মহাগুণ মডার্ণ নামক হাউসিং সোসাইটির একজন বাসিন্দা আমিও হতে পারতাম। দু হাজার দশ সালের শেষদিকে প্রথম যখন এই হাউসিংটির বিজ্ঞাপন কাগজে বেরোয়, দাম, লোকেশন ইত্যাদি বিবেচনা করে আমরাও এতে ইনভেস্ট করি, এবং একটি সাড়ে চোদ্দশো স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাট বুক করি। এবড়োখেবড়ো জমির মধ্যে একেবারে কিছু-নেই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলতে আমি দেখেছি। নিয়মিত যেতাম উইকেন্ডে। ধূলো-রাবিশ আর মেশিনপত্তরের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়ালো একের পর এক কুড়ি তলা, চব্বিশ তলা টাওয়ার। অসমান জমিতে চকচকে টাইল আনল সমান ভাব। মহাগুণ মডার্ণের হোয়াটস্যাপ এবং টেলিগ্রাম গ্রুপেও আমি যুক্ত ছিলাম বহুদিন। নিয়মিত বিল্ডারদের সাথে আলাপ আলোচনা করা, প্রতিবাদ করা ডিজাইন ভায়োলেশনের, প্রাইস এসক্যালেশনের, এবং বিল্ডারের অপরিসীম ঔদ্ধত্যের সামনাসামনি হওয়া - সমস্ত আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেস করেছিলাম। একদিন-দুদিন, একমাস দু মাস নয়, দীর্ঘ তিন থেকে সাড়ে তিন বছর। আর পাঁচটা "রেপুটেড" বিল্ডার যেমন হয়, মহাগুণ তার কোনও ব্যতিক্রম ছিল না, আজও নয়। তাদের বাঁদরামি এবং অন্যায় ঔদ্ধত্যের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছেছিল, যে আমার পক্ষে ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সঙ্গে আপোষ করে চলা আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না। আমি পজেশন পাবার কয়েক মাস আগে ফ্ল্যাটটি বেচে দিই।
সবাই তা দেয় নি। অনেকের কাছেই সেটা ছিল নিজের প্রথম ঘর, ভাড়াবাড়ির টানাপোড়েন থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল বেশির ভাগই, আমার ক্ষেত্রে অন্তত সে সমস্যাটা ছিল না। দু হাজার পনেরো সাল নাগাদ, আমি মহাগুণ মডার্ণের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি। এর পর মহাগুণ মডার্ণ ফ্ল্যাটের পজেশন দেওয়া শুরু করে, আমার এক ছোটবেলার বন্ধুও সেখানে থাকে, ফলে যাওয়া আসাও অব্যাহত ছিল। এই তো মে মাসেই গেছিলাম ওদের বাড়ি।
তো, মোদ্দা যেটা বলবার ছিল, মহাগুণ মডার্ণ হাউসিং সোসাইটির একজন বাসিন্দা আমি হলেও হতে পারতাম, নিজের ইচ্ছেতেই হই নি। তবে না হলেও ওখানকার অন্তত শ খানেক রেসিডেন্টকে আমি চিনি। দীর্ঘ তিন বছরের পরিচয়।
আজ যখন এই লেখাটা লিখতে বসেছি, বিশ্বাস করুন, আমি ওদের একজনের সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নি। আমি এই মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে রিলাই করছি এখনও পর্যন্ত খবরে যতটুকু বেরিয়েছে, এবং এই ঘটনার মধ্যে সরাসরি ইনভলভড আছেন, এমন কয়েকজনের ব্যক্তিগত বয়ানের ওপর।
যে কোনও হাউজিং সোসাইটির চারপাশে ঝুগ্গি ঝোপড়ি গজিয়ে ওঠে, গজিয়ে ওঠে অনুসারী বস্তি, যেখান থেকে সেই সদ্যনির্মীত আবাসনের কাজের লোকেদের সাপ্লাই হয়। এরা কারা? কোথা থেকে আসে?
