ক্লাস সেভেনে উঠেছি। সনাতনধর্মের মেয়েরা তাদের ধর্মশিক্ষা বিষয়ে অত্যন্ত কম নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। পেলেস থেকে অনেক নীচে নেমে গেছে দীপালি। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল আলোচনাসভায় অভিভাবকদের নালিশে পণ্ডিতস্যার খুব লজ্জা পেয়েছেন। স্যার দীপালিদের ধর্মশিক্ষার ক্লাস নিতেন, আবার আমাদের ইতিহাসের ক্লাসও করাতেন। ধর্মশিক্ষার পিরিয়ডে আমরা যে যার ধর্ম অনুসারে আলাদা ক্লাসে চলে যেতাম। তবে জানতাম, আমাদের মত কঠিন কঠিন আরবি শব্দ ওদের শিখতে হয় না।
রাগ সামলাতে না পেরে পণ্ডিতস্যার ইতিহাসের ক্লাসে গায়ত্রী, দীপালি, বুলু, সুনন্দাদের যাচ্ছেতাই বলে বকা দিলেন।
আমাদের খুব কৌতূহল হল, কী আছে হিন্দুধর্ম শিক্ষা বইতে, যে পঞ্চাশের উপরে নম্বরই ওঠেনি কারও! দীপালি তো কেঁদে ফেলেছিল রেজাল্ট ঘোষণার দিন।
পাতার পর পাতা উলটে বইটি আর কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। মাঝে শুক্রবার ফেলে দীপালির বইটি ধার করে বাসায় নিয়ে এলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ক্ষীণ করে হলেও আমাদের নিয়ে আব্বু মা কিছুক্ষণ গল্প করে। আমি দীপালির বইটি বের করে দেখাই। কী সুন্দর সুন্দর গল্প। আর ছবি? তুলনাই হয় না সেগুলোর সৌন্দর্যের সঙ্গে গল্পের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পেতে। ছোট্ট কৃষ্ণ দই চুরি করে খাচ্ছে, যশোদা মাঈ-এর মাথায় হাত, গাছের ডালে বাঁশি বাজাচ্ছে প্রেমিক কৃষ্ণ আর নীলাঞ্জনা জলে কৃষ্ণের বান্ধবীরা সোহাগী বকা দিয়েও বাঁশি অনিন্দিতসুরে জলকেলি করছে, বহু ফণাযুক্ত কালীয় নাগের মাথার উপর কৃষ্ণ নাচছে ধুমধুমাধুম, বিশাল বটবৃক্ষের নীচ দিয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে এক সাপ – যে কিনা আসলে নিয়তি, বিষ্ণুদেব শুয়ে আছেন বহুমাথা বিশিষ্ঠ সাপের ভেলায়, নরকের আগুনে কইমাছের মত ভাজা ভাজা করা হচ্ছে পাপীদের – এরকম কত শত গল্প, ছবি। পরীক্ষায় ওদের প্রশ্ন থাকে, কৃষ্ণ কে? নিয়তি মানে কী? গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ লেখ – ইত্যাদি।
শনিবার ক্লাসে ঢুকেই দীপালিকে বললাম, তোরা কী রে! কী করে এত কম নম্বর তুলিস? আমাদের বই দেখবি? দ্যাখ — নিম্নের বাংলা শব্দগুলি আরবিতে লেখ। আত্তাহিয়াতু আরবিতে মুখস্থ লেখ। আর দ্যাখ, কোথাও কোনো ছবি নেই। নিরাকার। নামাজ পড়ার নিয়মগুলোও আরবি। নিজের বা পরের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে হলেও আরবিতে চাইতে হয়। পারতিস তোরা?
গায়ত্রী দীপালি এখন পশ্চিম বাংলার কোথাও আছে। ওর দু’ভাই ওকালতি আর পলিটিক্স নিয়ে বাংলাদেশেই থাকে। বুলু, টুলু, অঞ্জলিরাও নব্বই সালের দিকে চলে গেছে। খুব কম বেড়াতে আসে। বাংলাদেশে এ এক পরিচিত দৃশ্য। সবাই জানে, প্রতিটি হিন্দু পরিবারেরই একটি খুঁটি আছে ভারতে। রাতে গল্প করছে, চা খাচ্ছে যে বন্ধুদের সঙ্গে, তারা সকালে জানতে পারে বন্ধুটি পরিবারসহ চলে গেছে ইন্ডিয়া। ওদের বাড়িটি গোপনে বিক্রি করে গেছে কোনো মুসলমান পরিবারের কাছে।
কিন্তু কবে থেকে এ দৃশ্যের আরম্ভায়ন?
