একদলের প্রশ্ন, ‘ও মনোরমা দক্ষালয়ে গমনকালে/ বৃষবাহন কোথায় পেলে? অন্যদলের উত্তর ‘ওটা পেয়েছি তোদের ম্যানেজারের গোয়ালে।’
এইভাবে কথার উপর কথা সাজিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে বেঁধে গাওয়া হয় এই গান। নাম বাধাই গান। মুখে মুখে তাৎক্ষণিক ভাবে বেঁধে গাওয়া হয় তাই এই নাম। এই গান সম্পর্কে গবেষক বিনয় ঘোষ বলেছেন, ‘ঠিক কবিগান নয় অথচ গানের টেকনিক কবিগানের মতো।’ প্রকৃতপক্ষে ‘বাধাই’ হল বৈষ্ণবদের মধ্যে প্রচলিত একপ্রকার সাংগীতিক উৎসব। পালন করা হয় জন্মাষ্টমীর পরদিন বিকেল থেকে তারপরের দিন বিকেল পর্যন্ত। অত্যাধুনিক সব বিনোদন চালু হলেও আজও প্রতিবছর বর্ধমান জেলার মেমারি থানার অন্তর্গত মণ্ডল গ্রামে পালিত হয় গ্রাম্য সংস্কৃতির এই উৎসব, বাধাই। এর উৎপত্তি বিবর্তন নিয়মকানুন এই সব কিছু নিয়ে আলোচনা করেছেন শৈবাল মুখোপাধ্যায় ‘লৌকিক ইতিকথা’ গ্রন্থে তাঁর রচিত ‘বাধাই, এক গ্রাম্য সাংস্কৃতিক উৎসব’ নামক প্রবন্ধে।
সার্বিক সংস্কৃতির বিকাশে আঞ্চলিক সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। আঞ্চলিক সংস্কৃতির আকরভূমি জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকা গ্রামগুলি। আঞ্চলিক সংস্কৃতির বৈচিত্র্য দেখা যায় পালাগান, লোককথা, সংগীত, উপকথা, স্থাপত্য ইত্যাদির মধ্যে। এইরকম বারোটি আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘লৌকিক ইতিকথা’ প্রবন্ধের সংকলনটি। সংকলন করেছেন দুই তরুণ সম্পাদক দীপাঞ্জন দাস ও প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ। বাংলার হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, আর্মানি, পোর্তুগিজ সংস্কৃতির নির্দশন উঠে এসেছে এই সংকলনটিতে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিবছর মহরম পালন করেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদ জেলার ‘সেন্সাস টাউন’ সালারের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ যেভাবে মহরম পালন করেন তা কিন্তু অন্যদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এই বৈচিত্র্য রয়েছে মহরমের খাবারে, উৎসব প্রতিপালনে, তৈরি করা মাটির ঘোড়ায়, মানুষের টানা গোরুর গাড়ি ব্যবহারে, মহরমের তাজিয়া নির্মাণে, মর্সিয়া গানে, লাঠিখেলায় ও মেলায়। আঞ্চলিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন প্রিন্স খান্দেকার তাঁর রচিত ‘সালারের মহরম উৎসব’ প্রবন্ধে।
রঞ্জিতা পালের প্রবন্ধের শিরোনামেই তার বিষয়বস্তু স্পষ্ট—‘ব্যান্ডেল চার্চ: ইতিহাস ও আঞ্চলিকতার এক ঐতিহ্য’ ১৫৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম গির্জা ব্যান্ডেল চার্চ। এই চার্চটি তৈরির পিছনে অবদান রয়েছে পোর্তুগিজদের। গ্রিসের ডোরিক স্থাপত্যের অনুকরণে গড়ে ওঠা এই চার্চ ভারত তথা বাংলার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাক্ষী। শোনা যায় বঙ্গোপসাগরে তুমুল ঝড়ে পড়া এক জাহাজের নাবিক প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জাহাজটি সুরক্ষিত ভাবে কোনো বন্দরে পৌঁছে গেলে নিকটবর্তী কোনো গির্জায় জাহাজের মাস্তুলটি প্রদান করবেন। সেই মাস্তুলটি আজও ব্যান্ডেল চার্চের শোভা বর্ধন করছে। ব্যান্ডেল চার্চের মা মেরির মূর্তিটি আগে ছিল পোর্তুগিজদের পুরোনো হুগলি শহরের একটি মিলিটারি চ্যাপেলে। ১৬৩২ সালে মোগলদের আক্রমণের সময় পোর্তুগিজ বণিক তিয়াগো মূর্তি সহ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মূর্তিটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। তিনি মারা যান এবং মূর্তিটি নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। কথিত কাহিনি, গির্জার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় পাদরি শুনতে পান তিয়াগোর ডাক। পরদিন গির্জার দোরগোড়ায় দেখতে পান মা মেরির হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটি। তুলে এনে মূর্তিটি গির্জায় স্থাপন করেন। এই কাহিনির বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি মারাত্মক ভুল রয়েছে এই প্রবন্ধে—বলা হয়েছে মূর্তিটির নাম ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েস।’