আসে সারা ভারত থেকে। যেখানে যেখানে খাবারের অভাব পড়ে। পিপলি লাইভ দেখেছেন? নাত্থা কীভাবে পৌঁছে গেছিল সিনেমার শেষে, দিল্লি শহরের আবাসন তৈরির ভিড়ে? তেমনি এরা আসে। এরা আসে ঝাড়খণ্ড থেকে, দক্ষিণ বাংলা থেকে, উত্তর বাংলার সমস্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া চা-বাগানগুলো থেকে, আসে আসাম থেকে, নাগাল্যান্ড থেকে। আসে উত্তরপ্রদেশ থেকে, রাজস্থান থেকে।
আসে বাংলাদেশ থেকে।
শুনুন, প্রথমেই চমকে উঠবেন না। আছে। এই সুবিশাল দিল্লি এনসিআর, নয়ডা-গুরগাঁও-ফরিদাবাদ-গাজিয়াবাদ মিলে যে বিশাল বিশাল জনবসতি, তার সোসিও-ইকোনমিক লেয়ারের একদম নিচের স্তরে এরা চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢোকে। সহজে এদের ধরতে পারা যায় না, কারণ হিন্দিভাষীরা বাংলা অ্যাকসেন্টের হিন্দি শুনে একেবারেই ধরতে পারে না আগত ব্যক্তিটি এপার বাংলার না ওপার বাংলার। এরা রিকশা চালায়, জোগাড়ের কাজ করে, লোকের বাড়িতে কাজ করে। এদের বৌদের সর্বাঙ্গে দারিদ্রের চিহ্ন থাকলেও সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে প্লাস্টিকের শাঁখাপলা খুব বেশিমাত্রায় প্রকট থাকে। যাতে সহজেই তাকে "হিন্দু" বলে চেনা যায়।
এদের আমি দেখেছি, দেখে আসছি। এদের আমি চিনি। কোথায় বাড়ি, প্রশ্ন করলে বলে কালিয়াচক, রায়গঞ্জ, নাকাশীপাড়া, হলদিবাড়ি, বনগাঁ ... মালদা, দিনাজপুর, শিলিগুড়ি। আমার লা-জবাব দিল্লি বইতে এদের নিয়ে সামান্য লিখেছিলাম, মনে আছে? আমার বাড়ি ছিল বসিরহাটে, আমার বাড়ি আছিল বনগাঁয়? আমি দীর্ঘ দিল্লিপ্রবাসে কখনও কাউকে বলতে শুনি নি - আমার বাড়ি হুগলিতে, হাওড়ায়, মেদিনীপুরে, বীরভূমে, বাঁকুড়ায়। একটিও না।
বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের একটা এক্সোডাস কিন্তু হয়েই চলেছে দীর্ঘদিন ধরে, একদম স্টেডি ফ্লো-তে। একটু নিরাপত্তা, একটু পয়সা রোজগার, আর একটু নিশ্চয়তার আশায় এরা কাঁটাতার পেরিয়ে আসে, ভারতে ঢুকে প্রথমে ব্যবস্থা করে একটি ভোটার কার্ডের। সীমান্ত এলাকাগুলিতে কীভাবে ভোটার কার্ডের ব্যবস্থা হয় তা অনেকেই জানেন, সে বিষয়ে আমি বিস্তারিত যাচ্ছি না, তবে একটা ভারতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা হয়ে গেলেই এরা ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতের শহরগুলোতে - দিল্লি ভোপাল মুম্বই পুণা চেন্নাই বেঙ্গালুরু। কলকাতার শহরতলিতেও ছড়িয়ে পড়ে এরা, যাদের দেখেই জয় গোস্বামীর সেই সব অবিস্মরণীয় কবিতা, ওপরে যে লাইনটা লিখলাম - সেইটা, কিংবা ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির কবিতা (চাল তোলো গো মাসিপিসি, লালগোলা বনগাঁয়)।
