সবে দোকানের ঝাঁপ খুলেছি। ঝিলমিল ঝিলমিল প্রজাপতি রোদ্দুর মিছিল করে দোকানে ঢুকে পড়ল আমার কফির দোকানে। আমিই মালিক আমিই বারিস্তা। আমার তো পুঁজি খুব কম। ছোট্ট দোকান। তবে জায়গাটা এক্কেবারে মোড়ের মাথায়। মোড়ের মাথা মানে চারদিক থেকে ঢালু পাথর বাঁধানো রাস্তা উঠে এসে এখানে মিলেছে। একটা দামাল ঝামড়া বেদানা গাছ। তার ঠিক পাশটায়। সেদিক থেকে মোটামুটি জমজমাট। এখন সবে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। আমি কফির মেশিন গুছিয়ে রাখছি। ক্যাকটাসগুলো জানালার কাছে রেখে দিচ্ছি। বোগেনভিলিয়া লালে লাল হয়ে আছে আমার দোকানের কাচের দরজার ওপর। আমি হাট করে দরজা খুলে রেখেছি। রোদ মেখে ফুলের একটা লালচে রং আমার লালসাদা চেক চেক কফিটেবিলের নকশা বুনছে। আন্দালুসিয়ার সেভিয়াতে বরাত জোরে একটু দোকানের ব্যবস্থা হয়ে গেল কোনোমতে। সে আর-এক গপ্প। পরে বলবখন। বেশ জমকালো এই জায়গাটা, ইহুদি খ্রিস্টান মুর ইসলাম সব সংস্কৃতির একটা সাড়ে বত্রিশ ভাজা। বছরের বেশির ভাগ সময় তো ট্যুরিস্টের ভিড়। তবে অন্য ঝামেলাও মন্দ নেই! কাছেই কোথা থেকে হাততালি আর পায়ের তালের চটাপট চটাপট শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাতসকালেই শুরু হয়ে গেছে ফ্ল্যামেঙ্কো নাচ। ট্যুরিস্টদের বায়না, উপায় তো নেই। সাতসকালেই মেকাপ চড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ তোলা পোশাক পরে নাচিয়ের দল হাজির। এই হাততালি আর পায়ের তাল শুনলেই আমার সঞ্জয় লীলা বনশালির গুজারিশ ফিল্মের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে। ঐশ্বর্য রাই নাচছে, কালো লাল স্কার্ট ফুলে ফুলে উঠছে, লম্বা কালো বিনুনি “মিল গয়ি, আজ আসমান সি, আ গয়ি আগে ম্যায় জহা সে, ইয়ে ক্যায়া হুয়া।। উড়ি নিঁদে আঁখো সে জুড়ি, স্বপ্নমোড়া রাতে, এ আমার কী হল। মাটিতে পা দিয়েছি না মেঘে, আঁচল থেকে খসে যায় কুচি কুচি তারা, আমাআআর হৃদয় তোমাতে হল হারা।”
আমি আমার দেশের রঙচঙে ছবিছাবা, নাচের বই কয়েকটা টেবিলে সাজিয়ে রাখি, আলতো করে গান চালিয়ে দিই। সা রে গ প নি সা। সা নি প গ রে সা। বিলম্বিতের চিনি গলে যায় কফির গরম তরলে।
“উন ক্যাফে সোলো, সেনোরিটা।”
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ, ঠিক এসে গেছে। প্রায়ই আসে। আসা-যাওয়ার পথে আমার কফির দোকান পড়ে কিনা।
“অমন তেতো কফি দিয়ে দিন শুরু করবে? ক্যাফে কন লেচে চলবে না?”
“নাহ, তেতোই দাও। মাথাটা জট পাকিয়ে আছে বুঝলে! টাপাস রেডি আছে?”
“অলিভ চিজ মাশরুম স্কুইড, চলবে?”
“তাই দাও।”
কফি আর স্ন্যাক্স সামনে ধরে দিয়ে বললাম, “আবার কী হল আমির? আবার কী করলে?”
