আজিম খান সমাধির উঁচু টিলায় তখন গরম বাতাস ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হচ্ছে। বাতাসে নিম ফুলের তীব্র গন্ধ। পশ্চিম আকাশ লাল। নিচে মেহরাউলির বিস্তীর্ণ জমিতে ইতিহাস বুনে গেছে ওরা। রাজো কি বাওলির পথে কে বা কারা ছড়িয়ে গেছে গোলাপ পাপড়ি। কিলা রায় পিথোরার দেওয়ালে পেখম ঝুলিয়ে ময়ূর। তার ঝুলন্ত পেখমের রঙে পড়েছে অস্তায়মান সূর্যের আলো। গরমকাল। গলা খসখসে হয়ে উঠছে সকলের। কুতুব মিনারের পেছনে ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাস্তান গুরু থেমে থেমে বলে
মিরি জাঁ
তেরা মিলনা তিশ্নগী কে দশত মে
উয়ো আব- এ- তাজা থা
যো শবনম ভি হ্যাঁয়, দরিয়া ভি
প্রিয়, তোমার দেখা পাওয়া আমার কাছে
তৃষ্ণার্ত মরুভূমিতে স্বচ্ছ জলের মত
যা কখনো শিশির কখনো বা সমুদ্র হয়েও আসে।
আজিম খান সমাধির পাথুরে ঘেরাটোপে সে গলা গমগম করে। তার আর্তির গভীরতা আমাদের ভেতর থেকে স্নিগ্ধ করে দিচ্ছে তখন। পরিষ্কার অনুভব করছি ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ । রাজিয়া সুলতান আর মালিক ইয়াকুত। ইয়াকুত বলছে, মালেকা এ আলম, আপনার মোহব্বত ও মেহেরবানি, শবনম ভি হ্যাঁয়, দরিয়া ভি।
দাস্তান গুরু একটু জল খেলেন আর দুটো খেজুর। অন্ধকার, কিলা রায় পিথোরায় তার চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে আলতো ভাবে। উঁচু পাহাড় থেকে ধাপে ধাপে নেমে আসছি বুনো ফুলের গন্ধের সঙ্গে। দাস্তান গুরু তার ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে নিল।
আমি নিচে নেমে এলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম রাজিয়া আর মালিক ইয়াকুতকে। শবনম ভি হ্যাঁয় দরিয়া ভি।
~ ২ ~
সফদরজং মকবারার ঘাসে বসে আমরা খসের শরবৎ খেয়ে ছিলাম। দাস্তান গুরু সেদিন আওয়াধের গল্পের রোশনাই ছড়িয়ে ছিল। পড়ন্ত বিকেল হয়ে উঠেছিল দিওয়ালির রাত। ঘাসে ঘাসে জোনাকি জ্বালিয়ে দিয়ে ছিল সে। আমি সেদিন দাস্তান গুরুর কাছে গিয়ে বলেছিলাম হাতে যে আতর ঘসে দিলেন, সেটা কোথায় পাব ? দাস্তান গুরু বলেছিল মেহরাউলিতে। ওর নাম আজিজ। আজিজ মানে প্রিয়।
হুমায়ুন মকবারায় স্বাধীনতা দিবসের আগে আগে দাস্তান গুরু স্বাধীনতার আগুনে ঝলসে যাওয়া কিছু দাস্তান শুনিয়েছিল। আমরাও ঝলসে গেছিলাম। কেউ কেউ কাঁদছিল। দাস্তান গুরুও কাঁদছিল। দাস্তান গুরুর চোখের তলায় যুগ যুগান্তের কালি। দাস্তান গুরু বলেছিল আমি কয়েক রাত ঘুমুতে পারিনি। এই দাস্তান গুলো আমাকে ঘুমোতে দেয় নি। তারা সব জ্যান্ত হয়ে আমার চারদিকে ঘুরে বেড়িয়েছে খালি। আমি মনস্থির করতে পারছিলাম না এই গল্প শোনাতে সবাইকে ডাকব না বন্ধ করে দেব ?