দিল্লিতে এদের ডায়ালেক্ট দেখে পার্থক্য করতে পারি আমরা, যারা বাঙালি। আমি একটু বেশিই পারি কারণ মালদা মুর্শিদাবাদ জলপাইগুড়ি এইসব জায়গায় বেশ কিছুকাল থাকার কারণে আমি এই সব এলাকার ডায়ালেক্ট সম্বন্ধে সম্যকভাবে পরিচিত। মেদিনীপুরেও থেকেছি, সেখানকার ডায়ালেক্টও আমার চেনা। তাই, চিনতে পারা যায়। দিল্লির স্থানীয়রা চিনবে না। কারণ তারা বাংলা ভাষা আর তার ডায়ালেক্টের রকমফের, কোনওটাই বোঝে না।
জোহরা বিবি সত্যিই বাংলাদেশের "ইমিগ্র্যান্ট" নাকি ভারতের নাগরিক, আমার জানা নেই। সে তর্কে আমি যেতে চাইও না। ছবি দেখেছি, ফেসবুকে পোস্ট পড়েছি, জোহরার আত্মীয় পরিজন প্রতিবেশিরা হাতে আধার কার্ড নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন, যা ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণ। আগেই বলেছি, আমার ব্যক্তিগত অ্যানেকডোট অনুযায়ী এই আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড বানানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একজন সীমা পার করা মানুষকে ভারতীয় বানিয়ে তোলা হয় তার পয়সা আর তার রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে, তাই হাতে আধার কার্ড দেখে আলাদা করে কিছু প্রমাণ করবার দায় আমার নেই। এটা একটা গ্রে এরিয়া - বর্ডারলাইন কেস। বাংলাদেশি হতেও পারে, না হতেও পারে। তর্কের খাতিরে এটুকু ধরে নেওয়া যেতেই পারে, সঠিক পরিচয়পত্রের জোরে জোহরা এবং তার সহযোদ্ধারা সকলেই ভারতীয়, ঠিক যতটা ভারতীয় আমি নিজে। আমার নিজের কাছেও ঐ একই পরিচয়পত্রেরা রয়েছে। দেশ, নাগরিকত্ব - এই বিষয়গুলো আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আবেগাপ্লুত করে না বলে আমি এই বিষয় নিয়ে একেবারে মাথা ঘামাতে চাইছি না। যা-ই হোক, এরা এতদিন এখানে কাজ করেছে একটা গেটেড সিকিওরিটিতে, নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়েই এদের গেটপাস বানাতে হয়েছে, মহাগুণ মডার্ণের (বা ফর দ্যাট ম্যাটার, যে কোনও গেটেড আবাসনের, আমি যেখানে থাকি এখন, সেখানকারও) সিকিওরিটি সেই পরিচয়পত্র ভেরিফাই করেই তাদের গেটপাস বানিয়েছে। এবং বিভিন্ন সোসাইটি আবাসনের একাধিক ফ্ল্যাটবাড়িতে তারা দীর্ঘদিন কাজ করে এসেছে, কোনও ঝামেলা ছাড়াই। সুতরাং এতদিন বাদে একটা ঝামেলা হবার পরে এখন "ওঁরাঁ বাঁংলাঁদেঁশিঁ" বলে নাকে কাঁদলে, আমার বিরক্তিই আসে।
এবার ঘটনায় আসা যাক। আগেই বলেছি, মহাগুণ মডার্ণের অন্তত একশো জন রেসিডেন্টকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। দিল্লি এনসিআরের আপওয়ার্ডস শাইনিং জনতা যেমন হয়ে থাকেন, এঁরা তেমনই। ইয়োগা করেন, পতঞ্জলির প্রোডাক্ট কেনেন, আবাসনের পাশে এককালে "কবরিস্তান" ছিল বলে আবাসনের রেট পড়ে যেতে পারে কিনা সে নিয়ে আতঙ্কিত থাকেন, এবং ভাষার ভিত্তিতে জোট বাঁধেন, ঘোঁট পাকান - বাঙালিরা দুর্গাপুজো, মারাঠিরা গণেশ চতুর্থী এবং উত্তর ভারতীয়রা শেরাওয়ালি মাতা কি চৌকি। ধর্মবিশ্বাস এখনও এ দেশে শেষ কথা বলে, সে বাঙালিই হোক কি দিল্লিওয়ালা।
