

~ ৩ ~
বিধাতার পিঙ্গল কেশরাশিতে জট লেগেছে। উত্তুরে হাওয়ায় খড়খড়ে হয়ে গেছে গায়ের চামড়া। মুখে অজস্র বলিরেখা, চোখ দুটো ঘোলাটে আর চোখের তলায় পুরু কালি বলে দিচ্ছে তিনি ইদানীং বিনিদ্র রজনি যাপন করছেন। হনহন করে এসে খুব বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন, “শোনো, আমি আর দেরি করতে পারব না। কালই আমি মহাপ্লাবন আনব। তুমি এইবেলা পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে নাও।”
যাকে উদ্দেশ্য করে তিনি এই কথাগুলো বলছিলেন সেই নোয়াহ তখন একটা পাথরের ওপর বসে একটা লম্বা লতানে গাছ পাকিয়ে পাকিয়ে তাঁর নতুন বল্কলের দড়ি বানাচ্ছিলেন। খুব অবাক হয়ে মুখ তুলে বললেন, “সে কী! আপনি তিন দিন পরে প্লাবন আনবেন বলেছিলেন। এখনও কত কাজ বাকি। জাহাজটার পাটাতন মেরামত করতে হবে। পালটার গায়ে বেশ কিছু তাপ্পি লাগাতে হবে। অমন পেল্লাই তিন থাক জাহাজ! সব ঘর-গেরস্থালি গুছিয়ে তুলে নিয়ে ভেসে পড়তে হবে। বাঁচব কি মরব ঠিক নেই, আর আপনি হুট করে এসে বলছেন কালকেই প্লাবন আনবেন! তা ছাড়া আমার বল্কলটাও বানানো শেষ হয়নি।
বিধাতা খুবই রাগের সঙ্গে বলে উঠলেন, “পাপের ভার আর আমি বইতে পারছি না! এত পাপ আর পাপের বিষে আমার ভালো করে নিশ্বাস নেওয়া হচ্ছে না। আমি ঘুমুতে পারি না। আদম আর ইভের বংশধরেরা আমার কালঘাম ছুটিয়ে দেবে জানলে আমি কখ্খনো মানুষ বানাতুমই না। শোনো হে নোয়াহ, আমি তোমাকে আর সময় দিতে পারব না। যা যা করবার এখ্খুনি করো। আমি কাল ঘোর প্লাবন নিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করে দেব। তোমাকে যেমন যেমন বলে রেখেছি, যাও করে ফ্যালো চটপট।
এই বলে বিধাতা একটা পাঁশুটে মেঘের আড়ালে হাওয়া হয়ে গেলেন।
নোয়াহ আর যাই হোক, বিধাতার মুখে মুখে কী করে তক্কো করেন? উপরন্তু তিনি বিধাতার বিশেষ প্রিয়পাত্র। তাঁর ওপর বিধাতা একটি অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব দিতে চলেছেন। নোয়াহ পড়িমরি করে ছুটে বউকে ডেকে বললেন, “গিন্নি, প্রভু বেজায় চটে আছেন। যা যা গোছাবার, এইবেলা গুছিয়ে নাও। মনে আছে তো কী কী নিতে হবে সঙ্গে? আমি যাই জাহাজটার পাটাতন, পাল এইসব ঠিক করিগে।
বিধাতা প্লাবন তুললেন। সে এক কীর্তিনাশা মহাপ্লাবন। ফুলে উঠল সমুদ্র। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে গেল। সব। জীবনের কোনো চিহ্নই রইল না। শুধু তোলপাড় জলরাশির মধ্যে গর্জনশীল চল্লিশার ঢেউ-এর মধ্যে আছাড়িবিছাড়ি খেতে লাগল মোচার খোলার মতো একটা জাহাজ। হ্যাঁ, ওটাই নোয়াহর তিনতলা জাহাজ। প্রলয়পয়োধি জলে তখন কেশব বিষ্ণু, নৌকার মতো মৎস্য অবতার হয়ে ডুবন্ত প্রাণকে রক্ষা করছিলেন কোথাও বা।
নোয়াহর তিনতলা জাহাজও বাঁচাল, ওই মৎস্য অবতারের মতোই সমস্ত প্রাণকেও বাঁচাল। নোয়াহ তাঁর বউকে বলেছিলেন, “সব প্রাণীদের ভেতর থেকে একটি নারী আর একটি পুরুষ বেছে নিয়ে ভেসে পড়ি চলো। আবার যদি কোথাও গিয়ে ঘর-গেরস্থালি বাঁধতে পারি। জীবন রুইতে পারি কোনোদিন!
এইভাবে জলের প্লাবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে ভাসন্ত-ডুবন্ত নোয়াহ একদিন দেখলেন, নাহ, অতটা উথালপাথাল মনে হচ্ছে না আজ! তিনি জাহাজের কুঠরি থেকে বেরিয়ে দেখলেন দিগন্তে এক পাহাড়ের আবছা ছায়া।
আবার এদিকে কোথায় যেন মন্দার পর্বতকে দণ্ড করে ক্ষীরসমুদ্র মন্থন হচ্ছিল। কেশব বিষ্ণু কচ্ছপ হয়ে তাঁর পিঠের শক্ত খোলের ওপর সেই পাহাড়কে তুলে নিলেন। মন্থন হল শেষ, উঠল অমৃত। প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খাবার চাই।
নোয়াহর জাহাজও এত দিন পর যেন জিরোতে চাইছে। সেই পাহাড় দুধেল গাইয়ের মতো তুলতুলে বরফে মোড়া। নোয়াহর মুখে বিজয়ীর হাসি। চিৎকার করে বলে উঠলেন, “গিন্নি, ও গিন্নি বাইরে এসে দ্যাখো একবার। এই পাহাড়ের গায়ে জাহাজটাকে ভিড়িয়ে দিই। চলো একটু ডাঙায় নামি। মনে হচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে গেলুম গো!”
