এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • লুপ্ত পূজাবিধি, জামরুল পাতা ও অন্যান্য নিরুদ্দিষ্টের প্রতি

    Sandipan Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৩৩১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বহরমপুরের বিখ্যাত মোহন সিনেমা হল যখন ভেঙ্গে মল তৈরি হল, সেই সময় বা তার আশেপাশে ফেসবুকে স্মৃতিচারণ আর কল্পনামিশ্রিত কিছু পোস্ট করেছিলাম। অনুজপ্রতিম রাজন গঙ্গোপাধ্যায় যখন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা 'অন্তিক' এর স্মৃতিকথায় বহরমপুর সংখ্যা বের করল তখন সেই পোস্ট গুলিকে একত্র করেই ছাপাতে চাইল। দেখলাম যে বয়সে পৌঁছেছি তাতে যে কোনো স্মৃতিচারণই ইতিহাসের অংশ বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
    তাই গোটা লেখাটি এখানে একসঙ্গে দিলাম।

    ------------------------------------------------------------------------

    লুপ্ত পুজাবিধি, জামরুল পাতা ও অন্যান্য নিরুদ্দিষ্টের প্রতি_____________

    নিমতলা বললে কলকাতার লোক শ্মশানঘাট বোঝে, আমরা বৈঠকখানা বুঝতাম। আমরা অর্থাৎ বহরমপুর গোরাবাজারের লোকেরা। সন্ধ্যের সময় আমরা প্রায় সবাই নিমতলার চারমাথার মোড়ে চলে আসতাম আর রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে গল্প করতাম। অনেকে একা একা দাঁড়িয়ে সিগারেট খেত। নিমতলার আশেপাশের বাড়িগুলো ছিল বেশ পুরোনো আর সেগুলোতে কখনই রঙ করা বা অন্য সংস্কারের কাজ কিছু হত না। সেই সব বাড়িতে অনেক মজাদার, কষে লুঙ্গি পড়া ও ঋণগ্রস্ত পুরুষ বাস করত। তাঁরা অনেকেই পান খেত এবং অনেকের আলুর দোষ ছিল। তবে তারা সদাশয়, অহিংস এবং বাৎসল্যরসে সিক্ত ছিল। কাকীমা এবং মাসিমারা খুব যাত্রা দেখতে ভালবাসতেন এবং রেডিও শুনতে। যদিও সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর বিকেলটুকুই ছিল তাঁদের অবসর। তাঁদের অতিসাধারণ, অকৃতার্থ সন্তানগুলিকে তাঁরা খুব ভালবাসতেন।তাঁদের ভালবাসার সুবাসে নিমতলার বাতাস ভরে থাকত। বিকেলবেলা তাঁদের মেয়েরা নানা প্রয়োজনে বেরোত। আমরা তাদের বুকের দিকে সেভাবে তাকাতাম না। কারণ শুধু তাদের মুখের দিকে তাকালেই আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকত না। আমরা ভাবতাম মানুষ ও মানুষী, কী আশ্চর্যভাবে আলাদা। এইসব ভেবে ভেবে আমাদের বিকেলগুলো সন্ধের দিকে ঢলে পড়ত। টিমটিমে আলো জ্বলে উঠত চারিদিকে। চায়ের দোকানের আওয়াজ, সিঙ্গারা ভাজার গন্ধ আর ভেসে আসা হিন্দীগানের কলিতে বড্ড মধুময় মনে হত জীবন। নিমগাছটা ভেঙ্গে পড়ার পর তার বিরাট শিকড়টা দেখে চমকে উঠেছিলাম। তারপর থেকে মনে হত এখানে কোথাও শূণ্যতা বাসা বাঁধছে। আস্তে আস্তে নিমগাছটার মত পুরোনো বাড়ি, পুরোনো দোকান এমনকি পুরোনো মানুষগুলো নেই হয়ে যেতে থাকল। আমরা যাঁদের অমর ভাবতাম যেমন কিশোরকন্ঠী কান্তি হালদার, বঙ্গোবাদক শান্তারাম এমনকি কবি নাসের হোসেন পর্যন্ত নিমতলা ছেড়ে কোথায় যে চলে গেলেন, আমাদের আর প্রমাণ করার মত কিছু রইল না। অথচ আমরা জীবন ও মৃত্যু দেখেছি, অসুখ তো আগে দেখিনি। অতিজরাগ্রস্ত মানুষরা শুয়ে থাকতেন বটে কিন্তু জীবন উৎসারিত হত তাঁদের কণ্ঠস্বর থেকে আর তাঁদের দৌহিত্র ও দৌহিত্রীরা ভীষ্মের শরশয্যার মত গুছিয়ে দিত তাঁদের বিছানা। এসব এখন শুধু স্মৃতির প্রত্নচ্ছবি যাকে ধারণ করার মত কোনো ক্যানভাস অবশিষ্ট নেই আর। এই দৃষ্টিগ্রাহ্য শরীর, এই সফল পুরুষকার, এই কর্তিত হৃদয়প্রকোষ্ঠ -- এই বুঝি আমাদের শুধু প্রাপণীয় ছিল? আমরা তো জানি এই ছায়াসরণির ওপর কত সে হৃদয় বিশ্রম্ভালাপে মেতে উঠত। রম্য সে চবুতর যে মায়াবকাশ দিত আজ তা দেবে কোন সপ্রতিভ মানুষ যে সফল, নিষ্পৃহ ও সাম্প্রদায়িক ?

