বাঁকুড়া জেলার অখ্যাত গ্রাম ব্রজরাজপুর। সেই গ্রাম বিখ্যাত হয়ে গেল শ্যামলীলাভূমি হিসাবে। শ্রীচৈতন্য পার্ষদ দাস গদাধরের পৌত্র মথুরানন্দ গোস্বামী পত্তন করেন এই গ্রামের এবং প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামসুন্দরের মন্দির। দক্ষিণ বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল এই ব্রজরাজপুর এবং প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরানো এক মন্দির এবং তাকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া দেবমাহাত্ম্য, লোককথা এবং ইতিহাস তুলে এনে দু-মলাটের মধ্যে বন্দি করেছেন লোকসংস্কৃতির গবেষক পার্থসারথি গোস্বামী।
ব্রজরাজপুরে শ্যামসুন্দরের মন্দির
এই বইয়ের পটভূমি শুরু হয়েছে ব্রজরাজপুর মন্দির তৈরি হবার বহু আগে থেকেই। জঙ্গলাকীর্ণ খাতড়া মহকুমায় বৈষ্ণব ধর্মের বিস্তার এবং বৈষ্ণব সংস্কৃতির হাত ধরে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের কথা উঠে এসেছে এই বইয়ের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে মন্দির গড়ে ওঠার ইতিহাস, ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।
বইয়ের শুরুতেই সংযোজিত হয়েছে দাস গদাধর গোস্বামীর একটি বংশতালিকা। যা বাঁকুড়া তথা দক্ষিণ বাঁকুড়ার বৈষ্ণবধর্মের গবেষকদের কাছে মূল্যবান নথি। ‘মথুরানন্দ গোস্বামী কথা’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে তাঁর প্রথম জীবন, গৃহত্যাগ ও বৃন্দাবনগমনের কথা। মথুরানন্দের বাল্যকালে প্রাথমিক পাঠগ্রহণ বেশ আকর্ষণীয়। লেখক উপস্থাপন করেছেন সুন্দর ভাবে, বিদ্যালয়ে গিয়ে ‘ক’ অক্ষর দেখে কেঁদে আকুল হলেন মথুরানন্দ। ‘‘তথায় যাইয়া বালক লাগিল কাঁদিতে।/ ‘ক’ অক্ষর দেখি তথা পড়িল ভূমিতে।।’’
গ্রন্থটিতে সমান্তরাল ভাবে প্রবাহিত হয়েছে ভক্তিরস। ভাবপ্রকাশের জন্য লেখক লাইন তুলে এনেছেন শ্রীশ্রী শ্যামলীলামৃত, শ্রীশ্রী চৈতন্যচরিতামৃত, শ্রীচৈতন্য ভাগবত ইত্যাদি বৈষ্ণব আকরগ্রন্থ থেকে। মথুরানন্দের বিগ্রহলাভ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘‘হের হে নয়নে শ্রীরাধার মনে দিলাম কপাট খুলিয়া।’’ আবার দেব আরাধনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘‘মন্ত্রতন্ত্র সাধনাদি কিছু নাহি জানি। /এই বলে কাঁদে আর চক্ষে বহে পানি।’’
প্রসঙ্গক্রমে এসেছে সুপুর তথা ধলভূমের রাজা জগন্নাথ ঢোলের কথা। নিঃসন্তান রাজাকে প্রজাগণ পর্যন্ত ‘আটকুড়া’ রাজা বলে উপহাস করত। এই উপহাস থেকে পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা এবং সন্তানলাভের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। বলা যেতে পারে বিষ্ণুপুরের রাজা হাম্বীর শ্রীনিবাসের সংস্পর্শে আসার ফলে মল্লভূম জুড়ে যেভাবে বৈষ্ণবধর্মের ঢল নেমেছিল, অনুরূপে জগন্নাথ ঢোলের মথুরানন্দের সংস্পর্শ ধলভূম জুড়ে বৈষ্ণব প্রচার ও প্রসারের ভূমি তৈরি করেছিল। এই অংশটিতে লেখক বর্তমান দক্ষিণ বাঁকুড়ায় বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের ইতিহাস সুনিপুণ দক্ষতায় এবং বিশ্লেষণধর্মী মন নিয়ে তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে সুপুর, অম্বিকানগর এবং খাতড়া রাজপরিবার গড়ে ওঠার মূল কারণ তুলে নিয়ে এসেছেন। যা বাংলার জমিদার বা রাজবাড়ি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের তথ্য সহায়ক হবে। বাংলার বুকে বর্গি আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ার সময় এর শিকার হয়েছিল ব্রজরাজপুরও। এই তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় শ্রীদাস গোবিন্দ রচিত আখ্যান থেকে—
এগারশ তেষট্টি সনে বৈশাখের অপরাহ্ণে
শুক্লপক্ষে তৃতীয়ার দিনে
একদল বর্গি এসে অত্যাচার কৈল যবে
এই ব্রজরাজপুর গ্রামে
এখানে লেখক তুলে এনেছেন ইতিহাসবিস্মৃত এক তরুণী বীরাঙ্গনা-র কথা। তিনি ছিলেন খাতড়ার তৎকালীন শাসক হরিশচন্দ্র ধবলের ভ্রাতা বীরচন্দ্রের কন্যা। শ্যামকে স্মরণ করে নিজ অসিবলে তিনি পরাস্ত করেছিলেন বর্গিদের—
সৈন্য মোর শ্যামচাঁদ অস্ত্র এই অসিখান
বল মোর গুরুর চরণ।
আর কি কহিব ওরে বৈষ্ণবরেণু ধরি শিরে
আসিয়াছি তোমাদের সদন।
এই আখ্যানে সম্ভবত বর্গিদের হাত থেকে মদনমোহন কর্তৃক বিষ্ণুপুরকে রক্ষার গল্পের ছায়া রয়েছে। তবে বিস্মৃতপ্রায় এই ইতিহাস তুলে এনে লেখক তাঁর গবেষক হিসেবে নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়ের পরিচয় দিয়েছেন।
বাংলা তথা ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মন্দির। আশ্চর্যের বিষয় প্রায় প্রতিটি মন্দিরের আরাধনাপদ্ধতি এবং নিবেদিত নৈবেদ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ব্রজরাজপুর গ্রামের মন্দিরের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। সুনিপুণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শ্যাম-রাইয়ের সেবাপদ্ধতি তুলে ধরেছেন এই বইয়ে। ভোগ নিবেদনের নৈবেদ্য হিসাবে লেখা রয়েছে, “সকাল ন’টার সময় মন্দির খুলে প্রভুর পূজা অর্চনা, পূজার শীতল হিসাবে নিয়ম অনুযায়ী যেসব সামগ্রীর প্রয়োজন সেগুলো হলো—গব্য ঘৃত বা গাওয়া ঘি মাখানো ও কিঞ্চিত লবণ সহযোগে তিন সের মুড়কি, দুই সের চিড়ে ভাজা, ছয়টি মিঠাই ও তার সঙ্গে নানা ফলমূল। মধ্যাহ্নভোগে নিবেদন করা হয় তিন সের তিন পোয়া আতপ চালের অন্ন, পাঁচ পোয়া কলাইয়ের ডাল, শাক, চাররকমের ভাজা, কুমড়োর তরকারি, শুক্তা ও চাটনি। এক সের চিড়ের পিঠে তাতে যেন চাঁছি ভরা থাকে এবং তিন সের দুধ ও এক পোয়া আতপ চাল ও পরিমাণ মতো গুড়ের পরমান্ন বা পায়েস। সব শেষে দিতে হয় পাঁচটি পান। তারপর প্রভুর শয়ন ও চামর দুলিয়ে প্রভুর পদসেবা করা অবশ্যই কর্তব্য। সন্ধ্যাভোগ অনেকটাই সকালের বাল্যভোগের ন্যায়।
বলা অত্যুক্তি হবে না সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রত্যহ যা ভোজন করা হয় দেবতাকে তাই নিবেদন করা হয়। অর্থাৎ দেবতাকে এখানে ঘরের সাধারণ সদস্য হিসাবে কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে। সুপুরের রাজা দেবসেবার জন্য দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যা বংশানুক্রমে ভোগ করে আসছেন মথুরানন্দ গোস্বামীর বংশধরেরা। বর্তমানে প্রায় পনেরোটি গ্রাম জুড়ে তাঁদের বসতি। এই পনেরোটি গ্রামের সদস্যরা সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে আছেন মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে। সেবাপদ্ধতির যে নিয়ম মথুরানন্দ গোস্বামী প্রবর্তন করে গেছেন তাঁর বংশধরেরা আজও তা অক্ষুণ্ণ ভাবে পালন করে আসছেন।
