গুলরুখি কবিতা লিখে শান্তি পায় না । একবার লেখার দিকে তাকায় , একবার কাটে , একবার শব্দ বদলায় । মহলের বাইরে রোদের তেজ বিজবিজ করে ঝরোখার জালি দিয়ে ঘরে ঢুকে পাথরের মেঝেতে নকশা বোনে । গুলরুখি সেই নকশাবোনা দেখে কিছুক্ষণ । আবার লেখাটা দেখে । তার মন খুব খুঁত খুঁতে । কোন শব্দটা জুতসই লাগসই এই নিয়ে মনের মধ্যে চলে কাটাকুটি খেলা । ওদিকে আবার বিস্তর কাজ পড়ে আছে । উফ শান্তি নেই মোটে । কর্পূর মেশানো জল এনে রাখে । খানিক খায় , খানিক মাথায় দেয় । উফ কী গরম ! শ্বেতপাথরের থালায় সকালের ফুলগুলো নেতিয়ে পড়েছে । বাববের মেয়ের নাম ছিল গুলরুখ । ফারঘানার যুদ্ধবাজ রাজা সেই দেশের গুলিস্তানকে আর ভুলতে পারেন নি ।
মেয়েদের সবার নাম হয় গুলরুখ , গুলচেহরা বা গুলবদন । আরেক গুলরুখের আনাগোনাও শুনতে পেয়েছিলাম আরও বেশ কিছু পরে । ইতিহাসে এইসব গুলরুখদের নাম লেখা থাকে না । সেই গুলরুখের ভালোবাসার সখী ছিল জাহান আরা । গুলরুখ, জাহান আরার জন্য কত নতুন গান বাঁধত । কত নাচের মুদ্রা শিখত শুধুমাত্র শাহজাদির মন মাতানোর জন্য । এরকমই একটা সন্ধে নিয়ে এসেছিল গুলরুখের যত্নে শেখা নাচ , জাহান আরার সামনে । সবে সন্ধে নেমেছে । একটা একটা করে বাতিদানে বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছে মহলের মেয়েরা । টানা বারান্দায় সারি দিয়ে প্রদীপ । সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য ! শাহজাদি জমকালো পোশাকে আতর ঢেলেছেন দেদার , কেয়াগন্ধী শরবৎ , স্নিগ্ধ আলোর টিপিটিপি মালা , অন্দরে ঘুঙুরের ছমছম , আকাশজুড়ে অস্তরাগ ! গুলরুখের কপালে ঘাম জমছে । শ্বাস দ্রুত হচ্ছে , পায়ের পাতা যেন মাটি ছুঁচ্ছে না একেবারে। নাচ শেষ হল । না থেমে উড়ন্ত চুনরি দিয়ে অশান্ত ঘূর্ণি তুলে নাচতে নাচতেই শাহজাদির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গুলরুখ । তার পেছনে পেছনে প্রায় দৌড়ে আসছেন জাহান আরা । আরে ! গুলরুখকে একটু ধন্যবাদও জানাতে পারলাম না যে ! চৈতির সুর ভাসছে সন্ধের হালকা বাতাসে । প্রদীপের শিখাগুলো দুলে উঠছে । জাহান আরা হঠাত দেখলেন গুলরুখের হাওয়ায় ভাসা চুনরির এক প্রান্তে আগুন ধরে গেছে ।
জাহান আরা দৌড়ে গিয়ে হাত দিয়ে গুলরুখকে সরিয়ে দিতে গেলেন কিন্তু আগুন ধরে গেল জাহান আরার পোশাকে । জামায় এতো আতর মাখানো ছিল যে হু হু করে আগুন ধরে গেল । সেই আগুনে জাহান আরা ভয়ানক পুড়ে গেছিলেন । সেরে উঠতে অনেক দিন সময় নিয়েছিলেন তিনি ।
আরেকটা নাম তখন খুব চলত , মাখফি বা মাখভি , মানে যে কেবল পালিয়ে বেড়ায় , দৃষ্টি এড়ায় , ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে । এই নামে কবিতা লিখতেন জমকালো সম্রাজ্ঞী নূর জাহান । আবার সেই নামের আড়ালেই লুকিয়ে রইলেন জেব উন্নিসা । জীবন টাই যার কেটে গেল সেলিমগড় দুর্গে । বন্দী অবস্থায় । আওরঙ্গজেবের মেয়ে । মৃত্যু এসে নিয়ে গেল তবু বাবা র ক্ষমা পেলেন না । সেইসব চিরদুঃখী মেয়েদের ব্যর্থ প্রেম , কবিতায় শ্বাস ফেলত ।
"শিল্পী আমার ছবি আঁকবার জন্য আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে কেন?