    মোহনবাঁশি
    --------------
    হল ভেঙ্গে মল হোলো। সিঙ্গল স্ক্রিন থেকে মাল্টিপ্লেক্স।অনিবার্যই ছিল এই পরিবর্তন। তবু মালিকপক্ষকে ধন্যবাদ হলের নামটা বেঁচে থাকল –মোহন। আমাদের বয়ঃসন্ধির স্বপ্নপুরী। খুব ভাল হত উদবোধনের জন্য জিত ফিতের মত চু কিত কিত খেলা নায়ক না এসে যদি হিন্দী সিনেমার কোনো নায়ক আসতেন। হিন্দী সিনেমাই তো ছিল মোহনের স্বপ্নাদ্য অর্ঘ্য, রূপকথারা প্রাণ পেত যেখানে সাদা পর্দায়।

    আমাদের ছোটোবেলায় অলিতে গলিতে ভুঁইফোড় ধনীলোক ছিল না। গোটা বহরমপুরে বড়লোক (ধনী অর্থে) গুনতে গেলে হাতের পাঁচ আঙ্গুলে শেষ হয়ে যেত। তাদের মধ্যে মোহনলাল জৈনদের পরিবারের আভিজাত্যই ছিল আলাদা। তাই সত্তর দশকের গোড়ায় যখন নকশালপন্থীদের স্কোয়াড শ্রেণীশত্রু খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন ওই পরিবারের রাজকুমার জৈনের মৃত্যু হয়ত অনিবার্য ছিল। এরপরও আমার বিশ্বাস, তাঁরা এই শহরের সংস্কৃতির অংশই ছিলেন, বাড়তি দেখনদারি না থাকা সত্ত্বেও।

