এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটি অতিসাধারণ ভ্রমণকাহিনি

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ নভেম্বর ২০১৫ | ৫৮৬২ বার পঠিত
  • লাদাখ নিয়ে লেখার শেষে নিজের কাছেই নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আবার রাস্তায় নামবই।

    রাস্তা আমাকে টানছিল। এ টান অনেকটা নিশির ডাকের মত, সাড়া দেবার আগে বহুৎ ভাবতে হয়, অথচ ভাবনার শেষে সাড়া না দিয়েও থাকা যায় না। সবাই এ ডাক শুনতে পায় না, কিন্তু যে পায়, তার রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। আমারও যাচ্ছিল। … কোথায় যেন একটা কোটেশন পড়লাম, স্বপ্ন সেইটা নয়, যেটা তুমি রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দ্যাখো, স্বপ্ন হল সেইটা, যেটা রাতে তোমাকে ঘুমোতে দেয় না। সেই স্বপ্ন আমার রাতের ঘুম নষ্ট করতে থাকল।

    লাদাখ থেকে ফিরে আসার পর কিছুদিন বেশ শান্তিতে ঘুমিয়েছিলাম। নিজের ভেতর একটা তৃপ্তি কাজ করেছিল কিছুদিন। কীসের তৃপ্তি? আমি মানুষটা খুব সাধারণ, খুব দুর্বল। এমন নয় যে আমি প্রথম বাইক চালিয়ে লাদাখ গেছি, সেই রাস্তায় প্রতি বছর বিভিন্ন ভাবে প্রচুর মানুষ যায়, একাধিকবার যায়, একা যায়, দল বেঁধে যায়, কিন্তু প্রতিটা জার্নিই নিজের মত করে অনন্য হয়ে ওঠে, ইউনিক। আমার জার্নিও তাই ছিল। অনভিজ্ঞতার জন্য প্রথমদিকে টালমাটাল, হওয়া সম্ভব ছিল না, তবুও ক্ষমতার শেষ সীমা পর্যন্ত চেষ্টা করে পেরেছি। সত্যি পারব, এমনটা লাদাখ পৌঁছবার আগে পর্যন্ত ভাবি নি।

    কিন্তু সে তৃপ্তি বেশিদিন থাকল না। এক মাস যেতে না যেতেই রাতে ঘুমের মধ্যে কালো পিচের রাস্তা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল, আয় – আয়। ঘুম ভেঙে যেত। মনের মধ্যে কল্পনা করতাম, আমি আবার বেরোচ্ছি – এইবারে লাহুল-স্পিতি, কল্পা-সাংলা-চিটকুল – নাকি অন্য কোথাও?

    দেড় মাসের মধ্যে নিজের জুন মাসের ট্রিপটা কেমন অবিশ্বাস্য লাগতে শুরু করল। আমি কি সত্যিই গেছিলাম? উচ্চণ্ড গরমের মধ্যে প্রথম দিনেই ছশো কিলোমিটার রাইড করেছিলাম? নিজের কাছেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আজ, এক্ষুনি যদি তোমাকে কেউ বলে কাল ভোরবেলা আবার লাদাখের জন্য স্টার্ট করতে হবে – তুমি পারবে? … দিল্লির গরম তখনও একই রকম প্রখর।

    কনফিডেন্স কমছিল মনের মধ্যে। না, আর বোধ হয় ওই রকমের রিস্ক নিতে পারব না। আবার একবার বেরিয়ে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সারাদিন বাইক চালিয়ে ছশো কিলোমিটার ড্রাইভ করা – আমার পক্ষে সম্ভব নয়। … নাকি সম্ভব? জাস্ট ঘরে ফ্যানের নিচে বসে আছি বলে এমন মনে হচ্ছে? বাইরে একবার বেরিয়ে পড়লে কি বাকিটা খুবই অসম্ভব? … কে জানে!

    এই সময়ে দেখে ফেললাম পিকু সিনেমাটা। আর সাথে সাথেই মনে সেট করে গেল পরের জার্নি। ইরফান খানের হাতে স্টিয়ারিং, গাড়ি চলেছে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে, কানপুর পেরিয়ে বেনারস পেরিয়ে কলকাতা। আর কলকাতা মানেই তো আমার আরেকটা ঘর! আমার মা-বাবা আছে, আত্মীয় পরিজন আছে, গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারলে একটা দারুণ অসাম সেলিব্রেশন হবে।

    একেই ঘুম আসছিল না রাতে, হয়ে গেল আরো বেশি করে ঘুমের দফারফা। পড়তে শুরু করলাম দিল্লি কলকাতা ট্রিপের ওপর যত রকমের লেখা, ট্র্যাভেলগ হয়। জোগাড় করতে লাগলাম তথ্যাদি, কীভাবে যাওয়া যায়, কোথায় থামা উচিত, কোন হোটেলে খাওয়া ভালো, সব পড়তে লাগলাম। গল্পটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকল চোখের সামনে। কয়েকটা জিনিস বুঝতে পারলাম, যেগুলো আলাদা করে আগে মাথায় স্ট্রাইক করে নি।

    দিল্লি থেকে কলকাতার দূরত্ব যদিও দেড় হাজার কিলোমিটার, পুরো ট্রিপটা যাওয়া-আসা মিলিয়ে পড়বে তিন হাজার কিলোমিটার। সুতরাং, তিন হাজার কিলোমিটার রাইডিং-এর প্রস্তুতি নিয়ে, তবেই বেরনো উচিত।
    যে পথে যাওয়া, সেই পথেই ফেরা। সাধারণত এই ধরণের লম্বা ট্রিপে যাওয়াটা যদিও ভালোয় ভালোয় হয়ে যায়, সেই একই পথে অতটা লম্বা জার্নি করে ফিরে আসা প্রায়শই প্রচণ্ড টায়ারিং হয়ে দাঁড়ায়, হাল ছেড়ে দিতে মন চায়। লাদাখে মানালির রাস্তা বন্ধ থাকায় আমাকে একই রাস্তা দিয়ে ফিরতে হয়েছিল – শ্রীনগর জম্মু হয়ে। এটা কতটা ফ্রাস্ট্রেটিং হয়, আমি জানি। কলকাতা থেকে দিল্লি ফেরার দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই, একটাই রাস্তা দিয়ে ফিরতে হবে। অতএব, মনকে সেইভাবে তৈরি করে নিয়ে বেরোতে হবে।
    রাস্তাটি চলেছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং ঝাড়খণ্ড হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে। রাজ্যগুলি বিভিন্ন কারণে খবরের কাগজের হেডলাইনে থাকে সারা বছর, তবে মূল হাইওয়েটা দিব্যি সেফ। যদিও সবসময়ে এটা রেকমেন্ডেবল যে ভোর ভোর শুরু করো, রাজ্যগুলো দিনের বেলায় পেরিয়ে যাও, বেশি রাতে ড্রাইভ কোরো না। এলাহাবাদ বা বারাণসী, দুটোর মধ্যে যে কোনও একটা জায়গায় থাকা যায় রাতে, তবে লোকে মূলত বারাণসীতেই থাকে, সেই মত জার্নি প্ল্যান করতে হয়।
    এবং, প্রতিটি রাজ্যই সমতলভূমিতে অবস্থিত। ঝাড়খণ্ডে হাল্কা পাহাড় আছে বটে, তবে তা নিতান্তই মালভূমির পাহাড়, তা বাদে পুরো রাস্তাটাই সমতল। গরমকালে প্রচণ্ড হিটওয়েভ চলে এইসব জায়গায় – ফলে গেলে গরম কমার পরেই যেতে হবে।

    সিকিনীকে ভয়ে ভয়ে জানালাম। সিকিনী প্রথমে তো উড়িয়েই দিল, আমি ইয়ার্কি মারছি ভেবে, আরে সিনেমাতে তো কতকিছুই দেখায়, তাই বলে রিয়েল লাইফে সেইসব পাগলামো করে নাকি কেউ? খানিকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করার পরে বুঝল, আমি ইয়ার্কি মারছি না, সিরিয়াসলিই বলছি। ওকে দু একটা ট্র্যাভেলগ দেখালাম, লিঙ্ক দিলাম পরে পড়ার জন্য। কিন্তু সে লাদাখ যাবার আগে কিছু পড়ে নি, এখন আর কী পড়বে? যে ডাক আমি শুনতে পাই, সে ডাক তো আর ও শুনতে পায় না! এ ডাক সবাই শুনতে পায় না। সিকিনী বা কন্যা ভূতোর কাছে বেড়ানো মানে কোথাও বেশ আরাম করে যাওয়া, তার পরে চুপচাপ কোনও একটা সীনিক বিউটির সামনে বসে থাকা, ওর কাছে “ছুটি” বা “বেড়ানো” মানে খাবার অর্ডার করে খাওয়া, নিজে রান্না না করা, টিফিন প্যাক না করা।

    সে হতেই পারে। সবার জীবনের নিজস্ব দর্শন থাকে। একজনকার দর্শন অন্যজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া খুব খারাপ জিনিস বলে আমি মনে করি, ফলে সাহস করে শেষ কথাটা পেড়ে উঠতে পারছিলাম না। তবু, গৃহযুদ্ধ অনিবার্য ভেবেও – খানিক দোনামোনা করে, শেষমেশ পেড়েই ফেললাম কথাটা।

    – যাবি আমার সঙ্গে?

    … তোরা যদি যাস, তা হলে গাড়ি নিয়ে যাবো, তোরা আরামসে বসে ঘুমিয়ে যেতে পারবি, ড্রাইভিং তো আমিই করব, গাড়িতে এন্টারটেনমেন্ট সিস্টেমও আছে, তাতে গান শোনা যায়, সিনেমা দেখা যায়, পছন্দের গান সিনেমা পেন ড্রাইভে ভরে যা ইচ্ছে হবে দেখবি, শুনবি, বোর হলে বইটই পড়বি, আর ফেরার সময়ে রাজধানী এক্সপ্রেসে করে ফেরত আসবি। আমি একলা ফিরব।

    আর তোরা যদি না যাস, তা হলেও আমি যাবো, একলা গেলে আর গাড়ি নিয়ে যাবার দরকার নেই – বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। দুদিনে দেড় হাজার কিলোমিটার সমতলে করা খুব বড় কোনও ব্যাপার নয়।

    না, বোম ফাটল না, ভূমিকম্প হল না, গৃহযুদ্ধও হল না। আমি মিছেই ভয় করছিলাম। সিকিনী এখন আমাকে চিনে গেছে। ও জানে যে আমাকে বারণ করে লাভ হবে না এই ব্যাপারে, ও জানে যে আমাকে রাস্তা টানে। কিন্তু ওকে যে টানে না এইভাবে! প্রথমে খুব খানিকক্ষণ দোনামোনা করল, এইভাবে এতটা রাস্তা বাই রোড যাওয়া – জানি না আমরা পেরে উঠব কিনা, তার ওপরে ভূতো অনেক ছোট, ও পারবে না এই ধকল নিতে, আর এ তো লাদাখের মত রাস্তা নয় – যে খানিক গেলেই পাহাড় শুরু হবে, সুন্দর দৃশ্য দেখা যাবে চারদিকে, এ পুরো উত্তর ভারতের ওপর দিয়ে যাওয়া, যার বিশেষ কোনও সৌন্দর্য নেই, তার ওপরে রাস্তা কেমন কে জানে, বিহারে কী অবস্থা হবে, কে জানে – এইভাবে গিয়ে কী আনন্দ হবে?

    আশ্বস্ত করলাম অনেকগুলো পয়েন্টে। না, বিহার আদৌ ডেঞ্জারাস নয় যদি দিনের বেলায় ক্রস করি – আর আমরা দিনের বেলাতেই ক্রস করব কারণ আমরা বেনারসে রাতে থাকব, সেখান থেকে ভোরবেলা বেরবো, আর বেনারস হচ্ছে বিহারের বর্ডার ঘেঁষে, ওখান থেকে বিহার জাস্ট কুড়ি কিলোমিটার। আমরা ভোর থাকতে থাকতেই বিহার পেরিয়ে যাবো। সৌন্দর্য – হ্যাঁ, হিমালয়ের সৌন্দর্য এ রাস্তায় নেই, কিন্তু এ রাস্তায় অন্য সৌন্দর্য আছে। বিহার আর ঝাড়খণ্ডের সীনিক বিউটি জাস্ট অসাধারণ, অন্যরকম, না দেখলে সে বর্ণনা দিয়ে বোঝানো যাবে না। আর রাস্তা? হ্যাঁ, ছোটখাটো কয়েকটা প্যাচ তো আছেই খারাপ, কিন্তু ওভারঅল রাস্তা ভীষণ ভালো, ওয়েল মেনটেইনড, রাস্তা খারাপ হবে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে ঢুকলে, তাও সে খানিকটাই। এত লম্বা জার্নিতে ওটুকু খারাপ রাস্তা – গায়ে লাগবে না।

    ভূতোকে নিয়ে একটা চিন্তা আছেই, মাত্রই দশ বছর বয়েস, খুব একটা বেড়ানোর ইন্টারেস্ট নেই, প্লাস ওর মোশন সিকনেস আছে। গাড়িতে চললে খানিক বাদেই বমি পায়, যদিও আজ প্রায় বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, তেমন কিছু ঘটে নি। আস্তে আস্তে বড় হবার সময়ে এইসব টেম্পোরারি সমস্যা কেটে যায়। দেখা যাক না, কী হয়। ওষুধপত্র নিয়ে উঠব, দরকার হলে বমির ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব।

    সিকিনী তবুও কিন্তু-কিন্তু করতে লাগল, এমনিতে তার আর খুব একটা আপত্তি নেই, কিন্তু অফিসে ছুটি পাওয়া যাবে কিনা সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। যাবার সময় আমি ফিক্স করছি নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, কালীপুজো আর ভাইফোঁটা একই সময়ে একই সপ্তাহে পড়েছে, আমার গত পনেরো বছর ভাইফোঁটা পাওয়া হয় নি, আর ভূতোরও একটা পিসতুতো ভাই আছে কলকাতায়, ভূতোও জন্মে থেকে “ভাইফোঁটা” কী জিনিস, তা জানে নি। মুশকিল হচ্ছে, কালীপুজোর সময়টা দিল্লিতে হয় দিওয়ালি, উত্তর ভারতের সবচেয়ে বড় উৎসব। সেই সময়ে অনেকেই ছুটিতে চলে যায়, বাড়ি যাবার জন্য, বাঙালিদের পক্ষে ছুটি পাওয়া ওই সময়টা একটু চাপ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ আমরা বাঙালিরা সাধারণত দু তিনদিনের ছুটি নিই দুর্গাপুজোর সময়ে, সেটাতে কেউ না করে না। দিওয়ালিতে ছুটি নিতে গেলে দুর্গাপুজোয় ছুটি নেওয়া যাবে না, আবার দুর্গাপুজোয় ছুটি না নিলেও যে দিওয়ালির সপ্তাহে ছুটি পাওয়া যাবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই।

    স্বাভাবিক। জুলাই মাসে দাঁড়িয়ে নভেম্বরে ছুটি পাওয়া যাবে কিনা তা আলোচনা করা একেবারেই যুক্তিযুক্ত নয়। ভূতোর স্কুল ওই সপ্তাহে বন্ধ থাকবে এটা জানা।

    তা হলে, সিকিনী যেতে না পারলে কি ভূতো যাবে আমার সাথে?

    ভূতোর কাছে কথাটা পাড়তেই ও এককথায় না করে দিল। মা গেলেও ও যেতে রাজি নয়, অতক্ষণ গাড়িতে যেতে তার ভালো লাগে না। তবে, ভূতো খুব অ্যাকোমোডেটিং পার্সন, মানতেই হবে, জাস্ট দু ভাবে ইনস্পায়ার করলাম, পিকু দেখালাম দুবার, আর বললাম, এই জার্নি আমার লাদাখ যাবার থেকে কোনও অংশে কম নয়, যদি এটা করতে পারিস, জানবি তোর বয়েসে এই রকমের ট্রিপ আর কেউ করে নি, স্কুলে গিয়ে ঘ্যাম নিয়ে সব্বাইকে বলতে পারবি, সবাই হাঁ হয়ে যাবে।

    চারদিনের মাথায় ভূতো নিজে থেকেই রাজি হয়ে গেল। কোনও জোরাজুরি করতে হল না।

    আমি দুজনকার জন্য ফিরতি রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে রাখলাম, বারাণসীতে রাহি ট্যুরিস্ট বাংলোতে যাবার এবং আসার রাতের জন্য ঘর বুক করে রাখলাম। ৭ই নভেম্বর শুরু করে ৮ই নভেম্বর সন্ধ্যেয় বাড়ি পৌঁছনো, আবার ১৪ই নভেম্বর শুরু করে ১৫ তারিখ রাতের মধ্যে দিল্লি ফেরত।

    আগস্ট গেল। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ সিকিনী আমাকে বলল, একটা টেস্ট ড্রাইভ করলে কেমন হয়? দোসরা অক্টোবর ছুটি, শুক্রবার পড়েছে, মানে লং উইকেন্ড। চল্‌, বেরিয়ে পড়ি।

    যা ভাবা তাই কাজ। গন্তব্য ঠিক হল ম্যাকলিওডগঞ্জ, ধরমশালা থেকে বাইশ কিলোমিটার ওপরে। দিল্লি থেকে পাঁচশো কিলোমিটার। যাওয়া আসা মিলিয়ে হাজার কিলোমিটার।

    দু তারিখ ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম। অনেকটাই ভালোয় ভালোয় গেলাম, মাত্রই পাঁচশো কিলোমিটার বলে ধীরেসুস্থে ব্রেক নিয়ে বিকেল নাগাদ ধরমশালায় পৌঁছলাম। তার পরেই শুরু হল এক বিকট জ্যাম। সেদিন ধরমশালার স্টেডিয়ামে ছিল ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ম্যাচ, লোকাল লোক তো বটেই, লং উইকেন্ডের মওকা পেয়ে দিল্লি পঞ্জাব থেকে হাজারে হাজারে লোক সেদিন এসেছে খেলা দেখতে এবং উইকেন্ডের ছুটি কাটাতে, ফলে পাহাড়ের সরু রাস্তা দিল্লির বদ্‌তমিজ ড্রাইভারদের হাতে পড়ে পুউরো জ্যামপ্যাকড, না যাবার রাস্তা খোলা, না আসার রাস্তা।

    বাইশ কিলোমিটার পেরিয়ে আমরা যখন হোটেলে গেলাম তখন রাত নটা বাজে। পরের দুটো দিনও খুব ভালো কাটল না, রাস্তায় থিকথিক করছে ভিড়, ম্যাকলিওডগঞ্জের একটা পাতিস্য পাতি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে টেবিলের ধারে লাইন দিতে হচ্ছে এই রকমের ভিড় সেদিন, ফেরার সময়েও রাস্তায় আম্বালার টোল গেটে বিশাল জ্যাম এবং দিল্লি ঢোকার মুখে আরও বিশাল জ্যামে পড়ে বেড়ানোর আনন্দটাই মাটি হয়ে গেছিল। চার তারিখ বাড়ি ফিরেছিলাম রাত দশটায়, সকাল সাতটায় ম্যাকলিওডগঞ্জ থেকে স্টার্ট করে। মানে, মাত্র পাঁচশো কিলোমিটার চলতে সময় লেগেছে পনেরো ঘণ্টা! মানে অ্যাভারেজ স্পিড সাড়ে তেত্তিরিশ কিলোমিটার ঘণ্টাপ্রতি? কিন্তু এত আস্তে তো আমি চালাই নি! শুধু জ্যামে এমন টাইম খেয়ে নিল? এভাবে চললে তো কলকাতার জার্নি দুদিনে করা চাপ হয়ে দাঁড়াবে!

    এদিকে গাড়িও খুব একটা ভালো চলছে বলে মনে হচ্ছিল না। কীরকম যেন একটা ফাঁপা আওয়াজ আসছে বনেটের নিচ থেকে গিয়ার পাল্টাবার সময়ে, ওদিকে গাড়ির স্পিড একশোর কাছাকাছি নিয়ে গেলেই সারা গাড়ি কীরকম থরথর করে ভাইব্রেট করছে, আশিতে নর্মাল চলছে। রাস্তা স্মুথ, এত ভাইব্রেট করার তো কথা নয়! নভেম্বরে গাড়ি নিয়ে সত্যিই বেরোতে গেলে একটা প্রপার সার্ভিসিং করানো দরকার তা হলে।

    আমার গাড়িটি ওয়্যাগনআর। ২০০৬এর মডেল। খুব বেশি চালানো হয় না, তাই ন বছরে উনত্রিশ হাজার কিলোমিটারের বেশি চলে ওঠে নি। শহরের রাস্তায় একশো কিলোমিটারের স্পিড ওঠে না – তাই কখনও খেয়াল করি নি এর আগে, কিন্তু এইবারে চালাতে গিয়ে মনে হল অল ইজ নট ওয়েল।

    কিন্তু সিকিনী কি যাবে? ভূতো কি যাবে? আমি একা গেলে তো বাইক নিয়েই বেরিয়ে যাবো, সেক্ষেত্রে গাড়ির সার্ভিসিং-এর এক্ষুনি কোনও দরকার নেই, বরং বাইকের জন্য আমাকে কিছু খরচা করতে হবে। সার্ভিসিং, নী গার্ড, ট্যাঙ্ক ব্যাগ উইথ জিপিএস ভিউয়ার। গাড়ি, না বাইক? কী নাচছে আমার কপালে? বাইক, না গাড়ি?

    দুর্গাপুজো মিটল। সোসাইটিতে পুজো হয়, আমার ওপর এইবারে পড়েছিল কালচারালের ভার। চারদিন ধরে অমানুষিক খেটে আমার গলায় হল ইনফেকশন, গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোয় না, তবু সেই গলা নিয়েই খানিক কুঁই কুঁই করে একদিন রাতে সিকিনীর কাছে কথা পাড়লাম।

    – ছুটি অ্যাপ্লাই করেছিস?
    – আরে ধুর, ও হবে না, বাদ দে। এমনিও ছুটি পাবো না, আর এক এক দিনে সাতশো আটশো কিলোমিটার যাওয়া জাস্ট ইমপসিবল ব্যাপার। দেখলি তো, ম্যাকলিওডগঞ্জ যেতেই কেমন পুরো দিন লেগে গেল?
    – কিন্তু, সে তো একে পাহাড়ি রাস্তা, তায় জ্যাম ছিল। যাক গে, যাবি কি যাবি না বল।
    – না, আমার আর যাবার মন নেই। বডডো হেকটিক হয়। কী যে তোর ভালো লাগে সকাল থেকে রাত্তির অবধি ড্রাইভিং করতে –
    – তা হলে ভূতো …?
    – আমি না গেলে ও যাবে কী করে? তুই ওকে সামলাতে পারবি না। গাড়ি চালাবি না সামলাবি? যদি শরীর খারাপ হয়?
    – যদি সামলে নিই?
    – তা হলে ওকে জিজ্ঞেস কর।

    ভূতোকে জিজ্ঞেস করা গেল। মা না-ও যেতে পারে শুনে খানিক দমে গেল, কিন্তু মেয়েটি বড় সহানুভূতিশীল। বাবার মনেও কষ্ট দেওয়া হবে, বোধ হয় এমন কথা চিন্তা করেই, সে বলল, কোনও ব্যাপার না, আমি বাবার সাথে চলে যেতে পারব।

    কিন্তু, মেয়ে মানে, তো মা মানে না। অতএব, আমার আবার চিন্তা শুরু হল। বাইক, না গাড়ি? গাড়ি, না বাইক? দুটোরই প্রো এবং কন আছে।

    বাইক মাইলেজ দেয় চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ কিলোমিটার প্রতি লিটারে। গাড়ি সেখানে দেয় – আঠেরো থেকে কুড়ি। জাস্ট অর্ধেক।
    যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়া আর কোনও টোলে বাইককে পয়সা দিতে হয় না। গাড়িতে সমস্ত টোলে পয়সা লাগে। দিল্লি থেকে কলকাতা টোটাল টোল পড়ে সতেরোশো টাকা, শুধু যেতে। এর পরে পেট্রল ভরার খরচ ইত্যাদি।
    একা গেলে সিকিনী আর ভূতোর ফেরার টিকিট ক্যানসেল করতে হবে। হাতে আরও নীট চার হাজার টাকা ফেরত আসবে। তাই দিয়ে অবশ্য গাড়ির টোলের খরচ উঠে যাবে।

    তা হলে? গাড়ি, না বাইক? হাতে আর মাত্র দুটো শনিবার আছে। সার্ভিসিং বলো, অ্যাকসেসরিজ কেনা বলো – সবই করতে হবে এর মধ্যে।

    মুশকিল আসান করল রাণা। রাণা আলম, আমার ফেসবুক বন্ধু, মেসেজ করে জানালো – বিয়ে করছে ৭ই নভেম্বর। ৮ তারিখ আমি কি বহরমপুরে আসতে পারব?

    কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের ডাকে পাহাড় ডিঙিয়েও যাওয়া যায়, বহরমপুর তো খুব কাছের ব্যাপার। তড়িঘড়ি রাণাকে ফোন করলাম। বললাম, এই ব্যাপার – আমি ৮ তারিখ রাতে বাড়ি পৌঁছচ্ছি। বিয়ের অনুষ্ঠানে তো আমি হাজির থাকতে পারব না, কিন্তু আমি ৯ তারিখ সক্কাল সক্কাল বহরমপুর গিয়ে তোমাদের সাথে দেখা করে আসব।

    বাইকে/গাড়িতে আমি দিল্লি থেকে আসছি – মূলত এইটুকু শুনেই ফোনের মধ্যে রাণা তিন চারবার খাবি খেয়ে ফেলল। তার পরে বলল, শোনো, এত চাপ নিতে হবে না, তুমি পারলে এসো, না পারলেও আমি কিচ্ছু মনে করব না, তুমি যে আসতে চেয়েছো, এতেই আমি যারপরনাই মুগ্ধ। শুধু আমার জন্য এক্সট্রা চাপ নিতে হবে না।

    খোকাকে বোঝানো মুশকিল যে রাইডিং বা ড্রাইভিং আমার কাছে “চাপ” নয়, বরং রিফ্রেশিং। কিন্তু আমি তখন দিশা পেয়ে গেছি, উত্তর পেয়ে গেছি আমার প্রশ্নের। বাড়ি যাবার তা হলে এখন একটা নয়, একাধিক কারণ হল। কালীপুজো, ভাইফোঁটা, পারলে গুরুর বন্ধুদের সাথে কলকাতায় একটা ভাট সাথে খ্যাঁটন, এবং, রাণার সাথে দেখা হওয়া, মিসেস রাণার সাথে আলাপ করা। আর, বিয়ে উপলক্ষ্যে যাওয়া, খালি হাতে কি যাওয়া যায়? একটা তো উপহার কিনে নিয়ে যেতে হয়। আর উপহার সমেত লাগেজ নিয়ে বাইকে যাওয়া একেবারেই পসিবল নয়। সুতরাং, আইদার দিস অর দ্যাট, আমি গাড়িতেই যাচ্ছি।

    পরদিন সক্কাল সক্কাল গাড়িটা সার্ভিসিং-এ দিতে গেলাম, আর সিকিনী-ভূতোকে জানিয়ে গেলাম, এইবারে তোদের কাছে দেড় সপ্তাহ সময়, আরাম সে ঠিক কর। আমি কোনও চাপ দেব না। তোরা যাস বা না যাস, গাড়ি যাবে, আমি যাবো। বারাণসীতে হোটেল বুক করা আছে যাওয়া এবং আসার, তোদের ফেরার টিকিট বুক করা আছে রাজধানী এক্সপ্রেসে। সমস্ত অপশন দিয়ে দিলাম, নাউ কল ইজ ইওর্স।

    সিকিনী বোধ হয় এতটার জন্য তৈরি ছিল না। বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল, সত্যি যাবি? পারবি এতটা যেতে? শিওর তো? আমি তা হলে ছুটির জন্য কথা বলব।

    সিকিনীর গালটা আলতো করে টিপে দিলাম আমি, ভরসা করে দ্যাখ, ঠকবি না। আমি পালটে গেছি সেটা তুই জানিস, কিন্তু কতটা পাল্টেছি, সেটা দেখবার এই সুযোগ। দ্যাখ – অফিসে কথা বলে।

    মারুতির সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে গাড়ির সমস্যাগুলোর কথা বললাম। সার্ভিস ইঞ্জিনীয়ার আমাকে নিয়ে টেস্ট ড্রাইভ করে খুব চিন্তিত মুখে গাড়িটাকে ওয়ার্কশপে নিয়ে গেল। ওয়ার্কশপে যে রকমের চ্যানেল থাকে, নিচটা ফাঁকা, দুদিকের সাপোর্টে চাকা প্লেস করে গাড়ির নিচে চলে যাওয়া যায়, সেইখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড় করিয়ে নিচে গেল ইঞ্জিনীয়ার। সেইখান থেকে আমাকে ইশারা করে ডাকল নিচে।

    নিচে গিয়ে যা দেখলাম, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। জং লেগে বনেটের নিচে পুরো লোহার ফ্রেম গলে অর্ধেক হয়ে গেছে। হাত দিলে ঝুরঝুর করে জং পড়ছে। ওর ওপরেই চাপানো আছে ইঞ্জিন সমেত সমস্ত কলকব্জা। যে কোনও মুহূর্তে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত ওই লোহার বিম ভেঙে গেলে, আর সেই অবস্থায় আমি পাহাড়ের ভাঙাচোরা রাস্তায় চালিয়ে এনেছি এই গাড়ি!