নোয়াহর জাহাজ থামল। সেই পাহাড়ের তলায়। জাহাজ বাঁধা হল পাহাড়ের গায়ে। নোয়াহ, সেই প্লাবন-পূর্ব যুগের আদিপিতা, আদি মাতাকে ডাক দিয়ে বললেন, “ভাঁড়ারে কী কী আছে দ্যাখো একবার। কিছু একটা রাঁধতে ভারী ইচ্ছে করছে। গিন্নি ভাঁড়ার হাঁটকে বললেন, “এই যা আছে নাও।” নোয়াহ জুলজুল করে দেখলেন কয়েক দানা গম। কিছু যব, একটু-আধটু দানা এদিক-সেদিক ছড়ানো-ছিটনো, ফলের দানা, দুটো বাদাম। তাই নিয়ে নোয়াহ পুডিং রাঁধতে বসে গেলেন। পুডিং বা পিষ্টক সে যাই হোক না কেন , তিনি মহানন্দে সেই পুডিং বানিয়ে গিন্নি আর যত ক-টি প্রাণী তাদের সঙ্গে ছিল সব্বাইকে নিয়ে খেতে বসলেন। এর নাম আশুরে। মধুসূদনের ভাঁড়ের মতো সেই খাবারে বেশ কুলিয়ে গেল সব্বার। খেয়েদেয়ে সেই বরফ তুলতুলে পাহাড়ের কোলে বসে খানিক বিশ্রাম নিলেন তিনি।
এই আরারত পাহাড়, আর্মেনিয়া আর তুরস্কের সীমানায়। হিব্রু বাইবেলের জেনেসিসে এইসব গল্প লেখা হয়েছে। আরমানি তুর্কিতে একেবারে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এখন দু-দেশের সীমান্ত বন্ধ। এদিকে মহরম মাসের দশ তারিখে মানে আশুরের দিন তুরস্কে বানানো হয় নোয়াহর আশুরে পুডিং। পরিমাণে অনেকটা করে। সবার মধ্যে ভাগ করে খাওয়া হয়। প্যাকেটে প্যাকেটে বাক্সে বাক্সে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়। ইহুদি, আদি খ্রিস্টান আর ইসলাম ধর্মের গোলোকধাঁধায় দুই দেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে আরারাত পাহাড় মুচকি মুচকি হাসে। সে তুরস্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে। অথচ আরমানির জাতীয় প্রতীকে দিব্যি রয়ে গেছেন!
বড়ো পবিত্র এই আশুরে। এই দিনে নাকি বিধাতা আদমের রাশি রাশি পাপ ক্ষমা করে দেন, নোয়াহর জাহাজ মহাপ্লাবনের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পায়, নোয়াহ মিষ্টি মিষ্টি আশুরে রাঁধেন আর জীবকুল আবার বাঁচতে শুরু করে। আবার আকাশ হেসে ওঠে, ফুল ফোটে চাঁদ ওঠে। ছেলেটি বাঁশি বাজায়, মেয়েটি সুর তোলে। ছেলেটির কাঁধে টিয়াপাখি শিস দিয়ে ডেকে ওঠে। জীবন রোপিত হয় আবার!
সেই যে সব প্রাণ একটি একটি করে বেঁচে গেল, তার মধ্যে আমিও বাঁচলাম, বেঁচে রইল আমার হিরামনও। সে এখন বেশ ডাগরডোগর। বাঁকানো লাল ঠোঁট, চকচকে সবুজ পালক। আমার কাঁধে বসে থাকে। এখনও বসে আছে। তাকে কাঁধে নিয়েই আমি চলেছি। মেহরাউলির পথে। শুধু আমি একা নই। গোটা শাহজাহানাবাদ আমার সঙ্গে চলেছে। আমার সঙ্গে চলেছে বললে ভুল বলা হবে। চলেছে সব বাদশার সঙ্গে। বলতে গেলে শাহজাহানাবাদ আজ ফাঁকা। বাদশা সাজগোজ করে চতুর্দোলা সাজিয়ে মেহরাউলির পথে চলেছেন। বাদশা চলেছেন তাঁর প্রিয় উৎসবে। শুধু বাদশার নয়, তামাম শাহজাহানাবাদের বড়ো খুশির তেওহার। ফুলওয়ালো কি সয়ের। সয়ের এ গুলফারোশাঁ। ফুল ব্যবসায়ীদের মোচ্ছব। চারিদিকে শুধু রং আর রং। এই ফুলগুলো দিয়ে বড়ো বড়ো ঝালর দেওয়া লম্বা লম্বা পাখা বানানো হয়। লাল, হলুদ, গোলাপি, কমলা রঙের ফুলের বাহারে চোখ ঝলসে ওঠে। পাখার চারদিকে সোনালি রুপোলি জরির ঝালর। শোভাযাত্রা করে এই রঙিন পথচলা। বাদশা আর শাহজাদা-শাহজাদিদের দোলা সবার আগে।
হিরামন বলল, “না না-আ, ঠিক বলছ না, সবার আগে নফিরিওয়ালা। তারা চলত তাদের নাকাড়া বা ডঙ্কা বাজিয়ে।”
—তারপর?
হিরামন বলে, “ভুলে গেছ সব? তারপর থাকত গাইয়ের দল আর সানাই। কী রাগ বাজত মনে আছে? নাকি তাও ভুলে বসে আছ?”