আমিরের কোঁকড়া সোনালি চুলে সেই ঝিলমিলে রোদ প্রজাপতি। পাশে রাখা ওর বাজনা বাজুকির ওপর আলতো হাত রেখে বলল—
“বড্ড দেমাক, বুঝলে? পাত্তা দিতেই চায় না।”
“কেন? এইতো সেদিন এত ঝড় তুললে। উফ কী মারাত্মক গিটার বাজাচ্ছিলে, এত ফাটাফাটি বাজাচ্ছিলে যে তোমার নাচনি তো তালই রাখতে পারছিল না। না হাতে, না পায়ে। তুমি বাজুকি আর গিটার দুটোই এতো ভালো বাজাও। লোকজন কেমন পাগলের মতো কচ্ছিল বল?”
এত ভালো ভালো তারিফ আমিরকে টলাতে পারল না। আওয়ারা মেঘের মতো মুখ, বৃষ্টি নামল বলে!
“Ay, Love is a journey through waters and stars,
Through suffocating air, sharp tempests of grain:
Love is a war of lightning….”
স্পেনের সেভিয়াতে বেশ কিছু দিন হল এসেছে আমির পেরেলমান লেবানন থেকে। নামডাক তো ভালোই আছে। দলবল আছে, লোকজনও ঘুরঘুর করে কিন্তু সেভিয়ার সেই ফ্ল্যামাঙ্কো নাচিয়ে তামারঙা মেয়ে তার দুচোখ জুড়ে। বাইলাওরা, নর্তকী!
কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, “আমির জানো, আমাদের দেশে একজন স্টারের নাম আমির।”
“স্টার?”
“ফিল্ম স্টার। আমির খান।”
মোবাইলে ছবি দেখাই।
হাততালি আর পায়ের চটাপট সমান তালে চলছে। দমকা হাসি আর হুল্লোড়। সেই সব হালকা শব্দ ভেসে ভেসে আসছে। দীঘল তামারঙা শরীর জুড়ে পোশাকের সমুদ্র ঘাগরা, তার বসনপ্রান্ত লম্বা হয়ে মাটিতে লুটোয়, নাচলে মনে হয় যেন মৎস্যকন্যা।
“কী অসাধারণ নাচে এরা। মারমেইড। আমার স্বপ্নের মারমেইড। বাইলাওরা!”
আমির আবার উদাস হয়ে গেল।
দূর ছাই! এ তো ভবি ভোলবার নয়। ঘুরেফিরে এক কথা।
আমি বলে উঠলাম “চলো, আমার দেশে এমন কত্থক নাচ দেখাব না ! মৎস্যকন্যা নয় একেবারে রাজকন্যা দেখবে চারদিকে। তখন আর ‘বিন্ত এল সালাভিয়া’ গাইবে না তুমি, গাইবে গোরি তেরি প্যায়জনিয়া। অথবা ভালো কইরা বাজাও গো বুজুকি সেভিয়া সুন্দরী নাচে ,এরকমও গাইতে পারো।”
দু-একটা লোক দোকানের দিকে আসছে। আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ব। বোগেনভিলিয়ার লাল, ফেটে যাওয়া বেদানার ছড়িয়ে থাকা লাল দানা আমার দোকানের লাল-সাদা খোপ কাটা চাদর আর রোদ্দুরের বিলি কাটা জাফরি কেমন যেন ঘোর লাগিয়ে দিল আর তার মধ্যে উত্তাল ঝড়ের মতো হংস্বধ্বনি রাগের মিড়খণ্ড দ্রুত খেয়াল যেন ফ্ল্যামেঙ্কো নর্তকীর লাল-নীল ফুলে ওঠা স্কার্টের ঘের বেয়ে ঝাপটা মারল মুখে। তিরতির তিরতির করে কোথা থেকে রাশি রাশি জুঁই ফুল সেভিয়ার আমার ছোট্ট কফিঘরে সুগন্ধের তুফান এনে দিল। চারদিকে আনন্দের হিল্লোল, আমার সখির বিয়ে যে, আহা চন্দন লেপনে অঙ্গ সুবাসিত, চোখে কাজল ।
অঙ্গ সুগন্ধন চন্দন মাথে তিলক ধরে, লাগি লগন পতি সখি সঙ্গ, পরম সুখ অতি আনন্দন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম আমিরের চোখ দুটো চক চক করছে। ও উঠে দাঁড়িয়েছে।
“সেনোরিটা, এই গান কে গাইছেন?”
