— রাজা সলোমন, খবর শুনেছেন? জেরুজালেমে আসছেন দক্ষিণের এক রানি। তিনি কেন আসছেন রাজা? আপনার কাছে?
— এটা একটা কথা হল? তাকে তো আসতেই হত। তাই আসছেন।
— মানে? একি হেঁয়ালি আপনার! এতদূর পথ উজিয়ে কত বিপদআপদ মাথায় নিয়ে একা মেয়েমানুষ, আমি তো কোনোদিন এমন কথা শুনিনি!
— তুমি আর এই দুনিয়ার কতটুকু জানো হে! আমার হুপুপাখি, কই গেল সে? সেই তো উড়ে গেছিল রানির দেশে। সেদিন থেকেই রানির কথা জানি। শুনেছি অনেক ধন দৌলত তার।
— আপনার থেকে বেশি নয় রাজা। হতেই পারে না। আপনি মহান।
— হ্যাঁ, তা যদি হয় তবে কেন তিনি আসবেন না? মহিমাময় সলোমনের কাছে? কেন আমি রাজস্ব চাইবো না তার কাছে? চড়া বাণিজ্য শুল্ক?
— রাজা, শুনেছি তারা অনেক দেবতার পুজো করে। জিহোভাকে মানে না! কী অনাচার একবার ভাবুন!
— হুম, জানি বৈকি! আসুন তিনি আসুন। তাকে দেখার বড় আগ্রহ আমার!
— তবে রাজা, সাবধানের মার নেই। শুনেছি তিনি নাকি অদ্ভুত!
— কী রকম!
— আপনি অশরীরী চর্চা করেন। তাই আপনার আগ্রহ থাকতে পারে মনে করে বলছি। তার নাকি পা দুটো লোমশ! আর পা দুখানি নাকি কেউ বলে ছাগলের কেউ বলে গাধার। মানে পায়ে খুর আছে। ইয়ে, মানে কেউ কেউ বলে ওর বাবা অথবা মা একজন জিন। জন্ম রহস্যময়! তাই এই দশা! হ্যাঁ, এমন কথাই সবাই কইছে শুনছি!
—হাহাহাহা, আসুন তিনি, সলোমনের প্রাসাদ তাকে স্বাগত জানায়। দেখি তাকে, কেমন মানুষ না জিন না পরি তিনি!
— শুনেছি তিনি ঘোর কালো!
— তাতে কী এসে যায়? আমি শুনেছি বিদ্যুতের মত চোখ ধাঁধানো রূপসী তিনি। মেধা তার সৌন্দর্য! কেন তুমি কি শোনোনি “হৃদ্কমলে ধুম লাগলে আর অন্তর মুগ্ধ হলেই সে সুন্দর”। আমি তার প্রতীক্ষায় রয়েছি।
— রাজা, যদি উনি আপনার বশে না আসেন!
— আমার বশে আসবেন না? তাও কী হয়? নাহলে তো রাস্তা খোলাই আছে। চড়া শুল্ক অথবা যুদ্ধ! দেখে যাও, সময়, দেখে যাও শুধু! তুমিই তো ধরে রাখবে সবকিছু তোমার দেহে, তোমার মনে। তোমার আত্মায়!
আলমিত্রা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে! কাহিনির কুহকে সে জড়িয়ে গেছে। আর বের হতে পারছে না। আলমুস্তাফার জাহাজ যেন না আসে! তিনি যেন এই কাহিনি শেষ করতে পারেন!