দীর্ঘশ্বাস কে কি আঁকা যায় ?”
উফ কী অল্প কথা ! কী তীক্ষ্ণ বেদনা !
দেখো কাণ্ড! আমরা তো ভুলেই গেছি , আমাদের গুলরুখির তো কবিতার ছন্দ মিলছে না । গুলরুখি বিরক্ত হয়ে এবারে লেখাটিকে গুটিয়ে রেশমের জোব্বা পরিয়ে একটা ঘণ্টা বাজালেন । দরজার সামনে কেউ একজন এলো । গুলরুখি রেশমি জামা পরা কবিতাখানি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন , শেখ জামালি ।
সে লোকটি কবিতাখানি নিয়ে ছুটে চলল শেখ জামালির কাছে । বোঝা গেল এই ব্যাপারটি বেশ ঘন ঘন ঘটে থাকে । গুলরুখির কাছ থেকে প্রায়ই কবিতা মেরামতি করতে শেখ জামালির কাছে লোক দৌড়োয় ।
সেগুন গাছের পাতা সর সর সর করে সারা উঠোনে ছড়িয়ে পড়ছে । বেলা হয়েছে অনেক । পিপল গাছের ডালে কে শুকুতে দিয়েছে সবুজ রঙের কুর্তা ? টপ টপ করে মাটিতে পড়ছে সবুজ রঙা জল। গাছের ছায়ায় বসে এক সুঠাম মানুষ স্থির চোখে দেখছেন সেই টপ টপ জল । ধীরে ধীরে তিনি বলছেন
"আমার মা রংরেজ ছিল ,কাপড় রাঙাত
লালচে , গেরুয়া, বাদামি হলুদ রঙ
বুনো লতার গন্ধ
কাপড় ফুলে ফুলে উঠত
হাওয়ায় , দোল খেত ।
গোলাপি রঙ ,
টপ টপ টপ
মাটিতে পড়তো ফোঁটা ফোঁটা “
তিনি কখন কোথায় থাকেন ঠিক নেই । ঘুরে ঘুরে বেড়ান । দরবেশ । রাজকাজেও যান । হ্যাঁ , কত দূর দূরান্ত । দূতিয়ালিও করেন ।
" পাহাড়ের খাড়াইএর দিকে
রত্নপুরার নদীর বালিতে
ঝিকমিক করে ওঠে চুনি ।
আমি শুধু দেখেছি
তোমার প্রজাপতি হাসি
আর চিকচিকে চোখ
ছেঁড়া জামা পরে আড়ষ্ট আঙুলে
আমি সেই খাড়াই শৃঙ্গ বেয়ে উঠতে থাকি
এই আকাশ এই স্রোত আমার কাছে
তোমার খুশির চেয়ে বড় নয় , কামালি ।
ওরা বলছে সেই শৃঙ্গ স্বর্গের ঠিক চল্লিশ মাইল নিচে ! “
জামালি, সুফি দরবেশ ।পরিব্রাজকের অভিজ্ঞতা , দরবেশের প্রজ্ঞা , বুকের ভেতরে উদাসী বাউল আর কী কী দিয়ে জামালির মাটি তৈরি হয়েছিল , জানা নেই । তবে তাঁর ইশক মাজাজি বা ভালোবাসার মানুষের প্রেম কবিতায় জমাট বেঁধেছে কামালিকে নিয়ে । কামালি আজো রহস্যময়। তাতে কী এসে গেল ?
জামালি লিখে ছিলেন
"মাথার ওপর বেগুনি আকাশ
নীল দরজা ।
মেয়েটির জামার সবুজ রঙ
দিল্লির কী রঙ বাহার !