বললাম “উস্তাদ আমির খান। আমাদের দেশের একজন... ।” “কথা শেষ হবার আগেই ঝড়ের মতো দোকান থেকে বেরিয়ে গেল আমির। ফিরে এল আবার, তখন আমি ঝাঁপ বন্ধ করছি।
“সেনোরিটা, এটা একবার শোনো। প্লিজ শোনো।”
আমির গিটারে টুং টাং টুং টাং বাজাচ্ছে, আর ধীরে ধীরে সেই অন্ধকার মাখা আমার ছোট্ট কফিশপে বেদানাগাছের তলায় আমির পেরেলমানের গিটার থেকে বাষ্পের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে বেরিয়ে আসছে রাগ হংসধ্বনি। দ্রুত তার চলন। চঞ্চল তার প্রকৃতি। মাদকতা। তার চোখে কাজল, কপালে চন্দন, গলায় জুঁই ফুলের মালা। কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে নেমে আসছে তার চুল, তার বসনপ্রান্ত লম্বা হয়ে লুটিয়ে পড়ছে। আর তাকে দেখাচ্ছে ঠিক ‘বিন্ত এল সালাভিয়ার’ মতো।
সেই অপার্থিব সন্ধের পরে তারপর বেশ কিছুদিন আমিরের আর দেখা নেই। ওর ইয়ারদোস্তদের মুখে শুনলাম ও নাকি অন্য কোথাও চলে গেছে।
কী অদ্ভুত লোকজন সব! যত্তসব ইমোশনাল কাণ্ড-কারখানা! এত আমার দোকানে ধারে বাকিতে খেয়ে গেলি একটা টা টা বাই বাই পর্যন্ত করতে নেই গা!
এর কিছুদিন পরে আমিও পাততাড়ি গুটোলাম। মানে বাধ্য হলাম। সেভিয়ার মিউনিসিপ্যালিটি থেকে হরেকরকম টাপাসের কিয়স্ক বসানো হবে। অতএব আমার এ শহরে ইতি। দোকানের ঝাঁপ শেষ বারের মতো বন্ধ করছি, চুনি পাথরেরে মতো লাল লাল টসটসে বেদানার দানা চারদিকে ছড়িয়ে আছে। যেন কার উজ্জ্বল চোখ থেকে কান্না ফেটে বেরিয়ে আসবে। সেই বালাইওরা মেয়েটিকে নিয়ে আমির যে গানটা খুব দরদ দিয়ে ছলছলে চোখে গাইত, শেষ বারের মতো মনে পড়ল।
নাহ, গোরেমিতে, উরুগুপে নেভশেহরে কোত্থাও এতটুকু জায়গা পাচ্ছি না। সুবিধেই করতে পাচ্ছি না। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে ফালতু দিন কাটছে।
শিরিন বলল “একবার আভানোসে চলে যা। এত ভিড়ভাট্টা পাবি না হয়তো, তবে দোকান হয়তো বসিয়ে দিতে পারবি।” আভানোসে বেলা থাকতেই গেলাম। বলতে ভুলে গেছি। আমি এসেছি আনাতোলিয়ায়। আন্দালুসিয়া থেকে আনাতোলিয়া। তুরস্কে।
আভানোসে গিয়ে দেখি চারদিকে মাটির নানারকম পাত্র, ঘড়া, গাড়ু বদনা, ভাঙাচোরা, টুটা-ফুটা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
“আরে এটা কুমোরদের জায়গা, শিরিন। দ্যাখ কত কুমোরের চাক। এদিকে সেদিকে চতুর্দিকে। এই এখানে কে কফি খাবে রে? অ্যাই শিরিন? এ কোথায় নিয়ে এলি?”
শিরিন ছবি আঁকে। কত দেশ ঘোরে। কত জানে শোনে। আমার এই গেঁয়োপনায় খুবই বিরক্ত।
“কী কখন থেকে কুমোর কুমোর করে যাচ্ছিস? আরে এটা পটারির তীর্থ। আভানোসের পটারির খুব নামডাক। এখানে এক ডাকসাইটে শিল্পী থাকেন। গালিপ। মানে আমাদের দেশের গালিব আর কি। শেরশায়েরি না করে পটারি করেন। আরে ওই দ্যাখ চেজ গালিপের ওয়ার্কশপ। কোটি কোটি টাকার জিনিস আছে। কত মেহনত করে বানাতে হয়। কত রং কত নকশা। কত রকমের পদ্ধতি। কুমোরের চাক, কাদার তাল, জ্বলন্ত চুল্লি। গনগনে আগুনে পুড়ে বেরিয়ে আসছে কী অসাধারণ সব কাজ।”
শেষপর্যন্ত শিরিনের অশেষ মুন্সিয়ানায় চেজ গালিপের ওয়ার্কশপের ঠিক পাশে আমার ঠাঁই হল।
অ্যাপ্রন পরে সারা গায়ে কাদা মেখে দাঁড়িয়ে আছে গালিপের ভাইপো কাদির। হাত তুলে শিরিনকে কী সব দেখাচ্ছে।
শিরিন ইশারায় আমাকে ডাকল। কাদির বলল “আপনি এখানে দোকান করুন আর আমাদের এখানে যেসব ট্যুরিস্টরা আসবেন তাদের জন্য চা বানাবেন।”
“চা? আমি তো কফি বানাই।”
“আমাদের এখানে চা-এর চল একটু বেশি। চা কফি দুটোই থাকবে না হয়। তবে আপেল চা-টাও বানানো শিখে নেবেন। সারাদিনে কয়েক দফা করতে হবে কিন্তু। বিকেলের পর আর নয়।”
“ইয়ে, বলছিলাম কী, কত নকশাদার পেয়ালা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আপনারা বোধহয় ফেলে দিয়েছেন। আমি যদি নিয়ে নিই।”
কাদির খুব একচোট হাসল, বলল “কত চান? রোজই পাবেন।”
যাক, একটা ছিমছাম জায়গা দেখে নানান ধরনের কাপ, আনাতোলিয়ার কিলিম, চেজ গালিপের ওয়ার্কশপের সুন্দর সুন্দর ফেলে দেওয়া ভাঙা টাইলস সব দিয়ে আমার চা আর কফির দোকান বসানো হল।
শিরিন বলল, “আমি নর্থ আফ্রিকা যাচ্ছি, আর আমাকে জ্বালাস না। এখানেই বাপু রয়ে যা। চেজ গালিপ মেসো-খুড়োর মতো মাথার ওপর রইলেন। আমি চললুম।”
এই বলে সেই এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ি মায়াবী জায়গাটায় আমাকে একলা ফেলে শিরিন চলে গেল। ম্যাপল গাছের পাতায় তখন হালকা কমলা রং, অ্যাপ্রিকট গাছের ওপরে মস্ত চাঁদ, যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।
“হেলো লেডি, মেরহাবা, নতুন মনে হচ্ছে? আগে তো দেখিনি।”
“দেখবে কী করে? আমি সবে কাল এসেছি। তুমি কে? এত দলবল নিয়ে এসেছ?”
“লেডি, আমি ট্যুর গাইড। গোরেমি থেকে আসছি। ওয়ার্কশপে এখন একদল নানান দেশের ট্যুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাদির বলে পাঠাল এখান থেকে চা আর কফি নিয়ে যেতে। তা, তুমি সামলাতে পারবে তো?”
“আমার দোকানে আমিই মালিক আমিই বারিস্তা।”
“আহাহাহা, এনি হেল্প?”
“না থাক।”
“তোমার বাড়ি কোথায়? ইন্দিস্তান?”
‘হুম।”
“তুমি ইয়োগা জান?”
“একসময় শিখেছিলাম। তুমি জান নাকি?”