সেদিন আমি চট করে চলে আসিনি। পা ঘষটাতে ঘষটাতে দাস্তান গুরুর কাছে গিয়ে বলেছিলাম আমাকে শাগিরদ করে নিন।
দাস্তান গুরু বলেছিল, আমি তো একটা বাউন্ডুলে পাগল। গুরু হব কেমন করে ? একটা পাগলকে কেউ গুরু মানে ?
A story is like water
That you heat for your bath.
It takes messages between the fire and your skin. It lets them meet, and it cleans you.
গল্প, জলের মত
স্নান করার জন্য যে জল তুমি গরম কর। আগুন থেকে সে তোমার ত্বকের গভীরে কিছু কথা নিয়ে যায় । তাদের দেখা হয় । আর তুমি শুদ্ধ হতে থাক।
দাস্তান মনের মত না হলে দাস্তান গুরু টাকা ফিরিয়ে দেয় ! কেন ফিরিয়ে দিচ্ছেন ? এটা তো আপনার পারিশ্রমিক।
দাস্তান গুরু বলে আজ আমার দাস্তান বে- জান, প্রাণহীন ছিল। নাহ আজ টাকা নেওয়া যাবে না।
আজ আবার কোনো বন্ধুর জন্মদিন। আজ কেউ কিন্তু কিছু দেবেনা প্লিজ। সে কী? এতোটা সময় আপনি আমাদের কোন দুনিয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন তার কোনো মূল্য নেই? পারিশ্রমিক নেবেন না?
-নাহ আজ একটা বিশেষ দিন। বন্ধুত্বের দিন। আজ এই গল্প বলা আপনাদের জন্য আমার উপহার। আজ কোনো লেনদেন নয়।
Lovers find secret places
Inside this violent world
Where they make transactions with beauty
এই নির্দয় পৃথিবীতে
প্রেমিকেরা খুঁজে নেয় নিভৃত এক জায়গা
যেখানে সৌন্দর্য লেনদেন হয় শুধু।
~ ৪ ~
এক সুফি পীর বলেছিল ছেলেকে "রাত কি রানি” ফুলের কাছে নিয়ে যেও না যেন। তাহলে তাকে আর বেঁধে রাখতে পারবে না। রাত কি রানি, শিউলি ফুল। নিশিরাত জুড়ে সে কান্নার মত ঝরে পড়ে। অজস্র কান্নার ফোঁটা। সেই উদাসী - গন্ধ ওকে ঘর ছাড়া করবে। সেই থেকে মা, রাত কি রানি ফুল থেকে ছেলেকে দূরে রাখে ! আজমেঢ় শরিফে মাথা কুটে এই ছেলের জন্ম। বাবার অকাল মৃত্যুর পরে চিরাগ এ দিল্লির আঙিনায় খেলে বেড়ানো এক খ্যাপা ছেলেকে দেখে মায়ের চিন্তা হয়। পীর বলে, রাজার দুয়ারে মাথা কুটলে রাজার জন্ম হয়, নিদেন পক্ষে মন্ত্রীর । ফকিরের দরগায় মাথা কুটলে ফকির হবে না তো কি শাহেনশা হবে?