আমি বললাম, “না না, মনে আছে, মনে আছে মল্লার, মল্লার।”
আকাশে তখন শাওন-ভাদর নখরা। এই ঝিরঝিরে বৃষ্টি, এই রোদ উঠে গেল। ভেজা পথে লটকে পড়ে থাকে অকাল গুলমোহর। আর বাতাস পাগল করে উড়ে বেড়ায় গোলাপের পাপড়ির সুগন্ধ। তার সঙ্গে রংমিশালি পতঙ্গ, ঘুড়ি।
বাদশা জাফরের খুব প্রিয় উৎসব। আমি মুখিয়ে থাকতাম কখন দেখব সেই প্যায়জনিয়া পরা টুকটুকে গোলাপি পা, মাটিতে তার নাজুক বুড়ো আঙুলের চাপ। অমনি মাথায় হিরামন ঠুকরে দেয়, খুব লায়েক হয়েছ না? সব বুঝি আমি।
হীরামন এক দণ্ড দাঁড়াতে দেয় না। তাকে চারদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে হয়। মেহরাউলির বাড়িগুলো একেবারে চমকাচ্ছে। ঝকঝক করছে সরাইখানা। কোথাও ফাঁকা নেই। ছন-ছনানান, ঘুঙরু বাজে। হুঁকোর গলায় ফুলের মালা জড়ানো।
পান খেয়ে মুখ লাল। মিঠাইওয়ালা মিঠাই বানায়। তন্দুর ভরতি খমিরি রুটি। বড়ো বড়ো মটকা ভরতি ঠান্ডা জল।
—মিয়াঁ, আব এ হায়াত পিলাউ?
আব এ হায়াত, জীবনের জল। বয়েই চলেছে, বয়েই চলেছে। কত ঘাটে ঘাটে থামছে, কত গন্ধ মাখছে, কত রকম পাত্রে ঢুকছে, আবার মেঘ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে।
আমি আর হিরামন কেওড়া দেওয়া ঠান্ডা জল খাই। আবার হাঁটি। সন্ধেবেলা বড়ো তালাও-এ আতশবাজি জ্বলবে। হিরামন আবার বাজি দেখলে ভয় পায়!
বাদশা জাফর প্রথমে থামবেন মা যোগমায়ার মন্দিরে। সেখানে ফুলের চাদর পেতে দেবেন। সক্কলে চাদর পেতে দেবে। সেখানে প্রসাদ খাওয়া হবে সবাই মিলে। আমরাও খাব।
তিনদিন ধরে সারা মেহরাউলিতে আনন্দলহরী। মা যোগমায়া মন্দিরের পরে ফুলের চাদর বিছিয়ে দেওয়া হবে কুতুবুদ্দিন বাখতিয়ার কাকি বা কুতুব সাহাবের দরগায়। সুফিসন্ত কুতুব সাহাব আর মা যোগমায়ার প্রেমের আলোর সুতো গেঁথে তুলছে এক অপূর্ব ফুলের মালা। হিরামন বলে, “তুমি জান এই মালার নাম কী?”
আমি বললুম, “তুই বল না! তুই তো খুব ওস্তাদ! সব জানিস।”
—এর নাম গঙ্গা জমুনি তেহজিব। এই মালা লম্বা হয়ে হয়ে গাঁথা হয়েই যাচ্ছে।
আমি বললুম, “এত ভারী ভারী কথা বুঝতে পারি না। চল ওইখানে যাই, রেশমি দড়ির ঝুলায় ফুলের দোলনায় পরিরা কেমন দোল খাচ্ছে, একটু দেখি গে যাই।” হিরামন, আমার মাথায় আলতো ঠোক্কর মেরে বলল, “যার যেদিকে ধান্দা!”
নবাব লখনউ ছাড়ার আগে তার মহল, ঝরোখা, দরজা, জলভরা চোখ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন আর তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে এল—
“যব ছোড় চলে লখনউ নগরি
তব হাল আদম পর ক্যা গুজরি ...।।
চলে তো এলেন। কিন্তু এমন এক শহরে এলেন যে তার হৃদয় উৎসারিত সেই নজম সেই শহরের এক অতি মনোরম কবির হাতে পড়ে কী হাল হল, সেই কবি লিখলেন তাঁর এক নাটকের জন্য।
“কত কাল রবে বল’ ভারত রে
শুধু ডাল ভাত জল পথ্য ক’রে।
দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন—
ধর’ হুইস্কি-সোডা আর মুর্গি-মটন।
যাও ঠাকুর চৈতন-চুট্কি নিয়া—
এস’ দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিয়া।”
এখন আমার আর সব কথা ভালো মনে পড়ে না। ওই হিরামন মাঝে মাঝে সুতোয় মাঞ্জা লাগিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়, তখন হাওয়ায় হাওয়ায় বিজলি, মেঘ আর রাতের জোনাকি আর আমার দশ ইঞ্চি টবের দুটো অকালে ফোটা বেলফুল সেইসব কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
বৃষ্টি ভেজা জুঁইফুলের গন্ধ পেলেই জোনাকিরা দল বেঁধে বেরিয়ে আসে। তখন মগজের খুপরির ঘুপচি অন্ধকারে আর কাঁহাতক থাকতে পারে ওরা ?
নাক আর কানের ফুটো দিয়ে একটা দুটো, একটা দুটো করে বেরুতে থাকে। গিল কা ইত্তর হাতের কব্জিতে যদি একটু লাগানো থাকে আর ধুনোদানে যদি বড়ো ঠাকুমার জ্বালিয়ে দেওয়া সম্ব্রনী ধিকিধিকি ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকায়, তাহলে পরিস্থিতি একেবারেই হাতের বাইরে চলে যায়। তখন ওরা চশমার সামনে জটলা পাকায়। নীল সাদাটে আলোর একটা ছায়াপথ তৈরি করে সেখানে মধুশালা বসিয়ে দেয়। সেই সময় ওদের হোশরুবা থেকে ভালো ভালো লাইন পড়ে শোনাতে হয়।
“The free spirit must drink wine
And my eyes are like goblets
My clay was kneaded with the juice of grapes
…the clergyman passed the decree to remain continuously drunk”
সবটাই ঠিকঠাক থাকে। ঝামেলা পাকায় শুধু হিরামন। সে সারা ঘর ফড়ফড় করে ডানা ঝাপটিয়ে শান্ত জোনাকিদের ভয় পাইয়ে দেয়। আমি ভীষণ বিরক্ত হই।
—তোরা সব দুষ্টু পাখির দল। তোরা খুব বিচ্ছু। গোবেচারা জোনাকিগুলোকে নাজেহাল করার কী দরকার?