“আহাহাহা, জানি না কিন্তু জানার ভান করি! হাহাহাহা।”
এত হাসিরই বা কী হল? আমি মনে মনে ভাবি।
“তা, তুমি এখানে চা-এর দোকান দিয়েছ কেন? ইন্দিস্তানে থাক না কেন?”
এত কেন কেন করলে আমার ভারী বিরক্ত লাগে। বলার মতো কীই বা আমার আছে? বন্ধুদের কাছ থেকে ধারে বাকিতে আমার দিন চলে। আমি এদের এতিমখানাতেই দিন গুজরান করি।
তবে কথা আর বাড়ল না। কারণ ওদিক থেকে ডাক এসেছে।
পরের দিন আবার মেসুট এরজান এল। সে প্রোফেশনাল গাইড। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে। আবার পোল্যান্ডেও গিয়েছিল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে। একটু ফাজিল গোছের। নানান কিসিমের লোক সামাল দিতে দিতে একটা তুখোড় স্মার্টনেস এসে যায়, সেরকমই।
আবার সেই প্রশ্ন, “তুমি ইন্দিস্তান থেকে এখানে কেন এলে?”
“জানো, আমি আগের জন্মে তুর্কি ছিলাম। সেই পূর্বজন্মের টানে টানে এখানে চলে এসেছি। কসমিক কানেকশন বলতে পারো।”
“হুম। ঠিক বলেছ। তাইপের একজন জ্যোতিষী আমকে বলেছিল আমি নাকি আগের জন্মে রোমান গ্ল্যাডিয়েটর ছিলাম। ইন্ডিয়ানও ছিলাম এক জন্মে। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি। আত্মায় বিশ্বাস করি।”
“আমিও।”
“স্ট্রিম অফ ইটারনিটি। অনন্তের ধারা। মৃত্যু একটা নাথিংনেসের দরজামাত্র।
তুমি আমি সবাই সেই পথে হেঁটে চলেছি। অনন্ত টানেল। আজ চলি। এনজয় দিস নাথিংনেস।”
পরের দিন, তার পরের দিন আবার তারপর চা বানানোর ফাঁকে আমাদের পুনর্জন্ম আর নাথিংনেসের আড্ডা মজে মজে আচার হতে থাকে। মেসুটকে আর অত তরল মনে হচ্ছে না। ওপরটা যদিও মিচকিন খুরাফাতি।
“জানো, আমি আবার জন্মাতে চাই কিন্তু এই পৃথিবীতে নয়। এই মহাকাশ এই ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত রহস্যের খনি। এর কিছুই আমরা প্রায় জানি না। আমি অন্য কোনো গ্রহে জন্মাতে চাই।”
“আরে এই সে দিনই তো, পড়নি? একটা রাশিয়ান ছেলে তার আগের জন্মের কথা বলছিল। মঙ্গল গ্রহে। খুব ডিটেইলে সব বলেছে, পড়েছ?”
“ইয়েস, আই রেড। হি টকড অ্যাবাউট টেলেপোরটেশন অল সো। বিস্ময়কর। আমি খুব বিশ্বাস করি। জন্মাতে চাই আবার। তবে অন্য গ্রহে। যদি কোনো ছাতা ধরে থাকো, হাতের মুঠি খুলে দাও, ছাতাটা উড়ে যাক। উড়ে উড়ে আকাশ হয়ে যাক। তোমার জায়গাটাকে বাড়িয়ে দাও। বাড়াতেই থাকো। বাড়াতে বাড়াতে আকাশের তারা হয়ে যাও।”
“তারা তো মানুষ মরে গেলে হয়। তুমি কি আমাকে এখখুনি মরে যেতে বলছ?”
“আহাহাহা, এখনই কি বলছি, যখন সময় হবে তখন।” এই বলে মেসুট ফিচকেমি করে উঠে পড়ে।
ট্যুরিস্টদের নিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করার আগে আকাশের দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলে
“বি আ স্টার অ্যান্ড লেট মি গো আউট অফ দিস ওয়ার্ল্ড।”
অপার্থিব নীল আনাতোলিয়ার আকাশ। মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাগগন মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি, বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে।
সেই বিদঘুটে নীলের মধ্যে জোনাকির মতো একরাশ তারা দেখতে দেখতে আমি সেদিনের মতো দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করি।
“লেডি, সারাদিন ধরে শুধু চা বিক্রি করবে? এমন একটা গাইডের সঙ্গে তোমার প্রায় প্রতিদিন দেখা হচ্ছে, কোথাও যাবার প্ল্যান ট্যান কিছু নেই?”