হৃদ কমলে যে ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সেই ভালবাসাই হোক গুপ্তধন তাহলে ! তাকেই খুঁজে খুঁজে বেড়ানোই আমার দাস্তান।
দাস্তান গুরু বলে দুপুরের খর রোদ যখন সন্ধের স্নিগ্ধতার সঙ্গে মিশে যেতে থাকে আমি তখন পাঁচ ছটা ছাগল নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে যেতাম। সেখানে মোঘল আমলের একটা কুয়ো ছিল। আমি সেই কুয়োর নিচে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতেই থাকতাম। আমি জানি না সেই অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে আমি কী খুঁজে বেড়াতাম ? আমার কোনো সঙ্গী সাথী ছিল না। কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে পড়ে আমার মনে হত আমি যেন একলা নই। ওই অন্ধকার বেয়ে একটা পথ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি সেই পথ খুঁজে বেড়াই।
গল্প কী আর এমনি এমনি দানা বাঁধে ? আমার এই অন্বেষা, আমার এই বুকের গভীরের গুপ্তধন একটু একটু করে আমার দাস্তানের মধ্যে মিশিয়ে দিই আমি। দরগার উঠোনে ময়ূর আর ময়ূরের ছানা ঘুরে বেড়াত । আমি ওদের পেছনে পেছনে ঘুরতাম। উঠোনে কত লোক আসত, বসত, কথা বলত। সেসব কিছুই বুঝতাম না। এখন বুঝতে পারি সেখানে অনেক ফকির সাধু আসতেন। মাথায় হাত রাখতেন। কোথায় চলে যেতেন তারা আমি জানতাম না। আমি ওদের সঙ্গে সন্ধে বেলায় ঘরে ফিরে যাওয়া পাখিদের মিল খুঁজে পেতাম। আর মেঘের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতাম। খেলার মধ্যে ঘুড়ি ওড়াতাম। অনেক অনেক অনেক উঁচুতে ঘুড়ি নিয়ে গিয়ে উধাও করে দিতাম তাকে। অনন্তে হারিয়ে যাবার জন্যই তো আসি আমরা।
পয়সাকড়ি কোনদিনই নেই। শুধু হৃদয় বিলিয়ে দিতে এসেছি আমি। বড় হয়ে বই এর দোকানে দোকানে গিয়ে অনেকটা সময় কাটাতাম। বই কেনার জন্য নয়। বই কেনার পয়সাই বা কোথায় আমার ? বই পড়ে নিতাম, যতটা পারতাম। বই এর যেসব জায়গা ভালো লাগত একটা গোলাপ তার মধ্যে রেখে দিতাম। দরগার গোলাপ আমার সঙ্গেই থাকে সবসময়। আমি জানতে পারব না কোনোদিন, সেই বইগুলো যারা কিনতেন তাদের কী মনে হত ! নতুন বইয়ের অক্ষরের সঙ্গে মেশা সুগন্ধে তাদের কী মনে হত ! তাই এই পথ, এই অন্বেষা, এই ভালোবাসার সঙ্গে আমি সুগন্ধও মিশিয়ে দিই আমার দাস্তানে।
He heals. He enlivens.
He tells the water to boil
And the steam to fade into the air.
সে নিরাময়, সেই প্রাণ
সে জলকে ফুটে উঠতে বলে
বাষ্পকে বলে বাতাসে লীন হয়ে যাও
~ ৫ ~
দাস্তানের আত্মা আছে। নীরবতার মধ্যে যে উপলব্ধি তাই দাস্তানে মুখরিত
আকার নেয়। দাস্তানে জমাট বাঁধে কত আবেগ কত অনুভূতি কত বিশ্বাস কত ত্যাগ, কত বেদনা । দাস্তানকে বাঁধা যায় না। সময় তাকে পোড়াতে পারে না। সময় গিলে নেয় সব, শুধু দাস্তানকে সে গিলতে পারেনা। একজন দাস্তানগো তার বুকের ভেতরে ধরে রাখে কত কত যুগ। তবেই না সে আশ্রয় হয়ে ওঠে মানুষের। তার দাস্তানের ছাতার তলায় দু দণ্ডের বিশ্রাম নেয় অস্থির মন।