সে বললে, “মন্দ বলনি! আমরা পক্ষীকুল খুব গোলমেলে আর সেয়ানা। আবার ডাকাবুকোও বটে।
তবে তুমি ল্যাপটপে এখন যা লিখছ, সেটা কিন্তু আগাগোড়া ভুল!”
আমি বললাম, “মানে? কী বলতে চাস তুই?”
হিরামনের খুরাফাতি বোঝা মুশকিল। হেঁয়ালি ছাড়া আর কিছুই ওর জানা নেই যেন! আমার মুখের সামনে ডানার ঝাপটা মেরে বলল, “ট্রয় যুদ্ধের কারণ, হেলেন?
এক্কেবারে ভুল।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, তুমি সব জেনে বসে আছ! সবজান্তা তোতারানি।”
সে অমনি বলে, “বেশি ঘাঁটিও না। তুমি দুপুরবেলায় বড়ো ঠাকুমা ঘুমুলে লুকিয়ে লুকিয়ে বিল্টুদাদুর আতরের বাক্স খোলো কেন, আমি জানি না বুঝেছ? তুমি জান যে আতরে জিন আর পরি থাকে। বিল্টুদাদুর কাছে ওরা রাত্তিরবেলা আসে। তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাই দেখতে গিয়েছিলে। ড্রইং শিখিয়ে বিল্টুদাদু বাড়ি এলে আমি সব বলে দেব।”
আমি বললাম, “বিল্টুদাদুকে আমি ভয় মোটেই পাই না। তুই নিজে কী জানিস বল দেখি।”
হিরামন চোখ টিপে বলল, “পথে এসো, পথে এসো। চলো চলো, ঘুরিয়ে আনছি।”
আমার সামনে তখন ধোঁয়াটে ঝিকিমিকি মিল্কিওয়ে। জোনাকির ছায়াপথ। সেই ছায়াপথে আমার রাহনুমা এক তোতাপাখি আর একঝাঁক জোনাকি।
একটা বিশাল রাজহাঁস। রাজহাঁসটির পিচ্ছিল সাদা পালক ঢাকা শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ছে রাজকীয় জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নায় স্নান করছে এক পেলব নারী। বলে নাকি রাজহাঁস শুদ্ধ, পবিত্র ও আধ্যাত্মিক। পরমহংস। ডিভাইন। সেই ডিভাইন রাজহাঁস তুঙ্গ মদমত্ততায় যাবতীয় প্রতীকী সম্ভ্রমকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে পরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে আছে সেই নারীকে।
আমি সেই বিশাল টেম্পেরার সামনে দাঁড়িয়ে হংসমধ্যে বকযথার মতো হিরামনকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী রে?”
হিরামন বলল, “আস্তে কথা বলো। আর গাড়লের মতো কথা বোলো না। তুমি এখন কয়েকশো বছর পিছিয়ে গেছ। মনে রেখো, এটা ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের ধনকুবের মেদিচিদের বাড়ি, থুড়ি প্রাসাদ!
এখন রেনেসাঁর সময়। শুকনো মুখে বাসি রুটি আর পচা চিজ খেয়ে তো রেনেসাঁ হয় না। পৃষ্ঠপোষকতা লাগে। বুঝলে?
মেদিচিরা কত শিল্পী সাহিত্যিককে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলেই এইসব কালজয়ী শিল্প সৃষ্টি হয়েছে, কথাটা বুঝলে!
আর দেখেছ রাজহাঁসটাকে! আমাদেরই খেচর গোত্র। কী সুন্দর, একবার তাকিয়ে দ্যাখো। এই ছবির নাম লেদা আর হাঁস।”
জোনাকিরা হাঁসের ওপর উড়ে গিয়ে বসছে। হাঁসের সাদা পালকে নীল নীল টুনি বাল্বের মতো। আর মেদিচিদের বাড়ির লাগামছাড়া বড়োলোকি দেখে আমার সত্যি সত্যি মাথা ঘুরছে। বাবা, কী দাপট!
হিরামন বলল, মাইকেল এঞ্জেলো থেকে শুরু করে লেদা আর হাঁস আঁকেননি এমন আর্টিস্ট তুমি বোধ হয় খুঁজে পাবেই না। শিল্পীরা খুব পছন্দ করতেন এই বিষয়টা। যেমন আমাদের দেশে কৃষ্ণের রাসলীলা, কালীয়দমন, শকুন্তলা ও সখী , নরনারীকুঞ্জর, মনে করো সেরকমই একটা পছন্দের বিষয়।”
আমি বললাম, “কথা তো হচ্ছিল ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ নিয়ে। আমরা দলছুট হয়ে খামকা মেদেচিদের বাড়িতে বসে বসে এখন ছবি দেখব? নাকি ওরা আমাদের তাজা আঙুর টাটকা জলপাই, কিছু খেতে টেতে দেবে?”
হিরামন বলল, “আমি যদি শখ করে একটু গৌরচন্দ্রিকা ভাঁজি, তাতে তোমার এত আপত্তির কারণ কোথায় হে? বাড়িতে বসে থাকলে তো বিল্টুদাদুর ছবি আঁকার রং গুলতে এখন! তার থেকে ফ্লোরেন্সে বসে বসে শোনো মান্ধাতা আমলের এক দিলচস্পি কিসসা।”
আমি বললাম, “বল, তাহলে।” সে বললে, “বিলাসী লোকেদের ঘর সাজানোয় লেদা আর হাঁসের ছবি থাকবেই ধরে নাও। রেনেসাঁর সময় থেকে আরও পিছিয়ে যাও। আরও। পম্পেই শহরের লাভা ছাইয়ের জঞ্জাল থেকে এখন বেরিয়ে আসছে সেই লেদা আর হাঁস। ফ্রেস্কো। সেখানেও বড়োলোকদের ভিলাগুলোতেও লেদা আর হাঁস।”
দেবী সরস্বতীর পায়ের তলায় যে অতি সুবোধ বশংবদ হাঁস, সেই হংস এখানে এক নারীর সঙ্গে প্রেমোন্মত্ত।
আমি কথার মাঝখানে বলে উঠলাম, “মেদিচিদের বাড়িতে বেশিক্ষণ ভালো লাগছে না, বুঝলি। আমার টাইমক্লকের ভীষণ সমস্যা হচ্ছে। তুই বেরিয়ে চল হিরামন।”
হিরামন বলল, “ন্যাকা! উনি যেন আজকের মানুষ! স্পার্টার রানি হেলেনের পায়ে ঝামা ঘসে দিতে একসময় সে কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বুঝি? লজ্জা লজ্জা করছে?