    ইঞ্জিনীয়ারকে বললাম, পুরো বিম চেঞ্জ করান। আর, পরের পরের সপ্তাহে আমি এই গাড়ি নিয়ে বাই রোড কলকাতা যাবো, সমস্ত দিক দিয়ে একদম ফিট করিয়ে দিন গাড়িটাকে।

    লোকটা বরাভয় দেখিয়ে বলল, চিন্তা করবেন না, একদম ফিট বানিয়ে দেব, তবে চারদিন মত রাখতে হবে গাড়িটা। আমরা সবকিছু টেস্ট করে তারপরে ছাড়ব।

    আমি বললাম, এক সপ্তাহ রাখুন, চাপ নেই।

    পাঁচ দিনের মাথায় গাড়ি ফেরত পেলাম গুণে গুণে আট হাজার টাকা দিয়ে। আবার আমাকে নিয়ে গাড়ির তলায় গিয়ে সমস্ত দেখাল, আর বলল, হাইস্পিডে গাড়ি ভাইব্রেট করছিল এই কারণেই, সাপোর্ট লুজ হয়ে গেছিল। এইবারে যত খুশি স্পিড তুলুন, গাড়ি আর কাঁপবে না।

    পাঁচ তারিখে, জার্নি শুরু হবার ঠিক দুদিন আগে, সিকিনী জানাল – তার ছুটি কনফার্ম হয়েছে। বস অনেক কথা শুনিয়েছে, কিন্তু লোকটা ভালো, ছুটি ক্যানসেল করে দেয় নি।

    আমার ছুটি সেই জুলাই মাস থেকেই অ্যাপ্রুভ করানো ছিল, এইবারে আমি আর আগের বারের মত রিস্ক নিই নি। অতএব, সন্ধ্যেবেলায় সিকিনী আর ভূতোকে নিয়ে বসলাম প্ল্যান ফাইনাল করতে। মূলত – ওদের মানসিকভাবে জার্নির জন্য তৈরি করতে। বেসিকগুলো জেনে রাখা দরকার।

    আমাদের জার্নি হবে দুটো ভাগে। একসাথে যে হেতু দেড় হাজার কিলোমিটার যাওয়া সম্ভব নয়, (অসম্ভবও নয়, ননস্টপ কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছে এমন লোককেও আমি চিনি – কিন্তু আমি সে পথে হাঁটছি না) তাই প্রথম দিনে আমরা যাব আটশো কিলোমিটার, বেনারস। রাস্তা ভালো, কিন্তু যতই ভালো হোক – দূরত্বটা যেহেতু বিশাল, তাই আমাদের বেরোতে হবে সকাল সকাল। ভোড় চারটেয় টার্গেট রাখব, সাড়ে চারটের বেশি দেরি করব না স্টার্ট করতে।

    প্রথম ক্রুশিয়াল পার্টটা হচ্ছে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে। যেটা আমরা জানি, দুশো কিলোমিটার সুপারস্মুথ। যদি দু থেকে আড়াই ঘণ্টায় ওই দুশো কিলোমিটার পেরিয়ে আসতে পারি, তা হলে পরের ছশো কিলোমিটারের জন্য চাপ কম থাকবে।

    ফলে, আমাদের কম স্টপ নিতে হবে। খুব দরকার ছাড়া থামব না। চিড়েভাজা করে নাও, ডিমসেদ্ধ করে নাও, দরকার হলে ফ্লাস্কে গরম চা নিয়ে চলো, রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করাব, গাড়িতে বসেই ব্রেকফাস্ট করব, তার পরে আবার দৌড়। লাঞ্চ, টয়লেট আর পেট্রল ভরা – এই তিনটে কারণ ছাড়া আমরা থামব না। নিতান্ত যদি না কারুর শরীর খারাপ করে।

    ওয়্যাগন আরের ট্যাঙ্ক ক্যাপাসিটি পঁয়ত্রিশ লিটার। মাইলেজের হিসেবে ফুল ট্যাঙ্কে খুব বেশি হলে পাঁচশো কিলোমিটার যাওয়া যেতে পারে। মানে, মাঝে একবার দাঁড়াতেই হবে তেল ভরার জন্য।

    পরের দিনের জন্য রইল বাকি সাতশো কিলোমিটার। না, ঠিক সাতশো নয়, সাড়ে ছশো, কারণ আমরা কলকাতা যাবো না, যাবো ব্যান্ডেল, যেটা কলকাতা থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার আগে পড়বে। আবার সক্কাল সক্কাল, বেশি নয়, সকাল ছটা নাগাদ স্টার্ট করতে পারলে বেলা দশটা নাগাদ বিহার, একটা নাগাদ ঝাড়খণ্ড ক্রস করতে পারব। ঝাড়খণ্ড পেরোলেই পশ্চিমবঙ্গ। সাড়ে তিনটের সময়ে শক্তিগড়ে পৌঁছে আমরা লেট লাঞ্চ করব। কচুরি ছোলার ডাল আর ল্যাংচা। ব্যাস, তার পরে বাড়ি পৌঁছতে আর এক থেকে দেড় ঘন্টা খুব বেশি হলে। সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে রেস্ট নিতে পারব।

    আমার নিজেরও তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছনোর প্ল্যান ছিল, কারণ পরদিন বহরমপুর যেতে হবে, রাণার বাড়ি। একটা ট্রেন আছে ভোর সাড়ে চারটেয় নৈহাটি থেকে, সকাল সাড়ে আটটায় বহরমপুর পৌঁছয়। সেটা ধরতে হবে। মানে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে ভোর সাড়ে তিনটেয়। তিনটে পঞ্চান্নতে গৌড় কিংবা চারটে দশের ব্যান্ডেল নৈহাটি লোকাল ধরে নৈহাটি স্টেশন, তার পরে লালগোলা প্যাসেঞ্জার। ওটা না পারলে নৈহাটি থেকে পরের ট্রেন আটটা পঞ্চাশে, সেটা বহরমপুর ঢুকবে বারোটা চল্লিশে।

    দেখি, কখন পৌঁছনো যায় – সিকিনীকে বললাম, আমরা সব্বাই শুক্রবার তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ব, কারণ ভোর চারটেয় বেরোতে গেলে তিনটেয় উঠতে হবে। এখন হাল্কা ঠাণ্ডা পড়ে গেছে, সকালে চান করার চাপ না নিয়ে বেনারসে সন্ধ্যেবেলায় পৌঁছে চান করা যেতে পারে। গোছগাছ এখন থেকেই সেরে রাখতে হবে।

    দিল্লি-কলকাতা রোড ট্রিপের নেশা এইবারে এদের মধ্যে হাল্কা করে লেগে গেছে – দুজনেই রাজি হয়ে গেল।

    অল্‌ সেট।
    পর্ব দুই
    ---------

    যাকেই বলছি, প্রত্যেকে বলছে, আপনার হাজব্যান্ড কি পাগল? এত অপশন থাকতে কেউ গাড়ি চালিয়ে কলকাতা যায়? খরচা তো অনেক বেশি পড়বে!

    যাকেই বলছি, প্রত্যেকে জিজ্ঞেস করছে – আপনি বারাণসীতে গিয়ে কাশী বিশ্বনাথকে দর্শন করবেন না? এমনি এমনি গিয়ে বেরিয়ে যাবেন?

    যাকেই বলছি, প্রত্যেকে জিজ্ঞেস করছে …

    এখন আর ঘাবড়াই না। আগে খুউব সন্দেহ হত। সবাই কি সুস্থ মানসিকতার? আমি একাই কি পাগল? যাকেই শোনানো হচ্ছে – সবাইই এই রকম বলছে? কই, আমিও তো কিছু কিছু লোকের সাথে আমার প্ল্যান শেয়ার করি, আমাকে তো কেউ এ রকম করে বলে নি! তা হলে এই “যাকেই”-এর স্যাম্পল সাইজ কত? অ্যাকচুয়েলি, কারা এই “যাকেই”?

    ওপরের কথাগুলো সিকিনীর বয়ানে শোনা। এ রকম অনেক বার “যাকেই বলছি” সিরিজ আমি অজস্রবার শুনেছি গত তেরো বছরের বিবাহিত জীবনে। আমার কোনও প্ল্যান, আমার কোনও সিদ্ধান্ত সিকিনীর মনঃপুত না হলে সিকিনী এই অস্ত্রটা প্রয়োগ করে। মানে আমার সিদ্ধান্তটা ভুল – সেটা একমাত্র সিকিনীরই মনে হচ্ছে না, ওর মতন “যাকেই”-এর দলও ভুল মনে করছে, এর অনুসিদ্ধান্ত – আমার সিদ্ধান্ত পালটানো উচিত। আসলে হয় তো খুব বেশি হলে একজন বলেছে, তাও হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে গিয়ে, সেইটা বাড়ি এসে আমার কাছে ব্যাখ্যান করার সময়ে একটু বিরিয়ানি হয়ে যায় আর কি। মানে ধরুন, কেউ যদি অফিসে বসে তার কলিগকে বলে, “আমার হাজব্যান্ডটা কী পাগলা দেখুন, বলে কিনা গাড়ি চালিয়ে দিল্লি থেকে কলকাতা যাবে। কী পাগলামি, না?” – তখন উল্টোদিকের কলিগ কি কখনওই বলবে, না না, আপনার হাজব্যান্ড খুবই সুস্থ, একটু অ্যাডভেঞ্চারাস আর কি …? সে জাস্ট কথা শেষ করার তাগিদে বলবে “বটেই তো, বটেই তো, কী পাগলামি!”

    সিকিনীর কেসটাও সে রকম। ডিসকারেজিত হবার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমি এ রকম “যাকেই বলছি” শুনেছি এবং শুনে থাকি। এই “যাকেই”-রা কখনও আমার প্রতিবেশিরা হন, কখনও তার অফিস কলিগরা হন, কখনও তার আত্মীয়স্বজনরা হন। তো, আমি এখন এই বক্তব্যসমূহে একেবারে ডিমোটিভেটেড হই না। আগে খুব রেগে যেতাম, জিজ্ঞেস করতাম, কে কে বলেছে এমন কথা, আমাকে নাম বল, কিংবা ওদের আমার ফোন নম্বর দিয়ে একবার বল সরাসরি আমাকে ফোন করে কথা বলতে, বা আমার সামনে এসে একবার বলতে বল। ধীরে ধীরে বুঝেছি, ইহা নিতান্তই সিকিনীর আপন মনের মাধুরী। “যাকেই বলছি”-রা আসলে কোথাও থাকে না।

    আবার থাকেও। সে গল্পে পরে আসছি।

    শুক্রবার আমি আপিস যাই না – বাড়িতে বসে ল্যাদ খাই। ইংরেজিতে বলে ওয়ার্ক ফ্রম হোম – কিন্তু আমার অফিসে কোনও কাজ নেই, আমি ঘরে কিংবা অফিসে জাস্ট বসে থাকার জন্য মাইনে পাই। তো শুক্রবার ছিল ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার ছিল, কিন্তু সেইদিন সিকিনী অফিস থেকে ফিরলই রাত পৌনে নটায়। কাজ সেরে জ্যাম ঠেলে আসতে দেরি। এর পর শেষ মুহূর্তের গোছগাছ, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি সেরে ঘুমোতে যেতে সেই সাড়ে এগারোটাই বাজল। তিনটেয় ওঠা খুবই চাপ, আমি তাই সাড়ে তিনটেয় অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমোতে গেলাম। যদিও ঘুম আসতে আসতে ক্যালেণ্ডারে তারিখ পালটে গেছিল।

    বেরোবার সময়ে আমার উঠতে একটুও দেরি হয় না, যদিও এমনিতে আমি একেবারেই আর্লি রাইজার নই। সাড়ে তিনটেয় উঠে হাল্কা করে চিড়ে-বাদাম ভাজা হল, এক রাউন্ড চা হল। ওরা যতক্ষণে রেডি হচ্ছে, ততক্ষণে আমি নিচে গিয়ে গাড়িতে কিছু লাগেজ রেখে এসেছি। আগের দিন ট্যাঙ্ক ফুল করে রাখা আছে। সাড়ে চারশো কিলোমিটার এমনিতেই চলে যাবে – মাঝে একবার আবার ভরতে হবে।

    ঠিক পাঁচটায় আমাদের গাড়ি স্টার্ট করল। ভূতো তো পেছনের সীটে বসেই কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সিকিনী সামনের সীটে। ওডোমিটারের রিডিং নিলাম – ২৯৫০৬ কিলোমিটার। আনন্দ বিহার – গাজীপুর – নয়ডা মোড় – ময়ূর বিহার – নয়ডা ফিল্ম সিটি ছাড়িয়ে গাড়ি এক্সপ্রেসওয়েতে পড়ল ঠিক পাঁচটা পঁচিশে। তখনও আকাশ অন্ধকার। দিল্লিতে এমনিতেই সকাল দেরিতে হয়, তার ওপর এখন তো শীতের শুরু। ভিজিবিলিটি চমৎকার।

    এক্সপ্রেসওয়ে একেবারে ফাঁকা। স্পিড বাড়িয়ে দিলাম, কিন্তু কাঁটা একশো ছুঁতেই গাড়ি আবার কেমন থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি স্পিড নামিয়ে নিলাম নব্বইতে। গাড়ি এবার স্টেডি। কেন এমন হল? বনেটের ফ্রেম বিম সমস্ত নতুন লাগানো হয়েছে, আমি নিজে দেখে নিয়েছি, তাও গাড়ি কেন কাঁপছে? এমনিতেও আমি একশোর ওপর উঠতাম না, বেরোবার আগে নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছি, যত খালি রাস্তাই হোক, গাড়ি একশোর ওপর চালাবো না, কিন্তু এই এক্সপ্রেসওয়েতেও যদি একশোর নিচে চালাতে হয়, তা হলে তো টাইম মেনটেন করা চাপ হয়ে যাবে। … তা হলে কি চাকার অ্যালাইনমেন্টে গড়বড় আছে? একমাত্র ওটাই আমি চেক করি নি। তাই হবে হয় তো।

    নব্বইয়ের স্পিডে চলতে চলতে একসময়ে পূবদিক লাল করে সূর্য উঠল।



    আর তখনই দেখতে পেলাম সামনের সাইনবোর্ডে লেখা – কলকাতা ১২৮৬ কিলোমিটার। আগ্রা আর মাত্র ৫০ – মানে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার মেরে দিয়েছি।



    একটু পরেই এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হল, ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে সাতটা। অ্যাজ এক্সপেক্টেড, আড়াই ঘন্টায় দুশো কিলোমিটার টেনে দিয়েছি। নট ব্যাড। গাড়ি সাইড করে হাল্কা ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। ডিমসেদ্ধ, চিড়েভাজা, বিস্কিট। তার পরে আবার জার্নি শুরু।

    এর পরে ফিরোজাবাদ, টুন্ডলা ইত্যাদি ছোটখাটো জায়গা পেরিয়ে ইটাওয়া। আগ্রা থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার। রাস্তা আর ততটা ভালো নয়, জায়গায় জায়গায় রাস্তার ওপরেই লোকালয়, বাজার বসছে, একটা দুটো ম্যানুয়াল ক্রসিং, তবু দেড় ঘণ্টার মধ্যেই ইটাওয়া পৌঁছে গেলাম। একটা মাঝারি সাইজের ফ্লাইওভার খানিকটা মুক্তি দিল শহরের জ্যাম থেকে, ফ্লাইওভারের ওপর থেকে দুদিকে দেখে বুঝলাম কেন এটাকে ইটাওয়া বলে।

    চারদিকে ইঁটের বাড়ি, আর একটা বাড়িরও বাইরে প্লাস্টার করা নেই। লাল লাল ইঁট দুধারে সর্বত্র দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বিরাজমান। দোতলা, তিনতলা, চারতলা – সব ইঁট বের করা বাড়ি। কুৎসিত একটি উত্তরপ্রদেশীয় টাউন। কিন্তু রাস্তা লা-জবাব। মাঝে দু একটা খারাপ প্যাচ আছে বটে, কিন্তু ওভারঅল স্মুথ রাস্তা, কংক্রিট, কিংবা অ্যাসফল্ট। রাস্তার দুধারে এই অসময়েও দুলছে প্রায় শুকিয়ে আসা একতলা বাড়ি-সমান উঁচু কাশের বন। তারই মাঝে চোখে নীল গগোলস লাগিয়ে, ফাটিয়ে একটি পোজ দিয়ে দিলাম গাড়ির সাথে।



    দেখতে দেখতে কানপুর এসে গেল, প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে।

    একটা সময়ে কানপুর পেরনো খুব ঝক্কির ব্যাপার ছিল। খুব ঘনবসতিপূর্ণ শহর। কিন্তু এখন সমস্ত কানপুর শহরের ওপর দিয়ে চলে গেছে একটি ইয়া লম্বা ফ্লাইওভার। প্রায় ৩০ কিলোমিটার লম্বা একটা এলিভেটেড রোড। এখন কানপুর সিটি পেরোতে সময় লাগে ঠিক পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট। এটা এখন এশিয়ার অন্যতম বড় ফ্লাইওভার।

    অনেক ট্র্যাভেলগ পড়ে এসেছি, জানাই ছিল যে আগ্রা পেরিয়ে বাকি উত্তর প্রদেশের ওপর দিয়ে যাবার সময়ে খুব সাবধানে যেতে হয়, কারণ অজস্র গ্রাম পড়ে রাস্তার দুধারে, এবং গ্রামের লোকেদের মাঝখানে ডিভাইডার লাগানো বোথ সাইড ক্যারেজওয়ে সম্বন্ধে প্রায় কোনও ধারণাই নেই। যে কোনও সময়ে দেখা যাবে উল্টোদিক থেকে আসছে একটা ট্রাক, কিংবা ট্রাকটর, কিংবা মোটরসাইকেল। হেডলাইট না জ্বালিয়ে, হেলমেট না পরে, প্রায়শই একটা মোটরসাইকেলে পাঁচজন সওয়ারি চেপে – এবং রাস্তার কর্নার ধরে আসারও কোনও গল্প নেই, কেউ কর্নার ধরে আসছে, কেউ মাঝের লেন ধরেই উল্টোদিক থেকে আসছে, যে যেমন পারে আর কি। উত্তরপ্রদেশ আফটার অল। নিজেকেই সাবধান হয়ে চালাতে হবে।

    গাড়িতে চলছে বর্ন ফ্রি, ই.টি., টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দা সী। ভূতো একবার ঘুম থেকে উঠে দুটো সিনেমা পরপর দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আর সিকিনী বসে বসে গপ্পো করে যাচ্ছি। আমি চালাচ্ছি, সিকিনী টুকটাক ফটো তোলার চেষ্টা করছে।





    কানপুর পেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে একটা ধাবায় থামলাম লাঞ্চ করার জন্য। লোকটি ভরদুকুরেই কিঞ্চিত চড়িয়ে ছিল মনে হল, প্রয়োজনের বেশি কথা বলে যাচ্ছিল। মেনু ফেনু কিছু নেই, এই আছে, ওই আছে – খানিক খাওয়াদাওয়া করলাম, খুব একটা খাদ্যযোগ্য ছিল না সে-সব, লোকটা কী জানি কীসের পুলকে, কলে পাইপ লাগিয়ে আমাদের গাড়িটাকে বেশ ভালো করে ধুইয়ে দিল।

    শুরু করলাম প্রায় পৌনে তিনটের সময় আবার। নিজেদের খাওয়া হয়েছে, এইবারে গাড়ির ফুয়েল মিটার বলছে গাড়িরও খাবার সময় হয়েছে। খানিক বাদে ঢুকলাম একটা ভদ্রগোছের পেট্রল পাম্পে, ট্যাঙ্ক ফুল করে নিলাম, নিজেরাও অল্পস্বল্প হাল্কা হয়ে নিলাম। পরের জংশন হচ্ছে এলাহাবাদ। এখানেও একটি আশি কিলোমিটার লম্বা বাইপাস আমাদের সযত্নে মূল এলাহাবাদ শহরের পাশ কাটিয়ে নিয়ে যাবে – অবশ্য তার জন্যে একটা বড় অঙ্কের টোল দিতে হবে। তা সে টোল তো দিয়েই আসছি, কত জায়গায় যে থামতে হল টোল দেবার জন্য।

    বড় বড় ট্রাক চলেছে, পিঠে গণ্ডাখানেক ট্রাক্টর বেঁধে।




    এলাহাবাদ বাইপাস পেরোতেই ঝুপ করে সুর্য ডুবে গেল, আর অন্ধকার নেমে এল হাল্কা করে।



    জিপিএস সেট করাই ছিল। বারাণসীর কাছে এসে কোন ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আমাদের বাঁদিকে টার্ন নিতে হবে, সেটা জানার জন্য আমাদের কাউকেই জিজ্ঞেস করতে হল না। আর সেইখানেই হল বিপত্তি। গুগুল ম্যাপ হাইওয়েগুলো যত সহজে লোকেট করে দেয়, শহরের মধ্যে রাস্তাঘাট ডেস্টিনেশন তত সহজে লোকেট করতে পারে না। ম্যাপ সবসময়ে শর্টেস্ট রুট খোঁজার চেষ্টা করে, সেটা গাড়ি চলবার উপযুক্ত হোক বা না হোক। সেই একবার সারিস্কা যেতে গিয়ে এই বিপত্তি হয়েছিল, গাড়ি নিয়ে একেবারে কার যেন গোয়ালে ঢুকে পড়েছিলাম। এইবারে হল বারাণসীতে। একে তো এমন অদ্ভূত একটি শহর, এখানে বড়রাস্তার চেয়ে গলির সংখ্যা বেশি। তার ওপর কোথাও কোনও স্ট্রিটলাইট নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত, সন্ধ্যে নামার পরে বুঝতে পেরেছি, ওয়ার্কশপ থেকে ফিরে আসার পরে গাড়ির বাঁ দিকের হেডলাইটটা আর কাজ করছে না। ডিপার দুটোই জ্বলছে, কিন্তু মেন বীম বাঁদিকেরটা বন্ধ। একটা হেডলাইটের ভরসায় চলা খুবই কষ্টকর, তাই ডীপার অন করে চলতে থাকলাম, এবং খানিক বাদেই আবিষ্কার করলাম, আমি একটা তুমুল সরু গলির মধ্যে চালাচ্ছি, সামনে কয়েকটা গরুর গাড়ি আর ট্রাক্টর, উল্টোদিক থেকে সাঁইসাঁই করে ছুটে আসছে মোটরসাইকেল আর মারুতি অল্টো বা এইট হান্ড্রেড।

    একটা লেভেল ক্রশিং পড়ল। আমি এইবারে আর জিপিএসে ভরসা না করে লোককে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, হ্যাঁ দাদা, বারাণসী ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনটা কোনদিকে পড়বে? আমাদের বুকিং আছে রাহী ট্যুরিস্ট বাংলোতে – ইউপি ট্যুরিজমের বাংলো, তার ল্যান্ডমার্ক হচ্ছে, ঠিক বারাণসী ক্যান্ট স্টেশনের সামনের গলিতে।

    লোকটি খুব চিন্তা করে বলল, আপনারা তো ভুল রাস্তায় এসেছেন, এখান থেকে গাড়ি ব্যাকও করতে পারবেন না, বরং এগিয়ে যান এই পাঁচিল বরাবর, ডানদিকে মুড়ে যান, আর্মি ক্যান্টনমেন্ট পড়বে, ওখান থেকে একটু এগোলেই ক্যান্ট স্টেশন।

    জয় গুগুল বলে এগোলাম, পাঁচিল বরাবর এগিয়ে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টেও পৌঁছলাম, তারপরে আরও দুবার এদিক ওদিক গোঁত্তা খেয়ে ঠিক স্টেশনের কাছে এসে পৌঁছলাম। পাঁচিলের ওইপারেই রেললাইন। ট্রেন আসছে, সিটি দিচ্ছে। কিন্তু হোটেল কই? শুনেছিলাম যে মেন রোডের ওপর লাইন দিয়ে হোটেল আছে? এ তো ফাঁকা একটা সরু রাস্তা!

    এইবার একটা রিক্সাওলাকে ধরলাম। সে বলল, আপনারা ক্যান্ট স্টেশনে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু এটা হল স্টেশনের পেছনের দিক। হোটেল আছে সামনের দিকে। আপনারা এইখান দিয়েই ফিরে যান, “সিধা” গিয়ে চৌকা-ঘাট পড়বে। সেখান থেকে ডানদিকে ঘুরলেই স্টেশনের সামনে পৌঁছে যাবেন।

    ট্র্যাভেলগে পড়েছিলাম বারাণসীর লোকেদের “সিধা জাইয়ে”-র গল্পটা। রাস্তা হয় তো এঁকেবেঁকে গেছে ডানদিকে, তারপরে বাঁদিকে। কিন্তু যতক্ষণ না রাস্তায় কোনও ব্র্যাঞ্চিং নেই, ততক্ষণ পর্যন্ত বারাণসীর ভাষায় আপনাকে “সিধা” যেতে হবে।

    আবার দুবার গোঁত্তা খেলাম। এক জায়গায় দেখি ওয়ান ওয়ে, এবং আমরা এসেছি উল্টোদিক থেকে। এগনো সম্ভব নয়। আবার একটা দোকানে জিজ্ঞেস করলাম, এবং সেই একই ডিরেকশন পেলাম, ব্যাক করে এই রাস্তায় সিধে যান চৌকা-ঘাট, তার পরে ফ্লাইওভারের তলা দিয়ে ডানদিকে।

    জিপিএস অফ করে দিলাম। গাড়ি ঘুরিয়ে একটু একটু করে এগোই আর লোককে জিজ্ঞেস করি। খানিক বাদে একটা প্রচণ্ড জমজমাট মোড়ে এসে পৌঁছলাম, আর পৌঁছেই মনে হল পুউরো পৌরাণিক যুগে পৌঁছে গেছি। মোড়ের ডানদিকে পেল্লায় প্যান্ডেল, তারস্বরে “জয় গঙ্গে মাতা” বাজছে, তারপরে তড়িঘড়ি সেটাকে বন্ধ করে একজন বাজখাঁই গলায় ঘোষণা করে উঠল, “হমারে মহারাজ জি আ গিয়ে হ্যাঁয়, বহোত দূর সে আয়ে হ্যাঁয়, আভি ও সিংহাসন মে আরোহণ কর রহে হ্যাঁয়। আভি হমারে পরম পূজনীয় মহারাজ জি-কা অভিষেক শুরু হোগা, ম্যায় বাকি মহারাজোঁ সে বিন্‌তি করতা হুঁ কি বো হমারে ইস অভিষেক প্রক্রিয়া মে পূর্ণ সহযোগ করেঁ। মহারাজ জি সিংহাসন মে আরোহিত হো চুকে হ্যাঁয়।

    কোন্‌ মহারাজের রাজ্যাভিষেক হচ্ছে রে ভাই? এ তো মোদী মহারাজের “ক্‌ষেত্র” বলে জানতাম। মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখার আগেই পুলিশ এসে পিপ্‌-পিপ্‌ করে বাঁশি বাজিয়ে আমাকে মোড় থেকে তাড়িয়ে দিল, নাকি আমার জন্য জ্যাম হচ্ছিল। হুঃ, গুল মারার জায়গা পায় নি। বারাণসীতে এমনি এমনিই জ্যাম লেগে থাকে, চব্বিশ ঘণ্টা, অষ্টপ্রহর।

    আবার এগোলাম। দু চারজনকে জিজ্ঞেস করে ঠিক পৌঁছে গেলাম এবারে। সাদা রঙের বারাণসী ক্যান্ট স্টেশন, তার ঠিক উল্টোদিকেই প্রতাপ হোটেল, আর তার পাশ দিয়ে ঢুকে গেছে গলি।

    সেই গলির ভেতর সারিসারি হোটেল, তার মাঝ দিয়ে আরেকটি গলি। সেই গলির শেষে একটি বিল্ডিং, সামনে লেখা টুরিস্ট বাংলো, উত্তরপ্রদেশ সরকার। অবিশ্যি গলি মানে, সরু রাস্তা। গাড়ি ঢোকা বেরনোর জায়গা আছে। ভেতরে পার্কিং-ও আছে।

    সাড়ে ছটায় বারাণসী শহরে ঢুকেছিলাম, হোটেলে ঢুকলাম পৌনে আটটায়।

    কত প্ল্যান ছিল, দশাশ্বমেধ ঘাট যাবো, রাবড়ি খাবো, প্যাঁড়া খাবো, কিসুই হল না।

    বেরোন হল। কিন্তু, রাবড়ি নয়, প্যাঁড়া নয়। সিকিকে প্রথম যেতে হল একটি পানের দোকানে। … কী ভাবছেন? খাইকে পান বনারস-ওয়ালা? নাঃ, সিকি পানাসক্ত নয় একেবারেই।