কিন্তু তোমার ভালোবাসার ছলাকলা সমস্ত রঙ কে ফিকে করে দিচ্ছে ।
আচ্ছা , কামালি তুমি যে স্বপ্নে দেখেছিলে গাঢ় লাল রঙের মখমলের
পোশাক
আমাদের জন্য ।
সেটা কি কোন শুভ সঙ্কেত ! "
জামালির কবিতার নিবিড়পাঠ বলে দেয় কামালি তার সাধন সঙ্গী । সঙ্গিনী নয় ! কামালিকে নিয়ে জামালির ইশক মাজাজি , অতীন্দ্রিয় পথ বেয়ে ইশক হাকিকি বা ঈশ্বরে লীন হয়ে যায় । লায়লার জন্য পাগল হয়ে গেছিল মজনু। লায়লার রূপ ছিল না । শরীরী সৌন্দর্য ছিল না । রূপের আড়ালে সে অরূপ বীণা বাজিয়ে ছিল মজনুর বুকে । যেমন হয়েছিল রাজা নাটকে রানি সুদর্শনার , শাপমোচনে কমলিকার । রূপের অতীত এই প্রেম বেঁধে রাখে না । এই প্রেম ছড়িয়ে দিতে হয় । অজস্র জোনাকির আলোর মত এই প্রেম ঘন অন্ধকারে জ্বলে ! সেই জোনাকি ধরবে বলে কতজনের জীবন পাল্টে যায় বেবাক !
“ জামালি মরে গেছে
আর সেই সঙ্গে আম বাগানটাও
সাদা সারসের দল তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে
আর আমি ডুবে যাচ্ছি ক্রমশ …
বিদায় গোলাপ
বিদায় কাঠ চাঁপা
বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে হিমালয়ে ।
একটা শাল জড়িয়ে
লেবুর স্বাদ নিতে নিতে
আমি উত্তমুখো হাঁটা দেব “
জামালির কবিতায় রাজত্ব করে ঘন রঙ , তীব্র গন্ধ , শরীরী প্রেম , আপাত হেঁয়ালি ভাষা । এসব ছাড়িয়ে সকলের অগোচরে সেই কবিতা ধরে অতীন্দ্রিয়ের ছায়া পথ ।
আমির খুসরো তার গুরু নিজামুদ্দিন মেহবুব এ ইলাহি কে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন ,
"শুধু একটি দৃষ্টিপাত , শুধু একটি দৃষ্টিপাতে ছিনিয়ে নিলে আমার সব কিছু
শুধু এক পলকেই জেনে নিলে আমার না বলা যত কথা “
তখন ইশক মাজাজির রশ্মি ,ইশক হাকিকির আলোর বন্যায় মিশে গিয়ে হয়ে ওঠে অলৌকিকের হেম সংকেত।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে ।
জামালি অনেক রাজা বাদশা দেখেছেন । দেখেছেন ইতিহাসের অমোঘ পালা বদল । সুলতানের পর এসেছে মোঘল । তাও দেখেছেন তিনি ।
লিখেছেন
"বাবরের আগে , হুমায়ুনের আগে
দীর্ঘ শীতের বহু আগে
সুলতান সিকন্দর, সেই শাসক
কবি আর কবিপ্রেমিক ছিলেন
আমাকে পরিয়েছিলেন তাঁর
সভাকবির মুকুট । "
নিবিষ্ট হয়ে দেখছেন জামালি , সেগুন গাছের উড়ো পাতা ঝাঁটিয়ে দিচ্ছে এক বালক । তার চোখদুটো অনিক্স পাথরের মত । তার হাতের আঙুলগুলো কী সুন্দর !
মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন জামালি । কেউ একজন এসেছে । তার হাতে ধরা রেশমের জামা পড়ানো পত্র ।
জামালি হাসলেন , বললেন, সুলতান সিকন্দরের কবিতা এনেছ ? দাও দেখি , কী ঠিক করতে হবে । তুমি একটু বস তাহলে ।
২
শীতও জাঁকিয়ে পড়েছে । হীরামনের পাগলামিও ততোধিক । তিনি এখন বালাপোষের ওম ছেড়ে বেরুতেই চান না । ডানা ঝাপ্টানোও বন্ধ । খালি চোখ বুজে আয়েশ করা এবং আজগুবি বকা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করছেন না । জানালার ওপর পুরু পর্দা । টুপটাপ শিশিরের হিম জমা হচ্ছে কাচের পাল্লায় । বেগুনি পিটুনিয়ার সেই হিম আবার ভালো লাগে । অন্ধকার বারান্দায় আমি ঠিক জানি দোয়েল দম্পতি এসে জম্পেশ করে হীরামনের নিন্দে করছে । হীরামন যা ঝগরুটে !সে বললে কবিতা মেরামতির আরও গল্প নাকি তার জানা আছে ।
কুমড়ো বিচি ভাজা আর গয়না বড়ি ভাজা ,খোলায় ভাজা শুকনো চিঁড়ে , আর কলার চিপস । বেশ গুছিয়ে বসেছি, বুঝলেন ।ইবন বতুতা লিখছেন , বঙ্গদেশ বড় সুন্দর । শস্যদানা উপচে পড়ছে । আর সব জিনিশের দাম নাকি অবিশ্বাস্য রকমের শস্তা !
