ড খরুচে হয় বাঙ্গালরা। খোলামকুচির মত টাকা উড়ায়। এপারের বিরিয়ানী খেয়ে ছ্যা ছ্যা করলেও দিব্যি দু চার প্লেট মেরে দেয়। সস্তায় রাম আনায়। সাথে বিশাল প্লেট ভর্তি চাট আসে। কি নেই সেখানে। সে কদিন রামুয়া খুব খুশি থাকে। হারুও । কিন্তু চন্দনবাবুর ভয়ে আধামরার মত ঢুকরে ঢুকরে মদ খায়। হাবুল আর বাবুল শেখ ফ্যা ফ্যা করে হাসে, দাদার হইল ভয় জাত ! পুতুর পুতুর জানপ্রাণ। বাঙ্গাল হইলে বুঝতা দাদা ।
তাই শুনে আরও কুঁচকে যায় হারু। মনে মনে বিড়বিড় করে, খেপুপাড়া কি বাংলাদেশে ! আচ্ছা, খেপুপাড়া নাকি হাবড়া ! সে আসলে কে ?
এবার মোছলমানদের ঈদ হয়েছে ম্যন্দামারা। চন্দনবাবুর গরুর ব্যবসা জব্বর লস খেয়েছে । হারু যদিও রামুয়ার সাহায্যে কিছু গরু নদিপথে পার করতে পেরেছে। কিন্তু সে আর কটা। কী এক অসুখ এসেছে দেশে। টিভিতে শুনেছে। দেখেছেও। লাল রঙ্গনফুলের থোকার মত । উড়ে উড়ে ভেসে আসে মানুষের দিকে। শরীরের যে ফুটোগুলো দিয়ে মানুষ নিঃশ্বাস নেয়, খায় সেই ফুটোতে একবার ঢুকে পড়লে আর রক্ষা নাই। সেই ভয়ে নাকমুখে ঠুলি পরে ঘুরছে সবাই। ওরা অবশ্য সারা দিনরাত গোরুর সাথেই থাকে। চন্দনবাবু বলে গেছে, গরিবদের করোনা ধরেনা। দেখছিস ত মরছে কারা। গোরুগুলো সাবধানে রাখিস।
তবু দুটো মাস্ক কিনে এনেছে রামুয়া।
পাড়ার দাদারা বলে চিনা শালারাই নাকি এ অসুখের ভাইরাস ছেড়েছে। নাক ফেটা হারামজাদা জাত। ভারতমাতার চরম শত্রু। টিভিতে চিনা মানুষদের ছবি দেখেছে হারু। ষ্টীলের থালার মত গোল চকচকে চেহারা। বাচ্চাকাচ্চা বুড়ো একরকমের দেখতে। বনগাঁর আকবর আলিদাদার দোকানে সাজানো থালার মত। কে জানে বাবা, মানুষ মেরে এদের কি সুখ !
আজকাল বাইরে কোথাও যাওয়া হয় না হারুর। গোহালেই থাকে। যত্ন নেয় গরুগুলোর । প্রত্যেক মাসের প্রথম রবিবার তিরিশটা গরু আর ওদের খাবার দিয়ে যায় চন্দনবাবু । তখন গরুগুলোকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করে। গাল দেখে , দাঁত দেখে , পেটে হাত বুলোও, গাভিদের ওলান ধরে পরীক্ষা করে। কোন গরুকে রোগা লাগলে জানতে চায়, কি রে হারু। খাবার দিসনি নাকি ?
কাঁচা টাকা দেয় না তেমন। রামুয়া তাই কী করে যেন বাড়তি পয়সা রোজগার করে। আগে খেত বিরিয়ানি। এখন লেবু, চিনি, চা পাতা কিনে আনে। মাঝে মাঝে বাসি পাউরুটি, আপেল, কমলা, বিস্কিট নিয়ে আসে। সেগুলো গরম জলে ধুয়ে কেটে হারুকে দিয়ে নিজেও খায়। হারু ভয় পায়, তুই ভিক্ষে করিস না ত রামুয়া ? বাবু জানলে জলে ফেলে মেরে দিবে তোকে।
ফুটন্ত জলে এক চিমটি পাতা ফেলে রামুয়া জানায়, ভিক্ষে দেওয়ার লোক কোথায় দাদা। সবাই যে ঘরবন্দি। এগুলো অই হাসপাতালের মাসিরা দিয়েছে।
টিভি চলে সারাক্ষণ। ডাক্তারবাবু থেকে সবাই সাবধান করছে, মাস্ক পর, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোও, ভিটামিন সি খাও, ডি খাও ।
খাও বলেই তারা খালাস । পাই কোথা কে ভাবে ! রামুয়া তাই এভাবেই যোগাড় করে আনে। আর আছে সূর্যের আলো। ফ্রি ডি ভিটামিন।
আজকে সেই ফ্রি ভিটামিন ডি খাচ্ছিল হারু। রামুর চীৎকারে অশ্রাব্য গালি দিয়ে সে জানায়, তুই কি শালার কানা হয়েছিস র্যা ? দেখ মালা সিন্দুর লক্কনের পাশেই আছে।
বাংলাদেশে কুরবানিতে গরু জবাই হবেই হবে। যতই সুধীজনরা ফেসবুকে চেঁচাক, করোনায় মানুষ মরুক কেউ ঠেকাতে পারবে না। বছরে মোছলমানদের মাত্র দুটো উৎসব। তাই না করলে চলে ? তবে সাধারণ মানুষরা এবার কুরাবানি দিচ্ছে না। ও দেশেও অসুখ। মানুষ মরছে। তার মধ্যে ঈদ কুরবানি কে করে !