আমি তখন অনেক বেশি ঠোঁটকাটা ছিলাম। মহাগুণ মডার্ণ তৈরি হয়ে উঠতে তখনও দেড় বছর বাকি, গাছেকাঁঠালগোঁফেতেল মোডে ভবিষ্যতের বাসিন্দাদের তখন হোয়াটস্যাপে আলোচনার বিষয় হয়েছিল, বিল্ডারকে বলে যদি সোসাইটি কমপ্লেক্সে একটি রামলালার মন্দির বানিয়ে নেওয়া যায়। প্রস্তাব রেখেছিলেন একজন, সোৎসাহে সমর্থন করেছিলেন অন্যরা "মন্দির হম ওহিঁ বনায়েঙ্গে" বলে। তার পরে বিস্তর বাদানুবাদ হয় এবং প্রতিবাদ করেছিলাম একমাত্র আমিই। "মন্দির হম ওহিঁ বনায়েঙ্গে" শব্দবন্ধগুলো আমাকে আজও হন্ট করে বেড়ায়, আমি ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম এই ফ্রেজটা পড়ে।
নাম যে হেতু প্রকাশিত হয় নি, আমি তাই জানি না যে বাসিন্দার ফ্ল্যাটে ঘটনাটি ঘটেছে, তাকেও আমি চিনি কিনা। এখন, যখনই কোনও ঘটনা ঘটে, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল ঘটনায় কোনও একটা পক্ষ অবলম্বন করে ঘটনার বিশ্লেষণ করা, হয় রেসিডেন্টদের পক্ষে, নয় জোহরাদের পক্ষে। আমি সজ্ঞানে দুদিকই পর্যালোচনা করবার চেষ্টা করছি, যতটা নিরপেক্ষভাবে হওয়া সম্ভব।
বাসিন্দাদের বক্তব্য অনুযায়ী, জোহরা চুরির কথা স্বীকার করেছিল, এবং গৃহকর্ত্রী তাকে দাঁড় করিয়ে বলেন, ঠিক আছে, তোকে সিকিওরিটির হাতে তুলে দিয়ে আসব, ওরা যা করার করবে, তুই এইখানে চুপটি করে দাঁড়া, আমি ঘর থেকে দুপাট্টাটা নিয়ে আসছি। এই বলে তিনি পাশের ঘরে যান, এবং দুপাট্টা নিয়ে বাইরের ঘরে ফিরে এসে দেখেন এই মওকায় জোহরা ভেগেছে। পরে জানা যায় সে সেই টাওয়ারেই আরেকজন প্রবীণ মহিলার বাড়িতে লুকিয়ে ছিল সারারাত। তাকে থাকতে দেওয়া হয়, রাতের খাবার দেওয়া হয়, সকালে চা রুটিও দেওয়া হয় এবং তার পরে সিকিওরিটিকে খবর দিয়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সিকিওরিটি জোহরাকে নিয়ে মহাগুণ মডার্ণের গেটের বাইরে বের করে দিয়ে আসে।
জোহরার বাড়ির লোকের বক্তব্য অনুযায়ী, সারারাত জোহরাকে ঐ ফ্ল্যাটেরই বাথরুমে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, মারা হয়, অ্যাবিউজ করা হয়। সকালে আধমরা অবস্থায় তাকে সিকিওরিটির হাতে তুলে দেওয়া হয়, জামাকাপড় ছেঁড়া ছিল।
এর পর পুলিশ আসে, তারা জোহরার স্বামীকে বলে, ওর চিকিৎসা দরকার, আগে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাও, চলো আমরাই ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসছি, তার পরে এখানে এসে দেখছি কী করা যায়।