    সেই সময়, গোরাবাজারে আমাদের পাড়ায় দুই ভাই থাকত -- তরুণ ও তাপস। দুই ভাইয়েরই মস্তিষ্কবিকৃতি ছিল, তাপসের একটু বেশি। তাপস প্রতিদিন রাস্তা থেকে পুরোনো কাগজ জড়ো করে সুতলি দিয়ে পাকিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে ছুঁড়ে দিয়ে কাগজের হকারের কাজ নকল করত। তরুণ ডান হাতটাকে মুঠো করে মুখের সামনে স্পীকারের মত ধরে গোটা গোরাবাজার ঘুরে বেড়াত আর আধো আধো উচ্চারণে জানাত ‘‘আগামী শুক্কুরবারে মোহন তকিতে’’ কোন বই আসবে। তরুণের ইনফরমেশন কিন্তু একদম ঠিকঠাক থাকত। তরুণ যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোপাপট্টির ড্যাবরা ‘‘আজা তুঝকো পুকারে মেরে গীত রে, মেরে মিতওয়া” – গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে চলে যেত, কোনোদিকে না তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। আমি মোহনে প্রথম সিনেমা দেখি ক্লাস থ্রিতে পড়াকালীন ‘হাতি মেরে সাথি’। রাজেশ খান্না তখন সুপার স্টার। হাতি মেরা সাথিতে ব্ল্যাক করে তপনদা মোহনের গেটের ঠিক সামনে একটা সিগারেটের দোকান করেছিল। সেই দোকানে একটা ফ্রেমে রাজেশ খান্নার সাতটা ছবি, মাঝে তপনদার ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। পরে রাজেশ খান্না মারা যাবার পর গোরাবাজার রুটিমহলের বাড়িতে তপনদা মাথা ন্যাড়া করে শ্রাদ্ধ করল, নেমন্তন্ন করে লোকও খাইয়েছে শুনলাম। এরপর ক্লাস ফোরে দেখি ‘অনুরাগ’, করমুক্ত ছিল বোধহয়, চক্ষুদানের ব্যাপার ট্যাপার ছিল, সেই ‘সুনরি পওয়ন, পওয়ন পূরবাইয়াঁ’। ক্লাস ফাইভে যখন, মামাবাড়ি থেকে কারা যেন এসেছিল, পাকেচক্রে পড়ে ‘‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম”। জীনত আমনের মাথায় সানগ্লাস তুলে রাখার স্টাইলটা ঘ্যাম ছিল। আমি যখন এইটে পড়ি তখন মোহনে শোলে এল। ত্রিশ সপ্তাহ চলেছিল মোহনে। কী করে যেন শেষের দিকে পারমিশন জোগাড় করেছিলাম দেখার। তখন মোহনের থার্ড ক্লাস (সবচেয়ে কম দামের) টিকিটের বিখ্যাত ব্ল্যাকার গাবগুল্লাকে প্রথম দেখি। গাবগুল্লার মুখ থেকে বাংলা মদের গন্ধ বেরোত, নিষ্ঠুর ছিল খুব, কিন্তু হাবভাব ছিল রাজার মত। পরে যখন চাহিদার অভাবে টিকিট ব্ল্যাকিং বন্ধ হয়ে গেছে, তখন গাবগুল্লা রিক্সা চালাত। কিন্তু কাউকে কোনোদিন বলতে শুনিনি, ‘‘বাবু্ যাবেন নাকি?” চুপচাপ রিক্সার ওপর বসে থাকত। থার্ড ক্লাসের একদম সামনের রো এর সিটগুলো চকবাজার সবুজ সংঘের ছেলেদের জন্য রিজার্ভ থাকত। ওরা রোজ একবার করে শোলে দেখত। তবে আমার সেরা অ্যাচিভমেন্ট ‘মুকাদ্দার কা সিকান্দার’ ছবিতে ফার্স্ট দিন ফার্স্ট শোয়ের টিকিট জোগাড় করা ব্ল্যাক ছাড়াই। পুলিস আসলে সেদিন ব্যাপক লাঠিপেটা করেছিল ব্ল্যাকারদের। আমি সকাল সাড়ে আটটা থেকে লাইন দিয়েছিলাম মোহনলাল জৈনের বাড়ির গেটের সামনে থেকে। ফার্স্ট ক্লাসের শেষ টিকিটটা আমিই পাই। আর সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার সিমি গারেওয়াল আর শশী কাপুর অভিনীত সিদ্ধার্থ ছবিটির টিকিট না পাওয়া। আমার সবেধন নীলমণি একটাকার নোটটা কোনো কারণে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাতে অবশ্য একটা টেনশন থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। আঠার বছর না হওয়ার কারণে আমাকে ঢুকতে দেবে কিনা ওই ছবিতে, সে নিয়ে টেনশন ছিল। মুকাদ্দার কা সিকান্দার চারবার দেখেছিলাম। সবকটা গানের কথা পুরো মুখস্থ ছিল। এখনও মনে আছে। হাম কিসিসে কম নেহি, লায়লা মজনু, কুরবানি – এইসব সিনেমারও। তবে ববি যখন প্রথম মোহনে আসে তখন আমি খুব ছোটো। দেখতে পাই নি। ম্যাঁয় সায়র তো নেহি গানটা যদিও দিনরাত করতাম।

    সেইসময় কোনো কোনো রোববার সকালে কিছু ক্লাব পয়সাকড়ির লক্ষ্যে মোহন সিনেমায় চ্যারিটি শো করত। কার চ্যারিটি জানি না, কিন্তু এক মাস আগে থেকে একটা রগরগে ইংরেজি ছবির পোস্টার হাউস চত্বরে শোভা পেত। তখন এমনিতে কোনো হলে ইংরেজি ছবি আসত না, নুন শোয়ের প্রচলনও হয় নি। ছবিগুলির নাম ‘বারবারিয়ান কুইন’, ‘রাসপুটিন’, ‘জাস্ট ম্যারেড’ – এইসব আর কি। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে চ্যারিটি শোগুলি পূর্ণতা পেত। শিবাজী অ্যাথলেটিক ক্লাব এসব ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট ছিল। এইরকম একটা ছবিতে সকালবেলা পৌঁছে দেখি, টিকিট শেষ, টিকিট বিক্রেতা ছেলেটি টিনের সুটকেসে টাকা পয়সা ভরে পালানোর চেষ্টা করছে, তাকে ঘিরে ধরেছে একদল টিকিট না পাওয়া লোক। তার মধ্যে আমার এক বন্ধুর কাকাকে দেখে আমি পালিয়ে আসলাম।