    তবে? শুনুন গপ্পো।

    হোটেলে ঢুকে রুম দেখে নিচে এসেছি গাড়ির কাছে, ডিকি থেকে সুটকেসটা বের করে ওপরে নিয়ে যেতে হবে। ডিকি খোলার পরেই হঠাৎ বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে একটা শক লাগার মত তীব্র ব্যথা, তারপরেই আঙুলটা হু-হু করে জ্বলতে লাগল। আঙুলের ওপরে একটা কালচে লাল বিন্দু, টোবা হয়ে ফুলে উঠেছে।

    হুল ফুটিয়েছে কিছুতে, অন্ধকারে ছিল। সাথে সাথে আঙুলের ওই জায়গাটা টিপতে থাকতাম। দু বিন্দু রক্তও বেরোল। সিকিনী বলল, রক্ত বেরোলে চিন্তার কিছু নেই, বিষ ভেতরে যায় নি। কিন্তু বিষ ভেতরে গেলে খানিকক্ষণের মধ্যেই জ্বর আসবে। যদিও খালি চোখে দেখে হুল টুল কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। এখন এর এক ও একমাত্র ওষুধ, চুন। আর বেনারসে শয়ে শয়ে পানের দোকান, এখানে চুনের অভাব? তাই ডান হাতে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল চেপে ধরে একটু এগোতেই একটা পানের দোকান পেয়ে গেলাম, অতঃপর ক্ষতস্থানে চুন লেপন এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা ঠাণ্ডা হয়ে ব্যথা মরে গেল।

    একটু ফ্রেশ হয়ে পৌনে নটা নাগাদ বেরোলাম। শুনেছি দশাশ্বমেধ ঘাট এখান থেকে খুব দূরে নয়, রিক্সায় তিরিশ টাকা নেয়। একবার তো দেখে আসি। আর কিছু না দেখলেও চলবে। বেশি দেরি হলে ওখানেই রাতের খাবার কিছু খেয়ে আসব।

    একটা ব্যাটারি রিক্সা নিলাম। পাগলের মত ট্র্যাফিক, সবাই তারস্বরে হর্ন বাজাচ্ছে আর ভিড়ের মধ্যেই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে। তার মধ্যেই কেমন ডজ করে এদিক ওদিক বেঁকিয়ে রিক্সাওলা আমাদের গোধূলিয়া মোড়ে পৌঁছে দিল। রাস্তা খুব একটা কম নয়, যা দেখলাম।

    কিন্তু এ তো রাস্তার মোড়, ঘাট কোথায়? রিক্সাওলা সামনে ব্যারিকেড লাগানো একটা গলির দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এইটাই দশাশ্বমেধ ঘাট যাবার রাস্তা, এর পরে আর গাড়ি যায় না, সামনেই হেঁটে চলে যান।

    রাত সোয়া নটা, কিন্তু কে বলবে রাত হয়েছে? থিকথিক করছে লোক। দুধারে সারি সারি দোকান, কাপড়জামা, বাসনকোসন, মিষ্টি-নমকিন। এমনি একটা দোকানে ঢুকে বললাম, প্যাঁড়া খাবো। সে আমাদের দুটো শালপাতার বাটিতে করে দুটো করে প্যাঁড়া দিল। মুখে দিয়েই থু-থু করে ফেলে দিতে হল। রামোঃ, কী বিচ্ছিরি টেস্ট। এই জিনিস লোকে খায় কী করে? মুখের টেস্ট ফেরাতে একটা করে সিঙারা খেলাম, সেটাও তেমনই বাজে খেতে।

    ধুত্তেরি বলে বেরোলাম, আর বেরোতেই দেখি রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িটায় ওপরে একটা বিশাল লাল রঙের রঙচটা সাইনবোর্ড, তাতে লেখা – ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী), দশাশ্বমেধ ঘাট।

    নিচের তলায় একজন ডক্টর বসুর হোমিওপ্যাথির দোকান, তার সামনে একটি ষাঁড় নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে শালপাতা চিবুচ্ছে, লোকে জাস্ট এপাশ ওপাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কতিপয় বিদেশিনী গলায় গাঁদাফুলের মালা ঝুলিয়ে হ্যাট-ম্যাট ইংরেজিতে গল্প করতে করতে বেরিয়ে গেলেন, ওদিক থেকে আওয়াজ এল – “অ্যাই বাবুউ, ফেরার সময়ে একটু রাবড়িটা দেখিস।” এদিকে পচা কলাপাতা-বেলপাতার স্তুপ, ওদিকে গোবরের গাদা, ওপরে সাদা হলুদ সোডিয়াম ল্যাম্প, তার মাঝে পত্‌পত্‌ করে উড়ছে বিভিন্ন সাধু-সন্ত-মহারাজদের “ভব্য সমাবেশ”এর ব্যানার, এইসব গা-ঘিনঘিনে ব্যাপার পেরিয়ে একটু এগোতেই দেখি সামনে দশাশ্বমেধ ঘাট।



    পোচ্চুর ছবি দেখেছি। কিন্তু সামনে থেকে দেখে এতটুকুও ইমপ্রেসিং লাগল না। রাত তখন সাড়ে নটা পেরিয়ে গেছে, লোক বিশেষ নেই, একটি মহিলা ঘাটের নিচের দিকের সিঁড়িতে চৌকি পেতে বসে তখনও পুজোর ডালি বেচছেন। কয়েকবার আমাদের অ্যাপ্রোচ করে হাল ছেড়ে দিলেন। প্রতি পুজোর টুকরিতে একটি করে জ্বলন্ত প্রদীপ। আমাদের সামনেই একজন পুজোর টুকরি কিনে গঙ্গা মাইয়ার আরতি করল, তারপরে জলে প্রদীপ ভাসিয়ে দিল।

    জলে সারি সারি নৌকো বাঁধা, তার কোনওটির গায়ে ভোডাফোন, কোনওটির গায়ে এয়ারটেল।




    সিঁড়ি দিয়ে উঠে উঁচু চাতালটায় এসে দাঁড়ালাম। দূরে সারি সারি আলো দেখা যাচ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ঐটা কাশী বিশ্বেশ্বরের ঘাট, দূরের ঐটা অসসি ঘাট। সর্বাঙ্গে ছাই মাখা একজন সাধুবাবা চান করতে নামল। পাশের চাতালে সারিসারি সেই মাদুরের ছাতা, এখন সবই খালি। দূরে কতিপয় বিদেশীর সাহচর্য্যে তিনজন সাধু গঞ্জিকা সেবন করছেন। সিঁড়ির ওপরে বাঁদিক ঘেঁষে বড় সাইনবোর্ডে লেখা – জল-পুলিশ। একটি পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞেস করে জানলাম, প্রতিদিন ভোর চারটের সময়ে বিশ্বনাথ শিবের প্রভাতী আরতি হয়। সাড়ে চারটে থেকে “দর্শন” শুরু হয়। সিকিনী বলল, আমাকে একজন অফিসে বলেছিল, দর্শন করার জন্য নাকি বিশাল লাইন পড়ে, কিন্তু সে এখানে কাকে চেনে – তাকে বললে ভিআইপি গেট দিয়ে তাড়াতাড়ি দর্শন করিয়ে দেবে। যাবি?

    কেন ভাই! আমার তো একেই এইসব ধর্ম মন্দির ভগবান ইত্যাদি আলবাল জিনিসে অ্যালার্জি আছে, তার ওপরে এইসব “ভেতর থেকে ব্যবস্থা” ইত্যাদিতে আমার আরও অ্যালার্জি আছে। ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে আমার দেখতে যাবার ইচ্ছে আছে ষোলআনা, কিন্তু “দর্শন” করার ইচ্ছে একফোঁটাও নেই। এখন সে-সব তো এদের “ভেতর থেকে ব্যবস্থা” করা লোককে বলে বোঝানো যাবে না। বারাণসীতে বসে নিজের বক্তব্য পেশ করতে গেলে আমি ক্যাল খেয়ে যেতে পারি। তার চেয়ে না যাওয়াই ভালো।

    মুখে বললাম, একটু তো ঘুমোতে দে আজ। সারাদিন ড্রাইভ করেছি আটশো কিলোমিটার। অত ভোরে উঠতে চাপ হয়ে যাবে। দেরি করলে আমাদের বেরোতে আরও দেরি হয়ে যাবে, শক্তিগড়ে পৌঁছে লেট লাঞ্চ করা যাবে না।

    সিকিনী বলল, ঠিক আছে, তা হলে কাটিয়ে দে। বেনারসে এসে কাশী বিশ্বনাথের মন্দির দেখব না – যাকেই বলেছি, সে-ই বলছে …

    ফিরে এলাম গোধূলিয়া মোড়ে। ঠিক মোড়েই একটি বাঙালি রেস্টুরেন্ট। ঠিক করলাম, সারাদিন লম্বা জার্নি করে এসেছি, কালও জার্নি আছে, সুস্থ থাকাটা জরুরি, অতএব, এক্সপেরিমেন্টে না গিয়ে বাঙালি খাবার খাও।

    তা খেলাম। চমৎকার ডাল ভাত বাঁধাকপির তরকারি মাছের ঝোল আর বেগুনভাজা দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়ে উঠলাম, শেষ করে বেরিয়ে পাশের দোকান থেকেই মাটির খুরিতে করে একশো গ্রাম করে রাবড়ি। উম্‌দা জিনিস। পেট ভরিল, কিন্তু মন ভরিল না।

    বারাণসী কিনা বিহারের প্রায় গায়ে লাগোয়া – বিহার বর্ডার এখান থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূর। যারাই বারাণসী বেড়াতে আসে, তারা এখান থেকে ঘুরে আসে সারনাথ বোধিগয়া। সারনাথ বারানসী থেকে খুবই কাছে। তো, বিহারের প্রক্সিমিটির জন্যেই বারাণসীর হিন্দিতে স্পষ্ট বিহারি টান। খেয়ে দেয়ে একটি ব্যাটারি রিক্সায় উঠে বসলাম, সেখানে আরও দুটি ছেলেমেয়ে ছিল, সম্ভবত কোথাও থেকে পড়ে ফিরছে, কলেজের ছাত্রছাত্রী। রাস্তায় ভিড় একটু কমেছে, তবে জিজ্ঞেস করায় রিক্সাওলা জানালো, বারাণসী কখনও ঘুমোয় না। চাইলে রাত তিনটের সময়েও রিক্সা পাওয়া যাবে। … এদিকে রিক্সা চলছে খুব ধীরগতিতে, প্রায় হাঁটার স্পিডে। একসময়ে থাকতে না পেরে ছেলেটি গলা তুলল – আরে ও ভাইয়া, ইতনা ধীরে কাহে চালাত হো, তানিক তেজ বঢ়াও না।

    পৌনে এগারোটায় হোটেলে ফেরত। হোটেলটি ভালো, পরিষ্কার, খুব দামীও নয়। জামাকাপড় বদলে শুতেই ঘুম জড়িয়ে এল চোখে।

    ফোনের আওয়াজে এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে গেল। কত রাত এখন? কার ফোন বাজছে?

    বাজছে সিকিনীর ফোন। নাম ফ্ল্যাশ হচ্ছে, সামবডি ডিরেক্টর অলোক কুমারের নাম। অফিস থেকে ফোন? এত রাতে?

    সিকিনী নাম শুনে বলল, ও হ্যাঁ, এ-ই বলেছিল বেনারসে এর কী চেনাশোনা আছে, ব্যবস্থা করে দেবে, তুই কথা বলে নে –

    আমিঃ কী বলব? হ্যাঁ, নাকি না?

    সিকিনীঃ বল যে সকালে বেরোতে হবে, যদি সকাল পাঁচটা নাগাদ দর্শন করিয়ে দিতে পারে, তা হলে যাবো।

    ফোন ততক্ষণে বেজে শেষ হয়ে গেছে। মোবাইলে দেখলাম, রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। ঘুমের দফারফা। অলোক কুমারকে ফোন করলাম। উনি ভোর পাঁচটা শুনে খুবই চিন্তিত হয়ে বললেন, আচ্ছা, দেখছি। আমি একজনকে বলে দিচ্ছি, বারাণসী পুলিশের একজন সাব ইনস্পেক্টর আপনাকে দশ মিনিটের মধ্যে ফোন করবেন। তাঁকে বলে দেবেন কখন যেতে চান, তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।

    হয়ে গেল। ভেবেছিলাম ছটা অবধি ঘুমিয়ে উঠব, শালা এই দর্শনের চক্করে পড়ে সব প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেল। রাতে যদি ঘুম কমপ্লিট না হয়, কাল সারাদিন আবার টানব কী করে? – কিন্তু, ভক্তি বড় কঠিন জিনিস। সেখানে এইসব পার্থিব লজিকের স্থান নেই।

    দশ মিনিটের মাথায় একজন এস আই ফোন করলেন। বললেন, সক্কাল সোয়া পাঁচটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে একজন আসবে, তার নাম কনস্টেবল মঙ্গল পান্ডে। এই তার নাম্বার। সে আপনাদের “দর্শন” করিয়ে দেবে।

    তাতিরাতাচি গামা হন্ডুরাস। “যাকেই বলেছি, সে-ই বলছে”-র এই হচ্ছে নীট ফল। যে জিনিসগুলো আমার সবচেয়ে অপছন্দের, সবচেয়ে ঘেন্না করি, সেই জিনিসগুলোর মধ্যে দিয়ে আমাকে কাল সকালে যেতে হবে। জাস্ট বিরক্তিকর।

    মনে মনে অসংখ্য গালাগাল মারতে মারতে – কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘড়ি দেখি নি আর।
    পর্ব তিন
    ---------

    জ্ঞানবাপী চিনেন? জ্ঞানবাপী? আমার লোগ থাকবে উখানে। নীল শার্ট। মনোহর। সি আপনাকে চিনে নিয়ে আসবে।

    আজ আমরা যে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির দেখি, সেটা এমন কিছু প্রাচীন নয়। আসল, আদি কাশী বিশ্বনাথ মন্দির অনেকবার ভেঙেছে আর গড়েছে। জ্ঞানবাপীর উল্লেখ কেন করলাম, সেটা বলছি একটু পরে। অবিশ্যি, আপনারা জ্ঞানীগুণী মানুষ, আপনারা সবই জানেন। তাও একটু বলি।

    অজ্জিনাল মন্দিরটি সম্ভবত তৈরি হয়েছিল ৪৯০ খ্রিস্টাব্দে। আর আজ যে মন্দিরটি আমরা দেখতে পাই, সেটি তৈরি করেছিলেন অহল্যা দেবী হোলকার, ১৭৭৭ সালে। বারাণসীর আরেকটি বিখ্যাত মন্দির, কালভৈরবের মন্দির, তৈরি করে দেন শ্রীমন্ত বাজীরাও পেশোয়া, ১৮৫২ সালে।

    তখন ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল। তিনি দিল্লি থেকে যাচ্ছেন বাংলায়, নদীপথে। সঙ্গে কতিপয় হিন্দু রাজা ও তাঁদের পরিবার। রাজাদের অনুরোধে সম্রাট একদিনের হল্ট দেন বারাণসীতে, যাতে রাজা এবং রাণীরা গঙ্গায় চান করে পবিত্র হতে পারেন এবং পুজো ইত্যাদি করতে পারেন।

    পুজো সেরে সবাই ফিরলেন, কেবল এক রাণী ফিরলেন না। সেই রাণীকে কোত্থাও খুঁজে পাওয়া গেল না। খবর যখন ঔরঙ্গজেবের কানে এসে পৌঁছলো, তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে লোক পাঠালেন চারিদিকে খুঁজতে। তারা খুঁজতে খুঁজতে বের করল, মন্দিরের গায়ে একটি সুন্দর কাজ করা গণেশমূর্তি, আসলে দেওয়ালে প্রোথিত নয়, চাপ দিলে সেটা সরে যায়। … সরানো হল গণেশমূর্তি, দেখা গেল সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। মন্দিরের নিচে। সেইখানে পাওয়া গেল হারিয়ে যাওয়া রাণীকে, তাঁর সম্মানহানি হয়েছে, তিনি বসে বসে কাঁদছেন।

    এই ভয়ঙ্কর অপরাধের খবর পেয়ে ঔরঙ্গজেব ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। যতই পাঁড় চাড্ডি হোন, আফটার অল রাজা রাণীরা তাঁর সঙ্গেই ছিলেন, তাঁদের সুরক্ষাহানি সম্রাটের উপস্থিতিতে, সম্রাট সেটা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি হুকুম দেন, মন্দির মাটিতে মিশিয়ে দেবার।

    … অনেক গল্পকথা প্রচলিত এই মন্দির ধ্বংস নিয়ে, তার মধ্যে এটাও একটা। এর কোনও ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, যে যেমন পেরেছে গল্প বানিয়েছে। ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট শুধু এটুকুই – কাশী বিশ্বনাথের মন্দির ঔরঙ্গজেবের আদেশে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। মাসির-ই-আলমগীরি, ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রামাণ্য দলিলে স্পষ্ট লেখা আছে, ৯ই এপ্রিল ১৬৬৯ সালে ঔরঙ্গজেবের আদেশে এই সুপ্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লিখিত হুকুম দেন সমস্ত রাজ্যের মন্দির এবং স্কুল – যেগুলো কাফেরদের দ্বারা পরিচালিত, সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার। এবং সেই লিস্টে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরও ছিল।

    জ্ঞানবাপী এই মন্দির প্রাঙ্গণেই অবস্থিত। বাপী মানে কুয়ো। কথিত আছে, প্রাচীন বিশ্বনাথ মন্দিরের যে শিবলিঙ্গ, সেটিকে উপড়ে ফেলে এই কুয়োর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, এবং সেই লিঙ্গ নাকি আজও কুয়োর মধ্যে রয়েছে। মোটামুটি ১৬৬৯ সালের আগস্ট মাসে এই ধ্বংসের কাজ সম্পন্ন হয়। যেখানে মন্দিরটি ছিল, সেটাকে ভেঙে মাঠ করে ফেলে সেখানে একটি মসজিদ বানানো হয়। জ্ঞানবাপী আসলে এখন একটি মসজিদ, সেই কুয়ো সমেত। এর একদিকের দরজা এখনও সেই প্রাচীন মন্দিরের দরজার সাক্ষ্য বহন করছে, যদিও আমজনতা তা দেখতে পায় না। অনেক পরে, ঔরঙ্গজেব মারা যাবার পরে এই মসজিদের গায়ে লাগোয়া মন্দিরটি, সেটা আজ লোকে দেখতে পায়, তৈরি করেন অহল্যা দেবী হোলকার। এই মন্দির তৈরি করার সময়েও যথেষ্ট কম্যুনাল টেনশন তৈরি হয়েছিল, মন্দিরে গরুর মাংস এবং মসজিদে শুওরের মাংস ছোঁড়া হয়েছিল, যার ফলে শুরু হওয়া দাঙ্গায় কয়েকশো লোকের প্রাণ গিয়েছিল বেনারসে। শেষমেশ দুই তরফেরই শুভবুদ্ধির জয় হয়, এবং মন্দির আর মসজিদ, আজ একই পাঁচিলের এদিক ওদিক করে বিরাজ করছে।

    মন্দির হম ওঁহি বনায়েঙ্গে – বলে যে বাঁদরের দল আদবানি আর বাজপেয়ীর কথায় নেচে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল, তারা বারাণসীতেও এসে এই জ্ঞানবাপী মসজিদটি ভেঙে গুঁড়িয়ে মন্দিরের পরিসর বাড়ানোর তালে ছিল, কিন্তু বারাণসীর মানুষ এখানে অযোধ্যা রিপিট হতে দেন নি। আজও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অ্যাজেন্ডায় আছে এই মসজিদ ভাঙা, তবে তারা কবে সফল হবে, এখনই বলে যাচ্ছে না।

    ********

    পৌনে পাঁচটায় ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের শব্দে। মঙ্গল পাণ্ডে আসবেন আমাদের নিতে, তাই তৈরি হতে হবে। চোখে তখন সর্ষেফুল দেখছি। ঘুম কমপ্লিট হয় নি। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। সোয়া পাঁচটায় গাড়ি আসার কথা। সিকিনী আর ভূতোকে তৈরি হবার সময় দিয়ে আমি নিচে নেমে এলাম। কিন্তু কোথায় গাড়ি?

    মঙ্গল পাণ্ডের ফোন নাম্বার ছিল, পাঁচটা কুড়ি নাগাদ ফোন লাগালাম। তিনি জানালেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছেন, গাড়ি এখন চৌকা-ঘাট পেরোচ্ছে।

    সত্যিই পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি চলে এল। গাড়ির সাইডে লেখা এনডিআরএফ, আর সামনে লেখা, পুলিশ। সিকিনীর “ভেতর থেকে” ব্যবস্থা করিয়ে দেবার ফলে এনডিআরএফের একজন কনিষ্ঠবল সকালবেলায় এসেছেন আমাদের রিসিভ করতে। ততক্ষণে সিকিনী আর ভূতোও চলে এসেছে, আমরা গাড়িতে চেপে বসলাম। ক্যামেরা হোটেলেই রেখে এসেছি, কারণ মন্দিরে ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ।

    ভোরবেলা গাড়িঘোড়া একটু কম, তবে গোধূলিয়া মোড়ে এসে দেখলাম বেশ জমজমাট ব্যাপার। অনেক বড় বড় বাস এসে দাঁড়িয়ে আছে এই ভোরবেলাতেও, প্রচুর পুণ্যার্থী সমাগম হয়েছে আর কি। আগের দিন আমাদের ব্যাটারি-রিক্সা এই মোড়েই নামিয়ে দিয়েছিল, আজ পুলিশের গাড়ি বাঁদিকে টার্ন নিয়ে ঢুকে গেল খানিকটা। একেবারে মন্দিরের গেটে এসে দাঁড়াল গাড়ি। পাণ্ডেজি আদেশ দিলেন – জুতো খুলে, পার্স রেখে তবে নামতে। কারণ মন্দিরে নাকি ওসব কিছুই অ্যালাওড নয়। – সে হতেই পারে। বেশির ভাগ হিন্দু মন্দিরেই এইসব নিয়ম হয় টয়। সিকিনীর পরামর্শমত দুশো টাকা পকেটে নিয়ে পার্স মোবাইল জুতো গাড়িতে ছেড়ে নামলাম খালিপায়ে।

    মন্দিরের সামনে সাতখানা পুলিশ, উদ্যত কারবাইন এলএমজি নিয়ে দাঁড়িয়ে। একটা মেটাল ডিটেক্টর গেট লাগানো, সেইখান দিয়ে সারা ভারতবর্ষ ঢুকছে মন্দিরে। লিটারেলি সারা ভারতবর্ষ। বাঙালি গুজরাটি তামিল রাজস্থানী – কে নেই সেই লাইনে। গেট দিয়ে ঢুকছে, তারপরে পুলিশ তাদের গায়ে থাবড়ে থাবড়ে চেক করছে, তারপরে মেটাল ডিটেক্টর ডাণ্ডা বুলোচ্ছে, তারপরে যেতে পারছে। পাণ্ডেজি গিয়ে কারবাইনধারী পুলিশের কাছে গিয়ে আমাদের দেখিয়ে কী সব বললেন, আমরা সাড়ে তিনজন পাশ দিয়ে সুট করে ঢুকে পড়লাম মন্দিরের পরিসরে, চেকিং ছাড়াই।

    লাইন ভেতরে চলে গেছে সর্পিল ভাবে। আমরা লাইনের পাশ দিয়ে দিয়ে এগোতে থাকলাম। ভেতরে বেশ কিছু দোকান, সবাই পুজোর ডালি বিক্রি করছে, ফুল, বেলপাতা, আর প্লাস্টিকের গ্লাসে করে দুধ টাইপের একটা জিনিস, প্রসাদী দুধ বোধ হয়, কিরম হাফ চন্নামেত্ত হাফ দুধ টাইপের দেখতে। ও হ্যাঁ, আর মিষ্টির বাক্সও ছিল ডালিতে। পাণ্ডেজি আমাদের দাঁড় করিয়ে তিন খানা ডালি কিনলেন, একটি নিজের জন্য, বাকি দুটি আমাদের দুজনকার জন্য।

    খেলতে নেমে ঘোমটা দেবার মানে হয় না। নিলাম, নিয়ে এগোলাম। লাইন ডানদিকে বেঁকে গেছে। সামনেই একটা পেল্লায় সিংদরজা, কাঠের, বন্ধ। এখানেও চারজন পুলিশ বসে আছে। পাণ্ডেজি আবার পুলিশদের গিয়ে কী বললেন, পুলিশ একগাল হেসে আমাদের জন্য দরজা খুলে দিল। ভিআইপি গেট। ঢুকতেই একটা সরু চাতাল, তাতে একদিকে সারিসারি মন্দির, সেই মন্দিরের সিরিজের শেষে একটা বড় চাতালওলা মন্দির, বেশ কারুকার্য করা, ওপরটা পেতল মোড়া। এটাই আসল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। পুণ্যার্থীদের লাইনটা আমাদের পাশ দিয়ে মন্দিরের পেছন দিক দিয়ে গিয়ে ঢুকছে, আর আমাদের সামনেই মন্দিরের যে দরজা, সেইখান দিয়ে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে আসছে একে একে। আমি দেখতে পেলাম, দরজার ঠিক ভেতরেই একটি ঘেরা জায়গা, সেইখানে লোকে ফুল-বেলপাতার ডালি উপুড় করে দিচ্ছে, আর রেলিং-এ মাথা রেখে কী কী সব প্রার্থনা করছে, দেড় সেকেন্ডের মধ্যেই একটা পুলিশ তার হাত কিংবা ঘাড় ধরে টেনে আমাদের সামনের দরজাটা দিয়ে বের করে দিচ্ছে।

    মঙ্গল পাণ্ডে জানালেন, চূড়াটা সোনার তৈরি। আসল সোনা। … লে হালুয়া। এটা সোনা? এমন ম্যাড়মেড়ে? (পরে গুগল করে দেখলাম, এই সোনার চূড়াটা বানিয়ে দিয়েছিলেন পঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহ। কে জানে, ভেজাল মিশিয়েছিলেন কিনা!)