কম্বলে পা ডুবিয়ে বই এ চোখ রেখে বললুম, রাখ তোর কবিতা । ইবন বতুতা কী সুন্দর লিখেছে হীরামন, তোকে পড়ে শোনাই ।
-পার্সিয়ান ক্যান্ডি , পার্সিয়ান ক্যান্ডির কথা ওই ইবন লেখেনি ?
-সে আবার কী ?আর ইবন বতুতা তোর ইয়ার দোস্ত নাকি?
-ওহ , তুমি এটাই জানো না ? এইটুকুন টুকুন মিষ্টি মিষ্টি ছোট্ট ছোট্ট দানা , জিভে জড়িয়ে যায় , হিহিহিহি।।
-বল না রে ব্যাপার খানা কী ? হিহিহিহি মানে তো তোর হেঁয়ালি বকা ।
-তাহলে তো শিরাজির কথা বলতে হয় ।
-শিরাজি মানে তো মদ! তুই শেষকালে আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস হীরামন !
-এ শিরাজি সেই শিরাজি নয় , এ হল হাফিজ এ শিরাজ । পারস্যের শিরাজ শহরে হাফেজ নামে এক কবি ছিলেন ।
- হীরামন!! আমি কি হাফিজের নাম জানিনা ? তুমি বড্ড বেড়েছ কিন্তু ! কী মনে আছে বলে ফেলো চটপট ।এখখুনি ফুলকপির বড়া আসবে ! তার আগেই শেষ করবি কিন্তু ।
বকুনি খেয়ে হীরামন এই প্রথমবার ডানা ঝাপটিয়ে ফড়ড়ড়ড় করে উঠে বসে । বলে শোনো তবে , তোমায় শুনিয়েই ছাড়ব আজ! শোনো ,
সাকি ! গোলাপ , টিউলিপ , সাইপ্রাসের বাগানে কী হিল্লোল ।ভারতের তোতা পাখিদের কী মিস্টি বোল
পারস্যের মধুস্বাদ ,কে করিবে আস্বাদ ?
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলি , তোর ওই বোকা বোকা কবিতাগুলো বলে এই আরামের সন্ধেবেলাটা মাটি না করলে চলছে না। না?
-হীরামন ক্যাঁক ক্যাঁক করে বলল , বোকা বোকা ?শোনো তবে , এগুলোকে বলে মেটাফোর !
-চুপ ! মেটাফোর শিখতে হবে একটা টিয়া পাখির কাছে? মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি?
- হ্যাঁরে বাবা , শোনোই না ! সুলতান গিয়াসুদ্দিন তিনটে লাইন লিখে আটকে গেলেন । কিছুতেই আর মনের মত করে লিখতে পারেন না । সব ভাব ,আবেগ ছন্দ আটকে যাচ্ছে । কিছুতেই খুলছে না ।
- তা এতো ভাব আবেগ কার জন্য?
-কার নয় , বল কাদের জন্য ? গিয়াসুদ্দিন ছিলেন ইলিয়াস শাহি সুলতান । এই গৌড় বাঙলার । তিনি খুব করিতকর্মা । অনেক দূর দূর দেশের সঙ্গে মেলামেশা করতেন যেমন চিন দেশ , পারস্য । তা ইনি আবার শের শায়েরিও করতেন । একদিন সুলতান ভয়ানক অসুখে পড়লেন । ঘা , পাঁচড়া এইধরনের , বুঝলে?
-তারপর?
- সুলতান হলে কীই হবে ? সেবার ভাগ নিতে সবাই কিন্তু হই হই করে এগিয়ে এলোনা । এগিয়ে এলো তার হারেমের তিনটি মেয়ে । দিনরাত এক করে সুলতানকে তারা পরম মমতায় , সেবা, যত্নে সারিয়ে তুলল । এই নিয়েও নাকি অনেক হারেম পলিটিকস হয়েছিল , জানো ?