    মোহন হলের সামনেটা সবসময় জমজমাট হয়ে থাকত। সামনে অনেকগুলো তেলেভাজা, মশলামুড়ি আর তেল জবজবে মোগলাই পরোটার দোকান। মশলামুড়ির অনেক দোকানেই মদ পাওয়া যেত। দোকানের পেছনের অন্ধকার মাঠটা ছিল মদ খাওয়ার জায়গা।তবে প্রেমিক প্রেমিকারা ওখানে কখনো যেত না। এমনিতেই মোহন হল অঞ্চলে একটু পুরুষকেন্দ্রিক ব্যাপার ছিল। তখন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা হিন্দী সিনেমা দেখতে গেলে বাড়িতে পারমিশান নিতে হত অনেকের । তবে ওখানে কখনো পুলিশের রেইড হতে দেখি নি। একটু বড় হবার পর আমরা জায়গাটাকে বলতাম বহরমপুরের ডাউনটাউন। পরে জেনেছি যে ভুল বলতাম, আমরা যে অর্থে বলতে চাইতাম ডাউনটাউনের মানে তা নয়। আজ থেকে মোহন হলের অঞ্চল আপ টাউন হয়ে গেল। এবারও ভুল বলছি ইচ্ছা করেই। এই শব্দগুলোর মানে একেক দেশে একেক রকম। এমনকি একই দেশের মধ্যেও আলাদা রকম। আমরা কী অর্থে বলছি সেটা আমাদের কাছেই থাকুক। কিছু কিছু রহস্য নিজেদের কাছেই গুপ্ত থাকা ভালো। পৃথিবীও তো ইতিমধ্যে অনেক প্রাচীন হল আমাদের সঙ্গে সঙ্গে।

    মোহনবাঁশি (২) ঃহাবল দাস পর্ব

    হাবলদার বয়স কত সে নিজে ঠিকঠাক বলতে পারত না। আর যা বলত সব মোহন টকিজের রেফারেন্সে। ‘আরে ওই যেবার মোহনে দেবানন্দের গাইড এল না, আমি তখন সিক্স কেলাসে পড়ি’, এইটা শুনে যদি কেউ হাবলদার বয়স আন্দাজ করতে চান তাহলে ঠকে যাবেন, কারণ এমন কোনো ক্লাস ছিল না যেখানে হাবলদা পড়াশোনার ভিত শক্ত করার জন্য বাড়তি এক বছর করে অন্তত না থেকে পরের ক্লাসে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়েছে। লালঝাণ্ডার পার্টি কখন প্রথম দুভাগ হল সেটা জানাতে হাবলদা বলত, ‘ঐ যেবার মোহন টকিজে কাশ্মীর কি কলি এল না’ – সেই প্রথম লালঝাণ্ডার বিভাজন আর শর্মিলা ঠাকুরের অপার্থিব সৌন্দর্য হাবলদার মধ্যে বুক মোচড়ানো বেদনার জন্ম দিয়েছিল। দেবানন্দ আর জীতেন্দ্রর দিকে অল্পবিস্তর টাল খেতে খেতে হাবলদা রাজেশ খান্নাকেই আঁকড়ে ধরেছিল বাকি জীবনভোর, ওই লাল ঝাণ্ডার মত। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে একক নায়ক হিসেবে রাজেশ খান্নার পরপর ১৫টি ছবি হিট হয়েছিল। এই সবকটি ছবিই এসেছিল মোহন টকিজে। প্রত্যেকটা ছবিই হাবলদা দেখেছে। এরমধ্যে দুটো ঘটনা ঘটল। যেবার রাজেশ শর্মিলা জুটির সুপারহিট ছবি ‘দাগ’ মোহনে রিলিজ করল সেবারই দেবযানীরা পাড়ায় ভাড়া এল। অরণ্যের আলোআঁধারি পথে শ্বেতাম্বরা শর্মিলা ঠাকুর আর রাজেশ খান্নার লিপে ‘মেরে দিল মে আজ ক্যা হ্যায় তু কহে তো ম্যাঁয় বতা দুঁ’ শুনে হাবলদার কেমন যেন হাত পা ছেড়ে দিল। আর শেষ লাইনে রাজেশ যখন শর্মিলার আলুলায়িত কেশদামের মধ্যে মুখ গুঁজে গাইছে, ‘তেরি গেসুয়োঁ (বাংলায় কেশদাম)) মে ছুপকর ম্যায় জহাঁ কে গম ভুলা দুঁ’ তখন হাবলদার স্থির বিশ্বাস হয়েছিল দেবযানীর খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে বোধহয় এই মমতাহীন পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ ভুলে থাকা, ভুলিয়ে রাখা যাবে। ততদিনে দেবযানীকে দেখে শর্মিলার কথা আর শর্মিলাকে দেখে দেবযানীর কথা, হাবলদার নিশিদিন মনে পড়ত। দেবযানীরও যে গালে টোল পড়ত আর চুল ছিল কালো একঢাল। যার মানে করতে পারত না হাবলদা সেরকম এক অজানা বিষাদে দেবযানীর মুখটা ঢলোঢলো থাকত। হ্যাঁ, দাগ ছবিতে শর্মিলাকে না দেখলে এসব সনাক্তকরণ চিহ্ন অজানাই থাকত হাবলদার।