    ঘাড়ধাক্কারত পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলেন পাণ্ডেজি। এইবারে পুজোর ডালি নিয়ে আমিও এগিয়ে গেলাম। গিয়ে শুনি, তিনি পুলিশকে বলছেন, ইয়ে ডিআইজি সাব কে রিশতেদার আয়ে হুয়ে হ্যাঁয়, ইনকো জলদি নিকালনা হ্যায়।

    বিশ্বাস করুন, আমার রিশতায় খানদানে কখনও কোনও ডিআইজি সাব নেই, ছিলেনও না। পাতি ঢপ মেরে আমাদের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন, আর আমি দেখলাম রেলিং-ঘেরা জায়গার মাঝে ওই দুধ-টাইপের লিকুইডের একটা মিনি পুকুর হয়ে আছে, তাতে ভাসছে ডাঁই করে ফুল আর বেলপাতার দল, তার মাঝে জেগে রয়েছে এত্তটুকু একটা শিবলিঙ্গ। এইখানে পুজো দিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। আর প্রসাদের প্যাকেটটা একবার ঠেকিয়ে নিতে হয়।

    লোককে ফুল বেলপাতা উপুড় করে ফেলতে অবজার্ভ করেছি – কিন্তু দুধের গ্লাসটা কী করে – সেটা তো দেখি নি। লাইনকে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে ডিআইজি সাবের রিশতেদারদের জন্য, যা করার আমাদেরকেই করতে হবে, অন্য কাউকে দেখে কপি করারও উপায় নেই। আমি ডালি উপুড় করে ফুল বেলপাতা ঢেলে দিলাম, গ্লাসটাও উপুড় করে ওখানেই ফেলে দিলাম, শিবলিঙ্গের একেবারে ওপরে। আমার দেখাদেখি সিকিনীও তাই।

    রেলিং-এর ভেতরে বসে ছিলেন এক পুজারী মহন্ত টাইপের কেউ। তিনি তো খেপে বোম – গিলাস য়ঁহা নেহি ফেকতে, ইয়ে তো থোড়াসা ডালকে বাকি পীনে কে লিয়ে হ্যায়, বলে গ্লাসদুটো তুলে সাইডে সরিয়ে দিলেন। পাণ্ডেজি একটু হতভম্ব হয়ে বললেন – আপনারা পুরো গ্লাস ঢেলে দিলেন কেন, ওটা তো বাবাজির প্রসাদী দুধ, ভাঙ মেশানো, ওটা তো খেতে হয় –

    পাগল নাকি! কী দিয়ে বানানো কে জানে, এখন আমায় সারাদিন ড্রাইভ করতে হবে, আমার সাতসকালে ভাঙ খেতে বয়ে গেছে। হেঁহেঁ করে হেসে বেরিয়ে এলাম দরজা দিয়ে। পাণ্ডেজি এইবারে নিয়ে চললেন মন্দিরের পাশের একটা গলি দিয়ে – কাশী বিশ্বনাথকে দর্শন করার পরেই নাকি অন্নপূর্ণা মাতার দর্শন করতে হয়। এগোলাম। এখানেও লম্বা লাইন, আমরা লাইনের বাইরে দিয়েই হেঁটে এলাম। গলির শুরুতেই দেখলাম লেখা আছে – কাশী বিশ্বনাথ গলি।

    বিশ্বনাথ মন্দিরেও ছিল শ্বেতপাথরের চাতাল, অন্নপূর্ণা মন্দিরেরও সিঁড়ি শ্বেতপাথরের, তার স্টেপে স্টেপে লেখা নাম, বিভিন্ন ডোনারের নাম, প্রথম ধাপেই দেখলাম লেখা আছে – (নাম মুছে গেছে) রক্ষিত, চন্দননগর। বাংলায়। আশেপাশে অনেক জায়গাতেই নোটিস হিন্দি আর ইংরেজির সাথে বাংলায় লেখা। সেখানে মাথা নুইয়ে নমো করলে পুরুতমশাই একমুঠো চাল দেন। এইবারে সেই চাল আঁচলের খুঁটে (অভাবে ওড়নায়) বেঁধে বাড়ি নিয়ে ঘরের চালের মধ্যে মিশিয়ে দিতে হয়, তা হলেই নাকি মা অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে ঘরে কখনও ভাতের অভাব হয় না।

    সবই পাণ্ডেজি বলে দিলেন, তাই জানলাম। নইলে আমার আঁচলও নেই, ওড়নাও নেই। সিকিনী চাল নিল হাতের মুঠোয়, নিয়ে রুমালে বেঁধে নিল। এইবারে বেরিয়ে আসার পালা। বেরোবার মুখে সামনের দিকে আঙুল দেখিয়ে পাণ্ডেজি বললেন, ঐখানে নন্দীজি বসে আছেন, ওঁর কানে মুখ ঠেকিয়ে মনস্কামনা জানালে সে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। তাকিয়ে দেখি, একটা গরুর মূর্তি, কালো রঙের। দুজন মহিলা এক এক করে সেই গরুর গলা জড়িয়ে ধরে কানে মুখ ঠেকিয়ে কী সব বলে যাচ্ছেন। পাণ্ডেজি খুব ইনসিস্ট করলেন ঐভাবে নন্দীজির কানে মনস্কামনা জানাতে, কিন্তু আমরা দুজনেই কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম – আমাদের তেমন কোনও মনস্কামনা নেই। পাণ্ডেজি একটু ক্ষুণ্ণ হলেন অবিশ্যি, কিন্তু আমরা ডিআইজি সাবের রিশতেদার বলে কথা, কিছু বললেন না।

    একই রাস্তা দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। বেরোবার মুখটা অবশ্য আলাদা, বাঁদিকে একটা পাঁচিল, তার সামনে ইয়া উঁচু উঁচু লোহার গরাদ বসানো। পাণ্ডেজি বললেন, এইটা একটা মসজিদ, এখানে এন্ট্রি নিষিদ্ধ। বুঝলাম, এর জন্যেই এত পুলিশ, এত কারবাইন, এত সুরক্ষা, আর এত গরাদ। এই সেই জ্ঞানবাপী মসজিদ।

    গাড়িতে চেপে বসে জুতো পরলাম, পার্স পকেটে ঢোকালাম, এবং দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি আমাদের হোটেলের দরজায় পৌঁছে দিল। ঘড়িতে দেখি ছটা চল্লিশ বাজে। তুমুল তাড়াতাড়ি হল তো! এমনিতে শুনেছি এখানে “দর্শন” করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিতে হয় টয়। মঙ্গল পাণ্ডের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে খুব ধন্যবাদ জানালাম এমন দ্রুত দর্শন করিয়ে দেবার জন্যে।

    হোটেলের ক্যান্টিনে হাল্কা স্ন্যাক্স এবং কফি খেয়ে রাস্তায় নামলাম যখন, তখন সাড়ে সাতটা বাজে। শক্তিগড়ে কোনওভাবেই সন্ধ্যের আগে পৌঁছনো আর সম্ভব নয়, তাই আগেই কোথাও লাঞ্চ করতে হবে। কাল সারাদিন লেগেছে শুধু উত্তর প্রদেশ কভার করতে, ইউপির পশ্চিমতম প্রান্ত থেকে শুরু করে আটশো কিলোমিটার পেরিয়ে আজ আমরা ইউপির পূর্বতম প্রান্তে। আজ আমরা পেরোব তিনটে রাজ্য। বিহার, ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গ।

    তার মধ্যে আজ আবার বিহারে কাউন্টিং। নীতিশ কুমার বনাম নমো।

    ঠিক আটটায় আমরা ইউপি পেরিয়ে বিহারে ঢুকে গেলাম। সুপার স্মুথ রাস্তা, জায়গায় জায়গায় টোল দেওয়া ছাড়া আর কোথাও দাঁড়ানোর ব্যাপার নেই। একে একে পেরিয়ে গেলাম সাসারাম, ডেহরি-অন-শোন, ঔরঙ্গাবাদ। হাজারিবাগের কাছে যখন আমরা বিহার পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডে ঢুকছি, তখন বাবার ফোন এল – বিহার ইলেকশনের ফল বেরিয়েছে, নীতিশ কুমারের জোট বিশাল মার্জিনে এগিয়ে, নরেন মোদী ধুয়েমুছে সাফ। বললে হবে? পুউরো কাউন্টিং-এর সময়টা আমি বিহারের রাস্তায় ছিলাম।



    ঝাড়খণ্ড বড় মায়াবী জায়গা। যেমনি এখানকার ন্যাচারাল বিউটি, তেমনি সুন্দর সুন্দর নাম। ঝুমরি তালাইয়া, কোডারমা, মধুপুর, এইসব নাম দেখছি এদিক ওদিক বোর্ডে, আর দূরে দেখছি হাল্কা ঢেউখেলানো ছোটছোট পাহাড়ের সারি, রাস্তার দুধারে তালগাছের সারি, আর নাম-না-জানা অসংখ্য ফুল। রাস্তাও চলেছে ঢেউ খেলিয়ে, কখনও উঁচু, কখনও উতরাই। ছোটনাগপুরের মালভূমি। আপনারা যারা ড্রাইভ করতে ভালোবাসেন, একবার অন্তত ঝাড়খণ্ডের রাস্তায় ড্রাইভ করবেন, মন খুশ হয়ে যাবে।




    দুপুর দুটোর পরে, বারাণসী থেকে ঠিক তিনশো বাহান্ন কিলোমিটার চলার পরে আমরা পৌঁছলাম গিরিডি। তিলুবাবুর বাড়ি এখানে। অধ্যাপক ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর সঙ্গে তো দেখা হল না, কিন্তু আমরা দেখলাম রাস্তার ধারেই একটা ছোট রিসর্ট টাইপের বিল্ডিং। গাড়ি ঢোকালাম সেখানে, নুডলস আর কী কী যেন অর্ডার করেছিলাম। খুবই নমিনাল দাম, কিন্তু অসাধারণ টেস্ট। তেমনি টেস্টি জল। অশোক ইন্টারন্যাশনাল না কী যেন নাম, কার্ডটা রেখে দিয়েছি, সবাইকে রেকো করলাম, এইখানে লাঞ্চ করবেন। চারদিকে ফাঁকা জমি, একটু দূরেই একটা ন্যাড়া পাহাড়ের টিলা, আর এদিক ওদিক তাল খেজুরের গাছ। সে যে কী অসাধারণ দৃশ্য, কী বলব।

    খেয়ে উঠে তিনটে নাগাদ আবার স্টার্ট করলাম। এর পরে এল তোপচাঁচি। এইখানে একটা মজার জিনিস দেখা যায়, আমি ট্রাভেলগে পড়েছিলাম, এইবারে দেখলাম।

    তোপচাঁচি টাউনে আসার একটু আগে, রাস্তার দুধারে সারিসারি দোকান। সেই দোকানে বিক্রি হচ্ছে, তলোয়ার। ঢাল, তলোয়ার, ছোরা, চাকু, নেপালা, চাপাতি, ভোজালি, কুঠার, আর, আর, বিভিন্ন সাইজের খেঁটে লাঠি। তেল মাখানো বাঁশের লাঠি। বিভিন্ন সাইজের। ও হ্যাঁ, হকিস্টিকও ছিল। রাস্তার দুধারে সারি সারি পনেরো পনেরোটা করে প্রায় তিরিশটা দোকান। এত অস্ত্রের এমন খুল্লমখুল্লা দোকান বোধ হয় এই একটি জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়।




    এর পরে ধানবাদ পেরিয়ে কুলটি. পশ্চিমবঙ্গের শুরু। এবং শুরু খারাপ রাস্তার। তখন প্রায় পৌনে ছটা বাজে, অন্ধকার করে এসেছে, আমার গাড়ির একটি হেডলাইট খারাপ। আর তেমনি বাজে রাস্তা। জায়গায় জায়গায় ডাইভার্সন, ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। আস্তে আস্তে পেরোতে থাকলাম আসানসোল, রাণীগঞ্জ, দুর্গাপুর।

    সমস্ত ট্রাভেলগে পড়েছিলাম, এই রুটের মেন গাঁট হচ্ছে পানাগড়। একটা পাঁচ ছ কিলোমটারের স্ট্রেচ আছে, ভাঙা রাস্তা, সরু রাস্তা, রাস্তার ওপরেই বাজার বসে এবং ভর্তি ট্রাফিক থাকে – বেশির ভাগই ট্রাক। সেই পানাগড়ে এসে পৌঁছলাম। তখন বেশ অন্ধকার, তাই ছবি তোলা হয় নি। পানাগড়কে বলা হয় গ্রেভইয়ার্ড অফ ভেহিকলস। রোড রোলার থেকে মিলিটারি ট্রাক থেকে মারুতি এইট হানড্রেড, সব রকম গাড়ির কঙ্কাল পাওয়া যায় এই পানাগড়ে। তা, জ্যাম ছিল, সরু আর বাজে রাস্তাও ছিল, কিন্তু ট্রাফিক মুভিং ছিল। একটু ধীরে হলেও পেরিয়ে গেলাম টুক করে। আর তার একটু পর থেকেই শুরু হল দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে।

    দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েটা খুব সুন্দর রাস্তা, কিন্তু এর শেষ পর্যন্ত আমাদের যাবার ছিল না, কারণ আমরা কলকাতা যাবো না।

    শক্তিগড়ে পৌঁছলাম সন্ধে সোয়া সাতটায়। রাস্তার দু ধারে সারি সারি দোকান, সব ল্যাংচা দিয়ে নাম। ল্যাংচা ধাম, ল্যাংচা হাট, ল্যাংচা কুটীর, ল্যাংচাপণ, ল্যাংচালয়, মানে রাস্তার দুধার পুউরো ল্যাংচাময়। প্রচুর রিভিউ পড়েছি এই জংশনটার। তাই গাড়ি পার্ক করে ঢুকলাম একটা দোকানে। দুটো করে ক্ষীরের ল্যাংচার অরডার দিলাম। দশ টাকা পিস।

    মুখে দিতেই হৃদয় ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। রামোঃ, এত্তো বাজে টেস্ট? কী জঘন্য কী জঘন্য। এই খেয়ে লোকে ভালো ভালো রিভিউ লেখে? এর চেয়ে তো আমাদের বালির মোড়ের সুইটস সেন্টারের ল্যাংচা অনেএক ভালো খেতে হয়! খানিক সীতাভোগ চেয়ে নিলাম, সে-ও পদের টেস্ট না। সিকিনীরও একই অবস্থা। ল্যাংচার স্বাদ চেখে মুখ বিকৃত করে ফেলেছে।

    মুখের টেস্ট ফেরাতে দুটো করে বেগুনির অর্ডার দিলাম। হ্যাঁ, বেগুনিটা দারুণ ভালো বানিয়েছে।

    খেয়েদেয়ে উঠলাম। কেমন খটকা লাগছিল, তা হলে কি আমরা ভুল দোকানে ঢুকেছি? গাড়ি বের করে একটু চালিয়েও, আবার সাত আটটা দোকানের পরে দাঁড় করালাম। দাদা, একটা পাঁচটাকার ল্যাংচা দিন তো!

    খেলাম, এবং একই রকমের বিচ্ছিরি লাগল। আর রিস্ক নিয়ে লাভ নেই, বাড়ি চলো।

    বাড়ির খুব কাছে এসে গেছি এইবারে। ভূতো আর বসে থাকতে পারছে না গাড়িতে, ক্ষণে ক্ষণে বলছে, আর কতক্ষণ? আর কতদূর?

    মেমারি থেকে ডাইভার্সন ওল্ড জি টি রোডে। বাবা বলেছিল, জিটি রোড এখন চকাচক বানিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। সে আমি দেখেওছি দোখনেশ্বর থেকে ব্যান্ডেল আসার সময়ে। ফাটাফাটি রাস্তা হয়ে গেছে পুরনো জিটি রোড।

    কিন্তু, এ কোথায় এসে পড়লাম? ট্রাকের সারি পেরিয়ে জিটি রোড শুরু হতেই শুরু হল তীব্র ভাঙাচোরা রাস্তা। সে কী বড় বড় গর্ত রে ভাই! এর আগের খারাপ রাস্তাগুলোকেও তখন ভালো বলে মনে হচ্ছিল। মেমারি পেরোলাম। বৈঁচি থেকে হুগলি জেলা শুরু হল, কিন্তু রাস্তা একই রকমের খারাপ। এক জায়গায় তো গাড়ির নিচটা ঠুকেই গেল গর্তে চাকা পড়ে। এ কী বিড়ম্বনা বাড়ির কাছে এসে।

    বৈঁচি, বৈঁচিগ্রাম, সিমলাগড়। এর পরে একটা লেভেল ক্রসিং। পাণ্ডুয়া এল। কালীপুজো আসছে, রাস্তার দু ধারে তাই আলোর মালা। ট্র্যাফিক। গ্যাঞ্জাম।

    পাণ্ডুয়া বাজারটা ছাড়াতেই ম্যাজিকের মত রাস্তা ভালো হয়ে গেল। ঠিক বালী থেকে হুগলি যেমন আছে, তেমনি – দুদিকে রিফ্লেক্টার বসানো মাখনের মত মসৃণ জিটি রোড শুরু হল। বুঝলাম, কাজ চলছে, কাজ পাণ্ডুয়া পর্যন্ত এগিয়েছে।

    এর পর? এর পর আরও দুটো লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে আদিসপ্তগ্রাম। সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তাটা গেছে ব্যান্ডেল মোড়। আর ডানদিকের রাস্তাটা “দিল্লি রোড” নাম নিয়ে গেছে বালীতে, সেখানে মিশেছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের সাথে। আমরা বাঁদিকের রাস্তা নিলাম। সোয়া নটায় আমাদের পাড়ায় ঢুকলাম। বাবা দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার মোড়ে। আস্তে আস্তে গলির ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে নিলাম।

    দিল্লি কলকাতা একদিকের জার্নি কমপ্লিট। ট্রিপ মিটার দেখলাম, আজকের দৌড় হয়েছে ছশো চুয়ান্ন কিলোমিটার।

    কাল যেতে হবে বহরমপুর। কিন্তু ভোর সাড়ে চারটের ট্রেন আর কোনওভাবেই ধরা সম্ভব নয়। আটটা পঞ্চাশেরটাই চেষ্টা করব। রাণাকে কাল সকালে ফোন করে নিয়ে বেরোব।
    পর্ব চার
    ---------

    আমি কি বাড়িতে বা পাড়ায় খুব উষ্ণ অভ্যর্থনা আশা করেছিলাম? আমাদের এ পাড়ায় বাস বহুকালের, সেই ১৯৮৮ সাল থেকে এইটা আমাদের বাড়ি। আশপাশের সমস্ত লোকজনকে আমি চিনি, নিতান্তই ছাপোষা মফস্বলী বাঙালির দল। আমি কি ভেবেছিলাম যে, তারা সবাই বাড়ি বয়ে আমাকে এসে বলবে, সিকি, কী করেছিস রে? তুই গাড়ি চালিয়ে একেবারে সেই দিল্লি থেকে এখেনে চলে এস্‌চিস? ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই, নইলে – এলাম, বাবা শান্তমুখে বাইরের গেটে তালা লাগাল, আমি আর সিকিনী মিলে লাগেজপত্র নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম, ঠিক সে রকম কোনও উষ্ণ উচ্ছ্বাসভরা আওয়াজ পেলাম না – এমনটা মনে হচ্ছে কেন? অনেক রাত হয়ে গেছে বোধ হয়।

    খেয়েদেয়ে একঘুমে সকাল। পূর্ব ভারত, এখানে ভোর হয় তাড়াতাড়ি। সোয়া ছটাতেই ঘুম ভেঙে গেল। দোতলার গ্রিলের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম বাড়ির বাইরে গাড়িটা সকালের আলোয় ঝিকমিক করছে, আর তার সামনে চার চারটি সন্তানকে নিয়ে কুকুরী মা প্রাতঃকালীন খেলাধুলো, আদর এবং দুধ খাওয়ানো একসাথেই চালাচ্ছে।





    খানিক বাদেই ভরপেটে দুটি ছানা গুটিশুটি মেরে ঢুকে গেল গাড়ির নিচে, আরামসে ঘুমিয়ে পড়ল একে অন্যের ঘাড়ে ল্যাজে মাথা রেখে। আমি নিচে নেমে এলাম।





    উঠোনে, যেমন চিরদিনই দেখে আসছি, শিউলি ফুল আর টগর ফুলেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ভূতো একসাথে এতগুলো শিউলি ফুল তো কখনও দ্যাখে নি আগে, তাই খুব খুশি, কোঁচড়ে ভরে শিউলি আর টগর কালেক্ট করল, করে ঠাম্মির কাছে বায়না করল ছুঁচসুতোর জন্য, মালা গাঁথবে। সে মালা কার গলায় পরাবে জিজ্ঞেস করাতে অবশ্য প্রচণ্ড রেগে গেল – তা আমার আর বেশি ঘাঁটাবার সময় ছিল না। বেরোতে হবে।





    এখান থেকে বহরমপুর যাবার একটিই মূল রাস্তা – এন এইচ ৩৪। রাণা এবং আমার বাবা – দুজনেই বলে দিয়েছিল গাড়ি নিয়ে একেবারে যাবার চেষ্টা না করতে, গাড়ির অ্যাক্সেল আর আমার শিরদাঁড়া – দুটোই নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এই দুশো কিলোমিটারের জার্নিতে। অগত্যা, ট্রেনই ভরসা। নৈহাটি থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ছাড়বে আটটা পঞ্চাশে – শিয়ালদা থেকে এসে। বহরমপুর পৌঁছবে বারোটা চল্লিশে। ঘণ্টাচারেক রাণার বাড়িতে কাটিয়ে বিকেলের ট্রেন ধরে ফেললে রাত্তিরের মধ্যেই আবার বাড়ি ফিরে আসব।

    ছোটবেলায় তিন বছর আমার কেটেছিল মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জে। বাবার তখন পোস্টিং ছিল সেখানে। তিন বছরে আমি বেশ কয়েকবার বহরমপুর গেছি। ধূলিয়ান, ফারাক্কা, হাজারদুয়ারী, পলাশী সমস্ত ঘুরেছি সেই সময়ে। কিছু বেড়ানোর ছলে, কিছু আবৃত্তি কম্পিটিশনের হিড়িকে। ছোটবেলায় আবৃত্তি করতাম, মূলত মায়ের উৎসাহে। এখানে ওখানে প্রতিযোগিতায় নাম দিতাম, আর আবৃত্তি করতাম বীরপুরুষ, কিংবা লিচু-চোর, নয় তো কাস্তে। ফার্স্ট সেকেন্ড প্রাইজ জিতে আসতাম। কখনও কখনও জঙ্গীপুর-রঘুনাথগঞ্জের বাইরেও আবৃত্তি কম্পিটিশন থেকে ডাক আসত, রঘুনাথগঞ্জের অগ্নিফৌজ অ্যাথলেটিক ক্লাব থেকে তখন আমাদের মত বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হত বহরমপুর। আবৃত্তি করে, কখনও প্রাইজ জিতে, কখনও কিছুই না জিতে ফিরে আসতাম। খুব আবছা মনে আছে বহরমপুর টাউনটা।

    সাতটা চল্লিশে বেরিয়ে পড়লাম। আটটা দশের ব্যান্ডেল নৈহাটি লোকালে বসে রাণাকে ফোন করে জানালাম, আমি বেরিয়ে পড়েছি, মোটামুটি পৌনে একটা নাগাদ বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে পৌঁছব। রাণাও খুব খুশি – বলল, আরামসে চলে এসো, বেলডাঙা ছাড়ালে আমায় একটা কল কোরো, আমি স্টেশনে চলে আসব তোমায় নিতে।

    পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের এই সব স্টেশনগুলোতে কী যেন একটা আছে, পুরনো দিনের অনেক অনেক স্মৃতি হু-হু করে উস্‌কে দেয়। এই চার্ম দিল্লির কোনও রেলওয়ে স্টেশনে হয় না। এই যে ঘষে যাওয়া কাচের বাক্সে সাজানো বিস্কুটের প্যাকেট, তিনদিনের বাসী প্যাটিস আর ক্রিম রোল, লাল রঙের শালু দিয়ে ঢাকা পানপাতা, আর চা-ওলার হাতে ইয়াব্বড়ো কেটলি আর সারিসারি মাটির ভাঁড়েরা – এদের আমি খুব চিনি। অনেক দুপুর, অনেক বিকেলের সঙ্গী ছিল এরা আমার। এখন আমি অন্য জীবন যাপন করি।

    একটু দূরে লোকাল ট্রেন থেকে নামল তিনটে লোক, তাদের হাতে বাঁশের লাঠির দুপ্রান্তে বাঁধা খেজুরপাতার ঝাঁটার গুচ্ছ, তাদের ধরেছে একটা লোক, প্লেন ড্রেসের লোক, সে কিছু একটা পয়সা ডিম্যান্ড করচে, যেটা দিতে এই তিনজনেই নারাজ। ঝাঁটাওলাদের একজন অনুরোধের ভঙ্গিতে সেই লোকটির বুকপকেটে একটা একশো টাকার নোট গুঁজে দিল, এত দূর থেকে কথা তো শোনা যাচ্ছে না, বুঝলাম রফা করতে চাইছে, তিনজনের জন্য একশো টাকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দিতে। ট্রেনে ঝাঁটা নিয়ে আসা নিষিদ্ধ কিনা জানি না, কেন এই তিনজনকে ধরেছে – ঝাঁটার জন্য নাকি বিনা টিকিটে আসার জন্য, তা-ও জানা নেই। আমি শুধু দেখছি, লোকটি টাকাটা নিচ্ছে না, বুকপকেট থেকে বের করে আবার ঝাঁটাওলার হাতে থাবড়ে ধরিয়ে দিচ্ছে, আর আরও রেগে গিয়ে কিছু বলছে।

    আমার মাথার ভেতরে দুলছে একটা কবিতা। উৎপলকুমার বসুর কবিতা।

    ঐ ছেলেটা বাবু ঐ হারামজাদা দু টাকা চায় ব্যাটা ছেলে খেটে খা না আমরা
    মেয়েমানুষ বালবাচ্চা আছে কোথায় পাব দু টাকা সেদিন দিইছি তাই বলে
    হপ্তায় হপ্তায় তোদের কি
    হারামজাদা মদ খাস বদমাইসি করিস আর আমাদের কাছে জুলুম আজ
    একটাকা কাল দু টাকা এই সেদিন দিলুম বাবু বিশ্বেস করুন বলে টাকা না দিলে
    চাল ফেলে দোবো পেটাবো তা মার না শালা হারামী ঘরে মা-বন নাই
    বাজারে এসে তোর রোয়াব এ চাদর গায়ে ছেলেটা কাল এস্‌ছিল বললুম
    পয়সা কোথায় পাবো বল সবাই রেশন ধরে আজকাল বিক্রি নাই কখনো
    কখনো কেউ আসে ইদিকে বলে চাল আছে গোবিন্দভোগ আছে কত কিজি
    বউনির সময় তার মধ্যে ঐ শালা মুখ গলিয়ে বলে দুটো টাকা দেরে মাগী
    নইলে এখানে বসতে পাবিনি জমিটা কি তোর রে হারামী লেকবাজার কি
    তোর বাপের তুই ব্যাটা ছেলে খেটে খা না পুলিশের কাছে প্রতিকার নাই ধরে
    নে যায় ঘুষ খায় আর ছেড়ে দেয় ক’বার হাজত ঘুরে এলি বল না বাবুকে এই
    শালা এই মড়াখেকো আর কদিন মস্তানি করবি সাগরেদ হইচিস চোরের
    সাগরেদ ন্যায্য কথা বলি এত লোগ খেটে খায় আর তুই তোর মরণ হয় না
    দু’কেজি আট আনা লাভ তোর ঘরে মা বোন নেই রে বলিস পেটাবি চাল
    ফেলে দিবি তোর মরণ হয় না রে বাঁদর ।

    [সই লুডো খেলা, উৎপলকুমার বসু]

    আটটা পঞ্চাশ কখন পেরিয়ে গিয়ে নটা বাজল, লালগোলা প্যাসেঞ্জারের দেখা নেই। চা-ওলাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম অল্পবিস্তর লেট এ ট্রেনে হয়ই। এসে যাবে। মনে ভয় পেলাম। শিয়ালদা থেকে নৈহাটি আসতেই যদি এত লেট করে, তা হলে বাকি রাস্তা কেমন যাবে কে জানে!

    লালগোলা প্যাসেঞ্জার, এই আমার দ্বিতীয়বার। প্রথম সফরের একটা ঝাপসা স্মৃতি আছে, অনেক দিন আগের – উনিশশো তিরাশি। আমি তখন সবে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি, ছ বছরের বাচ্চা। একদিন বাবা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি চলে এল, আর আমরা রিক্সা করে চললাম জঙ্গীপুর রোড স্টেশনের দিকে, ব্যান্ডেল যেতে হবে। বাবার মুখটা থমথমে। ট্রেন এল। লালগোলা প্যাসেঞ্জার। বসে জানলাম, ঠাকুমা মারা গেছেন। বাবার মা। তখনও মৃত্যু বোঝার বয়েস হয় নি, ব্যান্ডেল যাচ্ছি, সেখানে জ্যাকা আছে, মেজজেঠু আছে, ছোটকা আছে, কত মজা হয়, সেই আনন্দেই আমি মশগুল ছিলাম।

    সে বড় ভয়ঙ্কর জার্নি ছিল। তখন সিঙ্গল লাইন, আর লালগোলা ছিল প্রায় অল-স্টপেজ খুব লো-প্রায়োরিটির ট্রেন। মে মাসের তীব্র গরম। কয়লার ইঞ্জিন। মায়ের সঙ্গে করে আনা জল সম্ভবত ফুরিয়ে গেছিল। আমার চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়ে আমি চীল চিৎকার করে কাঁদছি, মা আমাকে ভোলাবার চেষ্টা করছে। আমার খুব তেষ্টা পেয়েছিল, কিন্তু জল তো নেই, মা শসা কিনে খাওয়াবার চেষ্টা করছিল। ট্রেন চলার থেকে থেমেই আছে বেশি। বাইরে তখন লু বইছে। জানলা নামাবার উপায় নেই, কারণ আমরা যে কামরায় বসেছিলাম, তার সবকটা কাঠের জানলা গায়েব। … তখন ট্রেনের জানলা কাঠের হত। অতএব, বসে বসেই শুকনো কাঠ গলায় শসা চুষতে চুষতে লু-এর ঝাপটা সইতে সইতে ব্যান্ডেল পৌঁছেছিলাম রাত নটায়। আমার কাকা জ্যাঠারা তখন সবে দাহ করে ফিরেছে। বাবার আর মাকে শেষ দেখা হয় নি। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। ট্রাঙ্ক কল বুক করতে হত। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে আর খবর দেবার উপায় থাকত না, তাই কাকা-জ্যাঠারা বিকেলের পর আর অপেক্ষা করতে পারে নি বাবার জন্য। ঠাকুমা যেখানটায় শুত, সেইখানটায় বিছানা আঁকড়ে ধরে বাবা আর জ্যাকার হাউহাউ কান্না আমার এখনও মনে আছে।

    লালগোলা প্যাসেঞ্জার শুনলেই আমার এইসব মনে পড়ে যায়। যদিও এ সব প্রায় তেত্রিশ বছর আগেকার স্মৃতি।

    এখন, দু হাজার পনেরো সালের নভেম্বর মাসে আমি নৈহাটির লাটফরমে দাঁড়িয়ে লোক গুনছি, আর ঘড়ি দেখছি।

    লালগোলা এল নটা পঁচিশে। পাক্কা পঁয়ত্রিশ মিনিট লেটে। উঠে বসার জায়গা পেলাম না, ঠাসা ভিড়, কোনও রকমে একটা চ্যানেলের মধ্যে নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

    রাণাঘাট পেরোবার পরে সামনে বসা একটা ছেলে, তার এক চোখ অন্ধ, আমাকে বলল, আপনি বসুন, আমি ভাবলাম সে বোধ হয় সামনে নামবে। বসলাম। কিন্তু ছেলেটা নামল না, দাঁড়িয়েই রইল। ঘণ্টাখানেক দাঁড়াবার পরে আবার আমার গায়ে হাত দিয়ে ডাকল ছেলেটা – এইবারে আমাকে একটু বসতে দেবেন? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছি।

    বোঝো কাণ্ড। এমন প্যাসেঞ্জারও হয় এই লাইনে? পালা করে বসা-দাঁড়ানো করতে করতে – বেলডাঙা আসতেই রাণাকে ফোন করে দিলাম। আর দেড়টার সময়ে বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকে বেরোতেই তার দেখা পেয়ে গেলাম। মোটরসাইকেলের পেছনে আমাকে লোড করে বহরমপুর শহর ঘোরাতে ঘোরাতে একসময়ে নিয়ে পৌঁছল রাণার বাড়িতে। প্রায় তিন যুগ বাদে দেখে বহরমপুরের একটা কিচ্ছু আমি আর চিনতে পারলাম না।

    গতকাল সদ্যই শেষ হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান। সারা বাড়ি জুড়ে তার চিহ্ন বিরাজমান। কিছু অতিথি আত্মীয় তখনও রয়েছেন, কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন। রাণা আর তার ভাই ব্যস্তসমস্ত হয়ে সবকিছু সামলাচ্ছে। খানিক বাদে রাণা বসার সময় পেল। বসলাম, খানিক গল্প হল। সশরীরে আসার পরে রাণার বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র হাতে পেলাম। বেশ সুন্দর ডিজাইন, আর তুমুল মজাদার লেখা।

    রাণা তখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না, আমি সত্যিই গাড়ি চালিয়ে এতটা এসেছি। … এই তো, এই ধরণের কথা শোনার জন্যেই তো আমি কাল থেকে মুখিয়ে ছিলাম। প্রশংসা শুনতে, আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে কে না ভালোবাসে?