মন দিয়ে শোনো, দেবরাজ জিউস বা জুপিটার এই গ্রিক মহিলা লেদার প্রেমে পড়েছিলেন।
‘A sudden blow: the great wings beating still
Above the staggering girl...’
মানে শুধু একটি সাধারণ রাজহাঁস নয়, একটি অতিকায় রাজহংস। তার বিশাল ডানার নীচে ঝটপট করছে একটি নরম নারী।”
—তারপর?
“The broken wall, the burning roof and tower
And Agamemnon dead.”
আমি দম আটকিয়ে বললাম, “তারপর?”
তারপর আর কী? ট্রয়ের যুদ্ধ শেষ। স্পার্টার রাজা অ্যাগামেমনন মারা গেলেন। ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস যে স্পার্টার হেলেনকে নিয়ে পালিয়েছিল, সে একে একে স্পার্টার সব বীর যোদ্ধাদের মেরে ফেলল। অ্যাকিলিসকে মেরে ফেলল পায়ের গোড়ালিতে আঘাত করে। অ্যাকিলিস হিল। ওর শরীরের সবচেয়ে দুর্বল অংশ। ওর মা অমরতার নদীতে ছেলেকে চান করাতে গিয়ে পায়ের গোড়ালি ধরে জলে চুবিয়েছিলেন। সারা শরীর জল মাখল, ওই গোড়ালিটুকু ছাড়া। দশ বছর ধরে স্পার্টার সঙ্গে ট্রয়ের লড়াই চলল ওই হেলেনকে নিয়ে।”
আমি বললাম, “তারপর?”
হিরামন বলল, “তারপর আর কী? সব ছারখার হয়ে গেল। অ্যাগামেমনন ছিলেন হেলেনের ভাসুর। হেলেনের পতিদেবতার নাম মেনেলাউস।”
আমি বললাম, “পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে সুকুমার রায়ের বড়োমন্ত্রীর গুলিসুতো খাবার মতো লাগছে। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এবারে চেঁচাব কিন্তু হিরামন, এই বলে দিলাম!”
হিরামন বলল, “শোনো শোনো। অত ধৈর্য হারিও না। তোমায় পরমহংসের মতো জলটুকু ফেলে দিয়ে ক্ষীরটুকু খাওয়াই। রামায়ণ মহাভারতের যুদ্ধ মায় পৃথিবীর যাবতীয় অশান্তি নাকি মেয়েদের জন্য ঘনিয়ে ওঠে? কিন্তু ভেবে দ্যাখো সর্বত্র তার পেছনে পুরুষ কী মারাত্মক কলকাঠি নাড়ে। এক রাজকীয় অতিকায় বলশালী রাজহাঁস হয়ে জুপিটার বা জিউস জাপটে ধরলেন নরমসরম লেদাকে। জবরদস্তি। সেই মিলনে জন্মাল হেলেন। খ্রিস্টের জন্মের মোটামুটি বারোশো বছর আগে। কী লোভ, কী লোভ। এখনও এতটুকুও শুধরোয়নি ব্যাটারা। খ্রিস্টের জন্মের চারশো বছর আগে টিমেথিইয়াস নাকি প্রথম লেদা আর হাঁসের মূর্তি গড়েন। তারপর থেকে সব ওই কপিক্যাট হয়েই চলেছে। ওপরের কবিতাটা একটা সনেট। ইয়েটসের লেখা। উনি কিন্তু বেশ চাবুক হাতেই জিউসের বদমায়েশিকে সনেটে ধরে রেখেছেন।
শুধু একটা সময় দিয়ে এই গল্পকে বাঁধতে পারবে না, জানো। শুধু স্থান কাল পাত্র বদলিয়ে বদলিয়ে যায়! ঘটনাটা একই থাকে।”
আমি হিরামনের জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে বললাম, “তবুও কি জানিস, একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম হেলেনের মায়ের নাম নেমেসিস্।”
হিরামন তার বিখ্যাত ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, “আর ট্রোজান হর্সের মতো আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে হবে না।
কাজেই ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ আসলে হাঁস, হেলেন নয়। ওই ‘হ’টুকুই যা কমন। এই আমি হিরামন তোমাকে বলে গেলাম হক কথা।” আমি হয়বদন হয়ে শুধু বললাম, “হায় হায়।”
—সেই দিঘিটার চারধারে হিজলের ঘন বন। হিজলের অনেক ডালপালা। অনেক। যেন ডাগর মেয়েটির মাথায় ঠাসা ঘন কোঁকড়ানো চুল। সে গাছের শিকড় যায় কতদূর! যেন নদী থেকে সমুদ্রে।
হিজলের বনের মধ্যে মস্ত এক দিঘি। হিজল দিদিরা দিঘির জলের আরশিতে মুখ দেখে আর দুলে দুলে ভালোবেসে একে অন্যের আঁচল জড়িয়ে হাত ধরে আরও ঘন হয়ে বসে। হিজলের বনে পৃথিবীর সব ঘুঘুপাখি কোথা থেকে ডেকে ওঠে সে খবর কুসুমকুমারী দাশের ছেলে ছাড়া আর কেউ কোনোদিন রাখেনি। সেই যে দিঘি, তার নাম গজাল দিঘি। নামটা এসেছে গজার মাছ থেকে। গজার মাছ জান?