এই অসুখের জন্যে রমজানের ঈদে কঠিন কড়াকড়ি ছিল। এখন ততটা নেই। মানুষের ভয়ও কমে গেছে। চন্দনবাবু এখন স্পেশাল যত্ন নিচ্ছে গরুগুলোর। এবার কম লাভে হয়ত ছেড়ে দিতে হবে ! ধরে রাখা মানে সেধে লস খাওয়া। ওপারে সাহেদভাইয়ের সাথে কথা হয়ে গেছে। দু একদিনের ভেতর লোক চলে আসবে। তিরিশ গরুর সাথে আরও তিরিশটা যাবে বেআইনি পথে। প্রতি বছরই যায়। সেই পথে গরু নিয়ে যায় হারু আর রামুয়া।
লক্ষ্মণের কপালে সিঁদুর মাখিয়ে মালা পরিয়ে রামুয়া একবার পিঠে চেপে বসে। এ ওর বড় সুখ। গরুর পিঠে চড়ে ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ পায় রামুয়া।
দু দিন পর সন্ধ্যা নাগাদ বাংলাদেশের চারজন বৈধ আর দুজন অবৈধ লোক এসে যায়। ক্ষিন্ন টাইপের দুটি লোক ভাঙ্গা দাঁত বের করে সালাম আলাইকুম বলে সেঁধিয়ে যায় গরুদের ভেতরে। ঘুরে ফিরে গরু দেখে লক্ষ্মণের সামনে এসে খুব তারিফ করে দাঁড়িয়ে পড়ে, ইডা বটে জব্বর একখান গরু হইসে। দাফনাগুলো দ্যাখ আক্কাস।
হ দেখতিসি। কতোয় নামবে কতি পারিস ?
চুপ কর। চুপ মারে থাকতি কয়িসে কিন্তুক। এগুলান যাবিনি আইনি পথি টিরাকে চাপে। আমাগের কি !
রামুয়াকে দেখেই লোকটা হাঁক পাড়ে, ও ভাইডি কিছু খাতি টাতি দেও। তুমাগের হোটেল টোটেলও সব বন্ধ নাকি রে ভাডি ? মনে কয় সারা দুনিয়াতি আল্লাহমাল কারফু নামাই দিছে।
মাঝরাতে বেআইনি দুজনের সাথে হারু আর রামুয়া চলে যায় অন্য খানে। সেখানে পাঁচটা বৈধ মালের নৌকা রাখা আছে। নৌকা যাবে ওপারে। তার পেছনে যাবে গরু। গরুর পেছনে সাঁতরাবে ওরা চারজন। প্রথম নৌকাটা ঠিক মত পার হতে পারলে চিন্তা কম। পশুরা খুব নিয়ম মানে। অই যে কথায় বলেনা, আগের হাল যেদিক যায়, পেছনের হালও সেদিক চলে। দুলাইনে তিনটি করে ছয়টা গরু থাকে এক নৌকার পেছনে। কোন গড়বড় হলে মাঝে মাঝে ডুব সাঁতার দিয়ে দেখে আসতে হয় ওদের। আবার দুপারের বনিবনা না হলে জান চলে যেতে পারে যে কোন সময় । কে না জানে বর্ডার পুলিশরা গুলি ছুঁড়তে ঢ্যামনা জাতের এক্সপার্ট !