    সিকিনীও মাঝে মাঝে প্রশ্নটা করে – কী পাস এত লম্বা লম্বা সময় ধরে গাড়ি চালিয়ে? কিছু তো এনজয় করা যায় না, তোর বোরিং লাগে না? টায়ারিং লাগে না? রাণাও সেই লাইনেই প্রশ্ন করল।

    আমি সবাইকেই প্রশ্ন ধরে ধরে উত্তর দিই। কী পাই, সে জানি না। ভালো লাগে। না, বোরিং লাগে না, টায়ারিং লাগে না, বরং ড্রাইভিং বা রাইডিং – আমার কাছে রিফ্রেশিং।

    একটু পরেই ওপর তলা থেকে খাবার ডাক এল। গিয়ে দেখি ক্ষুদ্র আয়োজন, কিন্তু তত ক্ষুদ্র নয়। মাটন বিরিয়ানি এবং মাটন কোর্মা। না হয় বিয়ের খাবার খাবো বলেই এসেছি, না হয় ট্রেনে শুধু এক ঠোঙা ঝালমুড়িই খেয়েছি সকাল থেকে, তাই বলে পেটের খোলস তো অনন্ত নয়! সে কথা কে বোঝাবে রাণাকে আর রাণার মা-কে! বিরিয়ানির থালা অর্ধেক শেষ না হতেই আবার বিরিয়ানি দিয়ে ভর্তি করে দেন, মাংসের বাটি শেষ হবার অপেক্ষা, পরক্ষণেই সেখানে আবার চারপিস মাংস, এবং স্বভাবোচিত বিনয়, এটুকু তো তুমি খেতেই পারবে, এ আর এমন কি!

    একটা সময়ে হাত তুলতেই হল, গলা পর্যন্ত মাটন আর বিরিয়ানি ঠাসা। রাণা ততক্ষণে বেশ হিংস্র হয়ে উঠেছে। হাত মুখ ধুয়ে আসতে না আসতেই দেখি আবার একটা প্লেট, তাতে রসগোল্লা, পান্তুয়া, আর দই।

    প্লেট নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসলাম। যাকে দেখার জন্য এতদূর আসা, সেই শ্রীমতি রাণার এতক্ষণে আবির্ভাব ঘটল। না, ওর নাম সায়ন্তিকা নয়, ওটা নিতান্তই রাণার কলমের দেওয়া নাম, তবে আসল নামটা আমি আপনাদের বলছি না, ওটা আপনারা রাণার থেকে জেনে নিন গে। মিষ্টি, বাচ্চামতম একটা মেয়ে, নেহাত শাড়ি পরে একটু বড় দেখাচ্ছে। বেশ মিশুকে, অনেকক্ষণ গল্পগুজব হল।

    চারটে বাজল, এবার যাবার পালা। এক প্রস্থ চা খেয়ে ঘুমটাকে তাড়া দিলাম, তারপরে রাণা আমাকে আবার মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে হুশ করে পৌঁছে দিল বহরমপুর কোর্ট স্টেশন। এবার ফেরা ভাগীরথী এক্সপ্রেসে। এটা আবার রাণাঘাটের পরে কলকাতা স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াবে, তাই আমাকে রাণাঘাটে নেমে ট্রেন পালটে নৈহাটি আসতে হবে।

    সাড়ে সাতটা পৌনে আটটা নাগাদ রাণাঘাট স্টেশনে এসে নামলাম। নৈহাটির ট্রেন আসবে আটটার একটু পরে। অলস চোখে দেখতে থাকলাম স্টেশনটাকে। ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম বাবার সাথে, এখানে। বাবার মামাবাড়ি এই রাণাঘাটে। এখন সব স্টেশনের মতই রাণাঘাটও আধুনিক হয়েছে। হুইলার স্টলে বই বিক্রি হচ্ছে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে মহিলা চেকার একজন বিনা টিকিটের যাত্রীকে ধরেছেন, শার্টের হাতা ধরে তাকে নিয়ে যাচ্ছেন টিকিট কালেক্টর অফিসের দিকে – আর আজ আমার কী হয়েছে, থেকে থেকে মাথায় ঝাপটা মারছে কবিতারা। মফস্বলের রেলস্টেশনে বোধ হয় কবিতারা ঘোরাফেরা করে। তাদের চোখে দেখা যায় না। এই রাণাঘাটও তো আমার এক প্রিয় কবির একদা বাসস্থান। আমার বাড়ি আছিল রাণাঘাটে, … তার আগে কী ছিল যেন?

    স্টেশন মাস্টার, আপনি দয়া করে এই
    লোকটিকে ছেড়ে দিন, বুড়ো লোকটার
    ত্রিসংসারে কেউ নেই।

    একজন আছে বটে, দূর সম্পর্কের – সেও টিকিটবিহীন –
    খুড়ো-বলে-ডাকা-সেই-সৌদাসের ছোট্ট ছেলেটা,
    খুড়ো বলে ডাকে কেন ঈশ্বর জানেন। খুব ক্ষীণ,

    আরো একজন আছে, হয় তো দূরতর সম্পর্কের,
    অথচ আত্মীয় ওর, আমি সেইজন।
    আরো একজন, আপনি, আপনি ছাড়া ওর কেউ নেই।

    তা ছাড়া আপনার নয় একচেটিয়া ক্যানিং স্টেশন।

    [যুক্তি, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত]

    ট্রেন এসেছিল সময়মত, বেসুরে বাউল গান শুনতে শুনতে পৌঁছলাম নৈহাটি, সেখান থেকে আবার ট্রেন বদলে ব্যান্ডেল। এইবারে সত্যি ক্লান্ত লাগছে। ছাঁদা বেঁধে খানিক বিরিয়ানি আনতে পারলে মন্দ হত না, দুপুরের খাওয়া কখন হজম হয়ে গেছে।

    আমি ঘুমোতে যাই, আপনারা বরং এই নেমন্তন্নপত্রটা পড়ে ঠোঁট চাটুন। রাণার লেখা। সত্যিই লা-জবাব।

    ==================================

    মান্যবরেষু,

    আগামী এতই কার্তিক, ১৪২২শে, আমি সজ্ঞানে সসম্মতিতে সশরীরে সায়ন্তিকাকে (ঐ আসল নাম যা, তার বদলে) তার সম্মতিক্রমে বিবাহ করতে চলেছি। এই উপলক্ষ্যে কিঞ্চিৎ (???) ভোজনাদির আয়োজন করা হয়েছে। না এলে মটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাপের অভিশাপ পাবেন। সুতরাং, পত্রপ্রাপ্তি মাত্রই এতই নভেম্বর বৌভাতে চলে আসার জন্য প্রস্তুত হোন। পত্রদ্বারা আমন্ত্রণের ত্রুটি অমার্জনীয়।

    পুনশ্চঃ উপহারস্বরূপ থালা বাটি গ্লাস কিছু আনার দরকার নেই। কারণ, ডিএ পাচ্ছি না বলে আমি থালা বাটি গ্লাসের রিসেল মার্কা ব্যবসা করতে যাচ্ছি না। তবে, বই দিলে কিছু আপত্তি করব না। এটাই আগাম জানিয়ে দিলাম।

    পাত্র এবং পাত্রী, দুজনেই উপস্থিত থাকার কথা। এসে দেখে নেবেন।

    মুদ্রণসহায়কের সংযোজনঃ কাটা পাঁঠা সবসময়েই বেশি করে ছটফট করে। প্রাণের বন্যা ভাবার কোনও কারণ নেই।
    পর্ব পাঁচ
    ---------

    নাঃ, কলকাতা আমার শহর নয়। এ শহরে আমি বোধ হয় একটি রাতও আজ পর্যন্ত কাটাই নি। সেই অর্থে দিল্লিই বোধ হয় আমার কাছে সেই শহর, যে শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু। কিন্তু তাই বলে কি কলকাতা বেড়াতে যাবো না? বিশেষ করে ব্যান্ডেলে এসে, যেখান থেকে প্রতি দশ পনেরো মিনিটে একটা করে ট্রেন যায় হাওড়া ইস্টিশনের দিকে, যেখানে যাবার জন্য আমাদের কখনও টাইম টেবিল দেখতে হয় না, জাস্ট ইচ্ছেমত ব্যান্ডেল স্টেশনে গিয়ে পড়লেই চলে?

    ভূতোও কলকাতা দেখে নি, মানে, কলকাতা "দেখা" বলতে যা বোঝায় আর কি। আসতে আসতে অনেক আলোচনা হচ্ছিল, হাতে যখন দু তিনদিন সময় রয়েছে, ভূতোকে একদিন সারাদিন ধরে কলকাতার যা সম্ভব দেখানো হোক। সমস্যা বাধছিল অঞ্চল বাছতে। কখনও ঠিক হয় সায়েন্স সিটি - তো পরক্ষণেই মনে পড়ে, ওখানে গেলে, শুধু ওটিতে যেতে আসতেই একটা গোটা দিন বেরিয়ে যাবে, খুব বেশি হলে নিকোপার্ক দেখা যেতে পারে ওর পরে, তার বেশি কিছু নয়। বরং সেন্ট্রাল কলকাতা টার্গেট করা হোক, জাদুঘর আছে, তারামণ্ডল আছে, ভিক্টোরিয়া আছে, আর দুপুরে লাঞ্চটা যদি আহেলি-তে করে ফেলা যায়, তো কেমন হয়? সিকিনী বলল, না, আহেলি বড় কস্টলি, আমরা বরং স্টার থিয়েটারের সেই ভ-মা তে যাবো। আমার মন অপশন দিচ্ছিল বালিগঞ্জ প্লেস, তো যাই হোক, বেরিয়ে তো পড়ি, যা হবে দেখা যাবে।

    প্রথম তারামণ্ডলে গিয়েই হতাশ হলাম, সে রিনোভেশনের জন্য বন্ধ ছমাস যাবৎ (আবছা মনে পড়ল, গত বছরেও এ চত্বরে এসে দেখেছিলাম রিনোভেশনের জন্য বন্ধ আছে, এ শহরে কদ্দিনে ছ'মাস হয় কে জানে!)। অগত্যা হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল।


    সেখান থেকে চিড়িয়াখানা। আমি নিজেই কলকাতার চিড়িয়াখানা দেখেছি, তখনও সম্ভবত ইশকুলে ভর্তি হই নি। এখন গিয়ে আর কিছুই চিনতে পারলাম না, তবে ভূতোর খুশিতেই এখন আমাদের খুশি হবার বয়েস।







    সবচেয়ে মন কাড়ল বাচ্চা হাতিটা, একটা দুষ্টু পায়রার সঙ্গে সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলা করছিল। আর পায়রাটাও তেমনি, আমাকে-ধরতে-পারে-না স্টাইলে খালি খালি বাচ্চাটার শুঁড়ের কাছে এসেই ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যাচ্ছে, আর বাচ্চাটা গোল গোল করে ছুটে যাচ্ছে।



    এর মাঝে খাবার ব্যাপারে পুরোপুরি মত পালটে সোজা চলে গেলাম পার্ক সার্কাস। আর্সালানে গিয়ে পেটপুরে আবার বিরিয়ানি খেলাম। সেখান থেকে ফিরে এলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে।

    প্রাক্‌-প্রেমপর্বে আমরা, মানে আমি আর সিকিনী, দু একদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বসেছিলাম। সেইসব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আর একদিন মনে আছে, দুজনে মিলে উনিশে এপ্রিল দেখতে গেছিলাম হাজরায়, বিজলি সিনেমাহলএ। সিনেমা দেখে সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসেছিলাম বাবুঘাট। অনেকক্ষণ লঞ্চঘাটে বসে থেকে তারপরে ট্রেন ধরে বাড়ি গেছিলাম। ভালোবাসার মেয়েটির হাত, সেই প্রথম অনে-কক্ষণ ধরে থাকার অভিজ্ঞতা, সারা শরীরের সেই শিরশিরানি আজও ভুলতে পারি নি।

    ভিক্টোরিয়ায় তখন সন্ধ্যে হচ্ছে। ধীরে ধীরে। এত আলোর কারিকুরি সেই সময়ে বোধ হয় ছিল না।






    এর পর একটা বাস ধরে বাবুঘাট। ফিরে দেখা সেই সময়গুলোকে। বিশ শতকের শেষ দশকের শেষ মাস। সিকিনী পরের মাসেই প্রথম চাকরি পেয়ে চলে যাবে মেদিনীপুর। আমি তখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করছি। ওকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে যাবো আমার পেয়িং গেস্ট আস্তানায়, চিংড়িঘাটা। বাবুঘাটে সারিসারি দাঁড়িয়ে ওড়িশা-ঝাড়খণ্ডমুখী বাস, আর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া চক্ররেলের ঝুমঝুম আওয়াজ মাঝেমধ্যে, লাইনটা পেরোলেই বিশাল বড় হুগলি নদী।

    কিছু বদলায় নি। কলকাতার এইসব অঞ্চল একই রকম রয়ে গেছে দশকের পর দশক। লঞ্চের টিকিট কাটলাম। লঞ্চ এল, হাওড়া পৌঁছলাম। কালীপুজো উপলক্ষ্যে সবাই সেজেছে খুব। হাওড়া ব্রিজ, হাওড়া স্টেশন।




    পরদিন আবার যাওয়া হয়েছিল কলকাতা। শারদ্বত হাওড়ায় এসে আমাকে তুলে নিল, সেখান থেকে গেলাম কাবলিদার বাড়ি। অনেকদিন পরে দেখা হল কাবলিদার সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হল তাপস, রৌহিন, সুমেরু আর অভিষেক আইচ। গুরুচন্ডালির বইপত্তর গোনাগুনির কাজ। কাজ সেরে আমাদের নন্দন চত্বরে যাবার কথা। সেখানে আরও আসবে লোকজন। একটা মিনি ভাটের আয়োজন করেছে শারদ্বত, আমার অনারে।

    ভবানীপুরে এই ছবিটা দেখলাম, মদন মিত্তির তখন সবে জামিন পেয়ে বেরিয়েছেন।


    তবে নন্দনের ভাট একটু হতাশ করল। শারদ্বত তো সর্বক্ষণই আমার সাথে ছিল, রৌহিন আর সুমেরুও পরের বাস ধরে এসে গেল, তাপস কেন জানি না এসেই আমাকে দেখে আবার পালিয়ে গেল। এর পরে এল রুণা, রাজীব সেনগুপ্ত এবং সবশেষে খানিকক্ষণের জন্য - সব্যসাচী কর। সায়ন্তনী এবং আরও কিছু কুচোকাঁচা আসবে বলেও এল না, বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে। তবে ভাটের স্পিরিট তাতে একটুও কমে না। খানিক কেজো আড্ডা সেরে আবার শারদ্বতের ঘাড়ে চেপে হাওড়া ফেরত। সেখান থেকে বাড়ি।

    কাল ভাইফোঁটা। মূলত এই অনুষ্ঠানটার জন্যই এই সময়ে আসা।

    আপাতত আমার বাড়ি আর পাড়ার আরও দু একটা ছবি লাগিয়ে শেষ করি।











    সামরানের নাম লিখতে ভুলে গেছি। ভাটে সামরানও এসেছিল।
    পর্ব ছয়
    --------

    আসলে কী জানেন তো, আমরা সকলেই দুটো জীবন কাটাই। একসাথে। একটা, যেটা আসল আমি, আরেকটা, যেটা সবাই আমায় জানে। আমার মুখোশ। লেখক যখন লেখে, উত্তম পুরুষে, তখন সে মুখোশ চড়িয়েই লেখে। তার মত ভালো, সংবেদনশীল, অ্যাডভেঞ্চারাস, পাগল প্রেমিক চরিত্রের প্রেমে যাতে সবাই পড়ে, সেটা এনশিওর করার দায়িত্ব নেয় লেখক নিজেই। লেখনীর দোষেগুণে সেই চরিত্রচিত্রণে সে কখনও সফল হয়, কখনও হয় না।

    সব লেখার ক্ষেত্রেই এ কথা সত্যি। সে গল্প উপন্যাস স্মৃতিকথা ট্র্যাভেলগ লেখাই হোক বা এক দু লাইনের ফেসবুকের স্ট্যাটাস। উত্তম পুরুষে লেখকের মত উত্তম আর কেউ হয় না।

    আর, দু একবারের চেষ্টায় যখনই লেখক তাতে সফল হয়ে যায়, তখন পাঠকের সেই এক্সপেক্টেশন ধরে রাখার একটা তাগিদ নিজের অজান্তেই গড়ে ওঠে তার মধ্যে। সে চেষ্টা করে যেন তার পরের লেখাগুলোকেও লোকে একইরকমভাবে পছন্দ করে।

    আমার এই লেখার প্রথম চারটে পর্ব লোকে যতটা মন দিয়ে পড়েছে, অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে, আমার মনের মধ্যে তত খুশি ভরে উঠেছে। কিন্তু পঞ্চম পর্ব – কেউ কেউ জানালেন, ততটা ভালো লাগে নি। কোথাও যেন একটা তাল কেটেছে। ঠিক দিল্লি-কলকাতা ট্র্যাভেলগের মধ্যে এইসব জিনিস – চিড়িয়াখানা গেলাম, আর্সালানে বিরিয়ানি খেলাম – এ সব খাপ খায় না।

    খারাপ লাগে নি? সত্যি করে বলো, সিকি। মনের মধ্যে কোথাও কি একটু ক্ষুণ্ণতা জমা হয় নি?

    হয় নি আবার? হয়েছে বৈকি। ভালো লাগাতে না পারলে, খারাপ লাগা এসে যাবেই অবধারিতভাবে। কিন্তু সে খারা লাগা তো অযৌক্তিক নয়। আসলে, আমার নিজেরও পোস্ট করার পরে পড়তে ভালো লাগছিল না। ট্র্যাভেলগের ট্র্যাক ছেড়ে গত পর্বটা কেমন মনোলগ হয়ে যাচ্ছিল – সেটা আমি নিজেও টের পেয়েছি। আসলে, লেখাটা যখন শুরু করেছিলাম, ঠিক, লোককে ভালো লাগানোর উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করি নি, এক্সপেক্টেশন জন্মাবে – এমন ভেবে আগের পর্বগুলো লিখি নি। জন্মে গেছে, এবং সেটা আমার কাঁধে এসে উঠেছে। এখন তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় আমার। সসম্মানে সে দায়িত্ব আমি ঘাড়ে নিয়ে আজকের পর্ব লিখছি।

    যে কোনও ভ্রমণকাহিনির তিনটে পার্ট থাকে – গিয়ে পৌঁছনো, ঘুরে দেখা, এবং ফিরে আসা। এখন, বেড়ানোর অংশটা – এই ট্রাভেলগে – কলকাতা, যেটা আমার লেখার অধিকাংশ পাঠকের কাছে আপুন-কা-ইলাকা, নিজের বাড়ি, নিজের পাড়া। বেড়াবার জায়গা নয়। সম্ভবত তাল কাটার সেটা একটা কারণ। যাই হোক, আগে থেকেই জানিয়ে রাখি, এই লেখা শেষ হবে আমার দিল্লি ফেরার পর, সম্পূর্ণ আট পর্বে।

    ===========================================================

    ১৬৭৩ সাল। পাটুলির জমিদার রামেশ্বর রায় তৎকালীন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে গঙ্গার ধারে বংশবাটি এলাকায় ৪০০ একরের একটি গ্রাম যৌতুক এবং রাজা উপাধি পান। তিনি সেখানে বসতি স্থাপন করেন। বংশবাটিতে বংশবিস্তারও করেন। প্রায় একশো বছর বাদে তাঁর বংশধর, রাজা নৃসিংহদেব রায় এইখানে একটি মন্দির বানান। ইতিহাস বলছে, রাজা নৃসিংহদেব যাচ্ছিলেন বিলেত। যাবার পথে তিনি কয়েকদিনের জন্য বারাণসেতে অবস্থান করছিলেন, যখন তাঁর সাথে পরিচিতি হয় কয়েকজন তান্ত্রিক সাধুর। বিলেত যাবার প্ল্যান ক্যানসেল করে তিনি বারাণসীতেই থেকে যান ছ বছর – ১৭৯২ থেকে ১৭৯৮, এবং সেই তান্ত্রিকদের কাছে তিনি মন দিয়ে তন্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন, কুণ্ডলিনী সম্বন্ধে সমস্ত জ্ঞান অর্জন করেন। তার পরে তিনি ফিরে আসেন বংশবাটিতে, এবং তন্ত্রমতে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। শেষ অবশ্য তিনি করে যেতে পারেন নি, তার আগেই ১৮০২ সালে রাজা মারা যান। এর পরে মন্দির সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব হাতে নেন তাঁর স্ত্রী, রানী শঙ্করী দেবী। মন্দির সম্পূর্ণ হয় ১৮১৪ সালে।

    এই মন্দিরটিই আজ হংসেশ্বরী মন্দির নামে বিখ্যাত। বলতে পারবেন, এখানে কোন দেবীর মূর্তি আছে?

    হংসেশ্বরী বললেই প্রথমে মনে আসে সরস্বতীর কথা, হংসবাহিনী। কিন্তু না, এই মন্দিরের সঙ্গে সরস্বতীর দূর দূর পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক নেই। এটি এই মন্দিরের কালীঠাকুরের নাম। এমন কি হংসেশ্বরীর সাথে হংস বা হাঁসেরও কোনও সম্পর্ক নেই। গল্পটা শুনুন।

    বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির এখন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া টেকওভার করেছে, তারাই রক্ষণাবেক্ষণ করে। এই অঞ্চলে এই মন্দিরটি বিভিন্ন দিক দিয়ে ইউনিক – এর স্থাপত্য সাবেকি তন্ত্রমতে বানানো – যা দক্ষিণবঙ্গের আর কোনও মন্দিরে নেই। এবং এর সংলগ্ন অনন্ত বাসুদেব মন্দিরও এই অঞ্চলের টেরাকোটার একটি মাত্র মন্দির। হুগলি জেলায় সম্ভবত আর কোনও টেরাকোটার মন্দির নেই।

    মূল মন্দিরটি ২১ মিটার লম্বা এবং এতে ১৩টি মিনার আছে। প্রতিটি মিনারের মাথা এক একটি পদ্মকুঁড়ির আকারে তৈরি। মন্দিরটি পাঁচতলা। প্রতিটি তলা তন্ত্রমতের এক একটি মূল স্নায়ুকে রিপ্রেজেন্ট করে – ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না এবং চিত্রিনী। মূল মিনারের একদম ওপরে সহস্রজ্যোতিসমেত সূর্যদেবের একটি ধাতুমূর্তি রাখা আছে। হংসেশ্বরী দেবী অধিষ্ঠিতা রয়েছেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে, নীলবর্ণের মূর্তি, চতুর্ভুজা। এটি নিমকাঠের মূর্তি। একইসঙ্গে এখানে শিব এবং কালীর পুজো হয়। তন্ত্রমতে, প্রাণায়ামের সময়ে শ্বাস ছাড়ার মুহূর্তে “হং …” বলে একটি নাদ নির্গত হয়। তেমনি শ্বাস নেবার সময়ে “স …” করে একটি আওয়াজ হয়। এই দুয়ের সংযুক্তিতেই হং-স। এবং দেবীমূর্তির সংযোজনে এই মুর্তির নাম হংসেশ্বরী।

    হংসেশ্বরী মন্দির দেখে এলাম ফেরার আগে। সে গল্প পরে। আগে ভাইফোঁটা।

    শুক্রবার সকালে ভাইফোঁটার পাট চুকল সাড়ে দশটা নাগাদ। ভূতো এবং তার পিসতুতো ভাইয়ের জীবনে প্রথম ভাইফোঁটা। দুজনেই খুব খুশি এবং উত্তেজিত।






    আমারও যেন কত বছর পর ফোঁটা নেওয়া হল? তেরো কিংবা চোদ্দ বছর।


    আজ শেষ দিন। ভূতো এর আগে ব্যান্ডেল চার্চ দেখেছে, কিন্তু ইমামবাড়া দেখে নি। তাই দুজনকে নিয়ে বেরোলাম ইমামবাড়া। এম্নিতে হুগলির রাস্তায় খুব একটা গাড়ি চলে না, মূল ফটকের পাশেই অঢেল জায়গা, গাড়ি লাগিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবো, সামনে ধাপিতে বসা একটি রিক্সাওলা, লুঙ্গি তুলে খানিক দাবনা চুলকে বলল – দাদা, এখানে কিন্তু গাড়ি রাখতে কুড়ি ট্যাকা নেব।

    আমি তো হাঁ। বলে কী? ইমামবাড়ার আশেপাশে এত বছর ঘুরেছি, আড্ডা মেরেছি, কখনও তো শুনি নি এখানে “গাড়ি” রাখতে টাকা নেয়? দিল্লির নাম্বার দেখে বেশি শখ হয়েছে বোধ হয়। শুধোলাম, কীসের টাকা হে?