জোহরা হাসপাতালে ভর্তি হয়, ইতিমধ্যে জোহরার গ্রাম থেকে কয়েকশো উত্তেজিত লোক এসে মহাগুণের গেটে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে, এবং যে বাসিন্দার বাড়িতে জোহরার নির্যাতন হয়েছে, তাদের ফ্ল্যাটে যাবার চেষ্টা করতে থাকে। সিকিওরিটি বাধা দেবার উদ্দেশ্যে শূন্যে তিন রাউন্ড গুলি চালায়। পরিস্থিতি ঘোরালো হয় এর পরেই, এন্ট্রান্সের কাচের আবরণ টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হয়, এবং মারমুখী জনতা ঢুকে পড়ে গেটেড সোসাইটির ভেতরে, যার নাম - মহাগুণ মডার্ণ।
প্রশ্ন ওঠে অনেকগুলো, এই পর্যন্ত শুনলে। প্রথমত, কাজের লোক চুরি করেছে, এইটাই একটু অবিশ্বাস্য লাগে, বিশেষত ঠিকে কাজের লোক, যারা রোজ আসে, কাজ সেরে চলে যায়, আবার পরের দিন আসে। যে ফ্ল্যাটে কাজ করে, সেই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের বিশ্বাস রাখা এদের কাজের একটা প্রধান শর্ত। নইলে এরাও টিকতে পারবে না। প্রোফাইলিংএর যুগে একজনের অসততার মাশুল দিয়ে বসে পুরো কমিউনিটি। বাড়িতে ঠিকে কাজের লোক যারাই রাখেন, তারাই জানেন এইটুকু বিশ্বাস এদের ওপর সবসময়েই রাখা হয়। সেইখানে একজন ঠিকে কাজের লোক, জোহরা, যেখানে সে অনেকদিন ধরেই কাজ করছে বলে জানতে পারছি আমরা, সে টাকা চুরি করছে, এইটা ভাবাটা একটু বেশি রকমেরই অবিশ্বাস্য ঠেকছে আমার।
অসঙ্গতি দুই, ধরে নিচ্ছি, জোহরা চুরি করেছে, টাকা চুরির কথা স্বীকারও করেছে। আপনারাই বলুন, সামনে স্বীকার করা একজন চোরকে আপনি কি কখনও বলবেন, এইখানেই দাঁড়া, কোত্থাও যাবি নি, আমি ঘর থেকে ওড়নাটা নিয়েই আসছি, নিয়ে এসে তোকে সিকিওরিটির হাতে দেব? দেখুন, আমি হলে প্রথম যেটা করতাম, সদর দরজায় ছিটকিনি লাগাতাম, আর ফোন করে সিকিওরিটিকে ঘরে ডাকতাম। মহাগুণ মডার্ণের প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে ইন্টারকম আছে, আর সেটা আছে সদর দরজার একদম কাছ ঘেঁষেই। আমি নিজে ওখানে একাধিকবার গেছি বলেই এটা আমি জানি। সুতরাং, মালকিনের বক্তব্য বা সামগ্রিকভাবে বাসিন্দাদের বক্তব্যটাও আমার খুবই কমজোরি লাগছে।
অসঙ্গতি তিন, যে প্রবীণ মহিলার বাড়িতে জোহরা নাকি রাতে শেল্টার নিয়ে ছিল, তিনি একবারও জিজ্ঞেস করলেন না কী ব্যাপার, কেন শেল্টার চাইছে, তিনি জাস্ট এমনি এমনিই তাকে রাতে নিজের ফ্ল্যাটে থাকতে দিলেন, খাবার দিলেন এবং সকাল হবার পর চা রুটি খাইয়ে তবে তাকে সিকিওরিটির হাতে তুলে দিলেন? আপনি ঐ জায়গায় থাকলে কী করতেন? খবর নেবার চেষ্টা করতেন না, কী হয়েছে? ইন্টারকমে ফোন করে সিকিওরিটিকে রাতেই ডেকে আনতেন না? সিকিওরিটি কি রাতে ঘুমোয়? আর তিনি কোথায়? তাঁর কোনও বক্তব্য এখনও সামনে এল না কেন?