হিরামন গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল। সে জানে না।
তখন পিসি বলল, “সে এক রাক্ষুসে মাছ। গজাল দিঘির কোন্ গহিনে অতলে কাদা পাঁকের মধ্যে থাকত। অমাবস্যার রাতে হিজলদিদিদের চুলের ফাঁকে ফাঁকে জোনাকি জ্বলত। সেই অন্ধকার ঝুপসি দিঘির জলে হঠাৎ ঘাই মেরে ফুঁড়ে উঠত গজাল মাছ।”
হিরামন দম আটকিয়ে বসে আছে। ডানা বন্ধ। ঠোঁট বন্ধ।
—তারপর কী হল পিসি?
—তারপর? তারপর বন থেকে বেরুল বাঘ। আর এদিকে দিঘির থেকে পাড়ের দিকে সটান উঠছে গজাল মাছ।
—তারপর?
—কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে, শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা!
পিসির মুখে মা ডাক শুনে হিরামন আকুল হয়ে বলে উঠল, “তারপর কী হল, বাছা?”
—তারপর সকালে উঠে গ্রামের লোকেরা দেখল এই বড়ো বড়ো কুলোর মতো গজাল মাছের আঁশ, চারদিকে ছড়িয়ে আছে। হিজলের গায়ে বাঘের নখের আঁচড়। এই হল আমাদের গজাল দিঘি। খুব পয়মন্ত দিঘি। মেয়ে-বউরা এসে সেইখানে সিঁদুর লেপে দিল। মাঘী পূর্ণিমার রাতে পাড়ের কাছে ভেসে উঠত ঠাকুরের বাসনকোসন। আর তার জল কীরকম ছিল জানিস? আমার মা বলতেন, একেবারে যেন ডালিম!
—ডালিম? জলের রং লালপানা ছিল বুঝি?
—তুমি বাপু একটু কম কথা বলো। ডালিম মানে ওর লাল রং বলিনি, সেই দিঘির জল ছিল স্বচ্ছ। কাচের মতো। ডালিমের দানা যেমন। দিঘির বাঁধানো ঘাটে হিজলের ছায়ায় বড়োমা, মেজোমা, রাঙামা, আমার মা, বাড়ির খুকিরা কত দুপুর-বিকেল কাটিয়েছে। বসার জায়গা বানিয়েছিল কাকারা। আর ছিল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো দাবার ছক। বাড়ির ছেলেরা এসে বিকেলবেলায় খেলত। জ্যাঠামনি, কুট্টিকাকা সবাই।
—জানো, আমাদের হল মাস্টারের গুষ্টি। চল্লিশজন ছাত্র থাকত এবং খেত।
হিরামন তো বিশ্ব কুঁড়ে। কাজকর্মের কথায় খুব উশখুশ করে বলল, “ওরে বাবা, তা, এত কাজ কে সামলাত বাছা?”
পিসি বলল, “চার বউ মিলেই রান্না করত। কিন্তু তার মধ্যেও রকমফের ছিল। এই যেমন মেজোমা, মেজোমার একটা আলাদা পজিশন ছিল সংসারে। কর্তারা তার সঙ্গে সবকিছু আলোচনা করতেন। তিনি বাড়ির সবকিছু দেখভাল করতেন। কার কখন কী দরকার, অসুখ করলে কী পথ্যি, সেরে উঠলে কী পথ্যি। আর বাড়ির সমস্ত বাচ্চাদের লেখাপড়ার দায়িত্ব মেজোমার। কাগজ কেটে কেটে বড়ো বড়ো অ আ ক খ বানিয়ে ছোটোদের উঠোনের মাঝখানে বসিয়ে পড়াতেন। রবিঠাকুরই বলো আর আশাপূর্ণা দেবীই বলো না কেন, মেজোবউরা একটু বেশি ডাকাবুকো। রাঙামা আর আমার মা সমস্ত কাজেই ছিল। আমার মায়ের লেখাপড়া তখনও শেষ হয়নি। সংসার ঠেলে তাকে পড়তেও হত।”
—ওহ তাহলে ওই বড়োমাই একটু আরাম-আয়েশ করতে পারতেন। বুঝলাম।
—হ্যাঁ তা তো বটেই! খুব আরামই করতেন কিনা! কাজ শেষ করে উব্দো খোঁপা বেঁধে আলতো করে গায়ে একটা চাদর ফেলে বড়োমা বেরিয়ে যেতেন গ্রামে, একেবারে ঘুঘু ডাকা ঘন দুপুর শেষ হবার আগেই, যখন সূর্য কাছারিবাড়ির নারকেল গাছের মাথা থেকে নেমে গেছে, বড়োমা সমিতির কাজে বেড়িয়ে পড়তেন।
হিরামন খুব খুশিটুশি হয়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি। সখী সমিতি। আচার দেয়, বড়ি দেয়, ধূপ বানায়।”
পিসি বলল, “কী যা-তা বকছ? তোমার শোনার ইচ্ছে হলে শোনো নয়তো উড়ে পালাও। আমি আমার ভাইঝিকে তার বাড়ির এসব না জানা কথা বলছি। তুমি মাঝখান থেকে কথা বোলো না যেন। আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে। বুড়ো হয়েছি, কথার খেই হারিয়ে গেলে তুমি ধরে দেবে?”
—গ্রামের মধ্যে বড়োমার অনেক কাজ থাকত, জানিস?
