মন্দির বিশেষজ্ঞ জে ডি বেগলার ১৮৭২ সাধারণাব্দে পূর্ব-ভারতের সমস্ত মন্দির পরিভ্রমণ করে রচনা করেন ‘A tour through Bengal Provinces’। সেই বইয়ের ১৯৫ পৃষ্ঠায় একটি মন্দিরক্ষেত্রের বর্ণনা আছে। ক্ষেত্রটির নাম ‘ধাদকি টাঁড়’। সেবিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘At Dhadki Tanr, near Tulsi Garya and Asanbani, was a large Temple, in an enclosure 120 feet square; the temple faced east, and had a mahamandapa and other chambers usual in complete temples... The temple had other subordinate temples around it, two to the north, two to the south, one in front, and probably there were two at the back…। তুলসীগড়্যা এবং আসনবনির সামনে এই বিস্তৃত মন্দিরক্ষেত্রের বর্তমানে কোনো চিহ্ন নেই। এইরকম অজস্র মন্দিরক্ষেত্র যা লুপ্ত হয়ে গেছে বা লুপ্তপ্রায় সেইসঙ্গে কালের ঝড়ঝাপটা সামলেও সসম্মানে টিকে আছে পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় সেইসব মন্দির নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ বই দিলীপকুমার গোস্বামীর লেখা ‘পুরুলিয়ার মন্দির’।
পুরুলিয়া জেলার সভ্যতা বহু প্রাচীন। পুরুলিয়া নামটির প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত একটি সনেটে—‘পাষাণময় যে দেশ, সেদেশে পড়িলে/বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে?/কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে/হে পুরুল্যে।’ বজ্রভূমি রূপে পুরুলিয়ার উল্লেখ রয়েছে জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গসূত্ততে। এই অঞ্চলে জৈন ধর্মের বিস্তার ঘটেছে সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীতে। এর মাঝের সময় নিয়ে ইতিহাস নীরব। পুরুলিয়ার সভ্যতা প্রাচীন হলে কী হবে এই অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে এখনও কোনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হয়নি। এই অঞ্চলে শৈবধর্মের বিকাশ ঘটেছে শশাঙ্কের হাত ধরে, শাক্ত, ব্রাহ্মণ্য ও বৈষ্ণব ধর্মের বিস্তার ঘটেছে পঞ্চকোট রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পালরাজাদের সঙ্গে এই অঞ্চলের রাজাদের সুসম্পর্কের কথা জানা যায়, সেই হিসাবে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব থাকাও অসম্ভব কিছু নয়। এই ধর্মবৈচিত্র্য মন্দিরস্থাপত্যে প্রভাব ফেলেছে।
ধর্মগত ভাবে পুরুলিয়ার মন্দিরস্থাপত্যে ও মূর্তিনির্মাণ শিল্পে জৈন প্রভাব সর্বাধিক। এরপর শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব রয়েছে। সর্ববৃহৎ মন্দিরক্ষেত্র তৈলকম্প গড়ে উঠেছে শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ও জৈন প্রভাবে।
তৈলকম্প বা তেলকূপীর মন্দির। ছবি: জে ডি বেগলার। ১৮৯৮। ছবিসৌজন্য লাইডেন ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি।