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববাংলার হিন্দু সমাজ একটি বোধে উপনীত হয় যে, যে কোনো সময় বৃটিশ সরকার বাংলাকে আবার বিভক্ত করে দিতে পারে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিক্ষিত হিন্দুদের অনেকেই পশ্চিমবাংলামুখী হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সে সময় শিক্ষাব্যবস্থায় পূর্ববাংলা স্বয়ংসম্পূর্ণ না থাকায়, অনেক শিক্ষানুরাগী মুসলিম পরিবারও রাজধানী কলকাতাতে চলে যেত। বলতে দ্বিধা নেই, সে সময় পূর্ববাংলা ছিল অবহেলিত এক জলজভূমি। জমিদারদের সবাই ভোগে, আরামে, কলকাতায় থাকত। আর নায়েবদের কাজ ছিল – যেভাবে হোক তাদেরকে টাকার যোগান দিয়ে যাওয়া। সাধারণ চাষাভুষো প্রজাদের এক টুকরো নেংটি আর তিন সানকি পান্তা পেলেই চলে যেত। লক্ষ্যণীয় যে এই প্রজাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। শিক্ষাদীক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতিতে অনগ্রসর এক বৃহৎ জনসমাজ। শোনা যায়, বৃটিশ আমলে কোনো ইংরেজকে বাংলা প্রদেশের প্রাদেশিক গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি নাকি এর চেয়ে শিয়ালদহে ফেরি করা পছন্দ করতেন। আর পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মনে করত, পূর্ব পাকিস্তান হচ্ছে মনুষ্যসদৃশ পোকামাকড়ের এক দেশ।
কিন্তু সময় চেতনা বহন করে। মুসলমানদের মধ্যেও নবজাগরণের সৃষ্টি হয় এবং শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমান সমাজেও পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যায়। বিপুল সংখ্যার মুসলিম শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং পূর্ববাংলার উন্নয়নের দাবী জানায়। এ পর্যন্ত ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ চিত্রটি ঠিকঠাক আছে। ১৯০৫ সালের পরেও সাধারণ হিন্দু-মুসলিম তাদের ছোটখাটো বৈপরীত্য নিয়েও পূর্ববাংলায় একই সমাজভুক্ত থেকে নিত্যকার জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু তারপর? ভারতবর্ষের রাজনীতিতে জোরশোরে ঢুকে পড়ে ধর্ম। বণিকের রাজদণ্ড পরিণত হয় ধর্মীয় মানদণ্ডে। ঘৃণার সঙ্গে জোট বাঁধে হিংসা। শুরু হয় বীভৎস দাঙ্গা। যারা এতদিন বিপদে-আপদে সুহৃদ, প্রতিবেশী ছিল, তারাই হয়ে গেল লুটেরা দাঙ্গাবাজ। কেউ কেউ ধর্ষক এবং খুনিও। চিরকালের জন্য সম্প্রীতির উঠান ভাগ হয়ে গেল। হিন্দুর জন্যে ভারত আর মুসলিমের জন্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল – এক গলা হিন্দু-মুসলিমের রক্তে রাঙা মঞ্চে দাঁড়িয়ে । শুরু হল দেশত্যাগের মিছিল। পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে চলে গেল অধিকাংশ হিন্দু। ভারত থেকে মোহাজের হয়ে এল লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু বিহারি ও বাঙালি মুসলিম। তাদের অন্তর জুড়ে ঘৃণার দাউ দাউ আগুন। এবারে যে পাকিস্তান হয়েছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে, প্রায় পঁচিশ বছর পর ভাষা, সংস্কৃতি আর জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেল। সৃষ্টি হল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। বাঙালির দেশ, বাঙালির শাসন। সংবিধানে আলো ছড়াল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ চার নেতার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেল অন্য অধ্যায়। একাত্তরে শরণার্থী হয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তার মধ্যে হিন্দু বাঙালির সংখ্যা ছিল বেশি। এদের সংখ্যাগুরু অংশ আর বাংলাদেশে ফিরে আসেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পড়ে। মেজর জিয়া ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে রাজনৈতিক দল গঠন করে, সে দলে দেশী-বিদেশি আওয়ামী লিগ বিরোধীদের সঙ্গে বাংলাদেশ-বিরোধী মানসিকতার বাঙালিরা যোগ দেয়। মূলত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মচাষের বড় মহাজন। জিয়া ১৯৭৭ সালে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামকে মুক্ত রাজনীতিতে সিদ্ধ করে পাকিস্তানে পালিয়ে থাকা জামায়াত ইসলামের নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শত্রুকে বাংলাদেশে পুনর্বাসন করে। দেশ ঘুরে যায় মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। কিছু কিছু অঞ্চলে শুরু হয় হিন্দুদের উপর আক্রমণ। ধর্মপালনে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় হিন্দুসমাজকে। নেতাদের খোলসও পাল্টে যেতে থাকে। প্রগতিশীল সমাজের চোখ ঢেকে ঠুঁটো করার চেষ্টা চলে। এদিকে গরীবিয়ানা ঘুচাতে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বাঙালি তরুণ, উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মুসলিম বাঙালি – যারা মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছিল শ্রমিক-চাকুরে হিসেবে – তাদের মানসিকতায় আরবি ছাপ পড়তে শুরু করে। আস্তে আস্তে পেট্রোডলারের সঙ্গে হিজাব বোর্কাও চলে আসে। ধর্ম এক যাদুময় আফিম। একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানী মনোভাবাপন্নরা – যারা পালিয়ে গেছিল বিভিন্ন দেশে – তারা সক্রিয় তো ছিলই, এবার অ্যাকশনে নেমে আসে। ফলে ৭৫ থেকে ৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্মগাছের শিকড় অনেকটা পোক্ত হয়ে গেল। আর বাংলাদেশের সংবিধানে শেষ পেরেক পুঁতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে ফেলল প্রেসিডেন্ট এরশাদ। এদেশের হাওয়ায় যে ধর্ম-ধর্ম কটুগন্ধে ভাসছে তা বুঝা গেল, ধর্মনিরপেক্ষ দল হয়েও আজ পর্যন্ত সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে, সাহস বা উদ্যোগ প্রকাশ করেনি বারবার ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ সরকার। একটি মুসলিম ধর্ম-রাষ্ট্রে হিন্দুরা কেন, কীভাবে নিরাপদে থাকার সাহস রাখতে পারে?
(ক্রমশঃ)