আজ সকালে রোদ উঠেছে। ঘাস এখনও ভিজে। আপ্রিকট গাছের তলায় বসেছে ওরা।
শান্ত সকাল। দানা খুঁটে খাচ্ছে পাখি। এর মাঝখানে বড় দুটি দীঘল চোখ তুলে
আলমুস্তাফা বলে উঠলেন,জানো তো আলমিত্রা, শেবার রানিকে নিয়ে ইয়েমেন ছাড়া আরো একটি দেশ দাবিদার ছিল। আফ্রিকার ইথিওপিয়া। দুই দেশের মাঝে শুধু একফালি জল বয়ে যায়।
ইথিওপিয়ার "কেবরা নাগাস্ত” হল রাজাদের গৌরবগাথা। সেখানে বলা হয়েছে পুরুষ প্রধান সমাজে রানি ছিল অসম্ভব তুখোড় এক মেয়ে। ঝলসে ওঠা এক বিদ্যুৎরেখা। জ্ঞান ও মনীষা, ধনরত্নের থেকে অনেক অনেক বড়। এই বিশ্বাস নিয়েই দেশ চালাত সে। তার বাবা মারা যাবার পর।
এখানে তাকে ডাকা হচ্ছে মাকেদা বলে। রানির নাম। রানি মাকেদা ভাবতে ভাবতে পথ চলেছে।
‘কেবরা নাগাস্তে’র রানি মাকেদা বা কোরানের রানি বিলকিস যাই হোক না কেন, শেবার রানি ভাবছে বণিক নেতা তামরিনের কথা। তামরিনের সঙ্গে রাজা সলোমনের ভালো আলাপ আছে। পাঁচশোর বেশি উট আর তিনশোর বেশি সদাগরি নৌকা আছে তামরিনের।
রাজা সলোমন তখন ব্যাস্ত। মন্দির তৈরি হচ্ছে। প্রচুর সোনা রুপো কাঠ দরকার। তামরিনকে ডেকে বললেন “আমাকে এনে দাও নীলা, সোনা আর আবলুশ কাঠ, যাতে পোকা লাগবে না।” তামরিনই তো মাকেদাকে বলেছিল, “রানি, রাজা সলোমন কী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দ্যাখেন! পাথর কাটা থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম নকশা, পুরোটাই তিনি দেখেন একই আগ্রহ নিয়ে! শয়ে শয়ে কারিগর মিস্ত্রি শিল্পী কাজ করেছিল।”
তামরিনের জিনিসপত্র রাজা ভালো দাম দিয়ে কিনে নিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, যা চাও যত চাও নিয়ে যাও নিজের দেশে। তামরিনের কাছ থেকে কত গল্প শুনেছে রানি। রাজা সলোমনের গল্প। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এই গল্পটা।
শোনো তবে আলমিত্রা। দুটি মেয়ে এলো কাঁদতে কাঁদতে, সঙ্গে একটি দুধের শিশু। একটি শিশু, দুটি মা। একজন বলছে বাচ্চাটা আমার! আরেকজন বলছে না আমার। বিহিত করুন রাজা মহানুভব। কেঁদে আকুল দুই মা! রাজা বললেন বেশ দুজনেই যখন মা, তখন শিশুটিকে ভাগ করে দি তোমাদের মধ্যে। খাপ খোলা তলোয়ার সাঁ করে নেমে আসে দুধের শিশুর বুকের কাছে। চিৎকার করে ছিটকে ওঠে এক মেয়ে, মারবেন না। মারবেন না, প্রভু। তার চেয়ে ওকেই দিয়ে দিন। তবু তো বেঁচে থাকবে বাচ্চাটা!
আরেকটি মেয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে ওঠে, হ্যাঁ টুকরো করে দিন। তাহলে কারুর ভাগ্যেই জুটবে না এই শিশু!
রাজা থামলেন এক মুহূর্ত। তারপর কাপড় জড়ানো সেই একরত্তি প্রাণকে তুলে দিলেন প্রথম মেয়েটির কোলে। সেই তার আসল মা!
চোখে জল আসে রানির। কত দূরদৃষ্টি! কী বিচক্ষণতা! কী সহানুভূতি!
নিরালায় ঈশ্বর নেমে এসেছিলেন একদিন, বলেছিলেন, কী চাও সলোমন?
উত্তর এসেছিল, মন পড়তে চাই। মন বুঝতে চাই। ভালো মন্দর তফাত যেন করতে পারি।
এতো কথা এতো গল্প শোনার পর রানির আর তর সইছে না। বিন্দু বিন্দু প্রেমকণা একরাশ জোনাকির মতো রানিকে ঘিরে থাকে আজকাল। রানি জানে, এ হল জ্ঞান প্রেম রেণু। রাজার প্রতি তার আকর্ষণ, রাজার মেধা। না, সেই আগুনে রানি ঝাঁপ দেবেনা। দ্রাক্ষারস ভরা স্ফটিক পাত্রের মত রাজার মেধারত্নটিকে হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেখে দেখার জন্যই তো এতদূর চলা!
জ্ঞান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পার্থিব সম্পদ অর্জন যদি উদ্দেশ্য হয় তবে তাকে জ্ঞানের আধারে রেখেই রক্ষা করতে হয়, বাড়াতে হয়! রানি একথা বিলক্ষণ জানেন।
তাই ভয়মেশানো শ্রদ্ধা বা কৌতূহল ছাড়াও রানির কাছে আরেকটি কারণ আছে এই পথযাত্রার। আর সলোমনের? রানির রূপদর্শন ছাড়া তারও আরেকটি কারণ আছে রানিকে দেখবার!