দাস্তান গুরু ধূপের গন্ধ পায়, গোলাপের গন্ধ পায়। খালি চোখে যাদের দেখা যায় না তারা দাস্তান গুরুকে ছুঁতে চায়। না বলা কথা বলতে চায়, তাদের চাপা বেদনা গুমড়েগুমড়ে মরে গেছে। তাদের কথা কেউ বলে নি। আঁধার রাতে দাস্তান গুরুর চারপাশে তারা ঘুর ঘুর করে। দাস্তান গুরু তাদের কথা শোনে। তখন দৃশ্যমানতা পেরিয়ে দাস্তান গুরু অতীন্দ্রিয় পথের যাত্রী। দুটো অদৃশ্য ডানা বেরিয়ে আসে তার পিঠ থেকে। ওয়েভ লেংথ বা তরঙ্গায়িত অনুভূতি সবাই বুঝতে পারে না। দাস্তান গুরু পারে । তাই দাস্তান গুরু অনেকের মনের গভীরে ডুবুরির মত সাঁতার কেটে ঝিনুকের ভেতরে মুক্তোর সন্ধান পায়। আর এই কারণেই দাস্তান গুরুকে অনেকে বুঝতে পারে না।
ভুল বোঝে। অনেকে দূরে সরে যায়।
এক শীতের সকালে ভুলি ভাটিয়ারি কি মহলে ছমছমে পরিবেশে দাস্তান গুরু বলেছিল
আশিকোঁ অর ফকিরোঁ কা কোঈ জমানা নহি হোতা
উয়ো জিস জমানেমে আয়ে উয়ো জমানা উনকা নহি হোতা
প্রেমিক আর ফকিরদের কোনো যুগে বেঁধে রাখা যায় না
তারা যে সময়ে আসে, সেই সময়কেও ছাড়িয়ে যায় তারা ।
দাস্তান গুরুকে শেষ বার দেখেছি জয়সলমেরের মরুভূমিতে। মুমল কি মেড়িতে। মুমলের প্রাসাদে। রুক্ষ রেগিস্তানে মুমল মহেন্দ্র প্রেমের দাস্তান আঁকে উড়ন্ত বালুকণা । অমরকোট থেকে প্রত্যেক দিন আসত মহেন্দ্র রানো। সন্ধে বেলায় উটে চরে। উটের নাম চিতল। খুব জোরে ছোটে। সেই উটে চরে মুমলের সঙ্গে দেখা করে আবার সকালে ফিরে যেত মহেন্দ্র । বাড়ির লোকে জানতে পেরে দিল চিতলের পা ভেঙে । নতুন উটে চড়ে মহেন্দ্র জয়সলমের যেতে গিয়ে পথ ভুল করে বারমের চলে যায় । এদিকে মুমল বসে বসে অপেক্ষা করে থাকে । তার বোনের নাম সুমল। সুমল ছেলেদের পোশাক পরে নৌটঙ্কি করে দিদির সঙ্গে। মহেন্দ্র আর আসে না, আর আসে না। মুমল আর সুমল ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক রাতে মহেন্দ্র এসে দেখে মুমলের সঙ্গে কে এক অচেনা পুরুষ ! মহেন্দ্র মুমলকে রাগে দুঃখে ছেড়ে চলে যায় । যখন সে বুঝতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
দাস্তান গুরু ঝাঁ ঝাঁ গরমে বালির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে জল বের করে আনে। রুখু পাথর আর বালির নিচে জল বইছে। অথচ বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
দাস্তান গুরু বিড়বিড় করে বলে
সাকি হ্যাঁয় আজ কওন কি হর কুজ এ সিফাল
আতা হ্যাঁয় এক নূর কা দরিয়া লিয়ে হুয়ে
সে কোন সাকি যে মাটির পাত্রে বয়ে আনে আলোর সমুদ্র ? নূর কা দরিয়া। দাস্তান গুরু ফিস ফিস করে আমাকে বলে ওই নূর কা দরিয়া খোঁজো গিয়ে।
মুমল আর মহেন্দ্রর প্রেম কাহিনি নাকি আত্মা আর ঈশ্বরের মিলন গাথা।
দাস্তান গুরু, হাতে নাড়া বেঁধে দেয়, মরুভূমির বালির ওপর বসে। তপ্ত বালুর ভেতর থেকে টুপ টুপ করে জল হাতে ফেলতে থাকে। বালিয়াড়ির পেছনে সূর্য ডুবছে । উট নিয়ে ঘরে ফিরছে গ্রামের লোক। মাথায় লাল পাগড়ি বেঁধে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে বানজারা ছেলে