“যাবার এত তাড়া কীসের? ধীরেসুস্থে গেলেই হবে। এখানে তো চারদিকে খালি গুহা আর গুহা।”
“আরে, কেভম্যান হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতে দারুণ লাগে। তুমি একটা কাজ করো, তোমার দোকানটা একটা কেভের মধ্যে করো। খুব জমে যাবে বুঝলে?”
“মেসুট লেগ পুলিং কোরো না। মোটেই ভালোলাগে না।”
“আহাহাহা, স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কী? এত অন্তহীন আনন্দ, লেডি। কোনো কাঁটাতার নেই, বর্ডার নেই। কোনো পাসপোর্ট লাগবে না। তার ওপর ফ্রি। লাগামহীন স্বপ্ন।
এখানে কত লুকোনো কেভ আছে জান? অনেকেই তার হদিশ রাখে না। চলো আমরা সেগুলো এক্সপ্লোর করি। সকালে ইলহারা ভ্যালিতে ইয়োগা করব। রেড ভ্যালির দিকে তাকিয়ে তুমি সন্ধেবেলা নিজেকে খুঁজে বেড়াবে। রাতে আমরা ওয়াইন নিয়ে বসে তারার দিকে তাকিয়ে নাথিংনেস নিয়ে আবার গুলতানি করব।
এবার দেখো তোমার সামনে একটা কেভ, ভিতরটা গরম গরম। তন্দুরির মধ্যে কাঠ পুড়ছে। ছাই জমা হয়েছে কিছু। একটা ফন মিউজিক বাজছে, খুব হালকা করে।”
আমি বললাম “হুম, কাঠপোড়ার গন্ধ পাচ্ছি বটে। মিস্টি মিস্টি ধোঁয়া ধোঁয়া। চিটির পিটির চিটির পিটির পিট পিট।”
“আর কী দেখতে পাচ্ছ?”
আমি বললাম, “লালচে আলো পাশের দেয়ালে এসে পড়েছে। কাঁপছে।”
“গুড। এবারে তামার পাত্রে কফি তৈরি করো। যাও। আর কী দেখতে পাচ্ছ?”
“রঙিন কুশন অনেক অনেক। কাঠ পোড়ার গন্ধ কফির গন্ধ। কাঠ পুড়ছে চিটির পিটির চিটির পিটির পিট পিট।”
বলতে বলতে আমার চোখ যেন আরামে গরমে আয়েসে জুড়িয়ে আসছে।
“গুড। এবার আমার সঙ্গে বলো—
কেভ কেভ কেভ
ওয়ার্ম ওয়ার্ম ওয়ার্ম
পিস পিস পিস
লাভ লাভ লাভ।”
আমার কী হল জানি না, আমিও আচ্ছন্নের মতো মেসুটের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে শুরু করলাম “কেভ কেভ কেভ, লাভ লাভ লাভ। শান্তি শান্তি শান্তি। প্রেম প্রেম প্রেম।”
সব কিছুরই একটা শেষ থাকে। উড়ে যাবার, ডানা মেলবার উদগ্র বাসনায় মেসুট তার পোল্যান্ডের ডিগ্রিকে কাজে লাগাতে তুরকিশ এয়ার লাইন্সে চাকরির দরখাস্ত ভরল আর বাক্স বেঁধে চলল ইস্তানবুল।
আমি মেসুটকে থ্যাংকস জানালুম, অনেক সুন্দর সময় সে আমাকে উপহার দিয়েছে। বোরেক, আপেল চা আর আদানা কাবাব দিয়ে ছোট্ট ফেয়ারওয়েল দিলাম। চেজ গালিপের ফেলে দেওয়া সেরামিকের টুকরোর ওপর একটা মোমবাতিও জ্বেলে দিলাম।
বললাম “তোমার চাকরির খবর এলে বোলো। আমরা সেলিব্রেট করব।”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ইফ দেয়ার ইজ এনি সাকসেস অ্যাট অল। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো লেডি, বিটমেয়েন রুইয়া বিটমেয়েন রুইয়া। অন্তহীন স্বপ্ন। রুইয়া রুইয়া রুইয়া।”