- সে যাক গে , মরুক গে । তুই গল্পটা শেষ কর ।
- সুলতান তো এই সেবা যত্ন পেয়ে কৃতজ্ঞতায় গলে গেলেন ! ভাবো একবার , সুলতানদেরও জীবনে এমন সময় আসে! তিনি ভাবলেন এই সেবাযত্নের প্রতিদানে তিনি নানান উপহার এসব তো দেবেনই , এর ওপর একটা কবিতাও লিখে দেবেন সেই তিন মেয়ের জন্যে । কবিতায় তিনটি ফুল সেই তিনটি মেয়ে । বুঝলে তো মেটাফোর !
- উফ , তার পরে কী হল ?
- তার পরেই হোল গন্ডগোল । সুলতান আর কিছুতেই কবিতাটা শেষ করতে পারছেন না । ভাষা , ছন্দ, ভাব সব গুলিয়ে ফেলছেন ।ওই সিকন্দর লোদির মত । কিছুতেই মনের মতো হচ্ছে না । হিন্দোস্তানের তোতা মানে কবিরা তো নাজেহাল ।খালি বকা খাচ্ছে সবাই । দেখেছ , কবি বোঝাতে তোতা শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে ! একমাত্র তুমিই শুধু আমাকে সবসময় খিচখিচ কর অথচ ইতিহাসে দ্যাকো ….
- কিসসা টা আগে শেষ কর হীরামন ।
- শোনো , হিন্দোস্তানের তোতাদের মানে কবির দলের যখন কালঘাম ছুটে গেছে সে সময় সুলতান গিয়াসুদ্দিন , মসলিন সমেত আরো নানান উপহার দিয়ে তার খাস দূতকে পাঠিয়ে দিলেন পারস্যে । কার কাছে জানো ? খোদ কবি হাফেজের কাছে । বিনীত অনুরোধ , কবিতাটি সম্পূর্ণ করুন আর আমার দেশে এসে থাকুন ।
-তারপর ?তারপর ?
- হাফেজ চিঠিখানা পড়লেন । দূতকে বললেন কবিতটি তিনি সম্পূর্ণ করবেন কিন্তু পারস্য ছেড়ে এই বয়সে সুদূর বঙ্গদেশ যাওয়া তার পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব । সেই শায়েরিটাই হল পার্সিয়ান ক্যান্ডি । হিন্দোস্তানের তোতাদের ঠুকরে ঠুকরে খাবার জন্য কবি হাফেজ পাঠিয়েছিলেন পারস্যের শিরাজ শহর থেকে, তার কবিতার মধু মাখিয়ে মাখিয়ে । ভালো না ? গল্পটা ?
-ওহ, ভারি গল্প ! হাফেজকে নিয়ে আমি আরো আরো গল্প জানি । তিনি খুব বেশি করেই আমাদের দেশে এসেছিলেন ।
- এসেছিলেন মানে ?
-মানে মেটাফোর ! মেটাফোর ।
- এই প্লিজ বল , আমি বিরক্ত করব না , বল না প্লিজ ।
-যে পার্সিয়ান ক্যান্ডির কথা খুব করে শোনালি সেই ক্যান্ডি খেয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দে নেচে উঠতেন । অনেকে ভাবত তাঁর মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে ।!
- এই শোনাও শোনাও আমি এই চুপ করে বসলুম । ঠোঁট বন্ধ করে , ডানা বন্ধ করে ।
- কী আর বলব ? দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাফেজ প্রীতি সবাই জানে । হাফেজের কবিতায় তিনি মগ্ন হয়ে পড়ে থাকতেন । হিমালয় ভ্রমণের সময় সারাটা পথ উঁচু গলায় হাফেজ পড়তে পড়তে চলেছেন । মধ্যরাতে নিদ্রাহীন চোখ তাঁর হাফেজকেই খুঁজেছে ।
“ আমি তো কেবল প্রার্থনা করেছি তোমার দৃষ্টির বিদ্যুতের আলো ।এ ছাড়া আর কোনো প্রার্থনা ছিল না আমার । বিদ্যুৎ পড়ে যদি সব ছারখার হয়ে যায় তো যাক । বিদ্যুৎ পড়ুক বিদ্যুৎ পড়ুক বলতে বলতে সব কিছু যদি জ্বলে যায় তাতে আর আশ্চর্য কী ?”