স্কুলবাড়ি, কাছাড়িবাড়িতে চরকায় তখন সুতো কাটা হচ্ছে। সে সুতোর প্রতিটি টানায় বোনা হচ্ছে কত ইতিহাস। বাড়ির ছেলেমেয়ে, বউ সব্বাই খদ্দর পরে। গ্রামে গ্রামে মেয়েদের সংগঠনের কাজটি করতেন বড়োমা।
—শুধু তাই নয়, বড়োমা আরও কী কী করতেন জানিস, মেয়েদের লাঠিখেলা শেখাতেন, ছোরাখেলা শেখাতেন। কোমরে কাপড় গুঁজে উঠোনে সব কসরত চলত। আবার ওই উঠোনটাই কখন মেজোমায়ের পাঠশালা হয়ে যেত। বড়োমা, যখন গ্রাম থেকে ঘুরে বাড়ি ফিরতেন তখন উঠোন জুড়ে শাঁখ বাজছে আর ধুনোর গন্ধে প্রার্থনা উঠছে আকাশের দিকে, নম নারায়ণ পরাবেদা/নারায়ণ পরাক্ষরা/নারায়ণ পরামুক্তি/নারায়ণ পরাগতি। সমস্ত পরিবার একসঙ্গে।
তখন দেশজুড়ে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলন। বালগঙ্গাধর তিলক মারা যাবার পরের বছর ১৯২১ সালে গান্ধিজি চাঁদা তোলার জন্য খুললেন তিলক স্বরাজ ফান্ড। সেই তিলক স্বরাজ ফান্ডে বাংলা থেকে অনেক অবদান এসেছিল। সেই যে হিজলের বন, গজাল দিঘি, কীর্তনখোলা নদী, বরিশালের হিজলতলার সেই বউরাও প্রায় সব গয়না তিলক স্বরাজ ফান্ডে দিয়েছিল। স্বদেশির তকমা আঁটা বাড়ি। দেশবরেণ্যদের পদধূলি সিঞ্চিত। পুলিনবিহারী দাস, অশ্বিনী দত্ত, সূর্য সেন। মুকুন্দ দাস, সবাই সেখানে পায়ের ধুলো রেখেছেন। উঠোনের দরজা ফাঁক করে কেউ আওয়াজ দিত পিকেটিং-এ বসতে হবে। বড়োমা রান্না শিকেয় তুলে তাঁর বাহিনী নিয়ে পুলিশের সামনে পিকেটিং-এ বসে পড়ত। আরও ফিসফাস গুজগুজ যখন ঘন হতে থাকত, দু-একটা সেপাই-পল্টন ইতিউতি তাকিয়ে মাস্টারদের উঠোনে ঢুকব ঢুকব করতে থাকত, ঠিক তক্ষুনি পাঁজা করা ছাই মাখানো বাসনের গুঁতো মেরে মেয়েরা বেরিয়ে যেত গজাল দিঘির দিকে। ছাই মাখানো বাসনভরতি ছোরা। সেই বাসন চুবিয়ে দিয়ে আসত দিঘির জলে, গজাল মাছের জিম্মায়। আবার রাতের বেলায় জোনাক পোকা মেয়েদের পথ দেখিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিত।
পুজোর সময় এই বাড়ির ছেলেরাই প্রতিমা গড়ত। নাটক লিখত। এস্রাজ বাঁশি বেহালা, সব বাড়িতেই। এমনকি বাড়ির দেউড়িতে যেসব মূর্তি ছিল যেমন ধর প্রদীপ হাতে মেয়ে, এরম বুঝলি, সবই বাবা, কাকা, কুট্টিকাকাদের হাতে গড়া।
হিরামন আর কথা কয় না। চুপ করে শোনে।
দেশভাগের অরুন্তুদ স্মৃতি যে পরিবারে নেই তারা সেই কষ্ট কখনোই বুঝবে না। ১৯৪৮ সালের শেষ জানুয়ারি। হিজলতলায় খবর এসে পৌঁছোল গান্ধিজিকে গুলি করা হয়েছে। সেদিন অরন্ধন। আগুন জ্বলবে না বাড়িতে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন উপড়ে ফেলা সেই দিনে ভিটেমাটি হারানো সেই বউরা গয়নার শেষ টুকরোটাও ফেলে দিয়েছিল কীর্তনখোলার জলে।
“গান্ধিজি, আপনি কি আমাকে মেঘ করে দিতে পারেন?
এই শরতেই তাহলে বর্ডার ফাঁকি দিয়ে হিজলতলা গ্রামে
আমাদের বাড়ির বাগানের ওপর মুখ বাড়িয়ে দেখতাম
আকন্দ ফুলে ফুলে ঢেকে আছে আমার বিষাদ অভিমান... ” (বাসুদেব দেব)
“পুব বাগানে স্মৃতির আনাগোনা” সেই স্মৃতিবিধুর একটি অন্য দুপুর। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় যারা, তারা স্মৃতিবিধুর নদী হয়ে কেবলই শিকড় ছুঁতে চায়। সেই দুপুরের কথা হিরামনই মনে করিয়ে দিল লিখতে। নইলে ভুলেই যাচ্ছিলাম।
বাইরে তুমুল যানজট আর কান ফাটানো হর্ন, লোকের গুঁতোগুঁতি। কিন্তু যেই গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম, সে এক বিস্ময়কর এক টুকরো শান্তি। পারস্য থেকে চলে আসা আরমানিরা এই শহরে একসময় কিং মেকারের ভূমিকা নিয়েছিল। তারা না থাকলে ইংরেজদের হালে পানি পাওয়া মুশকিল তো হতই। আরমানিদের অগাধ পয়সা। অঢেল। ইংরেজদের সাহায্য করে মোঘলদের সঙ্গে ইংরেজদের দোস্তালি মজবুত করে টুক করে আড়ালে সরে গেছে। একসময় কলকাতার অর্ধেক আকাশ জুড়ে ছিল তারাই। চিৎকার করে নিজেদের কথা বলার জাত এরা নয়। বেদানার রসে ভরা দেশ আরমেনিয়া। সেই রসের স্বচ্ছ অথচ নির্লিপ্ত আস্বাদ পেলাম। একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। রামকৃষ্ণ ঠাকুর বলেছিলেন বাতাস হও, গন্ধ বহন করো কিন্তু গন্ধে লিপ্ত হোয়ো না। আশ্চর্য ভাবে এটাই আরমানিদের বীজমন্ত্র। সেই দুপুরে আমাদের টেম্পারেচার মাপা হল, হাত দুখানি স্যানিটাইজারে ধুয়ে আরমানি কলেজে ঢুকেই দেখি দেয়ালে মাউন্ট আরারাতের ছবি। সেই তুষারধবল আরারাত। যেখানে মহাপ্লাবনের পর নোয়াহ প্রথম ভিড়িয়েছিলেন তাঁর জাহাজ, পৃথিবীর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল। সেই আরারাত পাহাড়ের ছবি আরমানিয়ার সর্বত্র। তারা এখনও সেই পাহাড়ে পৌছোনোর স্বপ্নকাপাশ বোনে। কিন্তু সেই পাহাড় তো তাদের দেশে নেই। সে আছে তুরস্কের সীমানার মধ্যে। আর রয়েছে তুরস্কের হাতে গণহত্যার রক্তের ধারাপাত। সেই নির্মম রক্তপাতের পথ ধরেই মনে পড়ে বুদাপেস্টের বাড়িতে বাড়িতে ইহুদি হলোকাস্টের মর্মান্তিক বিষাদগাথা শোনাতে চায় কত পরিবার। বুদাপেস্টের যে বাড়িটিতে থাকতাম সেখানে এক মস্ত সিন্দুকের মতো কাঠের বাক্স। একটা নকশাদার বিশাল চাবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদ্গন্ধ মাখা সেই বাড়িতে বসে মনে হত ওই চাবি ঘোরালেই বাক্স থেকে হুড়হুড় করে সব চরিত্রগুলো বেরিয়ে আসবে।
রোমের ট্রামে বসে এক উথালপাথাল চশমাসুন্দরীকে ঘাবড়ে-টাবড়ে গিয়ে রাস্তা জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বললে, “ভেবো না, আমিও ওখানেই নামব।”
—তুমি রোমে থাকো? (কী বোকা বোকা প্রশ্ন!)
—হ্যাঁ, কিন্তু আমি মন্টেনিগ্রো থেকে এসেছি। তুমি নাম শুনেছ আমার দেশের?
মেলবোর্নের আমাদের সঙ্গে ছিলেন নিক। বয়স্ক বাবা ধরনের। গাড়ি চালাতেন।
—আমার দেশ? এখানে না। গ্রিসে। কেন এখানে এসেছি? তিরিশের গ্রেট ডিপ্রেশন নিয়ে এসেছে।
তারপর গাড়ি থামিয়ে নেট খুলে কবি স্যাপহোর দেশ লেসবস খুলে দেখিয়ে দিচ্ছে যখন, তখন দেখি প্রশান্ত মহাসাগরে মিশে যাচ্ছে ইজিয়ন সাগরের দু-ফোঁটা চোখের জল।
এই পথা চলার সঙ্গে মার্কিনি মেল্টিং পটের তফাৎ আছে।
আমার ভাইপো, অরোদের স্কুলে ইতিহাস অন্যরকম ভাবে পড়ানো হয়। কী করে কনফ্লিক্ট দানা বাঁধে, সেখান থেকে একেবারে শেষ মাইলস্টোন, মাইগ্রেশন। সাত বছরের বাচ্চা সুইডেনের স্কুলে ইতিহাসের বিজ্ঞান পড়ে। নীল আকাশে মস্ত মস্ত তারার ছবি আঁকে। “বাহ, কী সুন্দর এঁকেছিস! অত বড়ো বড়ো তারা কেন রে?”
হিরামন বলে ওঠে, “ওহো, আসল জিনিসটাই দ্যাখনি, ছবির শেষে দ্যাখো, একটা ছোট্ট ছেলে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। আকাশের দিকে চেয়ে।”
অরো বলে, “ওটা আমি!! ওটা আমি!!”
এখন গরমকাল। সামনের সবুজ লনে বল দাপায় আইমন আর সুলেইমান। অরোর বয়সি। কিন্তু ঠিক অরোর মতো নয়। কোথাও আলাদা। ভীষণ ভাবে আলাদা। কারণ ওরা বয়সে শিশু, কিন্তু মনে শিশু নয়। শৈশব খুইয়েছে কখন, অজান্তে। ঘুম ভেঙে দেখেছে অন্য দেশ। অন্য যাপন। এখানে জায়গা পেতে হলে লড়াই করতে হবে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই শ্রেয়ার ফোন বাজে, দিদি বাড়ি থেকে বেরিও না। জি(গি)য়াটরগে মার্ডার হয়েছে। চার্চের সামনে।
মাইগ্রেশনের পরে কী হয়? অরো হয়তো নিজেই বুঝে যাবে একদিন! তবে সেই তারাগুলো যেন তখনও জ্বলজ্বল করে!
i | 124.17.***.*** | ০১ আগস্ট ২০২০ ১৩:১১95796
Bulu Mukhopadhyay | 122.163.***.*** | ০১ আগস্ট ২০২০ ১৫:০৫95803Asadharon. Sob koti akhyan ek sutoy bona.
Ami Travels of Ibn Batuta porte chai kothay pabo
b | 14.139.***.*** | ০১ আগস্ট ২০২০ ১৬:১৩95806
শক্তি | 2405:201:8805:37c0:4c57:849e:dcc:***:*** | ০৩ আগস্ট ২০২০ ২৩:০৮95879রুহানি পর্ব ৪ সুপর্ণার লেখা নয়তো নৌকো বাওয়া ।কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দেয় ।কি ভাষা, কি কথার বাঁধুনি
Amit | 203.***.*** | ০৪ আগস্ট ২০২০ ০৪:৫৪95881
Tim | 174.102.***.*** | ০৮ আগস্ট ২০২০ ০৮:০৬96033