অন্যদিক থেকে ভাবলেও, একটা জিনিস কেবলই আমার মনে হচ্ছে, কিছু তো একটা হয়েছিল। নইলে ঘটনাটা শুরু হল কী করে? মারধোর অ্যাবিউজ হোক বা না হোক, পুরো ঘটনাটার একটা তো ট্রিগার থাকবে। একটি মেয়ে যে রোজ রোজ একটা বাড়িতে আসছে কাজ করতে, হঠাৎই একদিন কেন সেই বাড়ির লোকের সাথে এই লেভেলে ঝামেলা তৈরি হয়ে যাবে?
হয় তো এসব ভাবা, তদন্ত করা পুলিশের কাজ, কিন্তু পরের ঘটনাগুলো আরও চমকপ্রদ। পুলিশ দাঙ্গা বাঁধানো, খুনের চেষ্টা এবং আরও কী কী সব ধারায় কেস রুজু করে তেরো জনকে অ্যারেস্ট করেছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ডিটেন নয়, অ্যারেস্ট, যাদের মধ্যে একটি পনেরো বছরের বাচ্চাও আছে। বাচ্চাটি জোহরার ছেলে। গ্রেফতার হওয়া সকলেই জোহরা যেখান থেকে আসে, সেই পাশের গ্রামের ছেলে। আরও বহুজনকে ডিটেন করেছে, ঐ গ্রাম থেকেই। কিন্তু যে লোকটির বিরুদ্ধে এই মব, এই ভায়োলেন্স, তাদের বিরুদ্ধে কী তদন্ত হয়েছে বা কী স্টেপ নেওয়া হয়েছে, কিছুই জানা যায় নি এখনও পর্যন্ত।
খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আউটরেজ এখন সর্বত্রই। ক্লাস অ্যাঙ্গল, পলিটিকাল অ্যাঙ্গল, রিলিজিয়াস অ্যাঙ্গল সব মিলেমিশে একাকার। একদল বলছেন এই সব হাইরাইজ সোসাইটিতে থাকা শাইনিং লোকগুলো এই রকমেরই হারামী হয়। এদের বাড়ি থেকে বের করে এনে প্যাঁদানো উচিত।
শুনে ভয় পাই। মরমে মরে যাই। আমরা, যারা সবসময়ে বলে বেড়াই - জেনেরালাইজ কোরো না, একটা গোষ্ঠীতে থাকা মানেই সবাই এক রকমের হয় না, ওপরে লেখা আওয়াজগুলো তাদেরই কারুর কারুর মধ্যে থেকে আসছে। আমি নিজেও একজন হাইরাইজে থাকা "শাইনিং" লোক। ক্লাস কনফ্লিক্টে তা হলে আমাকেও বাড়ি থেকে বের করে প্যাঁদানো জায়েজ হয়ে যাবে! আমিও তো মহাগুণ মডার্ণের বাসিন্দা হতেই পারতাম।
লোকটি যদি জোহরাকে সত্যিই ঐভাবে মারধোর করে বাথরুমে বন্দী করে রেখে থাকে সারারাত, তা হলে তা নৃশংস। আইন মেনে কঠিনতম শাস্তি সে পাক, এই দাবি আমি করছি। কিন্তু যারা মবের মধ্যে থেকে আওয়াজ তুলল - লোকটির বউকে নিয়ে এসে ধর্ষণ করা হোক, লোকটির বাচ্চাকে বের করে এনে খুন করা হোক (সত্যিই এই আওয়াজগুলোও উঠেছিল), সেই সব বক্তব্যের প্রায় কোনও নিন্দেই কিন্তু চোখে পড়ল না। আমার কোটাটুকু আমি পূর্ণ করে দিই এইখানেই, আমি এই রেপ কালচার খুন কালচারও এনডর্স করি না। যে বা যারা এই আওয়াজ তুলেছিল সেদিন, তাদেরও চিহ্নিত করা হোক, এবং তাদেরও যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