    লোকটা উদাস মুখে হাঁটু চুলকে বলল, এই এমনি – আমরা গাড়ি দেখার জন্য নিই।

    বললাম, তোমাকে আমার গাড়ি দেখতে তো কেউ বলে নি। এক পয়সাও দেব না।

    লোকটা আরও উদাস হয়ে বলল, না দিলে দেবেন না – এমনিই বললাম। আপনার ইচ্ছা।

    দুপুরে খেয়ে দেয়ে সিকিনী, ভূতো, এবং আমার দিদি ও তার পুত্রকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলাম অন্যদিকে। প্রথমে রাজহাটের দিকে, সেখানে নাকি একটি অ্যামিউজমেন্ট পার্ক আছে, গিয়ে দেখলাম ধূলিধূসরিত পার্কটি জঙ্গল সেজে বন্ধ হয়ে আছে, ভেতরে তিনটে অসহায় ময়ূর বন্দীদশা কাটাচ্ছে। দিদি বলল, চন্দননগরে “ছুটি পার্ক” আছে, সেখানে বাচ্চাদের জন্য ট্রেন রাইড ইত্যাদি কীসব আছে। গাড়ি ঘোরালাম দিল্লি রোড দিয়ে চন্দননগরের দিকে। গিয়ে দেখি ছুটি পার্কও বন্ধ। পাশের একটি পার্কের কাউন্টার থেকে মুখ বাড়ালেন এক দিদিমনি, বললেন, এই পার্কটাতে শুধুমাত্র “কাপল”রা সময় কাটাতে আসে, বাচ্চা নিয়ে গেলে আপনাদের ভালো লাগবে না।

    সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। অগ্রহায়ণের সোনালি ধানেরা দুলছে হাওয়ায়, সরু কিন্তু মসৃণ পিচের রাস্তায় পড়েছে সোনালি রোদের ছোঁয়া।





    আবার একটা পার্ক খোঁজার চেষ্টায় জল ঢেলে এইবারে এক রকম জোর করেই আমি সবাইকে নিয়ে গেলাম বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আলোয় সাজানো মন্দির দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। এই মন্দিরে আমি এসেছিলাম বোধ হয় ঠিক কুড়ি বছর আগে – ১৯৯৫ সালে, আমার জলপাইগুড়ি কলেজের এক বন্ধুর বাড়ি ছিল এখানে, তার সাথে। তখন এত সুন্দর ছিল না মন্দির পরিসর। এখন খুব সুন্দর ঝকঝকে বাঁধানো হয়ে গেছে – এএসআই রক্ষণাবেক্ষণ করে এখন। চারদিকে সুন্দর আলো দেওয়া, পাশের জমিদারবাড়ির ভগ্নাবশেষটুকুও সযত্নে সংরক্ষণ করা, আর অন্যপাশে পুকুরটাও। বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটালাম সেখানে।



    নিমকাঠের কালীমূর্তি-


    টেরাকোটার কাজ - অনন্ত বাসুদেব মন্দির।





    বড়-মেজ-ছোট -


    পাশেই জমিদারবাড়ির ভগ্নাবশেষ -


    মন্দির সংলগ্ন পুকুর -


    ==============================

    কাল সকালে আমার ফেরা। সিকিনী আর ভূতো ফিরবে রাজধানী এক্সপ্রেসে। আমি গাড়ি নিয়ে একলা ফিরব, এই রকমই কথা ছিল। কিন্তু পথের দেবতা আর আমার কথায় কবেই বা কান দিয়েছেন। আমার শুভানুধ্যায়ী স্বজন ধারণা করে নিলেন, একা একা অতটা রাস্তা ফেরত যাবে ছেলেটা – পারবে না। বোর হয়ে যাবে। ওর একজন সঙ্গী দরকার। আমি যদিও সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা একবারের জন্যেও অনুভব করি নি, তবু স্বজনবাহিত হয়ে বাবা প্রস্তাব পাড়ল যে, আমার সাথে যাবে। তারপরে ট্রেনে চেপে ফেরত আসবে।

    আমার আপত্তি করার কিছু ছিল না, গাড়ি তো খালিই যাবে, বারাণসীতে হোটেলও বুক করা আছে, বাড়তি কোনও সমস্যা নেই। কথা পাকা হওয়ামাত্র আমি বাবার জন্য ফিরতি টিকিট কেটে নিলাম।

    কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের আমার জন্য চিন্তা তবুও কমল না। বাবা বয়স্ক মানুষ, সে-ও আমার সঙ্গে টানা দুদিন অতখানি জার্নি করে উঠতে পারবে না, এই সাব্যস্ত করে পরিবর্তে অন্য দুজনকে আমার সাথে জুড়ে দেওয়া হল। একজন আমার আত্মীয় – গৌরব, অন্যজন তার বন্ধু, স্টিফেন। স্টিফেন গুরগাঁওতে চাকরি করে, কলকাতার ছেলে, ওর রবিবার এমনিই ফেরার ছিল, আর গৌরব তার বন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে এমনিই যাবে, যে হেতু আমি স্টিফেনকে সরাসরি চিনি ন।

    মনে মনে খুবই খারাপ লাগল, কোনও দরকার ছিল না আমাকে জিজ্ঞেস না করেই এইসব প্ল্যানপ্রোগ্রাম করার। আমি একাই ফিরতে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলাম। খামোকা লোকজন সাথে নিয়ে লম্বা জার্নি করার মত ইচ্ছে আমার ছিল না, আমার আসলে, খুব বেশি লোকের সাথে বনে না। তা ছাড়া, আমাকে বেরোতে হবে সক্কালবেলায়, গৌরব আর স্টিফেন আসবে কলকাতা থেকে, এদিকে গৌরবের সকালবেলায় ওঠার কোনওরকমের বদনাম নেই বলেই জানি, ওরা কীভাবে সকাল ছটার মধ্যে ব্যান্ডেল এসে পৌঁছবে? আমার এখান থেকে দেরিতে শুরু করা মানে বারাণসী পৌঁছতে রাত তো হবেই। আবার পরদিন ভোরে উঠে বেরনো …

    কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে আপত্তি জানানোর উপায় থাকে না, বিশেষত আপত্তির লক্ষ্য যদি নিজের আত্মীয়স্বজন হন। চুপচাপ বাবার জন্য কাটা ফিরতি টিকিট আবার ক্যানসেল করলাম। কথা হল গৌরব এবং স্টিফেন ভোর সাড়ে পাঁচটায় ব্যান্ডেল লোকাল ধরবে হাওড়া থেকে, সাড়ে ছটায় ব্যান্ডেল। আমাদের বাড়িতে এসে চা খেয়ে আমরা লেটেস্ট সাড়ে সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব।

    মনে অস্বস্তি নিয়েই ঘুমোতে গেলাম, ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে। কে জানে, কেমন হবে জার্নি – একটাই লাভ, গৌরব আর স্টিফেন, দুজনেই ড্রাইভিং জানে, আমাকে হয় তো একটানা পুরো ড্রাইভ করতে হবে না, ভাগাভাগি করে ড্রাইভ করা যাবে।

    ======================================

    তখনও কি জানতাম, পরের দু দিনে কী কী সাসপেন্স লেখা আছে আমার কপালে? আমি কি জানতাম, যে ট্রিপ শেষ করার আগেই আমাকে উলটো ভাবতে হবে – ভাগ্যিস আমি একা বেরোই নি? ভাগ্যিস আমার সঙ্গে আরও দুজন ছিল?
    পরের পর্ব লেখার আগে, পিপি এবং অন্যান্যদের জন্য একটুখানি অ্যাডেন্ডাম, হুগলি ইমামবাড়া সম্বন্ধে - আসলে এই ইমামবাড়া আর ব্যান্ডেল চার্চ - এই দুটোর সঙ্গেই আমরা হুগলিনিবাসিরা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে এগুলো নিয়ে আলাদা করে লেখার দরকার হতে পারে বলে মনে করি নি।

    হাজী মহম্মদ মহসীনের মূল তিনটি কীর্তি আজও হুগলি শহরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দুটিই গঙ্গার পাড়ে - একটি হুগলি মহসীন কলেজ, েকটি হুগলি ইমামবাড়া হাসপাতাল - যাকে আমরা চুঁচুড়া সদর হাসপাতাল বলে জানি, অন্যটি এই, ইমামবাড়া। তবে এটি আদি ইমামবাড়া নয়। জনৈক পারস্যদেশীয় ব্যবসায়ী, মহম্মদ আগা মোতাহার ১৭১৭ সালে এই ইমামবাড়ার প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একতলা একটি বাড়ি। নুনের ব্যবসায়ী আগা-বাবুর মনে ইচ্ছে ছিল এই বাড়িতে তিনি সস্ত্রীক বাকি জীবনটা কাটাবেন। সেই সময়ের দলিলে পাওয়া যায়, আগা মোতাহার খুব রইস আদমি ছিলেন। নিজের কোঠাবাড়িটি একতলা হলেও ইমামবাড়ার পুরো এলাকাটি ছিল বিশাল, খিদমতগার, বান্দা, নফরদের থাকার জন্যও তিনি সেখানে ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন।

    কিন্তু ব্যবসায়ে সফল হলেও, বিবাহিত জীবনে তিনি সুখী হতে পারেন নি। অগত্যা, সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাবার বাসনা ত্যাগ করে ১৭১৭ সালে তিনি এই বিশাল এলাকা আল্লাহ্‌র কাছে সমর্পণ করে দেন। নাম দেন নজরগাহ্‌ হোসেন। এর পরে ১৭৩৫ সালে তাঁর জামাই মির্জা সালেহ্‌-উদ্দিন এটিকে আরেকটু সম্প্রসারিত করেন, তাজিয়া-খানা নামে আরেকটি বিল্ডিং বানান, এবং পুরো এসটেটটি মুসলিম কমিউনিটির প্রতি উৎসর্গ করে দেন।

    আজ আমরা যে ইমামবাড়া দেখি, তার কোথাও সেই নজরগাহ্‌ হোসেন বা তাজিয়া খানার চিহ্নমাত্র নেই। কালের গর্ভে সে সব হারিয়ে গেছে। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেই ধ্বংসাবশেষের ওপর গড়ে উঠেছে আজকের ইমামবাড়া, হাজী মহম্মদ মহসীনের প্রায় সারাজীবনের জমানো সম্পত্তির একটা অংশের খরচে।

    ১৭৩২ সালের পয়লা আগস্ট হাজী মহম্মদ মহসীনের জন্ম। আগা মোতাহারের অতুল সম্পত্তির মালিক ইনি হন। শুধু আগা মোতাহার নন, তাঁর জামাই মির্জা সালেহ্‌-উদ্দিনের সম্পত্তিও উনি পান - কীভাবে সেটা আমার জানা নেই, যদ্দূর জানি সালেহ্‌-উদ্দিন সন্তানহীন ছিলেন।

    সম্পত্তি এবং প্রপার্টি পেয়ে তিনি এই পুরো প্রপার্টিটি একটি দানপত্র লিখে এক অছি পরিষদের হাতে হস্তান্তর করেন। মহসীনের লেখা থেকে পাওয়া যাচ্ছে - "I, Hajee Mohummud Mohsin, son of Hajee Fyzoollah, son of Agha Fyzoollah, inhabitant of the port of Hooghly, in full possession of all my senses and faculties, with my own free will and accord do make the following correct and legal declaration. That the zumindaree of pergunnah Qismut Syedpore, etc., appendant to Zillah Jessore, and Pergunnah Sobhnal, also appendant to the Zillah aforesaid, and one house situated in Hooghly (known and distinguished as Imambarah) and Imambazar, and haut (market), also situated in Hooghly, and all the goods and chattels appertaining to the Imambara aforesaid, agreeably to a separate list; the whole of which have devolved on me by inheritance and the proprietary possession of which I have enjoyed up to the present time. As I have neither children, nor grand-children, nor other relatives, who would become my legal heirs and as it is my earnestwish and desire to keep up and continue the usages and charitable expenditures (Murasum-o-Musaruf-i-husneh) of the nature of fateha, and tuheeat, etc., of the Huzerat (on whom be blessings and rewards), which have been the established customs of this family, I therefore hereby give, purely for the sake of God, the whole of the above property, with all its rights, immunities, and privileges, whole and entire, little or much, in it with it, or from it, and whatever (by way of appendage) might arise from it, or relate or belong to it, as a permanent appropriation for the following expenditure; and I have hereby appointed RujubUli Khan, son of Shekh Mohummud Sadiq, and Shakur Uli Khan, son of Ahmud Khan, who have been tried and approved by me, as possessing understanding, knowledge, religion, and probity Mootawulless (or trustees) of the said Waqf or appropriation, which I have entrusted to the above two individuals, that aiding and assisting each other they may consult, advise, and agree together in all matters connected with the joint management ofthe business of the said appropriation, in the manner following. ...

    ... Consequently this writing is executed as a deed, this 9th day of Bysakh in the year of hijree 1221, corresponding with the Bengal year 1213, that whenever it be required, it may prove a legal deed.”

    কিন্তু ইমামবাড়ার রিনোভেশন ইত্যাদি শুরু করবার আগেই এই মহসীন মারা যান, ২৯শে নভেম্বর, ১৮১২। এর পর যা হয়, ট্রাস্টি বোর্ড সম্পত্তি এবং জমিজমা নিয়ে টালমাটাল হতে থাকে, কী করা উচিত আর কী নয়, তাই নিয়ে খানিক খেয়োখেয়ি চলে, অনেকবার ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য পালটানো হয় - শেষমেশ ১৮৩৬ সালে তৎকালীন বাংলা গভর্নমেন্ট এই ট্রাস্টি বোর্ড অধিগ্রহণ করে, এবং তেসরা জানুয়ারি, ১৮৩৭ সালে সৈয়দ কেরামত আলি নামে একজন নামকরা আর্কিটেক্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ইমামবাড়ার কোর্টইয়ার্ড ঢেলে সাজানোর। রাজস্থানের জৌনপুর এলাকার বাসিন্দা কেরামত আলি ইমামবাড়া তৈরি করার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন । ১৮৪১এ ডিজাইন ফাইনালাইজ হয়, ১৮৪৫ সালে নতুন ইমামবাড়া বানানো শুরু করা হয়। ২০ বছর সময় এবং সাড়ে আট লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি হয় আজকের এই ইমামবাড়া।

    ১৮৭৫ সালে এই আর্কিটেক্ট মারা যান।

    ইমামবাড়া মানে, ইমামের বাড়ি। মূল ফটকটি আজও কাঠের, বিশাল উঁচু। ভেতরে ঢুকলেই আজকাল দশ টাকার টিকিট কাটতে হচ্ছে, আগে হত না। শেষ যখন ইমামবাড়া দেখেছিলাম, তখন ইমামবাড়া সত্যিই নোংরা ছিল, অনেক গরীব বে-ঘর মুসলমান ফ্যামিলি বাচ্চাকাচ্চা নোংরা খাটিয়া ছেঁড়া কাঁথা সমেত এখানে সংসার করত। এখন আর সে সব নেই।

    ভেতরে এক সুবিশাল উঠোন, বা কোর্টইয়ার্ড, তার মাঝে একটি আয়তাকার চৌবাচ্চা। এক সময় ফোয়ারা চলত এতে, বহুকাল হল সে খারাপ। দেখবার মত হচ্ছে চৌবাচ্চার চারপাশে লোহার ফেন্সিং-এর কাজ, এবং লোহার গ্রিল বা ফেন্সিং-এর কাজ সারা ইমামবাড়া জুড়ে। চৌবাচ্চার যেদিকে মেন গেট, তার ঠিক বিপরীত দিকে হচ্ছে জরি-দালান, মূল উপাসনাঘর। বিশাল উঁচু ছাদ, খিলানগুলোর ওপরে রঙীন বেলজিয়ান কাঁচ বসানো। দেয়াল জুড়ে হাদিসের আয়াত লেখা আরবী ভাষায়। আর হ্যাঁ, উঁচু সিলিং থেকে ঝুলছে বিশাল বিশাল শ্যান্ডেলিয়ার, ঝাড়লণ্ঠন, বিভিন্ন রঙের, বেলজিয়ান কাঁচের।





    এর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলে, সামনেই গঙ্গা। ছোট্ট একটা সূর্যঘড়ি রয়েছে, আজও ঠিক সময় দেয়। ঘড়ির ডায়ালে খোদাই করা আছে সোকাল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যে ছটা - রোমান অক্ষরে। কারণ এর আগে পরে তো সূর্যঘড়ি কাজ করে না। আমরা যখন সূর্যঘড়ির সামনে ভূতোকে নিয়ে দাঁড়ালাম, তখন বাজছে ঠিক বারোটা। সূর্যঘড়ির ছায়া পড়েছে বারোর ঘরে।



    ঘড়ি আছে আরও একটা, সদর দরজার ঠিক ওপরে। দুদিকে দুটো মিনার, তার মাঝে একটা বড়সড় ঘড়ি। আজও সেটা সঠিক সময় দেয়।

    এই মিনারে উঠে ঘড়িতে দম দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে দুটি জোয়ান লোক এই টাওয়ারের ওপর উঠে হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে দম দেয় ঘড়িতে, আধঘণ্টা ধরে। কেন দুজন লাগে জানেন? দম দেবার চাবিটার ওজন হচ্ছে কুড়ি কেজি। ঘড়িটা লন্ডন থেকে M/s Black & Hurray Co থেকে ১১৭২১ টাকা নগদে কিনে এনেছিলেন কেরামত আলি, সেই ১৮৫২ সালে। কোম্পানির নামটা এই কারণে উল্লেখ করলাম, কারণ এই সেই কোম্পানি, যারা লন্ডনের বিগ বেন বানিয়েছিল। ৩০ টন, চল্লিশ টন আর আশি টনের তিনটে ঘন্টা আছে এই ক্লক টাওয়ারে। ছোট ঘন্টাটা পনেরো মিনিটে একবার বাজে, বড় ঘন্টাটা বাজে ঘন্টায় একবার।

    মিনারে ওঠা যায় এখন। দুদিকে দুটো টাওয়ার, প্রতি টাওয়ারে ১৫২টা ঘোরানো সিঁড়ি, সিমেন্টের। একটায় শুধু ছেলেদের প্রবেশ, একটায় মেয়েদের। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে গ্রিলের দরজার ফাঁক দিয়ে সেই ঘণ্টা, প্রকাণ্ড গীয়ার লিভার ইত্যাদি সমস্ত দেখা যায়।



    ইমামবাড়ার বিস্তারিত ইতিহাস লেখা আছে এইখানে - আরও অনেক ছবিসমেত।

    http://www.chitrolekha.com/V1/n3/04_Mohsin_Hooghly_Imambara.pdf

    =======================

    ইতিহাস থেকে ফিরে আসি বর্তমানে। ইমামবাড়ার ঠিক সামনেই একটা স্কুল আছে, অ্যাবট শিশু হল - এখানে সিকিনী ক্লাস সেভেন অবধি পড়েছিল। ইমামবাড়ার পুরো প্রপার্টির একপ্রান্তে এখন থাকে শ'খানেক মুসলিম পরিবার, ইমামবাড়ার পাঁচিলের বাইরে অবশ্য, অন্যদিকটা হুগলির জেলাশাসকের বাংলো। সুন্দর বাগানে ছাওয়া ব্রিটিশ স্থাপত্যের বিশাল বড় এস্টেট। জেলাশাসক বাংলোর সামনেই একটা ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ি, যেখানে এক সময়ে কাবলিওয়ালারা থাকত, এখন তারা কোথায় জানি না, বাড়িটা মনে হল অ্যাবানডনড হয়ে গেছে।

    আরেকটু এগিয়ে, রাস্তাটা তিন ভাগ হয়ে গেছে। ডানদিক জেলাশাসকের বাংলোর পাঁচিল বরাবর চলে গেছে গঙ্গার দিকে, সেখানে এখনও সকালে মাছ নিলাম হয়। সোজা রাস্তাটা চলে গেছে চকবাজার মোড়ের দিকে। এই দুই রাস্তার মাঝে যে মাঠটা, সেটা ব্র্যাঞ্চ ইশকুলের মাঠ। মাঠের প্রান্তে স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৩৪ সালে। প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তখনও জন্মান নি। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কিছুকাল এই স্কুলে পড়েছিলেন, পরে বিড়ি খাবার অপরাধে তাঁকে রাস্টিকেট করা হয়, তখন তিনি মামাবাড়ি ভাগলপুরে চলে যান।

    এই রাস্তার মোড়ে রয়েছে একটা মাদার ডেয়ারি, আমাদের সেই ছোটবেলা থেকে, তার পেছনেই যে সাদা রঙের দোতলা বাড়িটা - এখন অবশ্য আর সাদা নেই, মৈসে পড়ে কালচে হয়ে গেছে সর্বাঙ্গ, এইখানে থাকতেন নজরুল ইসলাম আর ধূমকেতু পত্রিকার মক্‌শো করতেন। মাঝে দু একবার রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন নজরুলের সঙ্গে আড্ডা মারতে।

    উল্টোদিকে হাঁটলে ইমামবাড়া অ্যাবট শিশু হল ছাড়িয়ে গঙ্গার পাড় বরাবর রাস্তা চলে গেছে চুঁচুড়ার দিকে। এ পথে প্রথমে পড়ে হুগলি জেল। নজরুল এখানে বন্দী ছিলেন, জেলের সামনের মাঠে এখন নজরুলের একটি মূর্তি রয়েছে। এসব গল্প আমি লিখেছি আগে - আমার "স্মৃতির সরণী বেয়ে" লেখাটায়।

    এই হল আমার মফস্‌সল, আমার টাউন। এখানটাতেই আমার বাসা, আমার বাড়ি।
    ঘুমোতে গেলেই কি ঘুম আসে? এটা প্রত্যেকবার আমার হয়, পরদিন ভোরে উঠে কোথাও বেরোবার থাকলে আমার রাতে ঘুম আসতে চায় না। ফল যদিও মারাত্মক হতে পারে, গাড়ি বা বাইক চালাতে চালাতে ঘুম পেয়ে যাওয়ার মত বাজে জিনিস খুব কমই হয় লং জার্নিতে – যেটা আমার হচ্ছিল লাদাখ থেকে ফেরার সময়ে, মনে হচ্ছিল, বাইক চালাতে চালাতেই ঘুমিয়ে পড়ব, মনে হচ্ছিল চারপাশের ট্র্যাফিকে কনসেনট্রেট করতে পারছি না। যদিও তার আগের রাতে ভালোই ঘুমিয়েছিলাম, ওই ঘুম-ঘুম ভাবটা সেবারে হয়েছিল অত্যধিক গরমের কারণে, শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছিল।

    তবে এবারে অতটা চাপ নেই। সঙ্গে দুজন যাবে – দুজনেই গাড়ি চালাতে জানে, যদিও এই লেভেলের লং ড্রাইভ কেউই করে নি এর আগে। সারাদিনে এরা চালিয়েছে ম্যাক্সিমাম একশো কিলোমিটার – ঐ লাদাখ যাবার আগে আমার যে রকম স্টেটাস ছিল আর কি। তফাৎটা হচ্ছে, সেই স্টেটাস নিয়েও আমি স্বপ্নটা দেখে গেছিলাম, এরা ঠিক সেই রকমের স্বপ্ন দেখা লোক নয়, জাস্ট আমার শুভানুধ্যায়ী আত্মীয়ের পাল্লায় পড়ে আমার সঙ্গী হচ্ছে আর কি। তবু, এক আধ ঘন্টা এদের কেউ ড্রাইভ করে দিলেই আমি ঘুমিয়ে নিতে পারব রাস্তায়।

    চাপ আরও একটি, একটি নয় – বেশ কয়েকটি, একজনকে তো আমি চিনিই না, জানি না সে কেমন লোক হবে, অন্যজন প্রায় চেন স্মোকার বললেও কম বলা হয়। এই বস্তুটি আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না – আমার পাশে বসে সিগারেট খাওয়া। কিন্তু আত্মীয়তার নাম বাবাজীবন – অনেক জিনিসই সইয়ে নিতে হবে; যাক, যা হয় দেখা যাবে, বলে পাশ ফিরলাম।

    এমনিতেই সিকিনীর সঙ্গে অল্প যুদ্ধ হয়েছে। বাড়ি থেকে এবার বেশ কিছু জিনিস যাচ্ছে – পোস্ত, মুসুর ডালের বড়ি, মোচা, রসগোল্লা, সন্দেশ। এর মধ্যে প্রায় সবকটাই সিকিনী আমার হাতে গছিয়ে দিতে চাইছিল, কারণ আমার গাড়িতে জায়গা আছে। সিকিনী ভূতোকে নিয়ে লাগেজ নিয়ে একা ট্রেনে ম্যানেজ করতে পারবে না। তো অনেক নেগোশিয়েশনের পরে রসগোল্লা-সন্দেশগুলো সিকিনীর হস্তগত করিয়েছি, কারণ, এক তো আমি পৌঁছবো দু দিনে, তায় সর্বক্ষণ গাড়িতে এসি চলবে না, ওয়েদার মনোরম, মিষ্টি খারাপ হয়ে যাবেই।

    ফেরাটা অনেক সময়েই বেশ কষ্টকর হয়, কারণ জাস্ট পাঁচদিন আগে যে রাস্তা দিয়ে এসেছি, সেই একই রাস্তা দিয়ে আবার ফেরত যাওয়া, খুবই ফ্রাস্ট্রেটিং অভিজ্ঞতা হয়। তাও – আমার সঙ্গে দুজন যাচ্ছে, তাদের তো এটাই প্রথম।

    মা নারকোল কুরিয়ে রেখেছে গোটাকয়, সেগুলো আমি নিয়ে যাবো, আপাতত কোরানো নারকোল ফ্রিজে রাখা আছে, কাল সকালে উঠে মনে করে ফ্রিজ থেকে বের করে নিয়ে ভরতে হবে।

    ব্যান্ডেলের থেকে শুনেছি বর্ধমানে পেট্রলের দাম কম। এখান থেকে পাঁচশো টাকার তেল ভরে নিয়ে যাবো, বর্ধমানে গিয়ে ট্যাঙ্ক ফুল করতে হবে।

    একটা মিষ্টি মিউজিক বাজছে। কোথায়? … মিউজিকটা আমি শুনেছি, কোথায় যেন … কোথায় যেন … আমার মোবাইলেই কি?

    ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ভোর পাঁচটা পঁচিশ। আমার মোবাইলে অ্যালার্ম বাজছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে, টেরই পাই নি! যাক, ঘুমটা মন্দ হয় নি। ফোনটা হাতে নিয়ে দু মিনিট শুয়ে রইলাম। গৌরব হিসেবমত এতক্ষণে ট্রেনে চেপে বসেছে। একবার ফোন করব? উঠেছে কি আদৌ? হাওড়া স্টেশনে কি পৌঁছেছে? গৌরব তো সাধারণত বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে বলে শুনি নি … নাঃ, থাক, ছটাতেই করব।

    টয়লেটে গেলাম, ফ্রেশ হলাম, দাঁত মাজলাম। ছটা বাজল। গৌরবকে ফোন করলাম। “আরে বোলো না, ছটা ছাব্বিশে ট্রেন, তার আগে কোনও ট্রেনই নেই – আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছি, ছটা ছাব্বিশের লোকালে বসব, সাড়ে সাতটায় তোমাদের বাড়ি।”

    সিরাজউদৌল্লাকে পলাশীর আমবাগান চেনাচ্ছো, মিস্টার ক্যালকেশিয়ান গৌরব? ছটা ছাব্বিশের আগে ব্যান্ডেলের জন্য ট্রেন নেই? ঢপটা অন্য কারুর জন্য রেখে দিলে পারতে, অফ অল পার্সনস, আমার সঙ্গে কেন মারতে গেলে? সকাল চারটের সময় হাওড়া থেকে ব্যান্ডেলের প্রথম লোকাল ছাড়ে। কিংবা তারও আগে।

    এসব, মুখে বলা যায় না। মনে মনেই বললাম, এবং ক্যালকুলেশন সারলাম, শুরুতেই একঘণ্টা লেট। সাড়ে সাতটায় ট্রেন ব্যান্ডেলে আসবে মানে – আমাদের বাড়ি এসে চা খেয়ে বেরোতে বেরোতে কিছু না হোক, সাড়ে আটটা। কত রাতে বারাণসী পৌঁছবো আজ, কে জানে।

    মা, গৌরব, স্টিফেন আর আমার জন্য ব্রেড-মাখন বানাবার তাল করছিল, আমি বারণ করলাম – শুধু চা করো, ব্রেকফাস্ট আমরা শক্তিগড়ে গিয়ে করব। ওখানে অজস্র ল্যাংচার দোকানের প্রায় প্রত্যেকটাই সকালবেলায় জম্পেশ মটরশুঁটির কচুরী আর ছোলার ডাল করে বলে শুনেছি। ওখানে পৌঁছেই পেটভরে খাবো – আর ল্যাংচার দিকে ভুলেও হাত বাড়াবো না।

    দিদি বলল, তোরা ভুল করেছিস – ওই লাইনে সব দোকানে ভালো ল্যাংচা বানায় না, অথেন্টিক একটাই দোকান আছে, গৌরব চেনে – ও এলে আমি বলে দেবো – সেইখানে গিয়ে ল্যাংচা খাস, বাকি সব ল্যাংচার দোকান ফেক, ওই একটাই জেনুইন। খেয়ে জানাস, কেমন লাগল।

    সুটকেস গোছানোই আছে, বাকি শেষমুহূর্তের যা প্যাকিং, সেগুলো সেরে গাড়ির দিকে এগোলাম, অন্তত লাগেজ ভরার কাজটা তো সেরে রাখি। ছটা কুড়ি বাজে। … আমাদের বাড়িতে আজও সকালে রেডিও চলে। আকাশবাণী কলকাতা। খবর শুরু হয়েছে, প্রথমেই বলল, প্যারিসে ভয়ঙ্কর আতঙ্কবাদী হামলা হয়ে গেছে।

    আমি সুটকেস ছেড়ে টিভি চালালাম, যা দেখলাম, তাতে … কী বলব, একটা অপরিসীম খারাপ খবর দিয়ে দিন শুরু হল। সুটকেস আবার হাতে নিয়ে এগোলাম গাড়ির দিকে। ডিকিতে ভরা হল সুটকেস। সামনের দিকে বাঁদিকের চাকার হাওয়াটা মনে হচ্ছে বেশ কম। পাংচার হল নাকি? কাল তো চন্দননগর বাঁশবেড়িয়া করেছি, রাস্তা একটু খারাপ ছিল বটে, এমন কিছু খারাপ তো নয়! যাক গে – পরে দেখা যাবে। পাংচার নয় বলেই মনে হচ্ছে, বাকি তিনটে চাকার থেকে সামান্য হাওয়া কম।

    সাতটা চল্লিশে গৌরব আর স্টিফেন এসে পৌঁছল, চা-বিস্কুট খেয়ে টেয়ে, সবাইকে টা-টা করে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। ঘড়িতে সময় সকাল আটটা পনেরো। সিকিনী আর ভূতো দুপুরে বেরোবে খেয়ে দেয়ে, বাবা ওদের পৌঁছে দেবে হাওড়া স্টেশনে। ওদের ট্রেন বিকেল চারটে পঞ্চান্নয় ছাড়বে।

    প্রথমে একটা পেট্রল পাম্পে ঢোকা হল, কিন্তু ওদের হাওয়া মেশিন খারাপ, এর পরে রাস্তার ধারে আরেকটা দোকান, সেখানে মেশিন আছে, কিন্তু লোকটা নেই, তার বউ বসে দোকান সামলাচ্ছে। কী আর করা, আমরাই বসে পাইপ নিয়ে চাকায় হাওয়া ভরে নিলাম। মনে হল, ঠিকই আছে। আবার স্টার্ট করলাম।

    পুরনো জিটি রোডই নিলাম – যে রাস্তা দিয়ে এসেছি। এখন দিনের বেলা, খানাখন্দ দেখতে অসুবিধে হবার কথা নয়। … খুব অসুবিধে হলও না। সময় লাগল বটে সোয়া ঘন্টা, নটা চল্লিশ নাগাদ আমরা শক্তিগড়ে পৌঁছে গেলাম। গৌরব আমাকে বলল গাড়ি থামাতে একটা দোকানের সামনে – তার নাম আদি ল্যাংচা হাট।

    আহা, কিছু খেলাম। কচুরী আর ছোলার ডাল। কতগুলো কচুরী যে খেলাম, আর গুণি নি। এইবারে আসল টেস্ট – গৌরব বলল, ল্যাংচা খাবে তো?