মেসুট চলে যাবার পর বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। এত কথা বলতাম আমরা। কোনো একঘেয়েমি লাগত না। এভাবে কিছুদিন চালালাম। বরফ পড়ার সময় বেশ কষ্ট হতে লাগল। বেশ একা একা মনে হত। ট্যুরিস্টের ভিড়ও আগের মতো নেই। শিরিন ফোন করল, ওর ওখানে ক-দিন ঘুরে আসতে বলল। সুন্দর সুন্দর টাইলস আর ডিজাইন নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। আমি গালিপের কাছে গিয়ে বললুম, কাকু, বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। গালিপ আবার শিরিনের কাজ খুব পছন্দ করতেন। সেই জন্যই তো দোকানটা এত সহজে হয়েছিল। খুশি হয়েই বললেন যাও ঘুরে এসো, মা।
“শিরিন, এখন কোথায় তোর আস্তানা?”
“ট্যানজিয়ের। জিব্রালটর পেরিয়ে চলে আয়। সস্তার ফ্লাইট কী আছে দ্যাখ। পয়সা না থাকলে বল, আমি দিয়ে দিচ্ছি।”
পয়সা তো আমার কোনোদিনই নেই। কিন্তু এটা কী নাম বলল শিরিন! সেখানে তো তার বাড়ি।
ট্যাঞ্জিয়ের? বুকের ভেতর দিঘির জলের কাঁপন শুনি।
ট্যাঞ্জিয়েরর মেদিনাতে শিরিন থাকে। পুরোনো শহর। সরু সরু গলিঘুঁজি। গায়ে গায়ে লাগানো বাড়ি। মশলা জাফরানের গন্ধে ভুরভুর। দরদাম কেনাবেচা হাঁকাহাঁকি। কী সুন্দর সব চামড়ার জিনিস। এক-একটা গলি যেন এক-একটা রঙে আঁকা। এই প্রাণবন্ত রঙিন স্রোতই শিরিনকে বারবার নর্থ আফ্রিকা টেনে আনে, এবারে বুঝলাম।
শিরিনের ঘর ইজেলে ক্যানভাসে রং তুলিতে ছয়লাপ। বুকের ধুকপুকুনি আমার এতটুকুও কমেনি।
“জানিস, শিরিন, এখানে ওর বাড়ি।”
“কার? এখানে কাউকে তুই চিনিস? আগে তো বলিসনি। কে রে? আমাকে একটু হেল্প করতে পারবে মানে আর-একটু বড়ো ঘর যদি পেতাম, দেখতেই তো পাচ্ছিস সব কেমন ঘন্ট পাকিয়ে আছে।”
উত্তর দিলাম না। ঘরের কোণে ট্যাজিনে নিভু ঢিমি আঁচে বুরগুর আর ল্যাম্ব রান্না হচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে রান্না হয় বলে শিরিনের ওইতেই সুবিধে। রান্না চাপিয়ে ছবি আঁকতে বসে যায়। ঘরের বাইরে সন্ধের জমজমাট বাজার। ট্যুরিস্টরা দাস্তান শুনছে, সাপের খেলা দেখছে।
রান্নার বাষ্পের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আমার দীর্ঘশ্বাস।
পরদিন সকালে একটা বাচ্চা ছেলে এই বছর বারো-তেরো, শিরিনের কাছে এল। শিরিন তার হাতে একতাড়া বান্ডিল এটা সেটা ধরিয়ে কোথায় কোথায় দিয়ে আসতে বলল। লোকাল ভাষা জানি না, ফরাসিও বলতে পারি না। ছেলেটা চোখে চোখে হাসল।
“ছেলেটার নাম কী রে? তোর ফরমাশ খাটে বুঝি?”