অরফালিসের মন্দিরের ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। উঠোন থেকে চৌকাঠে লুটিয়ে আসছে নরম সন্ধ্যা। আজও জাহাজ এলো না আলমুস্তাফার। আলমিত্রা রাতের খাবার বানানোর তোড়জোড় শুরু করে। কাবুলিছোলার সঙ্গে হাড়ছাড়া ভেড়ার মাংস। সঙ্গে আলু আর গাজর। ধিকিধিকি আগুন। ধিকিধিকি লোবানের ধোঁয়া। আলমুস্তাফার পায়ের কাছে বসে আছে আলমিত্রা।
তখন লোহিতসাগর বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। ফিনিসিয় নাবিক, টায়ারের রাজা সকলের সাহায্যে রাজা সলোমনের বাণিজ্যের কী দাপট! শেবার তো সবই আছে পণ্য আছে, নৌকা আছে, পণ্যের বাজার আছে। কিন্তু এখন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে খোদ সলোমন। শেবার বণিকেরা দূর দূর দেশে আগের মত সহজে চলে যেতে পারছে না। না জলে, না স্থলে। তাদের মশলা তাদের রজন সুগন্ধি, নিজেদের দেশে নয়, দূর দূর দেশে এসব পণ্যের প্রবল চাহিদা! নিজেদের দেশে কে কিনবে এসব? তাদের স্বচ্ছন্দ বাণিজ্যে এক অদৃশ্য প্রাচীর তুলে দিয়েছেন সলোমন! দেশের সম্পদ সমৃদ্ধি বাড়বে কী করে যদি বাণিজ্য ঠিকমত না হয়?
এই পর্যন্ত বলে বাইরের দিকে তাকালেন আলমুস্তাফা। বাইরে কালো অন্ধকার যেন শেবার রানি হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে! সে তামসী! তাকে তো আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।
এক অদ্ভুত চোখে বাইরের আঁধারের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে থাকেন আলমুস্তাফা।
জেরুজালেম এসে যাবে অল্প সময়ের মধ্যে। রানি আসছেন মারিব থেকে। শেবার রাজধানী শহর। মারিব উছলে ওঠা সুন্দর। জেরজালেমের থেকে তার লোক সংখ্যাও বেশি। গমগমে। জেরুজালেম পাহাড়ের ওপরে রুখুসুখু। খরখরে বাতাস। মন্দির, রাজার প্রাসাদ, ছাগলের লোম বা ভেড়ার পশম দিয়ে বানানো তাঁবু চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জুডিয়া পাহাড়ের ওপরে জেরুজালেম। অনেক দূর থেকেই নজরে পড়ে।
রানি যেমন দূর থেকে জুডিয়া পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেই ভাবে জেরুজালেমের মানুষেরাও আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল কোন সুদূর থেকে আসা এক রানিকে দেখবে বলে।
সারি সারি উঠ। জমকালো এক দীর্ঘ সরণি। চলমান। সুগন্ধে ভরে যাচ্ছে বাতাস। প্রচুর সম্ভার, জাঁক জমক নিয়ে স্বচ্ছ লিনেন বা রেশমের ঘেরাটোপে এক আবছায়া নারী মূর্তি! ওই রানি! ওই যে রানি!
দু পাশে সার বাঁধা কৌতূহলী মুখ। ধীরে ধীরে একে একে রানির বাহিনী ঢুকে পড়ছে জেরুজালেমে। বাজনা বাজছে। রানির আগমন ধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে। রাজা সলোমন সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন। পরনে মহার্ঘ পোশাক। বরাবরই তিনি সাজগোজ করেন পরিপাটি। মুখে এসে পড়েছে রোদ্দুর। বাদামি চুল উড়ছে হাওয়ায়। একটি একটি করে ধাপ নেমে আসছেন তিনি।
দু হাতে পর্দা সরিয়ে রানি নেমে এল নতুন দেশের মাটিতে। রাজা এসে ধরলেন তার দুটি হাত! রানি চোখ মেলে দেখল।
পপলার গাছের মত রোদ্দুরে ঝিলমিলিয়ে উঠছে সে।
নিঃসঙ্গ পাহাড়ের খাঁজে রৌদ্রস্নাত হ্রদ যেন
অথবা পর্বতের গায়ে জমে থাকা বরফ
শুভ্র, শুভ্রতর সূর্যের আলোয়।
সে এরকমই।
তাকে ভালোবাসলাম।
বুক কেঁপে উঠল সে যখন এলো।
ভালোবাসার ভার যেন বইতে পারে না আমার শরীর।
নত হয়ে জড়িয়ে ধরতে চায় তার দুটি পা।
ইশ এইটুকু পড়ে সাধ মেটে না। আরো অনেকটা গল্প শুনতে ইচ্ছে করে।
(উট এক জায়গায় উঠ হয়ে গেছে। )
অসাধারণ লেখা। এই যে নানা সোর্স থেকে আসা সমান্তরাল গল্প। এটাই এই পৃথিবীর সবচেয়ে।বড় ইউনিফায়ার। মেলাবেন তিনি মেলাবেন! এই কাজটি মন দিয়ে ধ্যান দিয়ে করার জন্য কুর্নিশ সুপর্ণাকে।
খুব ভালো লাগছে।
ভীষণ ভালো লেখার হাত এই লেখিকার |khub ভালো লাগছে