    আমি কী বলব, ভেবে ওঠার আগেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, হ্যাঁ।

    একটা করে ল্যাংচা পড়ল আমাদের থালায়। খেলাম। সত্যি বলছি, এবারেও ভালো লাগল না। আমাদের বালির মোড়ের সুইটস সেন্টারে এর চেয়ে ঢেরগুণ ভালো ল্যাংচা পাওয়া যায়। এ কী টেস্ট? রসে চোবানো না জলে চোবানো বোঝাই যাচ্ছে না। ভাগ্যিস খানিক ছোলার ডাল বাঁচিয়ে রেখেছিলাম, সেইটা খেয়ে আবার মুখের টেস্ট ফেরালাম। দশটা কুড়িতে আবার গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে একবার চাকাটা দেখে নিলাম, না একদম ঠিক আছে। বোধ হয় হাওয়াই কমে গেছিল। এখন আর কোনও সমস্যা নেই।

    গৌরব বসল স্টিয়ারিং-এ, আমি পাশের সীটে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে চলল আরও কিছুক্ষণ, বর্ধমান ছাড়িয়ে।






    শক্তিগড়েও তেমন ট্রাফিক পেলাম না, সুন্দর পেরিয়ে গেলাম। গৌরবকে বলে দিয়েছিলাম স্পিড যেন একশো টাচ না করে, তা হলে গাড়ি ভাইব্রেট করবে, যত ভালো রাস্তাই হোক, নব্বইয়ের মধ্যে যেন চালায়। গৌরব সেইমতই চালাতে লাগল।



    দুর্গাপুরের রাস্তা

    একে একে পেরিয়ে গেল দুর্গাপুর, রাণীগঞ্জ, আসানসোল। আসানসোলে তেল ভরে নিলাম ট্যাঙ্ক ফুল করে। এখানে রাস্তা মোটেই ভালো নয়, জায়গায় জায়গায় ডাইভার্সন, যাই হোক, এক সময়ে দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার।

    গাড়ি নিজে না চালালে ক্যামেরাটা হাতে পাওয়া যায়, দু চারটে ছবি তোলা যায়।


    ঝাড়খণ্ডে ঢোকার একটু পরেই রাস্তাটা সুন্দর হয়ে গেল। ধানবাদ এসে গেল তার পরেই।


    ধানবাদের রাস্তা


    ঢেউখেলানো, উঁচুনিচু, ছোটনাগপুরের মালভূমি

    এর পরে পেরিয়ে এলাম তোপচাঁচির সেই সব তলোয়ারের দোকানগুলো, গৌরব আর স্টিফেন তো এসবের গল্প শোনে নি এর আগে। সারি সারি ঢালতলোয়ারের দোকান দেখে দুজনেই খুব উত্তেজিত। গৌরব তো একবার বলল গাড়ি দাঁড় করিয়ে একবার দর করে আসবে। অনেক কষ্টে তাকে নিরস্ত করলাম।

    আমি নজর রাখছি ট্রিপ মিটারের দিকে – ঠিক সাড়ে তিনশো কিলোমিটারের মাথায় পড়বে গিরিডির সেই অশোকা রিসর্ট। ওখানেই লাঞ্চ করব।

    অশোকা রিসর্ট পৌঁছলাম – তখন প্রায় তিনটে বাজে। গাড়ি ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে নিলাম পার্কিং-এর দিকে। গাড়ি থেকে নেমে বেরোতে যেতেই চোখ পড়ল সামনের বাঁদিকের চাকায়, আর দেখামাত্রই আমার মাথায় হাত!

    একেবারে বসে গেছে চাকা। একফোঁটা হাওয়া নেই।

    যে ভয়টাকে এতক্ষণ দূরে সরিয়ে রাখছিলাম, ইগনোর করছিলাম জোর করে, সেইটাই হল, কারণ এই পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত নই। ওভারকনফিডেন্স বলুন কিংবা ভুলোমনা – আমি আসার আগে আমার গাড়ির টুলকিট-টি বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছি। ডিকিতে যদিও একটি স্টেপনি আছে, অক্ষত, কিন্তু সঙ্গে না আছে জ্যাক, না আছে স্ক্রু-রেঞ্চ। এখন কী উপায়? হোটেলে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, কাছাকাছি “পাংচার শপ” কোথায় আছে – ওরা বলল, দু কিলোমিটার আগে পেয়ে যাবো। এখন, গাড়ি তো অতদূর টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে না, হাওয়াবিহীনভাবে এতটা এল কী করে সেটা ভেবেই আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছি, গৌরবই বলল, মনে হচ্ছে এটা সকালের কেস নয়। সকালে পাংচার ছিল না, পাংচার হয়েছে খুব রিসেন্টলি, রাস্তায় কোথাও। নইলে এইভাবে একেবারে হাওয়া নেই, অথচ নব্বইয়ের স্পিডে আমরা আসছি – এটা জাস্ট হতে পারে না। টের পেতামই। এটা এই রিসর্টে ঢোকার মুখেই হয়েছে।

    তাই হবে। সেটুকু ভেবে সান্ত্বনা পেলেও, এখন উপায় কী? টুলকিট চাই যে!

    রিসেপশনে কথা বললাম, ওরা বলল, এখানে আরও তিন চারটে গাড়ি আছে, কারুর না কারুর গাড়ি থেকে জ্যাক আর টুল জোগাড় হয়ে যাবে, আপনারা আরাম করে খাওয়া দাওয়া করুন, আমরা দেখছি।

    আস্বস্ত হয়ে খেতে ঢুকলাম। রুটি, চিকেন কালিয়া আর কী যেন – খিদেও পেয়েছিল খুব। খেয়েদেয়ে উঠে শুনি তারা খোঁজই নেয় নি, যেমন হয় আর কি। একটি গাড়ির ড্রাইভার সামনে ছিল – সে মানা করে দিল, তার কাছে টুল নেই। এর পরে “দাদা দেখুন্না দাদা দেখুন্না” করতে করতে পাওয়া গেল একটি ছেলেকে, অশোকা রিসর্টেরই একটা মারুতি ভ্যান, বাইরে দাঁড় করানো ছিল, তার ড্রাইভার। সে চাবি নিয়ে চলল আমাদের জ্যাক আর টুলকিট দেবে বলে।

    প্রচুর ধ্বস্তাধস্তি করেও ভ্যানের ডিকি খোলা গেল না। অতঃপর পাশের দরজা খুলে তার সিটের নিচে মুন্ডূ গলিয়ে যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে আমাদের হাতে দিল।

    স্টেপনি ছিলই, এটা অবশ্য টিউবলেস নয়, তবে যেমনই হোক, একেবারে আনইউজড টায়ার। মানে, এর আগে আমার পাংচার হয়েছে, কিন্তু শহরের মধ্যে, তাই স্টেপনি লাগাবার দরকার কখনও পড়ে নি। কাছেই পাংচার শপ পেয়ে গেছি, সারিয়ে নিয়েছি। স্টেপনি এই প্রথম লাগল।



    খানিক সময় নষ্ট হল – তবু ঝটপট চাকা বদলে আমরা এগোলাম, এইবারে স্টিফেন নিল স্টিয়ারিং। একটু এগিয়ে একটা পেট্রল পাম্পের সাথে একটা পাংচার সারাইয়ের দোকান পেলাম, সেখানে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চাকাটা আবার ডিকি থেকে বের করে সারিয়ে নিলাম, বেশ বড়সড় একটা ফুটো হয়েছিল। টিউবলেস টায়ারে ফুটো বোজানো বেশ সহজ কাজ, পাংচার কিটটা থাকলেই হয়।

    মুখ বুজে থাকা ছাড়া এখন গত্যন্তর নেই, কারণ দোষ সম্পূর্ণ আমারই। স্টিফেন বেশ কয়েকবার হাসতে হাসতে আমাকে বলল, এমন কাজ কেউ করে? কিট না নিয়ে এত লম্বা জার্নিতে …? মনে মনে কত গালাগাল দিয়েছিল, সে আমি সম্যক বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বলার কিছু নেই, এরা দুজন না থাকলে কী হত, সে আর আমি ভেবে উঠতে পারছি না তখন।

    লিক সারিয়ে হাওয়া ভরে সেটাকে আবার ডিকিতে ভরে – এইবারে ঝড়ের গতিতে এগোতে থাকলাম। স্টিফেন গৌরবের থেকেও পাকা ড্রাইভার, খুব স্মুথ চালাচ্ছে গাড়ি, এইবারে একটা অদ্ভূত জিনিস খেয়াল করলাম, গাড়ির স্পিড একশো টাচ করল, একশো পাঁচ-দশ, গাড়ি একটুও ভাইব্রেট করছে না আর। … তা হলে কি আগের চাকাটাতেই কোনও সমস্যা ছিল? প্রথম থেকেই সমস্যা ছিল?

    সন্ধ্যে সাড়ে সাতটাতেও আমরা ঝাড়খণ্ড পেরোতে পারলাম না, এর পরে পড়ে আছে পুরো বিহার। হাজারিবাগের কোথাও একটা ধাবায় আমরা ছোট হল্ট দিলাম, একটু চা-চিপস খেয়ে আবার দৌড় শুরু – এবারে গৌরব চালক।

    মোটামুটি আটটার পরে বিহারে ঢুকলাম, নটা কুড়িতে ডেহরি অন শোন। বারাণসী যখন আর আশি কিলোমিটার, তখন আবার গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করতে ঢুকলাম একটা পাম্পে। রাত তখন পৌনে দশটা। গৌরবকে বললাম, বারাণসী যখনই দেখবে আর পঁচিশ কিলোমিটার লেখা আছে, আমাকে চালাতে দিও – কারণ তোমরা ওই হোটেল খুঁজে পাবে না, আমি একবার এই রাস্তা দিয়ে গেছি, আমি চিনতে পারব।

    বিহার বর্ডার ক্রস করেই গৌরব আমাকে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিল, আমি খানিক গুগল ম্যাপ দেখে খানিক একে তাকে জিজ্ঞেস করে এগোতে থাকলাম। মুঘলসরাই জংশনের পাশ দিয়ে গেলাম, লম্বা একটা ব্রিজ দিয়ে গঙ্গা পেরোলাম। এইবারে এক চান্সে ঢুকে গেলাম রাহী ট্যুরিস্ট বাংলোয়। পৌনে এগারোটা।

    সরকারী হোটেল তাই ডাইনিং হল বন্ধ। সামনেই বারাণসী ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন, জমজমাট এলাকা, অসংখ্য হোটেল। সেখানে গিয়ে খাবার প্যাক করিয়ে আনলাম। গৌরব আর স্টিফেনের জন্য একটা রুম বুক করা হল, মাত্র আটশো টাকায় ডবল বেডরুম বুক হয়ে গেল।

    খেয়েদেয়ে শোয়ামাত্র ঘুমে তলিয়ে গেলাম, অবশ্য, পাঁচটায় অ্যালার্ম দিতে ভুলি নি। কালকের জার্নিটাই বড় – আটশো কিলোমিটার। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেরোতেই হবে। এখানে খাবার পাওয়া যাবে না; রাস্তায় খেয়ে নেওয়া যাবে।
    পর্ব সাত
    -------------

    ** ওপরের লেখার শুরুতে লিখতে ভুলে গেছিলাম। এট সপ্তম পর্ব।
    পর্ব ৮
    ---------

    ঘটনাবহুল! ইভেন্টফুল! সাসপেন্স! –

    শেষদিন যে ভাবে আমরা বারাণসী থেকে বাড়ি পৌঁছলাম, তাকে এক কথায় বা এক দু’শব্দে কীভাবে বিবৃত করা যায়, তারই চেষ্টা করছিলাম আর কি।

    এক সপ্তাহের কলকাতা ট্রিপের আজ শেষ দিন। সব ঠিকঠাক চললে আজ সন্ধ্যের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছনোর কথা। আটশো কিলোমিটার, একই রাস্তা দিয়ে ফেরা, তায় আজ পুরো দিনটা শুধু উত্তরপ্রদেশ আর উত্তরপ্রদেশের ওপর দিয়ে ফেরা। সীনিক বিউটি বলতে প্রায় কিছু নেই, অন্তত বিহার-ঝাড়খণ্ডের তুলনায়। অসম্ভব বোরিং হবার কথা, তাই প্রথম থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আজ বেশি ড্রাইভিং-এর চাপ নেব না। দুজন তো সঙ্গে রয়েইছে, ম্যানেজ হয়ে যাবে।

    গৌরব আর স্টিফেন বলে দিয়েছিল সকাল পাঁচটায় একবার কল করে নিতে। ওদের ঘরটা আমার ঘর থেকে তিনটে ঘর পরে। ঠিক পাঁচটায় উঠে পড়লাম, পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিটে কল করলাম। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম – ওরা শুধু উঠে পড়েছে তা-ই নয়, রেডি-ও হচ্ছে। গৌরব এর মধ্যেই দুটো সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। এই সিগারেটটা না হলেই আমার সমস্যা থাকত না – কাল সারাদিন বড় জ্বালিয়েছে গাড়ির ভেতরে সেই সিগারেটসেবন।

    আমিও রেডি হলাম। সাড়ে পাঁচটায় ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি গৌরব আর স্টিফেনও বেরোচ্ছে। ঝটপট চেক আউট করে নিলাম – পেমেন্ট তো করাই ছিল। গাড়িও কাল একদম গেটের সামনে পার্ক করেছিলাম। টুকটাক লাগেজ যেটুকু বের করেছিলাম, সেগুলো ঢোকালাম, এবং ঠিক পৌনে ছটায় গাড়ি স্টার্ট দিলাম।

    বারাণসী কখনও ঘুমোয় না, বিশেষত স্টেশনচত্বর তো ভারতের কোনো এলাকাতেই ঘুমোয় না। তবে অন্য সময়ের তুলনায় ট্র্যাফিক কম এই মুহূর্তে। ঝটপট নেভিগেশন দেখে শহরের বাইরে বেরিয়ে এন এইচ টু-তে উঠে পড়লাম। স্টিফেন বলল, আমাকে চালাতে দে (বয়েস জানি না – তবে আমার থেকে একটু বড়ই হবে, যাই হোক, অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত লোকেদের মুখে তুইতোকারি শুনলে আমার বেজায় মটকা গরম হয়ে যায়, কিন্তু আপাতত সহ্য করে যেতে হবে)। দিলাম। স্টিফেন সত্যিই চালায় ভালো। অচিরেই দেখলাম স্পিডোমিটারের কাঁটা একশো ছুঁয়ে ফেলল। খানিক পরেই একশো দশ।

    সামনে বোধ হয় কোনও ট্রাকের বস্তার ছ্যাঁদা থেকে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে একমুঠো কোনও দানাশস্য। ভোরের মুখে একগাদা পায়রা শালিখ উড়ে এসে সেখান থেকে খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করছে। সকালবেলার ন্যাশনাল হাইওয়েতে গাড়িঘোড়াও কম, কখনও ক্কচিৎ একটা দুটো ট্রাক চলেছে গদাইলশকরি চালে, ফলে পাখিগুলো কিঞ্চিত রিল্যাক্সড। কিন্তু এত সকালে একশো দশ পনেরোর স্পিডে ছুটে আসা একটা ওয়্যাগনআরকে তারা এক্সপেক্ট করে নি, ঝটপট করে উড়ে গেল ঠিকই, তবে একটা পাখি, পায়রা না শালিখ কে জানে, সজোরে হিট করল আমার গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে। … পাখির ধাক্কায় উইন্ডস্ক্রিনের ক্ষতি হবার কথা নয়, হয়ও নি, তবে পাখিটা বোধ হয় ওই ধাক্কার পরে বাঁচে নি। বাঁচবার কথা নয়।

    আমাদেরও পাখিকে ধাক্কা মারার পরে গাড়ি থামাবার কথা নয়, তাই থামানো হল না। গাড়ি আর হাইস্পিডে কাঁপছে না, রাস্তাও বিলকুল খালি, এই অবস্থায় যদি একটু হাইস্পিডে চালিয়ে নেওয়া যায় – তা হলে অনেকটা টাইম সেভ হয়। আটশো কিলোমিটার তো মুখের কথা নয়!

    বারাণসী তখন আটান্ন কিলোমিটার পেছনে ফেলে এসেছি, সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে এলাহাবাদ বাইপাসের হাতছানি, ঠিক তখনই ঘটল দ্বিতীয় ঘটনাটা।

    সকাল সাড়ে ছটা। হাইওয়ের দুপাশের জনপদ জেগে উঠছে, একটা দুটো সাইকেল বা মোটরসাইকেল দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে বিস্কুটের লোভে মালিকের হাতের দিকে লাফিয়ে উঠছে আপাত-পোষা কুকুরেরা। হঠাৎই, একটা লোক, তার হাতের বিস্কুটটা নিয়ে কুকুরের মুখে নাচাতে নাচাতে ছুঁড়ে ফেলল রাস্তায় – আমরা তখন সেইখান থেকে ঠিক দুশো মিটার দূরে। বিস্কুটের লোভে দৌড়ে এল কুকুর, কিন্তু সে আমাদের গাড়িটাকে খেয়াল করে নি, যতক্ষণে করল, তখন আর কিছু করার ছিল না, কিছু করার ছিল না আমাদেরও, একশো দশ কিলোমিটার স্পিডের থেকে এক সেকেন্ডে গাড়ি থামাতে গেলে আমরাই উলটে যেতাম। … দড়াম করে একটা শব্দ, গাড়িতে একটা হাল্কা জার্ক – আমি পাশের সীটে বসে ছিলাম, শেষ যেটুকু দেখতে পেলাম, কুকুরটা প্রচণ্ড জোরে পালটি খেতে খেতে রাস্তার পাশের ঝোপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তীরবেগে – তার দুচোখে কেমন একটা অবিশ্বাস … আর দেখা গেল না, আমরা অনেক দূরে এগিয়ে এসেছি।

    আরও দু তিন কিলোমিটার এগনোর পরে, গাড়ি থামানো হল। একবার গাড়ির সামনেটা চেক করে নেওয়া দরকার। কুকুর তো পায়রার মত হালকা প্রাণী নয়।

    নামলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি, তাই। সামনের বাম্পারের বাঁদিকটা, বনেটের থেকে লুজ হয়ে একটু নিচু হয়ে ঝুলছে। যে ক্লিপ দিয়ে ওটাকে সমানভাবে বনেটের সাথে আটকে রাখা হয়, বাঁদিকে কয়েকটা ক্লিপ ভেঙে গেছে। আর সামনের নাম্বারপ্লেটটা বেঁকে গেছে।

    গৌরব কোনওরকমে বাম্পারটাকে বনেটের সাথে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করল, মনে হল টেম্পোরারিলি লেগে গেছে। খারাপ লাগছিল, লাগারই কথা। বাড়ি থেকে বেরোবার মুহূর্তে আমি নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কোনও অবস্থাতেই একশোর ওপরে স্পিড ওঠাবো না, আমি ওঠাই নি, কিন্তু অন্যকে দিয়ে সেই প্রতিজ্ঞা করানো তো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এতদিন গাড়ি চালাচ্ছি, কখনও আমার গাড়িতে কুকুর ইত্যাদি চাপা পড়ে নি – অ্যাক্সিডেন্ট দেখেছি, চোখের সামনে স্পট ডেথ দেখেছি, রক্তের পুকুরে শুয়ে অ্যাক্সিডেন্ট ভিক্টিমকে শেষ ছটফট করতেও দেখেছি একবার, কিন্তু তবু, তবু … আমার নিজের হাতে কখনও হয় নি এ সব।

    হয় তো স্টিফেনেরও হয় নি কখনও, এইই প্রথম। ও-ও একটু অপরাধ বোধ করছিল। যাই হোক – আবার গাড়িতে বসলাম, স্টিফেনকে বললাম, দ্যাখো – যদি একশোর মধ্যে চালানো যায়, চাপ তো নেই, আমরা বাড়িই যাচ্ছি, যত রাত হোক, পৌঁছে তো জাস্ট ঘুমনো। তাড়াহুড়ো কোরো না।

    গাড়ি, আসলে মানুষের মতই। যত্ন করলে যেমন বোঝে, মিসহ্যান্ডল করলেও বোঝে। খানিক সময়ের মধ্যেই আমরা এসে পৌঁছলাম এলাহাবাদ বাইপাসের সামনে। আশি কিলোমিটার লম্বা বাইপাস চলে গেছে এলাহাবাদ শহরের বাইরে দিয়ে। আরেকটা এক্সপ্রেসওয়ে। কংক্রিটের রাস্তা এঁকেবেঁকে ঢেউ খেলিয়ে চলেছে।

    প্রায় অনেকটা পেরিয়ে আসার পরে – স্টিফেন তখনও স্টিয়ারিং-এ – ধীরে ধীরে দেখেছি স্পিড আবার বেড়ে গেছে, আসলে রাস্তা এত ভালো, কন্ট্রোলে রাখা খুব চাপ হয়ে দাঁড়ায়, হঠাৎ – “ফ্যাট্যাফ্যাট্যাফ্যাট্যাং” করে একটা তীব্র আওয়াজ, আর আমি পাশের সীট থেকে দেখলাম গাড়ির তলা থেকে লম্বাটে কালো রং-এর কী একটা যেন উড়ে বেরিয়ে গেল, হাওয়া হয়ে গেল পাশের ঝোপজঙ্গলে। … গাড়ি তখনও স্মুথ চলছে, কিন্তু স্পিড কমিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পেরিয়ে গেছি আরও দুতিনশো মিটার, ততক্ষণে।

    নেমে দেখি, চিত্তির কেস। সেই সামনের বাঁদিকের টায়ার। স্টেপনি থেকে খুলে যেটাকে লাগানো হয়েছিল। গরম হয়ে, নাকি দীর্ঘদিনের অব্যবহারের ফলে – কী হয়েছিল কে জানে, অর্ধেক টায়ারের ওপরের রাবারের আস্তরণ খুলে বেরিয়ে গেছে, ভেতরের তারজালি বেরিয়ে এসেছে।


    হাওয়া কমে নি, কারণ এটা টিউবওলা পুরনো টায়ার, হাওয়া তো রয়েছে টিউবে, কিন্তু এই টায়ার নিয়ে আর এগনো সম্ভব নয়। আবার পাল্টাতে হবে। কালকে আগের টায়ারটার লিক সারিয়ে স্টেপনিতে রাখা হয়েছিল, লেগে যাবে আবার – কিন্তু লজিস্টিকাল প্রবলেম সেই এক – টুলকিট নেই। … কালকে অশোক রিসর্টে ছিলাম, যে করে হোক ব্যবস্থা হয়ে গেছিল, এখন এই জনমানবশূন্য এলাহাবাদ বাইপাসে কীভাবে টায়ার বদলাবো?

    গৌরবের মাথাতেই প্রথম বুদ্ধি এল, সাথে সাথে আমার মাথাতেও – আমরা তো এখন এক্সপ্রেসওয়েতে আছি – টোল রোড, টোলের যে স্লিপটা রয়েছে, ওতেই হেল্পলাইন নম্বর লেখা আছে। একবার ফোন করে দেখলে কেমন হয়?

    টোলের স্লিপ থেকে চোখ সরিয়ে দেখি ঠিক আমাদের সামনেই রাস্তার মাঝে ডিভাইডারে একটা বোর্ড, তাতে একটা হেল্পলাইন মোবাইল নম্বর লেখা, এবং কী আশ্চর্য, দুটোই এক নাম্বার। লাগানো যাক তা হলে।

    লাগালাম নম্বর। রিং হল, কেউ ফোনও তুলল। বললাম, এই ব্যাপার। অন্যপ্রান্তের লোকটি জিজ্ঞেস করল – আপনারা এক্স্যাক্টলি কোথায় আছেন? … এইবার হল মুশকিল, চারদিক ধূ-ধূ ফাঁকা, কোনও ল্যান্ডমার্কও নেই, কীভাবে বোঝাবো কোন জায়গায় আছি? তখনই চোখে পড়ল, আমাদের গাড়ি থেকে দশ বারো পা দূরে একটা মাইলস্টোন। দৌড়ে গেলাম ফোন কানে রেখে, দেখি লেখা আছে, দিল্লি ৬৪৯ কিলোমিটার। সেটাই বললাম। ওরা বলল, মাইলস্টোনের সামনাসামনি দাঁড়ান, দেখুন সাইডে একটা নম্বর লেখা আছে, সেইটা বলুন। দেখি মাইলস্টোনের সাইডেও লেখা আছে 649। বললাম। লোকটা বলল, এখন তো আমাদের শিফট চেঞ্জ হচ্ছে, আমি নোট করে নিচ্ছি, রিকভারি ভ্যান পৌঁছে যাবে, কিন্তু দশ মিনিট দেরি হবে। পরের শিফটের লোকজন এসে গেছে, ওরা টেকওভার করলেই গাড়ি বেরোবে। দশ মিনিট অপেক্ষা করুন।

    ঘড়ি দেখলাম, পৌনে আটটা বাজছে। শিফট চেঞ্জের চক্কর দশ মিনিটে শেষ হবে না – সে জানি। তবু, খুব দেরি হয় নি এখনও, অপেক্ষা করা যেতেই পারে, ইন ফ্যাক্ট অপেক্ষা না করে কিছু করারও নেই, এই এক্সপ্রেসওয়েতে মানুষজন বাড়িঘর কিচ্ছু নেই আশেপাশে, পাংচার শপ তো পরের কথা।

    দু চারটে চলন্ত গাড়িকে হাত দেখালাম, ন্যাচারালি কেউই থামল না, আমাকে হাত দেখালে এই নির্জন রাস্তায় আমিও থামতাম না।

    আটটা বাজল। কারুর পাত্তা নেই। ফোন করব আরেকবার? … থাক। আরও পাঁচ মিনিট যাক।

    একটা লোক কোথা থেকে এল সাইকেল নিয়ে। কাছাকাছি কোনও গ্রামের লোক হবে। জিজ্ঞেস করলাম – আগে কোনও পাংচার শপ আছে কিনা। লোকটা খানিক ভেবে বলল, সিধা চলে যাও, এক পুল আয়েগা, পুল কে নিচে গাড়ি রাখকে প্যায়দল চলে জানা বাঁয়ে কে তরফ – এক গাঁও মিলেগা। উস গাঁও মে এক পেংচারবালা ব্যায়ঠা হুয়া হ্যায়। মুশকিল সে দো কিলোমিটার হোগা।

    যেভাবে সে বিবরণ দিল, আমরা কেউই সাহস পেলাম না। এদ্বের দু কিলোমিটারের হিসেব আমাদের সাথে ম্যাচ না-ও করতে পারে।

    আটটা পাঁচ। আবার ফোন করলাম হেল্পলাইনে – এবার অন্য লোক তুলল। বললাম সমস্ত, বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, রিপোর্ট পেয়েছি, ড্রাইভার জাস্ট এসেছে, আর দু মিনিটের মধ্যে স্টার্ট দেবে। এসে যাবে।

    আটটা কুড়ি। পঁয়ত্রিশ মিনিট হয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছি গৌরব আর স্টিফেন মিলে আমায় মনে মনে খুব খুব খিস্তি করছে, কিন্তু মুখে কেউই কিছু বলছে না।

    কংক্রিটের রাস্তা, ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, খুব ঘন খাঁজকাটা। টায়ারের সাথে ঘর্ষণ হয় বেশিমাত্রায়, টায়ার গরম হয়ে যায়। আমার এই টায়ারটা, সম্ভবত সেই ২০০৬ সালে গাড়ি কেনার দিন থেকেই স্টেপনিতে পড়ে ছিল, কখনও বের হয় নি। পড়ে থেকে থেকে রাবার শক্ত হয়ে গেছে, ভেতরের তারজালির বাঁধন থেকে আলাগা হয়ে গেছে ফ্রিকশনের চোটে। কাল টায়ার পাল্টাবার পর থেকে এই প্রথম কংক্রিটের রাস্তায় চালানো হয়েছে।

    ঠিক আটটা পঁচিশে একটা রিকভারি ভ্যান এসে থামল উল্টোদিকের রাস্তায়, সাতজন লোক নেমে এল। সমস্যাটা ভালো করে বুঝে নিয়ে আবার একজন দৌড়ে গেল ভ্যানের দিকে, জ্যাক রেঞ্চ সমস্ত নামিয়ে নিয়ে এল। দশ মিনিটে চাকা পালটানো হয়ে গেল। একটা লোক গাড়ির ফটো নিল, চাকার ফটো নিল, আমাকে দিয়ে লগবুকে সই করাল, এবং একটি পয়সাও না নিয়ে চলে গেল।

    ডিকির পেছন থেকে দেখি, স্টিফেন আমাকে হাতছানি দিয়ে দেখাচ্ছে, হাসতে হাসতে। গেলাম, আমার দিকে তাকিয়ে ডিকির ভেতরে হাত দেখিয়ে বলল, এটা কী? অ্যাঁ? এটা কী?

    ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ডিকির একদম ভেতর দিকে একটা খাঁজের মধ্যে একটা জিনিস রাখা। বের করে দেখি, স্ক্রু-জ্যাক। বোঝো কাণ্ড! আমার গাড়িতেই ছিল, আমি ন’ বছরেও জানতাম না? এমন জায়গায় ছিল, কোনওদিন খেয়াল করি নি। ড্যামেজড টায়ারটা স্টেপনিতে ঢোকাতে গিয়ে স্টিফেন দেখতে পেয়েছে।

    বেজায় লজ্জার ব্যাপার। কতখানি আনপড় লোক আমি মাইরি! নিজের গাড়িতে কী আছে, নিজেই জানতাম না! অবশ্য শুধু স্ক্রু-জ্যাক থেকেও লাভ নেই, অন্য টুলগুলো, রেঞ্চ ইত্যাদি তো বাড়িতে ফেলে রেখেই এসেছি। লোক ডাকতেই হত। যাক, কী আর করা। পুরনো চাকাটাই আবার লাগিয়ে দিয়েছে, সেটা কাল লিক হয়েছিল, লিক সারিয়ে হাওয়া ভরে রাখা ছিল। আবার যে লিক হবে না, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। তাই, সাবধানে চালাতেই হবে। স্টিফেন দেখলাম, পরপর এতগুলো ঘটনায় বেশ ব্যোমকে গেছে, আমাকে বলল, আমি আর চালাব না এখন, তুই চালা একটু।

    আমি স্টিয়ারিং-এ বসলাম। একবার স্পিড বাড়িয়ে দেখলাম, একশো ছুঁলেই সেই গাড়ির ভাইব্রেশন আবার ফিরে এসেছে। তার মানে এই টায়ারটা ডিফেক্টিভ। যাক, আর একশোর ওপরে একদম ওঠা নয়। পৌনে নটায় স্টার্ট করলাম।

    সাড়ে নটায় এলাহাবাদ বাইপাস শেষ হল, যথারীতি আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গার দু কিলোমিটার কেন, দশ কিলোমিটার পরেও না কোনও গ্রাম দেখেছি, না কোনও “পাংচার শপ”। দোকান দেখলাম একেবারে বাইপাস শেষ হবার পরে। জঘন্য চা, নট-সো-জঘন্য জিলিপি আর পাটপাতার পকোড়া দিয়ে জলযোগ সারলাম। ধীরে ধীরে পেরোতে থাকলাম একের পর এক এলাকা। এইবারে রাস্তায় আস্তে আস্তে ট্র্যাফিক বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উল্টোদিক থেকে আসা বেপরোয়া গাড়ির সংখ্যা। সব রকমের গাড়ি, মোটরসাইকেল, সাইকেল, মিনি-ট্রাক, ট্রাক্টর – নির্বিকারভাবে কেউ রাস্তার মাঝখান দিয়ে, কেউ ডানদিক ঘেঁষে, কেউ বাঁদিক ঘেঁষে, একেক সময়ে, একে গ্রামের কাছে একেক রকমের অভিজ্ঞতা। একশোর মধ্যে স্পিড থাকলে তবেই এসব ডজ করে করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

    একসময়ে কানপুর এল। শহরের ওপর দিয়ে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার লম্বা ফ্লাইওভার পেরিয়ে আমরা আবার নিচের রাস্তায় নামলাম।


    অনেকটা যাবার পরে, প্রায় তখন বেলা সাড়ে এগারোটা, একটা জায়গায় দাঁড়াতে হল।

    সামনে সারিসারি গাড়ির লাইন, যতদূর চোখ যায়। হয় তো সামনে কোনও টোল আছে, কম গেট খোলা, তাই লম্বা লাইন পড়েছে। আমরাও লাইনের শেষে দাঁড়ালাম।

    প্রায় আধঘন্টা কেটে যাবার পরেও যখন লাইন এগলো না, তখন কেমন সন্দেহ জাগল। আশপাশের সমস্ত গাড়ির ড্রাইভাররাই উশখুশ করছে, কেউই কিছু জানে না। গৌরব একটু এগিয়ে গেল খোঁজ নিতে। আমি ক্যামেরা নিয়ে দুটো ছবি তুললাম। কোন জায়গা, কে জানে!


    গৌরব ফিরল আরও দশ মিনিট পরে, বলল, বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হাই ভোল্টেজ তার ছিঁড়ে পড়েছে একটা ট্রাকের ওপর, ট্রাক জ্বলেপুড়ে খাক, সঙ্গে পুড়ে গেছে সাতজন লোক। ডেডবডি নামিয়ে রাখা আছে রাস্তার ওপর, পুলিশ এসেছে।

    সব্বোনাশ করেছে। এ জ্যাম তো কখন ছাড়বে, কেউ জানে না। একজন লোকাল লোক সেইসময়ে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, সে সবাইকে বলতে বলতে আসছিল – পাশে একটা ধূলোভরা কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে বাঁদিকে, এইটা দিয়ে একটু এগিয়ে চললে জ্যাম কাটিয়ে আবার হাইওয়েতে ওঠা যাবে।

    পড়ি-কি-মরি করে পরপর কয়েকটা গাড়ি বাঁদিকের রাস্তায় ঢুকে গেল। আমরা আরও কিছুক্ষণ দোনামোনা করলাম – যাওয়া উচিত, নাকি অপেক্ষা করা উচিত? একটা টায়ার জখম, দেখে মনে হচ্ছে রাস্তা বলে কিছু নেই, আর যাই হোক, এটা গাড়ি চলার রাস্তা নয়, নিতান্তই গ্রামের সাইকেল চলার রাস্তা। ঢোকা কি উচিত হবে? একবার গাড়ি বসে গেলে না পাবো হেল্প, না সাইড করার জায়গা আছে, না ব্যাক করার। আমাদের তিনজনই তখন এ ওর মুখের দিকে চাইছি।

    দশটা-পনেরোটা-কুড়িটা গাড়ি পরপর ঢুকে গেল যখন, তখন বললাম, যা হয় হবে, চলো, ঢুকে পড়ি। আমরা একুশতম গাড়ি হয়ে ঢুকে পড়লাম সেই কাঁচা রাস্তায়।



    কাঁচা, কিন্তু একেবারে কাঁচা নয়। হয় তো দশ, কি পনেরো বছর আগে একবার পিচ ঢালা হয়েছিল এ রাস্তায়, দু এক জায়গায় এবড়োখেবড়ো দু একটা প্যাচ সেই প্রাচীন পিচের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। হেলতে দুলতে আমাদের গাড়ি এগলো, সামনেও গাড়ির লাইন, পেছনেও। এক জায়গায় একটা ঝুপড়ি মত দোকান, সে বোধ হয় অলরেডি অনেকগুলো ড্রাইভারকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার কাছে গিয়ে কাঁচ নামানো মাত্র, সে গড়গড় করে বলে গেল, বাস এক কিলোমিটার অ্যা্যসে জানা পড়েগা, তার পরে তিরাহা আসবে (টি-জংশন), সেখান থেকে ডানদিকে পাক্কি সড়ক গেছে, সেই সড়ক ধরে প্রথম কাট ছেড়ে পরের ডানদিকের পাক্কি সড়ক-ওলা কাটটা নিলেই আপনারা আবার মেন রোডে পৌঁছে যাবেন।

    বেশ, এগোলাম। খানিক আগে সত্যিই একটা টি-পয়েন্ট পেলাম, সব গাড়িই সেখান থেকে ডানদিক নিচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই, সব গাড়িই একই রাস্তায় চলেছে। তবে পাক্কি সড়ক মানে রাস্তায় পিচের দৃশ্যমানতা একটু বেশি, পিছ বোধ হয় সেই দশ বছরের পুরনো। প্রথম কাট ছেড়ে পরের কাটে আমরা অন্যদের মতই ডানদিক নিলাম। এটা ঠিক রাস্তা না বলে জমির আল বলা ভালো। আল ধরে চললাম। বাঁদিকে কর্ষণ করে রাখা জমি, কে জানে কীসের চাষ হবে, অপূর্ব ডিজাইন হয়ে পড়ে ছিল।

    খানিক এগোতেই দেখলাম খালি ন্যাশনাল হাইওয়ে। পেছনদিকে জ্যামের কোনও চিহ্নমাত্র নেই, সামনেও খালি। হাইওয়েতে উঠে আবার স্পিড বাড়ালাম। খানিক এগিয়ে গাড়ি থামালাম টায়ার চেক করার জন্য। না, টায়ার ঠিক আছে, হাওয়া কমে নি।

    আড়াইটের সময়ে গাড়ি ঢোকালাম একটা পেট্রল পাম্প-সংলগ্ন ধাবাতে। বৈষ্ণো ধাবা, নন ভেজ নেই, কিন্তু খিদেটা খুব পেয়েছে, এখন ভেজ ননভেজ খুঁজে সময় নষ্ট করার মানে হয় না, আর এ হল উত্তরপ্রদেশের ইন্টিরিয়র, এখানে ননভেজ কী কোয়ালিটির হবে, কেউ জানে না।

    খেলাম। রুটি, আলু-জিরা, পনীর মাখানি। পেট ভরে খেলাম। সোয়া তিনটের পরে আবার চলা শুরু। এখনও ইটাওয়া আশি কিলোমিটার দূর, সেখান থেকে একশো কিলোমিটার দূরে আগ্রা। তার পরে দিল্লি আর দুশো। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে যদি আগ্রা ঢুকতে পারি, তা হলে দিল্লি সাড়ে সাতটায় ঢুকে যাব অনায়াসে।

    গৌরব এর আগে কাজের সূত্রে দিল্লি এসেছে বটে, কিন্তু যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে কখনও দ্যাখে নি। বললাম, ঠিক আছে, যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে তুমি চালাবে। দেখবে, কী রকম এক্সপিরিয়েন্স।

    ক্রমশ ইটাওয়া ছাড়িয়ে গেলাম। রাস্তা ভালো খারাপ মিশিয়ে এই অংশে, জানাই ছিল। সুন্দর থোকা থোকা লাল সাদা ফুল ফুটেছে জায়গায় জায়গায়, ডিভাইডারের মধ্যে। সূর্য ক্রমশ পশ্চিমদিকে ঢলছে। ট্রাফিকের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু মানুষ বা জিনিসপত্র নয়, ঘোড়ারাও চলেছে আগ্রা বা দিল্লির উদ্দেশ্যে, কোথা থেকে আসছে কে জানে!



    ফিরোজাবাদ ঢুকলাম, তখন পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে গেছে। এখান থেকে আগ্রা আর সাতাশ কিলোমিটার। তুমুল জ্যাম। গৌরব বলল, আগ্রাতে পৌঁছে চা খাবে, অনেকক্ষণ চা খায় নি।

    আগ্রা ঢুকলাম খানিক পরেই, তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। প্রথম যখন গ্রেটার নয়ডা, নয়ডা, দিল্লি লেখা বোর্ডগুলো দেখলাম, গৌরব ভুলেই গেল চা খাবার কথা। বললাম, রেডি হও, লাস্ট দুশো কিলোমিটার তুমি চালাচ্ছো। গৌরব খুব খুশি।

    এক্সপ্রেসওয়ের শুরুতে গাড়ি রেখে একটু বিশ্রাম নিলাম। সিকিনীকে ফোন করে স্টেটাস জানিয়ে দিলাম, সিকিনী আজ দুপুরে বাড়ি ঢুকেছে। আমিও ঢুকব আর কয়েক ঘন্টা পরেই।


    লম্বা ছুটিতে দিল্লির অনেকেই বেরিয়ে পড়েছিল, তারা সবাই ফিরছে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে, টোল বুথের কাছে ম্যাসিভ জ্যাম। যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে এই জ্যাম কোনওদিন দেখি নি। প্রায় কুড়ি মিনিট নষ্ট হল একটা টোল বুথ পেরোতে।

    ঠিক রাত আটটায় আমার মোবাইল রোমিং থেকে লোকাল নেটওয়ার্ক ধরল, আমরাও বাঁদিক টার্ন নিয়ে নয়ডায় ঢুকলাম। এক্সপ্রেসওয়ে চলবে আরও দশ কিলোমিটার, গৌরব থাকবে স্টিফেনের বাড়িতে, স্টিফেনের বাড়ি গুরগাঁওয়ের কাছে, আমার বাড়ির বিলকুল উল্টোদিকে। স্টিফেন খুব বলছিল বটে – আমাদের কোনও একটা মেট্রো স্টেশনে নামিয়ে দিলে আমরা এমনিই চলে যাবো, তবে আমিই রাজি হলাম না। পথের সাথীকে ঘর অবধি এগিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। এরা দুদিন ধরে অনেক করেছে, আমাকে একটানা গাড়ি চালাতে হয় নি।

    কালিন্দী কুঞ্জ, ওখলা পেরিয়ে আমরা মেহরৌলি-গুরগাঁও রোড ধরলাম। ছতরপুর স্টেশন পেরোলাম, আর দুটো স্টেশন পেরোলেই স্টিফেনের আস্তানা, ঘড়িতে রাত নটা ছুঁইছুঁই তখন, হঠাৎ সামনে একটা বাজে ঘটনা ঘটে গেল। বাঁদিক দিয়ে আমাদের তীরবেগে ওভারটেক করে গেল একটা টাটা সুমো, আমাদের সামনেই একটু আগে বাঁদিক দিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল একটা লোক, তীরবেগে তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেল সুমোটা। আমি সাথে সাথে ব্রেক মারলাম, আর দেখলাম, লোকটা উড়ে গিয়ে রাস্তার বাঁদিকের প্রান্ত থেকে ডানদিকের প্রান্তে পড়ল, ডিভাইডারের কাছে একটা ডিগবাজি খেয়েই নিজে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।

    ভাগ্যিস, রোববারের রাত, রাস্তায় বেশি ট্র্যাফিক ছিল না। মোটরসাইকেলটা মনে হল ভালোই ড্যামেজ হয়েছে, কিন্তু লোকটা আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেছে। দাঁড়িয়ে ঝুঁকে নিজের পায়ের কাছে হাত দিচ্ছে – মানে ওর হাত পা কোমর পিঠ – সমস্ত অক্ষত। হেলমেট ওর মাথা বাঁচিয়ে দিয়েছে। সুমোটা বেপাত্তা ততক্ষণে।

    গৌরবের গলা শুকিয়ে গেছে ভয়ে। আমরা আর দাঁড়ালাম না, কারণ লোকটা অল্প আহত হলেও মারাত্মক আহত নয়। সম্ভবত সামান্য কেটেছড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। কয়েকটা গাড়ি আর অটোরিক্সা দাঁড়িয়ে গেছে দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। একটু পরে স্টিফেন গৌরবের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল – ওয়েলকাম টু দিল্লি। এখানে এসব হতে থাকে। লোকটা বেঁচে গেছে, এটাই বিশাল ভাগ্য ওর।

    আমার মনে পড়ল, অনেকদিন আগে, আইটিও-র সিগন্যালে এইভাবেই আমাকে ধাক্কা মেরেছিল একটা চলন্ত অটোরিক্সা। মোটরসাইকেল উড়ে বেরিয়ে গেছিল, আমার কিছু হয় নি। সিকিনী ছিল পেছনের সীটে, ইমপ্যাক্টে সে পড়ে গিয়ে কোমরে অল্প চোট পেয়েছিল।

    নটা কুড়িতে স্টিফেনকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি ফিরলাম। চেনা চেনা রাস্তা সব, রাতের সিগন্যালদের কাছ থেকে হাল্কা লাল আর সবুজ রঙ মেখে চুপ করে শুয়ে আছে। একে একে পেরিয়ে গেলাম মেহরৌলি, পঞ্চশীল এনক্লেভ, গ্রেটার কৈলাশ, লাজপত নগর, প্রগতি ময়দান, নিজামুদ্দিন …

    দশটা কুড়িতে বাড়ি। এন্ড টু এন্ড জার্নি সমাপ্ত হল।

    *********************

    রেকর্ডের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, দেশের প্রথম দুটো ন্যাশনাল হাইওয়ে আমি পুরো কভার করেছি। এন এইচ ওয়ান, লাদাখ, আর এন এইচ টু, কলকাতা। আবার হয় তো কিছুদিনের নিশ্চিন্দি, তার পরে আবার রাস্তা ডাকবে, আয় – আয়, তার পরে আবার সুযোগ খোঁজা, নতুন কোনও রাস্তার, কিংবা এই রাস্তাতেই, অন্যভাবে।

    খুবই খরচসাপেক্ষ ট্রিপ ছিল এইটা। এক এক দিকে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার করে প্রায় তেরো হাজার টাকার পেট্রল গেছে। টোল দিতে হয়েছে দেড় দেড় – তিন হাজার টাকার। কলকাতা যাই নি বলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের টোল দিই নি, ওটা দুদিকে ধরলে হয় চৌত্রিশশো টাকা। এর সাথে হোটেলের ভাড়া, খাওয়া এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক। রোজ রোজ এ ট্রিপ করা সম্ভব নয়, তবে ইচ্ছে আছে, আরেকবার এই রাস্তায় বাড়ি যেতে হবে, এইবারে বাইকে। দুটো অভিজ্ঞতাই হয়ে থাকা দরকার।

    *********************

    পাঁচ দিন বাদে, কথায় কথায় সিকিনীকে জিজ্ঞেস করলাম, এইবারে বল, কেমন লাগল পুরো ট্রিপটা।

    সিকিনীর দুচোখ পুরো ঝিকমিকিয়ে উঠল, ফ্যান্টাস্টিক, অসাধারণ। আমি নিজে ভাবতে পারি নি আমি এতক্ষণ বসে বসে জার্নি করতে পারব, কিন্তু করে দেখলাম, কোনও ব্যাপারই না। মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম, মেয়েও খুবই এনজয় করেছে। খরচের দিকটা বাদ দিলে, এইভাবে বেরিয়ে পড়াই যায় আবার।

    একটা মানুষ, এই বিশাল লম্বা জার্নির শেষে তার আগের মত থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল, এখন তার মনেও লেগে গেছে লং ড্রাইভিং-এর নেশা – এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারি জীবনের কাছে, বলুন?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ নভেম্বর ২০১৫ | ৫৮৬২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অ্যাপ্রুভাল প্রসেস | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৫ ০৭:৫৩66879
  • সিকি সেই কমেন্ট অ্যাপ্রুভ না করলে দেখা যায় না। এখন তো দিব্যি দেখা যাচ্ছে - সিকি সেখানে উত্তরও দিয়ে দিয়েছে।
  • aranya | ***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০১:৫৯66880
  • অতীব সুস্বাদু
  • অষ্টম পর্ব | ***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৯:০৩66881
  • অষ্টম পর্ব টা কবে পাবো? দুদিন হয়ে গেল যে।
  • আজ হবে না | ***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ১১:৫৮66882
  • কাল এসে যাবে।
  • Abhyu | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ০৬:২৪66889
  • সুন্দর।
  • Paakhi | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ০৯:৫৩66890
  • এই লেখাটায় এখনো রিভিসানের অবকাশ আছে হয়্ত, টেকনিকাল কোয়ালিটিও কিন্তু বেশ ভাল। লেখার প্রসাদগুণের কথা বাদ দিয়েই বলছি।
  • আজ কখন? | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১০:০৫66883
  • রাতের দিকে পাওয়া যাবে কি? তাহলে দিনের বেলায় মাঝেসাঝে চেক করা বন্ধ করে মন দিয়ে কাজ করবো। ঃ)))
  • শেষ পর্ব | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১০:৩৮66884
  • বেরিয়ে গেছে, তবে আপাতত ব্লগে পাওয়া যাচ্ছে। সাইটে বোধ হয় রাতের দিকেই আপডেট করবে।
  • d | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১১:১৭66885
  • দুটো`ঈ তো ব্লগ। ঐটে পার্সোনাল এইটে কমিউনিটি
  • 0 | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১১:৪২66886
  • ক্ষি ক্ষাণ্ডো :-) টুলকিটখানা ডিকিছাড়া হলো কেং কয়ে?!

    ছবিগুলোর মধ্যে 0439 (ঝকঝকে নীল আকাশ আর রাস্তার বাঁদিকে ঘন সবুজ ঝাঁকড়া পাতাওয়ালা গাছটা) আর 0452 (পড়ন্ত বেলার হলদেটে আকাশ) বেশী ভাল্লাগলো।
  • সে | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১১:৫০66887
  • পড়া হয়ে গেল শেষ পর্ব। সুন্দর।
  • 0 | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১২:২৫66888
  • সে'দির কমেন্ট দেখে আম্মো খুঁজেপেতে গিয়ে খেরোর খাতা পড়ে এলুম :-) সুন্দর ব্লগটা।

    যা ভেবেছি! লাস্ট'টা পড়ার আগে সাত নং অব্দি পড়েই কেমন যেন লাগছিল। আর কিছু না হোক, জ্যাকটা তো চট করে ডিকিছাড়া হবার কথা নয়! আর টুলকিটও তো এমনিতে ওখানেই পড়ে থাকে। নিশ্চ'ই মাঝে কোনো কারণে বের করা হয়েছিল। পরে আর রাখা হয়নি ডিকিতে।
    সূর্যাস্তের আর লাল-সাদা ফুলঝোপের ছবিদুটো দারুণ হয়েছে। আর সেপিয়ায় তোলা ওই কাঁচা-রাস্তার ছবিটাও।
  • sosen | ***:*** | ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:১৮66893
  • শেষ হলে কমেন্ট লিখবো ভেবেছিলাম।
    লেখাটা সম্পর্কে কিছু বলছি না, যেমন সিকি লেখে। আমার একটু লম্বা লেগেছে কিন্তু ট্রাভেলোগ এ সে সব বলার অবকাশ নেই।
    আমার যেটা বলার, সেটা হলো আমার মনে হয় সিকি একজন ইভলভিং মানুষ। রোজকার ঘিসাপিটা জীবনকে একটু একটু করে বদলে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা ও অবকাশ দুটো-ই ওর আছে। এই লেখাটা, বাইকে লাদাখ --যে কোনো কারণেই সে যাওয়াটা হোক, সেই বদলে নেওয়ার জার্নির রেকর্ড হয়ে এগুলো থাকবে। সবাই থোড়িই পারে, বা পারলেও রেকর্ডটা রাখে না। দুটো-ই মূল্যবান।

    চলতে থাকুক।
  • সিকি | ***:*** | ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৫:৫৮66894
  • মন দিয়ে, ধৈর্য রেখে এতখানি পড়ার জন্য সব্বাইকে ধন্যবাদ। সৎভাবে বলতে গেলে, এই লেখার শেষদিকটা আমার ভালো লাগে নি, বলা ভালো, আমি ভালো লিখতে পারি নি, ভালোভাবে শেষ করতে পারি নি। শুরুটা যে সুরে বেঁধেছিলাম, শেষদিকে সুর কেটে গেছে। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মানসিকতা নিয়ে লিখতে বসার ফল। কখনওই একটা পর্ব লেখার সময়ে পরের পর্ব নিয়ে ভাবি নি, সামঞ্জস্য থাকছে কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামাই নি, যখন যেমন মনে এসেছে, লিখেছি।

    বদলে নেবার চ্যালেঞ্জ - হ্যাঁ, বদল তো একটা ঘটেছে, সেটা আমি বুঝতে পারি। সিকিনী প্রায়শই আমাকে বলে, আমি নাকি খুব বদলে গেছি। আমি খুবই নিরীহ ঘরোয়া টাইপের মানুষ ছিলাম। আমাকে পালটে দিয়েছিল সেই অসুখটা, যার জন্য আমি একেবারে মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এসেছিলাম।

    শেষ স্টেজ ছিল, আর একটা দিন দেরি হলে আমার বাঁচার কথা ছিল না। আমার ফুসফুসের এক তৃতীয়াংশ চিরদিনের মত নষ্ট হয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারি। আর পাঁচজনের ফুসফুস যে ক্ষমতায় কাজ করে, আমার করে না। এইটা যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছিলাম, সেইদিন থেকে শুরু হয়েছিল আমার বদলে যাবার পালা। ওই যে প্রশ্নসকল, কেন বেরোই, কী পাই - তার উত্তর এটুকুই, এ আমার নিজের সাথে নিজের লড়াই। কারুর সাথে নয়, কারুর কাছে কিছু প্রমাণ করার চেষ্টা নয়, স্রেফ নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা, ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস নিয়েও আমি এমন কিছু করতে পারি, যা আর পাঁচজনে করার কথা ভাবে না। জাস্ট, এইটুকুই। এর বেশি কিছু না।

    এই খামতিটুকু শরীরের ভেতরে না থাকলে হয় তো এত সিনিকাল হতাম না :)

    ---------------------

    টুলকিট তো নিজে নিজে ধক দেখাবার জন্য বের করে রাখি নি - গাড়ি সার্ভিসে দেবার সময়ে বের করে রাখা হয়েছিল, তার পরে ঢোকাতে ভুলে গেছিলাম। এদিকে টুলকিট থাকলেও, স্ক্রু-জ্যাক যে আমার গাড়িতেই লুকনো ছিল, আমি সেটাই জানতাম না অ্যাদ্দিন, মানে পুউরো আনপড় যাকে বলে।

    ---------------------

    পাখি, মানে প্রণবদা কোথায় লুকিয়ে থাকে, আর ঠিক সময় বুঝে আমার লেখায় এসে কমেন্ট করে যায়। তুমি আজকাল একদম লেখো না কেন? হ্যাঁ, লেখাটায় অনেক মাজাঘষা দরকার। তবে আর করে কী হবে, লেখা তো শেষ।

    ----------------------

    শ্রীসদার সঙ্গে বসার ছিল একদিন, বসা হয় নি, রোবুকে ফোন করেছিলাম, তার সেদিন ছুটি ছিল না। দেখা হল না এদের সাথে। আর যাবার আগে লোভ দেখিয়েছিলাম রাজদীপকে, তো রাজদীপ ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতা আসছিল, তারিখও ম্যাচ করছিল না। পরে কখনও হয় তো রাজদীপের সঙ্গে বেরনো যাবে।

    ----------------------

    এইটুকুই। এখন কদিনের শান্তি। আবার রাতের ঘুম নষ্ট হওয়া শুরু হলে পরের জার্নির প্ল্যান করব। কাউকে জানাবো না। ফিরে এসে লিখব। ... আমাকে যদি কেউ এই রকমের একটা চাগ্রি দিত :(
  • Manish | ***:*** | ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৬:২৫66891
  • খুব ভালো লাগলো।
  • de | ***:*** | ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৭:৪৫66892
  • দারুণ লেখা! আবার কবে বেরোচ্ছো? আবার এমন একটা লেখা পাওয়া যাবে!

    টুলবক্স ছাড়া এই এত্তোটা জার্নি করতে ধক লাগে - আমি শুধু ভাবছিলাম, ভাগ্যিস ভুতো আর তার মা ফিরতি পথে সাথে ছিলো না! তাহলে মুশকিল ছিলো!
  • তাপস | ***:*** | ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০৭:০৫66895
  • ফর দ্য রেকর্ড, আমার শেষটা ভাল লেগেছে। মানে শেষটাও। খাপছাড়া! কী জানি? হয়ত সিকি সিকির প্রত্যাশা মেটায়নি। এই আর কী! লাদাখের শেষেও থ্যাংকিউ বলেছিলাম। এবারও ওই থ্যাংকিউ টুকুই।
  • kiki | ***:*** | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ১১:৩৬66896
  • ভালো লাগলো। কিন্তু দুটো কথা বলার ছিলো, হংসেশ্বরী মন্দিরের পাশে ওটা মনে হয় পুকুর নয়, পরিখা। গোল করে ঘিরে আছে।

    আর স্বর্ণকুমারী দেবীর ইমামবাড়ীটা একবার পড়তে শুরু করেছিলাম। মহম্মদ মহসীন মনে হয়( নাম গুলো যে ভুলে গেলাম) ঐ লোকটির সৎ ছেলে। তার একমাত্র মেয়ের বরকে উনি সব লিখে দিয়েছিলেন, কিন্তু জামাইটি মেয়ের প্রতি অবিচার করেছিলো। এবং সব সম্পত্তি উড়িয়ে দিচ্ছিলো। পুরো পড়ে উঠতে পারিনি, এত বোরিং আর জ্ঞান দেওয়া টাইপ লেখার ধরণ বলে।আর মহম্মদ বোনকে খুব ভালোবাসতো। সে নিজেও ব্যবসায়ী ছিলো।
  • pipi | ***:*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:৪৯66897
  • গোলা! এইটা আর লাদাখ - দুটোই চটি হোক।
  • :) | ***:*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৫:১১66898
  • :)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন