মধ্যযুগে ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বন্দরের নাম সপ্তগ্রাম। শুধুমাত্র বন্দর বললে এর মূল্যায়নকে সংকুচিত করা হয়। গঙ্গা, সরস্বতী সহ একাধিক নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত সপ্তগ্রামের কথা বর্ণিত হয়েছে পুরাণ, মহাকাব্য থেকে শুরু করে বহু আধুনিক সাহিত্যে। উর্বর শস্যভূমি, হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, মুসলমান সহ একাধিক ধর্মের সাধনভূমি এবং সমৃদ্ধ শিল্পনগরী হিসাবে এই এলাকার দখলের জন্য লড়াই বেঁধেছে ধর্মের কারণে, সম্পদের কারণে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে।
এই অঞ্চল সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে, এবং ঐতিহাসিক তথ্যে। তাই গবেষকরা বারবার আগ্রহ দেখিয়েছেন এই অঞ্চল নিয়ে। শুধুমাত্র ঐতিহাসিক বা আঞ্চলিক গবেষকদের গবেষণা দ্বারা এই অঞ্চল আলোচিত হয়েছে এমনটা নয়। বহু বৈষ্ণব পদকর্তা, ঔপন্যাসিকও আগ্রহ দেখিয়েছেন এই অঞ্চল নিয়ে। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের সংঘাত নিয়ে সপ্তগ্রামের পটভূমিকায় তিনি রচনা করেন উপন্যাস ‘বেনের মেয়ে’। চৈতন্যদেবের জীবনী লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ থেকে জানা যায় বৈষ্ণব ধর্মের ষড়-গোঁসাইদের অন্যতম রঘুনাথ দাসগোস্বামীর পিতৃব্য হিরণ্যদাস ইজারাদার থাকার সময় এই বন্দর থেকে আয়কৃত অর্থের বারো লক্ষ টাকা সুলতানকে দেওয়ার পরেও তাঁর হাতে আটলক্ষ টাকা উদবৃত্ত থাকতো। এ থেকে বোঝা যায় এই বন্দর অর্থনৈতিক দিক থেকে কতটা সমৃদ্ধ ছিল।
সপ্তগ্রামের প্রাচীন সরস্বতী নদীর বর্তমান অবস্থা। (ছবি উইকিপিডিয়া)
স্বাভাবিক ভাবেই এই বন্দর এলাকার সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক নানা দিক দিয়ে লেখালিখির সেই দীর্ঘ সারণীতে নবতম সংযোজন বলা যেতে পারে দিলীপ সাহা রচিত ‘সপ্তগ্রামের সন্ধানে’ বইটিকে।
২৪০ পাতার এই বইটিতে লেখক তুলে ধরেছেন বাংলার ইতিহাসের পটভূমিতে সপ্তগ্রাম। প্রসঙ্গ ক্রমে এসেছে প্রত্নস্থল বর্ধমান জেলার বীরভানপুর, পাণ্ডু রাজার ঢিবি, বাণগড়, মঙ্গলকোট, প্রাচীন তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড় এবং মোগলমারীর কথা। কিভাবে আর্য সংস্কৃতি সংঘাত এবং সখ্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল বাংলা তথা সপ্তগ্রামের সমস্ত অঞ্চলে। লেখক দাবি করেছেন বঙ্গদেশে আর্যদের শাসনাধিকারের পূর্বেই কয়েক শতক জুড়ে তাঁদের মতাদর্শ প্রচারিত হয়েছিল। এবং এই মতাদর্শ প্রচারিত হয়েছিল ত্রিবেণীকে ভিত্তি করে। বলা হয় কনৌজের রাজা প্রিয়ব্রতের সাত সন্তান ত্রিবেণীর সাতটি গ্রামে তপস্যা করতে আসেন তাই সাতটি গ্রামকে একত্রে সপ্তগ্রাম বলা হয়। এই সাতটি গ্রাম হলো শিবপুর, কামারপাড়া, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিশ বিঘা, বাসুদেবপুর, কৃষ্ণপুর এবং দেবানন্দপুর। যদিও সব গবেষক এই গ্রামগুলিকে প্রাচীন সপ্তগ্রামের গ্রাম বলে মানতে চাননি। লেখক বিভিন্ন গবেষকদের মতবাদ তুলে ধরে একটা সমাধানসূত্রে আসতে চেয়েছেন। পুরাণে সপ্ত সংখ্যাটি মঙ্গলসূচক সংখ্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সূত্রেই সপ্তগ্রামের নামকরণের সার্থকতা খুঁজতে চেয়েছেন লেখক। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন পঞ্চদশ শতকের কবি শঙ্কর-কিঙ্কর মিশ্র রচিত ‘গৌরীমঙ্গল’ কাব্যের দুটি পঙ্ক্তি — গৌড় মধ্যে সপ্তগ্রাম মহাপুণ্যস্থান / ত্রিবেণীর তীরে সপ্তঋষির বিশ্রাম। তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতামত সাপেক্ষে লেখক দেখিয়েছেন গুপ্তযুগে পৌরাণিক ধর্ম প্রত্যক্ষভাবে রাজানুগ্রহ লাভ করলে ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রাম নগরের বিকাশ হয়। সেই হিসাবে বন্দর হিসাবে গুরুত্ব পাবার আগে ধর্মীয় স্থান হিসাবে সপ্তগ্রামের গুরুত্ব ছিল। বন্দর নগরী হিসাবে গুরুত্ব বাড়ে তাম্রলিপ্ত বন্দরের পতনের পর এবং গুরুত্ব কমে চট্টগ্রাম বন্দর বিকশিত হবার পর।
প্রত্নস্থল সপ্তগ্রামেরও গুরুত্ব অপরিসীম। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সপ্তগ্রাম পরিদর্শনের পর ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে লিখেছেন,‘ত্রিশবিঘা হইতে পূর্বে বাঁশবেড়িয়া ও উত্তরে মগরাগঞ্জ ও ত্রিবেণী হইতে পশ্চিমে মগরা ও দক্ষিণে বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত যদি একটি চতুরস্ত্র ক্ষেত্র কল্পনা করা যায়, তাহা হইলে সেই ক্ষেত্রটিই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষে পরিপূর্ণ। মোগল সাম্রাজ্যের প্রারম্ভে সপ্তগ্রামের অবনতি আরম্ভ হয়, আর এক শত বৎসরের মধ্যে বিশাল নগরী অরণ্যে পরিণত হইয়া পড়ে।’ বেদ পুরাণের যুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত স্থিত এই সপ্তগ্রাম যে একটি উন্নত প্রত্নস্থল তা লেখক বিভিন্ন যুক্তি এবং ঐতিহাসিকের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে উন্নত প্রত্নস্থল হলেও আজও সেভাবে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ হয়নি। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আবিষ্কৃত পাথরের সরস্বতী মূর্তি, ত্রিশবিঘা গ্রামের অপর পাড়ে সরস্বতী নদীর দক্ষিণ তীরে আলীখোজা গ্রামে প্রাপ্ত মহিষমর্দিনী মূর্তি ইত্যাদি প্রত্নস্থল হিসাবে এই অঞ্চলের গুরুত্ব তুলে ধরে।