লেখক বিভিন্ন মন্দিরের ইতিহাস ধরে ধরে আলোচনা করে দেখিয়েছেন এই জেলার বৈষ্ণবধর্ম প্রভাবিত মন্দিরস্থাপত্যগুলি গড়ে তোলার পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল পঞ্চকোট রাজ্যের রাজাদের। কিছু পরিমাণে মন্দির গড়ে উঠেছিল জয়পুর, বেগুনকোদর, বাঘমুণ্ডি, বরাভূম ও মানবাজারের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এই মন্দিরনির্মাণ শিল্পকে তিলে তিলে সাজিয়ে তুলেছিলেন জৈন শ্রেষ্ঠীরা। আরও আশ্চর্যজনক তথ্য হল এই জেলার বেশির ভাগ মন্দির নির্মিত হয়েছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
এখানের মন্দিরস্থাপত্যগুলির প্রাচুর্য দেখে গবেষকরা এই জেলাকে ওপেন মিউজিয়ামের মর্যদা দিয়েছেন। জেলার মন্দিরগুলিকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যেসমস্ত গবেষক তাদের মধ্যে অন্যতমরা হলেন ডালটন, বেগলার ডেভিডম্যাক কাচ্চন প্রমুখ। এঁদের উত্তরসূরি বলা যেতে পারে তারপদ সাঁতরা, দীপকরঞ্জন দাস প্রমুখকে। এই ধারার নবতম সংযোজন বলা যেতে পারে লেখকের এই গ্রন্থের লেখককে।
দিলীপকুমার গোস্বামী পুরুলিয়া জেলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজার বছরের পুরানো মন্দিরের ব্যাখা ও মননশীল বিশ্লেষণ করেছেন। জেলার প্রস্তর নির্মিত শিখরমন্দির, পীড়ামন্দির, চারচালা, আটচালা, পঞ্চরত্ন মন্দির ও জোড়বাংলা মন্দিরগুলির চিত্রসহ বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে মন্দিরগুলির ইতিহাস, প্রচলিত বিশ্বাস এবং সেইসঙ্গে সংরক্ষকদের কথাও আলোচনা করেছেন। বইটিতে প্রায় ৭০টি মন্দির নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম তেলকুপি, দেউলঘাটা, ক্রোশজুড়ি, বেলকুড়ি, পাড়ার লক্ষ্মী, চণ্ডী ও রঘুনাথ মন্দির, এবং বান্দার দেউল। পাশাপাশি আলোচনা করা হয়েছে মন্দিরক্ষেত্র পাকবিড়রা, বুধপুর ট্যুশামা, গড়পঞ্চকোট, বরাবাজার, মানবাজার, জয়পুর, বেগুনকোদর ইত্যাদি নিয়ে।
মধ্যযুগে পুরুলিয়ার উপর দিয়ে তৈরি হওয়া অহল্যাবাই রাস্তার জেলার প্রাচীন রাস্তাগুলির অন্যতম। এই রাজপথের দু-পাশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল অজস্র টেরাকোটার চারচালা আটচালা মন্দির। এই মন্দিরগুলো নিয়ে সেভাবে কোথাও আলোচনা করা হয়নি। বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটার চেয়ে এগুলোর গরিমা খুব একটা কম নয়। চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত রচিত ‘বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা’ বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরগুলির একটি দলিল। এইরকম একটা দলিলের খুব প্রয়োজন পুরুলিয়া জেলার টেরাকোটার মন্দিরগুলি নিয়ে। পুরোপুরি না হলেও লেখকের এই বই সেই অভাব কিছুটা পূরণ করেছে।
পুরুলিয়ার চেল্যামা গ্রামে রাধাগোবিন্দ মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির কারুকার্য।