অবশ্য আজ পর্যন্ত চন্দনবাবুর সাথে এ ঘটনা ঘটেনি। তিনি ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। সব দলের সবাইকে দিয়ে থুয়ে খেতে ভালবাসেন।
লক্ষ্মণের সাথে অন্য গরুরা যে ট্রাকে চড়ে যাবে সেটি এসে গেছে। পেট্রোপোল পার হলেই সাহেদ সাহেবের লোকরা গরুগুলো নিয়ে যাবে বাংলাদেশের বেনাপোল। সেখানে অস্থায়ী কোন গোহালে বিশ্রাম দিয়ে অপেক্ষা করবে রাতের । ঢাকার জ্যাম বিশ্ববিখ্যাত। রাতে রওনা দিলে ফেরির ভিড় পারাতে পারলে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকবে। ভোর ভোর নির্দিস্ট হাটে পৌঁছে যাবে গরুগুলো।
বেনাপোলে থাকতেই লক্ষ্মণের কপাল আর শিং থেকে সিঁদুর মুছে, গেন্দার মালা খুলে সোনালি রূপালি লাল বেগুনি রঙের জরির মালা পরিয়ে দিবে ওরা। চেহারা পাল্টে রাজা বাদশার মত হয়ে যাবে তখন। নাম রাখবে বাহাদুর বা শাহেনশা । কুরবানীর হাটে কোন ধনী মোছলমান প্রচুর টাকায় কিনে আল্লার নামে কুরবানি দিয়ে দিবে বাদশা বা শাহেনশা ওরফে লক্ষ্মণকে।
চন্দনবাবু টাকার ব্যাগটা আলমারিতে রেখে তালা লাগিয়ে বার কয়েক চেক করে দেখে। খাই খর্চা বাদ দিয়ে ভালই লাভ হয়েছে। কোভিড১৯ মানুষকে ধর্ম অনুরাগী করে তুলেছে। যা ভেবেছিল তারচে বেশি লাভ হয়েছে। তিনতলার উপরে হাল ফ্যাশানের দুটি রুম করার ইচ্ছে। মেয়েটা থাকে ইউএসএ। বেড়াতে এলে নিজের মত করে থাকতে পারবে। ছেলেটা সবে চাকরিতে ঢুকেছে। খুব ভাল গল্প কবিতা লিখে। এরমধ্যে বেশ নামডাক হয়েছে । অনেক জায়গা থেকে আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ আসে। মাঝে মাঝে ফেসবুকে ছেলের ক্যারিশমা দেখে চন্দনবাবু। কুরবানি এলেই ছেলে প্রাণী হত্যার উপর বেশ ঝাঁঝালো স্ট্যাটাস দেয়। হিসেব নিকেশ করে জানিয়ে দেয় সারা দুনিয়ার মোছলমানরা একদিনে কতগুলো গরু খুন করে তার খতিয়ান। ঢাকার রাস্তাগুলোকে লালরঙে ছাপিয়ে রক্তনদী করে দেয় যারা তাদের সাথে খুব দোস্তি ছেলের। গলা মিলিয়ে সুকঠিন শাস্তি দাবি করে প্রাণীহত্যার দায়ে জড়িত লোভী গরু ব্যবসায়ীদের।
দেখেশুনে খুব হাসে চন্দনবাবু। মেয়ের বিয়ে, ছেলের পড়াশুনা, বাড়িঘর সবই গরু ব্যবসার টাকায়। মাংস খেতে বরাবর ভালোবাসে তার ছেলেমেয়ে। এমনকি রাতের খাবারে মাটন কিম্বা চিকেন না পেলে ছেলে অর্ডার করে দেয় কোন ফুড চেইনএ। বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝেই ঢুঁ মেরে আসে মুসলিম মহল্লার হোটেলগুলোতে। হাসিঠাট্টা করে ছেলের কাছে জানতে চায়, খাস যখন এগুলো করিস কেন ? ছেলেও হাসতে হাসতে জানিয়ে দেয়, ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের কথা। স্বয়ং গরুর মাংস খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রবর্তন করার সাথে সাথে যিনি একথাও বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু খাব, যদি সে মাংস সুপক্ক হয়’।
কুরবানির আগের রাতে চন্দনবাবু ফেসবুকে দেখে তার কবি ছেলে বাংলাদেশের এক মুসলিম বান্ধবীকে ট্যাগ করে লিখেছে, পাশের ফ্ল্যাটে একটি দুম্বা কেঁদে যাচ্ছে। মায়াকাজলের মেয়ে তোমাদের কি মায়া হয় না !
বেশ লাগল। আরও পড়তে চাই।
ভাল লাগল। এতো নিখুঁত বর্ণনা, দৃশ্যাবলী, তঞ্চকতার উন্মোচন ! শেষের শ্লেষ একেবারে মর্মে গিয়ে বেঁধে।
আবুল বাশারের 'ভোরের প্রসূতি' মনে পরে গেল। সেটি অবশ্য উপন্যাস। আপনার গল্পের অনুপুঙ্খ বর্ণনার কাজ ঐ অসাধারণ লেখাটিকে মনে করাল।
গল্প ভালো লেগেছে। আলতো টানে মুখোশ খসিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।