মন্দিরে বিভিন্ন তিথিতে পালনীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা লেখক এই গ্রন্থে তুলে এনেছেন। এর অন্যতম—জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, রাস উৎসব, মঙ্গল আরতি, চাঁচর, দোলযাত্রা ইত্যাদি। বর্ণিত হয়েছে আরতিগীতং যা মথুরানন্দ গোস্বামী রচনা করে গেছেন। এখানের রাস উৎসব নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘‘বাঁকুড়ার ইন্দপুরস্থিত ব্রজরাজপুরের শ্যামসুন্দর মন্দিরের রাস উৎসব প্রায় ৩৭৫ বৎসর পুরাতন।’’ যতদূর জানা যায় ব্রজরাজপুরে রাস উৎসবের শুভসূচনা করেছিলেন মথুরানন্দ পত্নী কনকলতা দেবী। এই রাস মধ্যমরাস অর্থাৎ এই রাস অনুষ্ঠিত হয় বৃন্দাবন বা নবদ্বীপের রাসের পরের দিন। সেদিন সন্ধ্যা আরতির পর মূল মন্দির থেকে প্রভু শ্যামসুন্দর, রাধারাণী ও ললিতার বিগ্রহ পালকিতে করে নিয়ে যাওয়া হয়, মন্দিরের মূল ফটকের বাইরে পশ্চিমে অবস্থিত রাসমঞ্চে। প্রসঙ্গত অনুরূপ নিয়ম মল্লভূম বিষ্ণুপুর সহ বৃহত্ভূমের প্রায় সর্বত্রই প্রচলিত ছিল।
শুধু ইতিহাস নয় বহুবর্ষ প্রাচীন এই মন্দির নিয়ে আবর্তিত হয়েছে একাধিক লোককথা তথা কিংবদন্তি। বাঁকুড়া জেলার লোককথা নিয়ে এখনঅ পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ কাজ হয়নি। তাই লোককথার গবেষকেরা এই বই থেকে তাঁদের গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করতে পারেন। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে প্রেমলতা বা ললিতার কথা, যে কিনা সাধারণ মানবী হয়ে দেবী রূপে স্থান পেয়েছে শ্যামসুন্দরের পাশে। মথুরানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানদের মধ্যে দেবতার অধিকার নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা নিরসন হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। আবার তস্কর উদয় সিংহের চোর থেকে ভক্ত হয়ে ওঠার গল্প তুলে ধরা হয়েছে এই পুস্তকে। ইতিহাস, কিংবদন্তি, লোককথার সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে এই পুস্তকে। শুধু ইতিহাসনির্ভর পুস্তক হিসাবে নয় বরং বলা যেতে পারে মথুরানন্দের বংশধর হিসাবে লেখক তাঁর শেকড়ের সন্ধান করেছেন এই পুস্তকের মাধ্যমে।
দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায় অঙ্কিত প্রচ্ছদ যথাযথ হলেও প্রকাশনীর বাঁধাই এবং ছাপা উন্নত মানের নয়। ভুল থেকে গেছে প্রুফ সংশোধনেও। ১০৫১ সনে প্রতিষ্ঠিত ব্রজরাজপুর এবং মন্দির সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য লেখক তুলে ধরলেও বইয়ে কোথাও তথ্যসূত্র দেওয়া হয়নি। মন্দিরের বর্ণনা ও গঠনশৈলী থাকলে পূর্ণাঙ্গ হত ব্রজরাজপুরের এই মন্দির সম্পর্কে তথ্য।
তা সতত্ত্বেও বলা যেতে পারে প্রত্যন্ত এক গ্রামের মন্দির নিয়ে রচিত এই বই পথ দেখাবে আঞ্চলিক সংস্কৃতির গবেষকদের।