‘‘হাট বসেছে শুক্রবারে
বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে… ’’
রবি ঠাকুরের এই লাইন পড়েননি অথচ বাংলা ভাষায় কথা বলেন এমন মানুষ বিরল। অথচ এই হাট নিয়ে মাথা ঘামাই আমরা ক-জন? এই হাট নিয়েই অজানা সব তথ্য সংগ্রহ করে দু-মলাটের মধ্যে তুলে এনেছেন অঞ্চল সংস্কৃতির গবেষক সুপ্রিয় ঘোষ। ‘নদীয়ার হাট-হদ্দ’ নামে এই বইয়ে তুলে এনেছেন হাটের ইতিহাস, ভূগোল। এই ভূগোলের সীমানা আবদ্ধ থাকেনি শুধু নদীয়া জেলার মধ্যে বরং তা বিস্তৃত হয়েছে সমগ্র বাংলায়।
লোকজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হাট। হাটের উপর নির্ভর করে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রাম্য সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে এই হাটগুলিতে। কিন্তু স্থানে স্থানে এই হাট সৃষ্টির ইতিহাস কী? এই প্রসঙ্গে এই বইয়ের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, ‘‘১১৯৬ খ্রীষ্টাব্দে উৎকীর্ণ শ্রীমদ্ভোম্মন পালের রাক্ষস গাড়ি তাম্রশাসন অনুসারে সুন্দরবন এলাকায় ও গঙ্গাসাগরের নিকটে বিরাজ করত আরও একটি অনুরূপ নদীবন্দর— তার নাম ‘দ্বারহাটক’। হাটক ও হট্টক সম্ভবত সমার্থক, অর্থাৎ বাণিজ্যকেন্দ্র যেটির অবস্থান ছিল দ্বার দেশে দ্বার বলতে এখানে নদীর মোহনা।” এই হট্ট বা হট্টিকার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় পাঁচ শতকের লেখাতে, যদিও আট শতক ও তার পরবর্তী আমলের লেখমালায় হট্ট বা হট্টিকার উল্লেখ অনেক বেশি পরিমাণে লক্ষ করা যায়। প্রাচীন হট্ট বলতে বিপণনকেন্দ্র বোঝাত, গ্রামীণ হাট শব্দটি হট্ট-র সমার্থক।
বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে শ্রীরাধিকার মথুরার হাটে দধিদুগ্ধের পসরা বিক্রি করতে নিয়ে যাবার সুন্দর চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে: ‘আম্ভা হেতু রাধিকারে বুলিহ কপটে।/দধি দুধ বিচি নিআঁ মথুরার হাটে।।’ (নৌকাখণ্ড)
এই হাটের অস্তিত্ব ছিল পালযুগেও। নালন্দার নিকট অবস্থিত দেবপালদেবহট্ট এই নামটি যে একটি বৃহৎ হাটের অতীত স্মৃতি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে এতে সন্দেহের কিছু নেই। হাট সৃষ্টির ইতিহাস সন্ধানের পাশাপাশি প্রাচীন হাট সম্বন্ধে অনেক তথ্যসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন লেখক। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে লেখক সেই সময় নদীয়ার হাটে বিক্রিত পণ্যসামগ্রীর একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন— ‘‘লেখিতে না পারি যত দাসদাসী প্রেমের মন্দিরে খাটে।।/যে যে দ্রব্য সব ভুবন দুর্লভ বিকায় নদীয়া হাটে।।’’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমাপদ চৌধুরী, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বাংলার বহু সাহিত্যিকের লেখায় উঠে এসেছে হাটের বর্ণনা। প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লেখক বিভিন্ন সাহিত্যিকের রচনা তুলে ধরেছেন। যেমন, নদী তীরবর্তী হাটের বর্ণনায় তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘সমস্যাপূরণ’ বর্ণিত হাট—‘‘সেদিন সোমবার, হাটের দিন। ছোটো একটা নদীর ধারে হাট। বর্ষাকালে নদী পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। কতক নৌকায় এবং কতক ডাঙায় কেনাবেচা চলিতেছে, কলবরের অন্ত নাই। পণ্যদ্রব্যের মধ্যে এই আষাঢ় মাসে কাঁঠালের আমদানিই সবচেয়ে বেশি, ইলিশ মাছও যথেষ্ট। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে; অনেক বিক্রেতা বৃষ্টির আশঙ্কায় বাঁশ পুঁতিয়া তাহার উপর একটা কাপড় খাটাইয়া দিয়াছে।’’