মধ্যযুগের কবি বিপ্রদাস চাঁদ সওদাগরের সপ্তগ্রাম শহর দর্শন বর্ণনায় বলেছেন, ‘বুহিত্র চাপায়্যা কুলে চাদ অধিকারী বলে / দেখিব কেমন সপ্তগ্রাম। / তথা সপ্ত রিসিস্থান সর্ব্বদেব অধিষ্ঠান / সোক দুখ সর্ব্বগুণধাম।।’ এই বর্ণনায় মূল সপ্তগ্রাম ও তার বর্ধিত অংশের পরিচয় পাওয়া যায়। লেখক বইটিতে মূল সপ্তগ্রাম ও তার বর্ধিত অংশে মোট ৪৭টি গ্রামের উল্লেখ করেছেন যেগুলিতে মধ্যযুগের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া গেছে। সেইসঙ্গে সপ্তগ্রামের সাতটি গ্রামের আদিনাম, তাদের অবস্থান এবং গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যেমন খামারপাড়া গ্রামটির পূর্বনাম সন্ধানে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসে উল্লিখিত গোলীন গ্রামকে খামাড়পাড়া বলে উল্লেখ করেছেন। আবার উল্লেখ করেছেন বর্তমানে ত্রিশবিঘা একটি ছোট মৌজার নাম। রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার সময় আদি-সপ্তগ্রামের নাম ছিল ত্রিশবিঘা। জানা যায় চৈতন্য-পরিকর নিত্যানন্দের নির্দেশে দুর্ভিক্ষের সময়ে বৈষ্ণবদের দ্বাদশ গোপালের অন্যতম উদ্ধারণ দত্ত এই স্থানে অন্নসত্র খুলেছিলেন।ত্রিশবিঘার সরস্বতী নদীর ধারে আগে বন্দর সপ্তগ্রামের জাহাজের নোঙর ও চেন দেখা যেত।সেই সময় সপ্তগ্রামের অন্যতম দেবানন্দপুর ছিল পারসি শিক্ষার মূল কেন্দ্র। মধ্যযুগের প্রখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায় ১৬/১৭ বছর বয়সে এখানের ফারসি কেন্দ্রের ছাত্র ছিলেন। এ সম্পর্কে ভারতচন্দ্র লিখেছেন,‘দেবের আনন্দধাম দেবানন্দপুর গ্রাম / তাহে অধিকারী রাম, রামচন্দ্র মুন্সী / ভারতে নরেন্দ্র রায়, দেশে যার যশ গায়/ হোয়ে মোরে কৃপাদায় পড়াইল পারসি।।’ প্রসঙ্গত কথাসাহিত্যক শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাল্যকাল এই দেবানন্দপুরেই কেটেছিল।
সপ্তগ্রামের সৈয়দ জামালউদ্দিন মসজিদ (ছবি উইকিপিডিয়া)
সংশ্লিষ্ট কয়েকটি গ্রামের বিষয়ে চর্চার সময়ে আলোচনা করা হয়েছে শঙ্খনগরের কথা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসে ‘সংঘনগর’-এর উল্লেখ করেছেন। সংঘ কথাটি এক সময় এখানে বৌদ্ধদের উপস্থিতি বোঝায়। সংঘ থেকেই কি শঙ্খ এসেছে? ডিঙ্গলহাট ছিল সপ্তগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যের প্রধান কেন্দ্র। সুলতানি যুগে এখানেই ছিল দুর্গ ও কাস্টমস হাউস। এখানে মাটির তলা থেকে পাওয়া গেছে কৃষ্ণমূর্তি সহ বিভিন্ন মূর্তি, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, শঙ্খ, কড়ি ইত্যাদি। চৈতন্য-পার্ষদ নিত্যানন্দের আগমন হেতু একটি গ্রামের নাম নিত্যানন্দপুর।
অনেকে মনে করেন পর্তুগিজরা সপ্তগ্রামে এসে ভোদো গ্রামে অস্থায়ী ছাউনি নির্মাণ করে থাকত। এখানে রজার সাহেব এবং জনশ্রুতিতে মীর সাহেব বলে প্রাপ্ত দুই পর্তুগিজ সাহেবের সমাধি এই তথ্যের সত্যতার ইঙ্গিত দেয়। পাশাপাশি আলোচনা করা হয়েছে সরস্বতী নদীর পশ্চিম পাড়ের কয়েকটি গ্রাম যথা ঝাপা, তারাবিহারী,বারেকপুর ইত্যাদির আলোচনা করা হয়েছে। ঝাপার একটি স্থানের নাম ‘বর্গিপোতা’ যা বর্গি আক্রমণের কথা স্মরণ করায়।