আসলে মূর্তিটি পরিচিত ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’ নামে (তথ্যসূত্র: ব্যন্ডেল চার্চের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট — http://www.bandelchurch.com/about/)। ‘Voice’ এবং ‘voyage’ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা শব্দ—একটি স্বর, অন্যটির মানে যাত্রা। মুদ্রণপ্রমাদ বা যে কারণেই এই ভুল হয়ে থাকুক তা সংশোধন করা দরকার। প্রায় চারশো বছর অতিক্রম করা এই চার্চকে ‘ব্যাসিলিকা’ সম্মানে ভূষিত করেছে ভ্যাটিকান।
ব্যান্ডেল চার্চে ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’
বাঙালির রান্নাঘরে সগর্বে বিরাজ করছে পটলের দোলমা। অথচ এই রান্না বাঙালির নিজস্ব রান্নাসংস্কৃতি নয়। আর্মানিরা এই রান্না শিখিয়েছিল বাঙালিদের। ওদের রান্নার মতোই ইংরেজদের আগে কলকাতায় আসা আর্মানিরা আজ বাঙালিদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে গেছে। গবেষকদের মতে শেঠ, বসাক, বর্ধন, সরকার, পাল, বাঙালিসমাজে প্রচলিত এই উপাধিগুলি আর্মানি সংস্কৃতির অঙ্গ। কলকাতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণ হয়েছে আর্মানি শব্দ থেকে। কলকাতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আর্মানিরা। এ সংক্রান্ত নানা তথ্য রয়েছে অসিত দাস লিখিত ‘আর্মানি কলকাতার সুলুকসন্ধান’ প্রবন্ধে।
মিষ্টি বাঙালি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নারকেলনাড়ু, তিলনাড়ুর ইত্যাদি নানা প্রকার নাড়ুড় মতো একসময় জনপ্রিয় ছিল পানিহাটির ‘গঙ্গাজল নাড়ু’। এই নাড়ুর ভক্ত ছিলেন শ্রীচৈতন্য। তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকা দেওয়া হয়েছে এইভাবে— ‘নারকেলখণ্ড আর নাড়ু গঙ্গাজল/চিরস্থায়ী খণ্ডবিকার দিয়েছে সকল।’ পানিহাটিতে জৈষ্ঠ্য মাসে যে দণ্ডমহোৎসব মেলা আর কার্তিক মাসে স্মরণমহোৎসব মেলা অনুষ্ঠিত হয় তার সঙ্গে জড়িত আছে বৈষ্ণব ভাবাদর্শ এবং নাড়ু। পাশাপাশি এই উৎসবকালের পরিবর্তনে মিলিয়েছে চৈতন্যদেব এবং পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে। কথামৃততে সেই দৃশ্য সুন্দর ভাবে বর্ণিত হয়েছে। ‘ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পেনেটীর মহোৎসব ক্ষেত্রে বহু লোক সমাকীর্ণ রাজপথে সংকীর্তনের দলের মধ্যে নৃত্য করিতেছেন। বেলা একটা হইয়াছে। আজ সোমবার, জৈষ্ঠ্য শুক্লা ত্রয়োদশী তিথি, ১৮ ই জুন, ১৮৮৮। সংকীর্তন মধ্যে ঠাকুরকে দর্শন করিবার জন্য চতুর্দিকে লোক কাতার দিয়া দাঁড়াইতেছে। ঠাকুর প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া নাচিতেছেন। কেহ কেহ ভাবিতেছে, শ্রীগৌরাঙ্গ কি আবার প্রকট হইলেন। চতুর্দিকে হরিধ্বনি সমুদ্রকল্লোলের ন্যায় বাড়িতেছে। চতুর্দিক হইতে পুষ্পবৃষ্টি ও হরির লুট পড়িতেছে।’ শ্রীচৈতন্যের হাত দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসবের বর্তমান গতিপ্রকৃতি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন সৌভিক রাজ।
ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা ছবির একটি দৃশ্য অনেকেরই মনে থাকবে—বিড়িতে সুখটান দিচ্ছেন শিব আর টিনের জিভ খুলে কালীও। আসলে লোকসংস্কৃতি তথা আঞ্চলিক সংস্কৃতির অঙ্গ শিব-গৌরীপালার অংশ এটি। এই পালাকারদের কেউ বাদাম বেচেন, কেউ বা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই খেটে-খাওয়া মানুষের কথাই উঠে আসে এই পালাগুলিতে। যেমন বর্তমান কুশীলবদের একজন শম্ভু মালাকার বাদামবিক্রেতা। এই পালা মূলত পূর্ববঙ্গ থেকে এই বঙ্গে এসেছে। এর সীমানা সংকুচিত হতে হতে এসে ঠেকেছে বর্ধমান জেলার নীলপুর কাঞ্চননগরের কিছু পল্লীতে। এখানে এখনও পুরুষেরাই গৌরী সাজে।
শুধু শিব-গৌরীর পালা নয়, ‘রাবণকাটা’ বলে প্রবন্ধে দেশবিদেশে মূলত অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন মুখোশনাচের আলোচনা করা হয়েছে।
বইটির প্রবন্ধগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষকদের শ্রমসাধ্য তথ্য আহরণের ফসল। বইয়ের সুন্দর প্রচ্ছদটি এঁকেছেন শিল্পী ঋষভনাথ।
পরিশেষে একটি ত্রুটির কথা—সম্পাদকদ্বয়ের বানানের ব্যাপারে আরও যত্নশীল হওয়া দরকার ছিল। খুব সাধারণ বানান ভুল পাঠে পীড়া দেয়। সেগুলি সংশোধন করলে বইটি সর্বাঙ্গে সুন্দর হবে।