জানেওয়ালে হমারে মেহফিল সে
চান্দ তারোঁ কো সাথ লে কে যা
হম খিজা সে নিভা কর লেঙ্গে
তু বাহারোঁ কো সাথ লে কে যা
আমার মেহফিল ছেড়ে যাবে যদি, চাঁদ আর তারাও সাথে নিয়ে যাও
শুকনো রুখু ঋতুই আমার ভালো, বসন্ত তুমি তোমার সাথেই নিয়ে যাও
~ ৭ ~
দাস্তান গুরুর প্রিয় ঋতু বর্ষা। দাস্তান গুরু আমাকে হাতের তালুতে বসিয়ে বৃষ্টির জলকণায় উড়িয়ে বলে যা, দেখে আয়। দাস্তান দেখে আয়।
মহাবালেশ্বরের বৃষ্টি মনে পড়ে। সবুজ উপত্যকার বুক থেকে ঘন ভাপ ওঠে। সেই ঘন ভাপ আসলে জিজাবাঈ এর স্নেহ-উত্তাপ । সেই স্নেহ আকাশে উঠে জমে জমে দুধেল মেঘ হয়ে যায়। পুরু ঘন জমাট স্নেহ মেঘ। সেই মেঘের বৃষ্টি, দুধের বৃষ্টি। চারিদিক দেখা যায় না। সাদা। সব সাদা। সেই দুধ সাদা সফেন বারিধারায় ফনফনিয়ে ওঠে সবুজ। যেখানে সেখানে। শ্যাওলা, লাইকেন, ফার্ন, দামাল ঘাস। নাছোড়বান্দা সবুজ। ভরভরন্ত সবুজ। দিকচক্রবাল জুড়ে সহ্যাদ্রি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে জিজাবাঈ ভোঁসলের সেই দুরন্ত ছেলে । শিব্বা রাওয়ের ঘোড়ার পেছনে ছুটছে একদঙ্গল মাওয়ালি জোয়ান। ঘন জঙ্গলে, পাহাড়ে পাহাড়ে। মহাবালেশ্বরের বর্ষা বারে বারে ফিরিয়ে আনে তাদের। শিব্বারাওএর মাওয়ালি বাহিনী জল পড়লে তর তরিয়ে বাড়ে। প্রশস্ত সবুজ সেনানী দুধজলে স্নান করে। মহাবালেশ্বরে এলে তুমি সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাবে। সেই স্নেহধারা থেকে বাঁচাতে পারবে না নিজেকে। কিছুতেই না।
সেই দুধসাদা বৃষ্টির নিচে যখন দুহাত মেলে দাঁড়াও বাতাসে তখন আদুর স্ট্রবেরির গন্ধ । সাদা দুধ, স্ট্রবেরি - ভালোবাসায় সোহাগী গোলাপি। স্ট্রবেরির গন্ধ মাখা সেই বৃষ্টিতে উদ্দাম ভিজে ছিল যে যুবকটি সে তার ছেলের সঙ্গে এখন গ্রীষ্মদিনে সমুদ্রের পাশে খেত থেকে স্ট্রবেরি তোলে। সেই খেত -টাটকা সেই ফল আর রঙিন ফুল সাইকেলের ক্যারিয়ারে নিয়ে তারা বাড়ি ফেরে। সমুদ্রের ওপারে যে দেশ তুমি তার নাম জানো ? ওর নাম ক্রনবরো। ওখানে থাকত এক বিষণ্ণ রাজপুত্র হ্যামলেট। কান্নার শ্রাবণ জলে ওফেলিয়া ডুবে গেছিল একদিন ।
শিমলার বৃষ্টি মনে পড়ে। মেঘের হাত ধরে হেঁটেছিলাম সহচরীর মত। মেঘেরা ঘরে ঢুকে পড়তো কফি খেতে। যাবার সময় বই খাতা ভিজিয়ে দিয়ে যেত , মনে পড়ে। জানালার কাচে ওদের দুষ্টুমি, নাক ঘসে দেওয়া, মনে পড়ে।
আকাশ জুড়ে প্রথম যেদিন বর্ষা নেমেছিল দেওয়াল জোড়া কাচের জানালা দিয়ে এক অতিরঞ্জিত নৃত্যনাট্য দেখেছিলাম, মনে আছে। এক খ্যাপা চিত্রকরের ক্যানভাস জুড়ে রঙের মিছিল, রঙের বিদ্রোহ দেখেছিলাম। এতো না ভেবে তাকে এক অবিস্মরণীয় দৈব আলোও মনে করা যেতে পারে । জানালার বাইরে দূরে কুহেলি পাহাড়ের সারি। ওয়াশ পেন্টিং । ছাই রঙের মেঘ জমছিল। টকটকে কমলা রঙের সূর্য সেই ছাই মেঘে ঢাকা পড়তে পড়তে যে রং বাহার খেলিয়ে দিল তখন সেই চিত্রকর বিদায় নিয়ে এক জাদুকর ঢুকে পড়েছে নিমেষে তার খোলসে। সব মাস্টার স্ট্রোক !
