কলকাতা নগরী পত্তনের বহু আগে সমৃদ্ধ বন্দরনগর হিসাবে প্রকাশ ঘটেছিল হুগলির। ১৭৯৫ সালে ইংরেজ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জেলা হিসাবে হুগলির প্রকাশ ঘটে। যদিও তারও বহু পূর্বে জনপদ হিসাবে অস্তিত্ব ছিল হুগলির।
ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৫১৭ সালে ব্যাবসা করার উদ্দেশ্যে পোর্তুগিজরা বঙ্গদেশে আসে। বলা যেতে পারে এই প্রথম কোনো বিদেশি শক্তির বাংলায় প্রবেশ ঘটেছিল বাণিজ্যের কারণে। তাঁদের হাত ধরেই বাংলার প্রধান বাণিজ্যবন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল হুগলি। ক্রমে ক্রমে এই অঞ্চলে হাজির হয় ওলন্দাজ, ইংরেজ, দিনেমার, বেলজিয়ান, জার্মান ও আর্মেনীয় বণিকেরা। সেইসঙ্গে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে জড়িয়েছেন দিল্লির শাসকদের সঙ্গে কখনও স্থানীয় জমিদারেরা বা আঞ্চলিক রাজারা।
১৬৩২। পোর্তুগিজদের বিতাড়িত করে হুগলি বন্দর দখল নিচ্ছে মুঘলসেনা। শিল্পী: অজানা। ছবিসৌজন্য: রয়াল কালেকশন ট্রাস্ট, লন্ডন
সুতরাং বলা অত্যুক্তি হবে না, এক বর্ণময় ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। সেই ইতিহাস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষক তুলে এনেছেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় একশো বছর আগে ধারাবাহিকভাবে তিনি বসুমতী পত্রিকায় হুগলির ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলেন। সেই লেখাগুলি এবং সেই সঙ্গে হুগলি জেলার উপর আজ পর্যন্ত যতগুলি বই ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে তার একটি পঞ্জি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘হুগলিজেলার ইতিহাস ও গ্রন্থপঞ্জি’ বইটি।
বইটির শুরুতেই হুগলির অস্তিত্ব কতদিনের তার অনুসন্ধান করা হয়েছে। লেখা হয়েছে, “হুগলি একটি পুরাতন সহর। ১৪৯৫ খৃষ্টাব্দে কবি বিপ্রদাস ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। ঐ সালে বিপ্রদাসের বাঙ্গালা অক্ষরে ‘মনসার ভাসান’ ও ‘মনসা’ নামে দুইখানি পুস্তক এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত আছে।” তিনি ওই গ্রন্থ রচনার সময়কাল হিসাবে লিখেছেন, “সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ। নৃপতি হোসেন সাহা গৌড়ে সুলক্ষণ।।”
সিন্ধু ৭, ইন্দু ১, বেদ ৪, মহী ১; ‘অঙ্কস্য বামা গতি’ ধরলে এই হিসাবে ১৪১৭ শকাব্দ তথা ইংরেজির ১৪৯৫ সাল। যা এই অঞ্চলের তৎকালীন সময়ের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। এই অঞ্চলের নামকরণের কারণ সমন্ধেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধান। বিভিন্ন মতের অবতারণা করে লেখক দেখিয়েছেন যে হোগলা গাছ থেকে গোলিন এবং গোলিন থেকে হুগলি। যদিও এই বিষয়ে পৃথক মত রয়েছে। এবং তার যথাযথ উপস্থাপন লেখক করেছেন।
হুগলিতে ডাচ ‘ফ্যাক্টরি’। শিল্পী: হেন্ড্রিক ভ্যান শুইলেনবুর্গ। ১৬৬৫। ছবিসৌজন্য: রিজক্স সংগ্রহালয়, আমস্টর্ডম।
ইতিহাসের বর্ণনায় উঠে এসেছে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একাধিক যুদ্ধবিগ্রহের কথা। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন দেশীয় এবং বিদেশি শাসকদের কার্যকাল এবং সেইসময়ে হুগলির উত্থানপতন। শুধু যুদ্ধবিগ্রহই নয় বাদশাহ জাহাঙ্গিরের কন্যার কঠিন পীড়া নিরাময় করে গাব্রিয়েল বাওটন (Gabrial Boughton) উপহারস্বরূপ হুগলিতে কুঠিনির্মাণের অনুমতি চেয়ে নেন। এটা ১৬৫৬ সালের কথা। এ থেকে ও হুগলির গুরুত্ব অনুমান করা যায়। ইতিহাসের তথ্য হিসাবে উঠে এসেছে হুগলি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটদের তালিকা। প্রথম জেল নির্মাণের কথা এবং তৎকালীন সময়ে জেলের কয়েদিদের প্রদেয় বিভিন্ন খরচের বরাদ্দের পরিমাণ। যেমন জানা যায় কয়েদিদের জন্য প্রত্যহ ছয় ছিলাম তামাক বা গাঁজার জন্য বরাদ্দ ছিল ১০ কড়ি।
বহু প্রচলিত প্রবাদপ্রবচনের উৎসের সন্ধান দেওয়া হয়েছে এই বইয়ে। যেমন “বেটা যেন নবাব খাঞ্জা খাঁ।” এই খাঞ্জা খাঁ হুগলির শেষ ফৌজদার ছিলেন। পিপলটীর কাছে তাঁর বসতবাড়ি ছিল। আবার ‘রায়বাঘিনী’ বলা হত ভূরশুটের রানি ভবশঙ্করীকে। রাজা রুদ্রনারায়ণের এই রানি রুদ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর রাজ্যের ভার তুলে নিয়ে, পাঠান সেনাপতি ওসমানকে পরাজিত করেন। তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট আকবর ভবশঙ্করীকে ‘রায়বাঘিনী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ইতিহাস মানে এই বইয়ে শুধু শাসকশ্রেণি তথা রাজারাজদের কাহিনিই উঠে এসেছে এমনটা নয়। তৎকালীন হুগলির সমাজজীবন, রাস্তাঘাটের কথা, জিনিসপত্রের দাম, ডাকঘর স্থাপনের কথা, ডাকের ওজন ও মাশুলের কথা ইত্যাদি বহুবিধ বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। পুরাতন সংবাদপত্রে হুগলির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খবর লেখক তুলে ধরেছেন। যেমন সমাচারদর্পণে প্রকাশিত সহমরণের একটি সংবাদ—“তৃতীয় সন জেলা হুগলীতে একশতবার স্ত্রী সহগামিনী হইয়াছে। গতবৎসর ঐ দুইশত স্ত্রী সহগামিনী হইয়াছে।” (৫৫ সংখ্যা ১৮১৯| ৫ জুনবাং ১২২৬| ২৪ জ্যৈষ্ঠ ‘সমাচারদর্পণ’)। অনুরূপে সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়, সংবাদপ্রভাকর, সোমপ্রকাশ, সাধারণী ইত্যাদি সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। যা গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হবার খবর প্রকাশিত হয়েছিল সাধারণীতে এইভাবে, “বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হুগলী জেলার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হইলেন।” (‘সাধারণী’ ১২৮২| ৭ই ফাল্গুন।)। তৎকালীন সময়ে হুগলির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রের তালিকা সংযোজিত হয়েছে। যার মোট সংখ্যা ২০ টি। দানবীর হাজী মহম্মদ মহসীনের মহান জীবন ও সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা তুলে ধরছেন লেখক।
লবণ ও নীলের ব্যাবসা করে এইসময় একশ্রেণি বেশ ধনী ও সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিলেন। এই লবণ ব্যাবসার জন্য কোম্পানিকে শুল্ক দিতে হত। এই বইয়ে লবণ ব্যাবসা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আছে। লেখা হয়েছে, ‘‘পুরাতন নথি হইতে লবণ–শুল্কের আয় সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ১৭৬৫ খ্রিস্টব্দে নুজাম-উ-দ্দৌল্লার সন্ধিপত্রে এই জানা যায় যে, মোগলশাসনের সময় হুগলি লবণের আড়তের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই সন্ধিপত্র হইতে আরও জানা যায় যে, ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানীর অন্য সমস্ত মাল ও পণ্যদ্রব্যের কর বা মাশুল দিতে না হইলেও লবণের জন্য শতকরা ২।।০ টাকা মাশুল দিতে হইত এবং এই মাশুলের পরিমাণ হুগলীর বাজারদর হইতে নিরূপিত হইত।’’
ভৌগোলিক তথ্য হিসাবে উঠে এসেছে একাধিক নদীর কথা। যার অনেকগুলি মৃত বা মৃতপ্রায়। যেমন সরস্বতী নদী। এই নদী সম্পর্কে বলা হয়েছে, “সপ্তগ্রাম এই নদীতীরে অবস্থিত ছিল। ১৫শ শতাব্দী পর্য্যন্ত এই নদী প্রবল ছিল।” আবার রোণ নদী নিয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘এই রোণ নদী তীরে ‘দিল আকাশ গ্রাম’। এইখানে একদিন শনিয়া ধাঙর নামে এক বাগদী রাজা ছিল। ঐ রাজা চতুরানন নামে এক ব্রাহ্মণকুমারকে প্রতিপালন করে। পরে ঐ বাগদী রাজাকে হত্যা করিয়া ব্রাহ্মণকুমার নিজে রাজা হয়। ঐ চতুরাননের দৌহিত্র বংশ ভূরশুট রাজবংশ। রোণনদীকে এখন রোণের খাল বলে।’’ এইভাবে ভূগোল ইতিহাস মিলে মিশে গেছে। যা শুধু ইতিহাস বা ভূগোলের ছাত্র-ছাত্রীদের নয় সাধারণ পাঠককেও এই বইটির প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। একই ভাবে উঠে এসেছে বালী খাল, ডানকুনি নালা, কানা-নদী বা কুন্তীনদী, বেহুলা নদী ইত্যাদির কথা।
পোর্তুগিজরা বাঙ্গলায় আধিপত্য বিস্তার করেছিল বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল বাংলা ভাষায়। একাধিক পোর্তুগিজ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বাংলা ভাষায়। যেমন, বালতি, বোতল, বাঁশ ইত্যাদি। এর একটি তালিকা সংযোজিত হয়েছে এই বইয়ে। যা ভাষাবিজ্ঞানীদের কাজে লাগবে।
বৃহত্তর হুগলির অংশ হিসাবে বিশদে বর্ণিত হয়েছে রিষড়া, চন্দননগর, বাঁশবেড়িয়া ইত্যাদি এলাকার উত্থানপতনের ইতিহাস। সেই সূত্রে এসেছে একাধিক পদবির উৎপত্তির ইতিহাস। যেমন বাঁশবেড়িয়ার দত্তরা ধনশালী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠলে তাঁরা খাঁ খেতাব পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত সেকালে পারসি ‘খাঁ’ উপাধি হিন্দুরাও পেতেন। হোসেন শাহের মন্ত্রী গোপীনাথ বসুর উপাধি ছিল ‘পুরন্দর খাঁ’। বাঁশবেড়িয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে রাজা নৃসিংহদেবের পত্নী রানি শঙ্করী কর্তৃক হংসেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে।
গ্রন্থপঞ্জি অধ্যায়ের সূচনায় বর্ণনা দেওয়া হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে হুগলির গরিমার কথা। বলা হয়েছে “১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ বঙ্গদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতের ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় বছর। এই বছরেই হুগলী জেলাতে সঞ্চালনযোগ্য বাংলা মুদ্রাক্ষরের জন্ম হয়। জনৈক জন এন্ড্রুসের মালিকানাধীন হুগলীস্থিত ছাপাখানা থেকে ১৭৭৮ খিষ্ট্রাব্দে প্রকাশিত নাথানিয়েল ব্রাসি হালহেড রচিত ‘A Grammar of the Bengal Language’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ওই সঞ্চালনযোগ্য বাংলা হরফ ব্যবহার করা হয়।’’ এই অংশে সংযোজিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে ছাপা একটি বাংলা বইয়ের তালিকা। যা বাংলা ভাষা প্রসারে হুগলি তথা শ্রীরামপুর মিশনারিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রমাণ দেয়।
বইটির শেষে হুগলি নিয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত ১৮১ টি বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়েছে। যা বইটির সম্পদ। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন মৃণাল শীল। একথা অনস্বীকার্য হুগলির ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহীদের বইটি যথেষ্ট সাহায্য করবে। তবে বইয়ে সূচিপত্র থাকলে পাঠকদের সুবিধা হত। প্রুফ দেখার ত্রুটির জন্য অনেক বানান ভুল থেকে গেছে, যা পাঠের অন্তরায়।
(উদ্ধৃতির বানান মূল বানানের অবিকৃত রাখা হয়েছে)