“নাম-টাম অত জানি না, হাতে হাতে একটু সাহায্য করে। ওই যে কোনার স্টুডিওর ফ্রেঞ্চ মহিলা, ওকে পাঠিয়ে দেন দরকার মতো।”
একদিন চোখদুটো দেখলাম, যেন কালো ধোঁয়া জমাট বেঁধে আছে। যেন অনন্ত টানেল। যেন একবার ঢুকে গেলে কোথায় সেঁধিয়ে যাব। অ্যাই ছেলে, কী নাম তোর?
ইশারায় জানতে চাইল ওকেই জিজ্ঞেস করছি কি না।
হ্যাঁ হ্যাঁ তোকে।
ইবনে।
আমিও যেন কালবৈশাখীর ঝড় এসেছে, ছাদ থেকে জামাকাপড় তুলতে হবে এরকম ব্যস্ততার সঙ্গে শিরিনের কাছে দৌড়ে গিয়ে বললাম, “শোন, আমার আর আছেটাই বা কী? নাথিং। আমি এখানেই একটা চায়ের দোকান দেব, তোকে বিরক্ত করব না। আমার দোকানে আমিই মালিক আমিই বারিস্তা। সঙ্গে তোর একটা স্টুডিও থাকবে, আর ওই যে এত সুন্দর সুন্দর সিরামিকের টাইলস, তোর কত ভালো ভালো টুকরো কাজ এখানে সেখানে পড়ে আছে তাই দিয়ে একটা লেটারিং করে দিবি আমাকে। দোকানের নাম রাখব এবার।”
প্রায় দম বন্ধ অবস্থায় শিরিন বলল “কী নাম?”
আর আমি খুব ফুরফুরে গলায় এক গাল হাসি দিয়ে বললাম, রিহলা।
আর হিব্রু ভাষায় চা (Chai)-এর মানে জানিস তো? বেঁচে থাকা। জীবন।
“আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি
দেখা যায় তোমাদের বাড়ি
তার নীল দেয়াল যেন স্বপ্ন বেলোয়ারি
তার কাচদেয়াল যেন স্বপ্ন বেলোয়ারি
সেই বাড়ির নেই ঠিকানা
শুধু অজানা লাল সুরকির পথ
শূন্যে দেয় পাড়ি”
হাস্নুহেনার সুগন্ধের মতো সমস্ত চেতনাকে আবেশে মদির করে দিল
কিস্তিগুলো আর একটু ঘন ঘন এলে---
যেমন ছবিগুলো, তেমনি ছবির মত লেখা।
অপরূপ।
লেখার সঙ্গে ছবি আছে। সাজানো গোছানো ছবি - দেখ্তে ভালো কিন্তু আপনার অক্ষর, শব্দ, বাক্য অনেকগুণ ভালো ছবি তৈরি করে - জ্যান্ত ছবি ।
'বোগেনভিলিয়ার লাল, ফেটে যাওয়া বেদানার ছড়িয়ে থাকা লাল দানা আমার দোকানের লাল-সাদা খোপ কাটা চাদর আর রোদ্দুরের বিলি কাটা জাফরি কেমন যেন ঘোর লাগিয়ে দিল আর তার মধ্যে উত্তাল ঝড়ের মতো হংস্বধ্বনি রাগের মিড়খণ্ড দ্রুত খেয়াল যেন ফ্ল্যামেঙ্কো নর্তকীর লাল-নীল ফুলে ওঠা স্কার্টের ঘের বেয়ে ঝাপটা মারল মুখে। তিরতির তিরতির করে কোথা থেকে রাশি রাশি জুঁই ফুল সেভিয়ার আমার ছোট্ট কফিঘরে সুগন্ধের তুফান এনে দিল। চারদিকে আনন্দের হিল্লোল, আমার সখির বিয়ে যে, আহা চন্দন লেপনে অঙ্গ সুবাসিত, চোখে কাজল ।'
এই তো ছবি - ছবির সঙ্গে সুর, রং ঘ্রাণ -
বাকি ছবি অবান্তর লাগে ।