শেষ খবর পাওয়া অনুযায়ী, যাঁরা দুঃসময়ে জোহরাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিনের মারমুখী জনতাকে যাঁরা শান্ত করেছিলেন নিজেদের একক প্রচেষ্টায়, তাঁদের 'বিষাক্ত আগাছা' বলে চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে আরএসএস, এবং তাদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী তারা ধর্মের খেলা খেলতে শুরু করেছে। জোহরা যেহেতু ধর্মচিহ্নে মুসলিম, এবং তদুপরি বাংলাভাষী, অতএব সে বাংলাদেশের ইমিগ্র্যান্ট, এবং তাকে যারা তোল্লাই দিচ্ছে, তারা সমাজের শত্রু, হিন্দুত্বের শত্রু। সামাজিকভাবে সমস্তরকম একঘরে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাদের ওপর, নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাবার পর্যন্ত সাহস করতে পারেন নি তাঁরা গত পরশু।
এবং প্রোফাইলিং শুরু হয়েছে সমস্ত হাউসিং সোসাইটিতে। "ব্যান বাংলাদেশী ওয়ার্কার্স"। কীভাবে এঁরা "বাংলাদেশি" চেনেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না, দুটি মাত্র অভিজ্ঞান, বাংলাভাষী এবং মুসলমান - এর মানেই বাংলাদেশি, স্থানীয় লোকজনের কাছে। আর এই একটি স্লোগানের মাধ্যমে সবাইকে একটা মেড-ইজি সমাধান খাইয়ে দেওয়া হল, বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্টদের দূরে সরিয়ে রাখলেই এই ধরণের অনভিপ্রেত ঘটনা আর ঘটবে না কোনও আবাসনে। কেউ চুরি করবে না, কাউকে সারারাত আটকে রেখে মারধোর করলেও তার বস্তির লোক এসে ঝামেলা করবে না বড়লোকদের আঙিনায়। এক কথায় এদের আর্থিক সুরক্ষা, নিশ্চয়তা সমস্ত শেষ করে দেওয়া হল। এমনিতেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা এই হাউস-মেড বা ঠিকে কাজের লোকেদের জন্য কোনও ন্যূনতম মজুরি সংক্রান্ত আইনই নেই।
এর সঙ্গে চলছে পুলিশের ধরপাকড়। নয়ডা পুলিশ এই সব ক্ষেত্রে কী রকমের এবং কতটা সক্রিয় হতে পারে, তা আমরা দেখেছি অনেকদিন আগে, নিঠারির কাণ্ডের সময়ে। সুপ্রিম কোর্ট হিয়ারিংএর সময় মন্তব্য করেছিল, (নয়ডা) পুলিশ কুকুরের স্তরে নেমে গেছে। নয়ডা পুলিশের সক্রিয়তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি আরুশি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সময়েও। নয়ডা পুলিশের মহানুভবতার প্রমাণ আমার ব্যক্তিগত স্তরে আছে। নয়ডা সেক্টর বাষট্টির পুলিশ চৌকি প্রভারী কৈলাশ শর্মার সঙ্গে আমার দীর্ঘ বাকবিতণ্ডা ভুলতে আমার অনেক বছর সময় লাগবে হয় তো, নেহাতই তা একান্ত ব্যক্তিগত বলে তার বিবরণ এখানে দিলাম না।