সরস্বতীর পূর্বপাড়ে লুপ্ত কয়েকটি গ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে।গ্রাম নামের অর্থ সন্ধান করে প্রাচীন গ্রামগুলিকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন লেখক। একটি উদাহরণ তাঁতিদের মধ্যে যাঁরা বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতেন, তাঁদের শেট-বসাক বলা হত।সপ্তগ্রামের বসাকদের মূল কেন্দ্র ছিল হরিদ্রাপুরে।এখনও এ এলাকার একটি বড় পুকুরকে 'বসোকো' বলা হয়। এই পুকুরের পিছনে ও পাশের জায়গাগুলিকে প্রাচীন মানুষেরা ‘বসাকদের বাগান’ বলতেন। হোসেন শাহর নামেই সম্ভবত ‘হোসেনাবাদ’। কোন খোজা শাসকের স্মৃতি বহন করে চলেছে আলীখোজা নামে জনপদ।
সপ্তগ্রামের জনবিন্যাস ও সমাজের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে লেখক দেখিয়েছেন বিভিন্ন জাতির সমাহার ঘটেছিল এখানে। এই জাতিগুলির মধ্যে যেমন জলচল উচ্চবর্ণ ছিল,তেমনি জল অচল নিম্নবর্গ ছিল। আবার কিভাবে সুবর্ণ বণিকরা বল্লাল সেনকে যুদ্ধের সময় সোনা ধার দিতে না চাওয়ায় রাজা তাদের জল অচল জাতিতে নামিয়ে দেন। যা থেকে বোঝা রাজানুগ্রহ জাতিভেদ প্রথার নিয়ন্ত্রক ছিল।লেখক লিখেছেন চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতুর গুজরাট নগর নির্মাণ সপ্তগ্রাম সহ আশেপাশের অন্যান্য নগরকে অনুসরণ করেই লেখা হয়েছে। যা থেকে এখানের জাতি বৈচিত্র সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
রাজনৈতিক ইতিহাস ধারায় সপ্তগ্রাম বর্ণময় অধ্যায়। এখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭শতক থেকে আলোচনা করা হয়েছে ১৭৫১ সালে বাংলায় বর্গী আক্রমনের সময় পর্যন্ত। মাঝের সময়টা ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের লড়াই।বইয়ের একটি অধ্যায়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত 'বেনের মেয়ে' উপন্যাসটির অধ্যায় ভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে। যা প্রাপ্তি বলা যেতে পারে। বইয়ের শেষে সংযোজিত বিভিন্ন সময়ের ম্যাপ এবং আলোকচিত্র তৎকালীন সপ্তগ্রামকে বুঝতে সাহায্য করে। কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল অঙ্কিত প্রচ্ছদটি যথাযথ।
তবে বইটিতে এতো বেশি পূর্বজ লেখকদের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে যে লেখকের মূল বক্তব্য হারিয়ে যায়। বইয়ে উল্লিখিত অনেক তথ্যের কোন সূত্র বা উৎস উল্লেখ করা হয়নি। যেমন এক জায়গায় লিখেছেন বাংলার নব্বই শতাংশ মুসলিম ধর্মান্তরিত বা এদেশ থেকে চিন দেশে যুদ্ধের ঘোড়া সরবরাহ করা হতো। এই তথ্যগুলোর কোন উৎস দেওয়া হয় নি। বিভিন্ন অধ্যায় বুঝতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসটির উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু একটি স্থানের প্রকৃত ইতিহাস সন্ধানে একটি উপন্যাস নির্ভর তথ্য কতটা গ্রহনযোগ্য এ প্রশ্ন থেকেই যায়।