মানভূম পুরুলিয়ার প্রত্নস্থলগুলির মধ্যে প্রতিনিধি স্থানীয় এবং প্রাচীন হল তেলকূপি। একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত রামপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ কাব্যে তৈলকম্প রাজ্যের কথা আছে। এটি ছিল জেলার অন্যতম বৃহত্তম মন্দিরক্ষেত্র। ১৯৫৫-১৯৫৬ সালে দামোদর উপত্যকা নিগমের পাঞ্চেৎ জলাধার নির্মাণের সময় মন্দিরগুলি জলমগ্ন হয়। বেশির ভাগ মানুষের ভ্রান্ত ধারণা আছে তেলকূপির মন্দিরগুলির বেশির ভাগ ছিল জৈন দেউল কিন্তু লেখক এই গ্রন্থে জে ডি বেগলার এবং দেবলা মিত্রের বিবরণ সহ দেখিয়েছেন ওখানের মন্দিরগুলির বেশির ভাগগুলির দেবতা শিব, বিষ্ণু, গণেশ, সূর্য ইত্যাদি। কেবলমাত্র একটি জৈন তীর্থঙ্কর নেমিনাথের শাসন যক্ষিণী অম্বিকার মন্দির ছিল। অর্থাৎ এখানে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পাঁচটি প্রধান ধর্মমতের চারটি যেমন শৈব, বৈষ্ণব, সৌর এবং শাক্তদের প্রাধান্য ছিল।
আবার এই জেলা ও রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈনক্ষেত্র ছিল পাকবিড়রা। ওখানে একদা অনেক মন্দিরের চিহ্ন থাকলেও বর্তমানে টিকে রয়েছে মাত্র তিনটি। তবে একসময় ওই জৈনক্ষেত্রে যে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের চব্বিশটি পৃথক দেউল ছিল তা তথ্যপ্রমাণ সহ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন লেখক।
পুরুলিয়ার পাকবিড়রা-তে প্রাচীন জৈনমন্দির।
পুরুলিয়া জেলা জুড়ে বৈষ্ণব সংস্কৃতির ঢল নেমেছিল তৎকালীন শাসকবর্গের হাত ধরে। এদের অন্যতম পঞ্চকোটরাজ, বরাবাজাররাজ, জয়পুররাজ, বেগুনকোদররাজ প্রমুখ। বেগুনকোদর, বরাবাজার এবং জয়পুর রাজাদের বদান্যতায় তৈরি হওয়া রাসমঞ্চগুলি জেলা তথা রাজ্যের স্থাপত্যশিল্পের গৌরব। যেমন দর্শনীয় স্থান পঞ্চকোট পাহাড়ের উপরে অবস্থিত জগমোহন সহ রঘুনাথবরের শিখর ঘরানার মন্দির।
পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোটে শিখর ঘরানার মন্দির।
এ জেলার অনার্যভাষা গোষ্ঠীর মানুষের সংস্কৃতির চিহ্ন বহন করে চলেছে প্রাপ্ত বীরস্তম্ভগুলি। রাজ্যের আর কোনো জেলায় বীরস্তম্ভের এত আধিক্য দেখা যায় না। জেলায় প্রাপ্ত প্রায় সব বীরস্তম্ভগুলির উল্লেখ থাকলেও বরাবাজার থানার বররা গ্রামের সিংসর্দার পাড়ায় প্রোথিত বীরস্তম্ভগুলোর উল্লেখ এই বইয়ে নেই।
প্রচ্ছদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে বান্দার দেউলের আলোকচিত্র, যা বইয়ের মূলভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। প্রচ্ছদশিল্পী প্রশান্ত মজুমদার। বইয়ে সংযোজিত মন্দিরের আলোকচিত্রগুলি বইয়ের সম্পদ।
পুরুলিয়ার মন্দিরস্থাপত্যগুলির উপর কোনো পূর্ণাঙ্গ বই ছিল না। সেই অভাব এই বই কিছুটা পূরণ করবে বলা যায়। তবে এই বইটির শুরুতে মন্দিরের একটি রেখাচিত্র দিয়ে মন্দির বিষয় কবি ভিন্ন প্রতিশব্দ যেমন বাঢ়, গন্ডী, মস্তক, তলপত্তন, জগমোহন ইত্যাদি বোঝানো থাকলে সাধারণ পাঠকদের সুবিধা হত। বইটির ২৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন ‘জেলায় তিনটি সূর্যমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে’ আবার ৩৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন ‘চারটি সূর্যমূর্তি জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে’। এইরূপ ছোটো ছোটো কিছু অসংগতি রয়েছ।
তবে বইটি লেখকের কঠিন পরিশ্রম, গভীর বিশ্লেষণী মন এবং ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল তা অস্বীকার করার উপায় নেই।