নয়ডা পুলিশ আবার সক্রিয় হয়েছে। মহাগুণ বিল্ডারও তাদের হাউসিংএর রেপুটেশন বজায় রাখতে মরিয়া, এক শ্রেণীর বাসিন্দাদেরও মানসিকতা ঠিক সেই ধরণেরই, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, বিল্ডার সকলেই বিজেপির হাতে, এমতাবস্থায় আরএসএসের মাঠে নামাটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। প্রথম তিন দিন জোহরার স্বামী লাগাতার হুমকি পেয়েছেন পুলিশের কাছ থেকে, কারণ মূলত তাঁর কথাতেই গ্রামের লোকজন জড়ো হয়েছিল মহাগুণ মডার্ণের গেটের সামনে। রাত তিনটের সময়ে তাদের গ্রামে হামলা করে নয়ডা পুলিশ, তুলে নিয়ে যায় একাধিক জনকে, যার মধ্যে ছিল জোহরার পনেরো বছরের ছেলেও। তাকে অবশ্য পরদিন ছেড়ে দেয় পুলিশ, গাড়ি থেকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়, কারণ মাইনর ছেলেকে পুলিশ কাস্টডি দিলে পুলিশ নিজে কেস খেয়ে যেত। কিন্তু গ্রেফতার হয়েছে তেরোজন।
সামনের লড়াইটা আরও কঠিন। লড়াই তো শুধু চিহ্নিত "অপর পক্ষে"র বিরুদ্ধে নয়, লড়াই সদাসর্বদা নিজের সাথেও, নিজের লোকের সাথেও। আমরা, যারা লড়াইয়ের প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করার সাথে সাথে তাদের বাড়ি থেকে বের করে গণহারে "প্যাঁদানোর" কথা বলি, প্রতিপক্ষের বাড়ির মেয়েদের রেপের হুমকি দিতে শুরু করি, প্রতিপক্ষকে হাতের সামনে পেলে তাকে মেরে সবার সামনে ঝুলিয়ে দেবার পক্ষে সওয়াল করি। নিদেন পক্ষে হাত মুচড়ে ভেঙে দেবার স্বপ্ন দেখি, যাতে প্রতিপক্ষ কখনও বিরিয়ানি খেতে না পারে।
কথাগুলো কখনও বলা দরকার ছিল। আজ বললাম। বলছিলাম না, লড়াইগুলো নিজেদের সাথেও?
** শেষতম সংযোজনঃ গ্রেফতার হওয়া তেরো জনের মুক্তির জন্য সব রকমের চেষ্টা চলছে। সোমবারের মধ্যে সেশনস কোর্টে জামিন না পাওয়া গেলে হাইকোর্টে মুভ করার কথা ভাবা হচ্ছে। এদিকে "ব্যান বাংলাদেশি মেড" ক্যাম্পেন চালানো আপওয়ার্ডলি শাইনিং বাসিন্দাদের অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। গত চার দিনে নিজেদের বাসন মেজে আর বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে, তাঁরা এখন নিজ নিজ সোসাইটির ম্যানেজমেন্ট এবং সিকিওরিটিদের সাথে সেটলমেন্টে এসেছেন, সঠিক আইডি কার্ড থাকলে সেই সমস্ত কাজের লোকদের আবার কাজে বহাল করা হোক। মহাগুণ মডার্ণেও সিগনেচার ক্যাম্পেন শুরু করা হয়েছে "মেড"দের কাজে পুনর্বহাল করার উদ্দেশ্যে। মেডরা ফিরে আসছেন, এবং জোহরাও নতুন কাজ পেয়ে গেছে। মহাগুণ মডার্ণেই।
মজদুর কামগার ইউনিয়ন এবং আরও কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গ্রেফতার হওয়া লোকেদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।