শুধু হাটের বর্ণনা নয়, লেখক অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন কারা বসাতেন এইসব হাট। এই প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন বহু দিন ধরে চলা কয়েকটি হাটের উদাহরণ। যেমন, ‘মেহেরপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে সৈয়দ আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, ‘‘হৃদয়পুরের জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু ১৮৯০ সালের দিকে নিজ উদ্যোগে ভবরপাড়া গ্রামের সন্নিকটে হাট বসানোর উদ্যোগ নেন।’’ হাওড়া ময়দানে চড়কডাঙায় গড়ে ওঠে বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ বস্ত্রহাট, যা ‘মঙ্গলা হাট’ নামে পরিচিত। গড়ে তোলেন আন্দুলের মল্লিকরা হাওড়া, হুগলি ও মেদিনীপুরের তাঁতিদের অনুরোধে। অনুরূপ একটি বৃহৎ হাট উত্তর কলকাতার হরি সাহার হাট, পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা কাটোয়া মহকুমার সমুদ্রগড় গণেশ কর্মকার তাঁত কাপড় হাট ইত্যাদি।
বহুবিধ দ্রব্যের হাটের কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি নির্দিষ্ট বিষয় ভিত্তিক হাটের কথাও উঠে এসেছে বইটিতে। যেমন, নদীয়ার মাজদিয়ায় বসে নলেন গুড়ের হাট, উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহার থানার পতিরাজ হাট বসে ডোকরা শিল্পকর্ম নিয়ে, মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে একটা সময় বসত দই-এর হাট, বাঁশের হাট, হাঁড়ি হাট। এইভাবে লেখক প্রতিটি জেলাভিত্তিক হাটের একটি তালিকা প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছেন, যা হাট নিয়ে গবেষকদের উপকৃত করবে।
গ্রামবাংলার মানুষের কাছে হাট হল মূলত বাজার। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্যের সঙ্গে সঙ্গে শখের জিনিসও গ্রামের মানুষেরা সংগ্রহ করেন। প্রাপ্ত দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে গ্রামের মানুষের মুখে শোনা যায় ‘হাটে হিরে টু জিরে সব মেলে’। এর একটি সুন্দর তালিকা উপস্থাপন করেছেন লেখক।
প্রয়োজনীয় উপাদানের পাশাপাশি হাটে গোপনে বিক্রি হয় দেশি মদ, হাড়িয়া, পচুই, মহুয়া, গাঁজা ইত্যাদি। গাবগুবি বা একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করেন কেউ কেউ। বসে জুয়ার আসরও। পাশাপাশি গ্রামীণ যোগাযোগেরও বৃহৎ ক্ষেত্র এই গ্রামীণ হাটগুলি। পূর্বে জমিদার ঢ্যাড়াদারদের দিয়ে বিভিন্ন বিষয় প্রচার করতেন হাটে হাটে। আজও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প থেকে শুরু করে মুরগি লড়াই সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার খবর, যাত্রাগানের আসর ইত্যাদি বিষয়ে প্রচারের জায়গা হাট। আবার বিনোদনেরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গ্রামীণ হাটগুলো। এর অন্যতম সাপের খেলা দেখানো, শারীরিক কসরত দেখানো, ম্যাজিক দেখানো ইত্যাদি।
স্থানের নামকরণেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে হাট শব্দটি। গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে থাকা এইরূপ বহু স্থাননাম তুলে এনেছেন লেখক। যেমন, রামপুরহাট, হাট শিমুল, আতাইহাট, আদরাহাটি ইত্যাদি।
আবার বাংলা সাহিত্যে হাট নিয়ে প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচনের সংখ্যাও কম নয়। সেইসব প্রবাদ-প্রবচনের উৎসের সন্ধান করার চেষ্টা করেছেন লেখক। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘পড়ল কথা হাটের মাঝে,/যার কথা তার গায়ে বাজে। বা ‘ছেলে নষ্ট হাটে, বউ নষ্ট ঘাটে’।
বইটির নাম ‘নদীয়ার হাট-হদ্দ’ হলেও লেখকের হাট সম্পর্কিত আলোচনা নদীয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। সেই হিসেবে হাট নিয়ে প্রায় সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী বই বলা যেতে পারে এই বইটিকে। লেখক বিভিন্ন জেলাভিত্তিক হাটের যে তালিকা তুলে ধরেছেন সেই তালিকা সম্পূর্ণ নয়। যেমন বীরভূম জেলার হাটগুলির তালিকায় সংযোজিত হওয়া উচিত ছিল রবি ও বৃহস্পতি বার বসা রাজনগরের হাটের কথা। অনুরূপে আরও নিবিড় তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে জেলাভিত্তিক সব হাটগুলি তালিকায় সংযোজিত হলে এই তালিকা সম্পূর্ণ হত।
সুন্দর আলোচনা ,সমৃদ্ধ হলাম ,,,