দাস্তান গুরু বলে ছিল আকাশের ওই মাতাল রঙ পারবি দাস্তানে মেশাতে ?
Let me, O let me bathe my soul in colours, let me swallow the sunset and drink the rainbow
আমার চেতনা ডুবে যাক রঙে, সূর্যাস্তের রঙ আমি গিলে নিই, আর চুমুক দিয়ে তুলে নিই রামধনু।
উইলো গাছের নিচ দিয়ে গ্লেন ভ্যালি থেকে সামার হিলের রাস্তায় যে মেয়েটি ভুট্টা বিক্রি করে তাকে দেখেছ ভালো করে ? আমি দেখেছিলাম। মেঘ যখন পাইন গাছের মাথায় ঘনিয়ে আসতো, কোথায় সেই মেয়ে? শোঁ শোঁ হাওয়ায় দুলছে পাইনের মাথা। শেষ ট্রেন মিলিয়ে যাচ্ছে বাঁকে। আর সেই মেয়ে একটা রঙের তুফান তোলা মোনাল পাখি হয়ে ঢুকে পড়েছে সেই পাইনের ঘন জঙ্গলে। এসব নিজের চোখে দেখা। এসব বর্ষাদিনেই হত।
মান্ডুর বৃষ্টি মনে পড়ে। উজ্জয়িনী থেকে একদিন মেঘ অলকার দিকে ভাসিয়ে ছিলেন এক কবি। মালবদেশের বর্ষায় বিরহের গান লেখা হয়। বিরহ, বিরহীর মিলন চায় না। সে বিরহেই পুড়ে মরে। মান্ডুর বৃষ্টি তাই অঝোর কান্না। প্রেমিক গায়ক যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে মেঘ হয়ে ঝরে পড়ে কেবল। পাহাড়ের মাথায় গুমরে গুমরে মেঘ হয়ে যায়। তারপর হাহাকার হয়ে ঝরে পড়ে। কোথায় হারিয়ে গেছে তার প্রেমিকা। মাহেশ্বরে নর্মদা ফুঁসে ওঠে। বৃষ্টির হাহাকার তাকে অশান্ত করে দেয়। প্রবল রাগে উথালপাথাল নর্মদা বৃষ্টির হাহাকারকে বলে, চলে গেছিলি কেন ? চলে গেছিলি কেন ? সে মেয়ে ভেসে গেছে জলে। আর তাকে পাবিনা।
মহারাজা, কেবরিয়া খোল, রস কী বুঁদ পঢ়হি। আমার দাস্তানগুরু বলেছিল, বৃষ্টি ঝরলে প্রার্থনায় বসতে হয় । ইশক ইবাদাত আর সবর। প্রেম, প্রার্থনা আর ধৈর্য। সেই বৃষ্টি, জুঁই ফুলের মধ্যে দাস্তান ভরে দেয়। আমি যে কবে থেকে সেই রুহানি বৃষ্টির জন্য বসে আছি, দাস্তান গুরু। কোথায় সে বৃষ্টি ?
দাস্তান গুরু ঝরে পড়তে পড়তে বলে, এই দুনিয়াটা একটা দাস্তান। সবর। সবর। সবর। অপেক্ষা। অপেক্ষা। অপেক্ষা। আমি আবার ফিরে আসব, সেই আলো, সুগন্ধ আর প্রেম নিয়ে, এক নাম না জানা নক্ষত্র থেকে।
এক জমানা গুজর জানে পর দেখা রঙগ আপনি আঁখো কা
হয়রান অলগ, পশেমান অলগ।
সুনসান অলগ , বিয়াবাঁ অলগ,
এক যুগ পেরিয়ে যাবার পর দেখলাম আমার চোখের রঙ
বদলে গেছে বিস্ময়
বদলে গেছে লজ্জা
একাকিত্বের ধরণ অন্যরকম
এমনকি শূন্যতার মানেও বদলে গেছে।
এধরনের অজস্র নরম লেখা ক্লিশে টাইপের হয়। কিন্তু এই ধারাবাহিক বেশ ভাল হচ্ছে। লেখককে ধন্যবাদ।
অদ্ভুত সুন্দর লেখা, বিমোহক!