এমন হাফেজপ্রেমিক দেবেন ঠাকুরের ছেলে তাঁর সত্তর বছর বয়সে এসে বসলেন কবি হাফেজের পাশে । পারস্যে হাফেজের সমাধির পাশে বসে রবীন্দ্রনাথের মনে হল কোন ভুলে যাওয়া বসন্ত থেকে কোনো এক মুসাফির এসেছে যেন ।
৩
খুদি বা অহং কে ধুয়ে জল না করলে ইশক মাজাজি থেকে ইশক হাকিকিতে পৌঁছবে কেমন করে ? রাধা কৃষ্ণের মত তাই ফিরে ফিরে এসেছে হির রাঞ্ঝা , লায়লা মজনু বা মুমল মহেন্দ্র ।বুল্লে শাহ গাইতেন
“ কাল আমি রাঞ্ঝা থেকে দূরে ছিলাম
আজ আমি মিলেছি আমার প্রভুর সাথে
ওগো , আমাকে তোমরা হির বলে ডেকো না
ডেকো আমায় রাঞ্ঝা বলে শুধু “
ইশক মাজাজি যদি ফুল হয় , সুগন্ধে মাতায় , ইশক হাকিকি হল ফল মানে আল্টিমেট । ব্রহ্মে লীন ।
রুমি লিখছিলেন ,
"তৃষ্ণা আমাকে জলের কাছে নিয়ে এসেছে
সেখানে আমি চাঁদের প্রতিফলন কে আঁজলা করে পান করেছি ।"
জলের মধ্যে চাঁদের আলো পান করতে রুমিকে শিখিয়েছিলেন ভবঘুরে চালচুলোহীন শামস । পণ্ডিত রুমির খুদি বা অহং ধুয়ে আসল রুমিকে টেনে বের করে এনেছিলেন শামস এ তাব্রিজি । শামস মাঝে মাঝে হাওয়া হয়ে যেতেন । রুমি খোঁজ খবর করে ধরে নিয়ে আসতেন । শেষ বার যখন শামস উধাও হলেন দীর্ঘ শোকের পর রুমি উপলব্ধি করলেন শামস তো কোথাও হারিয়ে যান নি । রুমি আসলে শামসের মধ্যেই মিশে গেছেন । তাঁর ছাত্র হুশামকে তিনি বলেন আর শামসকে খুঁজতে হবে না । এক গভীর উপলব্ধি থেকে রুমি যা বলে যেতেন হুশাম লিখে রাখত । এইভাবেই রচিত হল মসনভি ।
"জায়গাটা সুন্দর। পুকুর ঘাট। তার পাশে একটা ভরন্ত আখরোট গাছ। একটা খ্যাপাটে লোক সেই গাছে উঠে বসে একটা একটা করে আখরোট তুলে পুকুরের জলে ফেলে দিচ্ছে।আর কান খাড়া করে শুনছে, একটা একটা করে বাদাম টুপ করে জলে পড়ছে।ছোট ছোট বুদবুদ।জলটা তিরতির করে কেঁপে উঠল। জলতরঙ্গ।
একটা সেয়ানা লোক এসে বলল, আচ্ছা বুদ্ধু তো! যখন নীচে নেমে আসবে, একটাও বাদাম পাবে না। সব জলে ভেসে যাবে।
খ্যাপাটে লোক টা বলল, আমি তো আখরোট তুলতে আসিনি। আমি তো আখরোটের বাজনা শুনতে এসেছি!শোন, কেমন সুর তুলছে ওরা জলের মধ্যে।শোন।"
দু:খিত। লেখাটি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।।ছবিও সংযোজিত।
এরকম কাব্যশ্রীমণ্ডিত গদ্য কম পড়েছি
আমার প্রথমে জিহাল-এ-মিসকিন মনে এসেছিল। তবে ছাপ তিলক হয়ত বেশি কাছাকাছি। বা সম্পূর্ণ অন্য কিছু।
Chaap Tilak Sab Chheen Li Re Mose Nainaan Milayike
You Have Snatched Away All Trace of Me With One Glance of Your Enchanting eyes
Yakayak az dil do chashm-e-jadu,
Basad farebam baburd taskin.
Suddenly, using a thousand tricks
the enchanting eyes robbed me of my tranquil mind.