    হাবলদা ছিল ডাবল রিফিউজি, মানে রিফিউজি ফ্যামিলিতে অ্যাডোপ্টেড। সুধাময় গুপ্ত আর হারানজ্যাঠা (দুজনেরই নাম পরিবর্তিত) ছিলেন আমাদের অঞ্চলে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। সুধাময়জ্যাঠূর স্ত্রী উমারাণি ওপার বাংলা থেকে চলে আসার সময় বাপ মা হারানো হাবল দাসকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। পরে সুধাময়জ্যাঠু সি পি এম তৈরির পর সেখানে চলে আসেন, হারানজ্যাঠা সি পি আইতেই থেকে যান। লাল ঝাণ্ডার ভাগ হাবলদা বুঝত না, ডাকলে হারানজ্যাঠার মিছিলেও চলে যেত। এ নিয়ে বিশেষত সুধাময়ের বড় ছেলে অপূর্বর কাছে অনেক গালও খেয়েছে। আবার অপূর্বর ছোটো ভাই আশিস যখন নকশালবাড়ির পথ ধরে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে, তখন পোস্টার মারা থেকে অনেক টুকিটাকি কাজও করে দিয়েছে হাবলদা। আশিস বহরমপুর জেলের মধ্যেই শহীদ হয়েছিল। তবে সুধাময় জ্যেঠুকে হাবলদা একই সঙ্গে যমের মত ভয় আর দেবতার মত ভক্তি করত। একবার জ্যেঠুকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবার সময় পুলিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠির বাড়ি খেয়েছিল হাবলদা। পরে সেই নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘পুলিসের লাঠি ঝাঁটার কাঠি, ভয় করেনা কম্যুনিস্ট পাট্টি’।

    রাগানোর জন্য ছেলেরা বলত, ‘কিসের পাটি হাবলদা, তোমার দাঁতের?’
    ফোকলা দাঁতে খিস্তি দিত হাবলদা।

    সাতের দশকের শেষ দিকে আমরা যখন হিন্দী সিনেমা দেখা শুরু করি তখন রাজেশ খান্নার যুগ অস্তমিত। অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের ইমেজ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন। রাজেশ খান্নার ভক্তরা সব বুড়ো হয়ে গেছেন বা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। অত সুন্দর গান নিয়েও মেহবুবা বা অনুরোধ ফ্লপ। রাজেশ খান্নাকে মারামারি করলে মানায় না, নাচতে পারেন না, নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা নেই ফলে ফ্যান বেস ক্রমক্ষীয়মাণ। ক্রমশঃ নস্টালজিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠতে থাকলেন রাজেশ। এই সময় মোহন টকিজের একটা ঘটনা মনে পড়ে। অমিতাভ তখন সুপারস্টার। এক দেড় বছরের মধ্যে সুপারহিট হয়েছে মুকাদ্দার কা সিকন্দর, ত্রিশূল, ডন, কসমে ওয়াদে, সুহাগ, কালা পাত্থর, গ্রেট গ্যাম্বলার।রাজেশ খান্না আর তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকরা তবু প্রচারহীন লড়ে যাচ্ছেন ওই ‘লাল ফেরাও, হাল ফেরাও’ এর মত। এই সময় মোহনে রাজেশ খান্নার একটা সিনেমা এল ‘অমরদীপ’। তা, সেই সময় সিনেমার দর্শকরা ছবি দেখতে দেখতে সোচ্চারে অনেক মন্তব্য করত। যেমন ভিলেন যখন নায়িকা এবং নায়কের বাবা মা ইত্যাদিকে গোপন ডেরায় থামের সঙ্গে বেঁধে রেখে লম্বা লম্বা ডায়লগ দিচ্ছে আর প্যারালাল কাটিংয়ে নায়ক মোটর বাইকে চেপে পাহাড় জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে তাদের উদ্ধারে আসছে তখন ফ্রন্ট রো থেকে কেউ চেঁচিয়ে ভিলেনের উদ্দেশে ঠিক বলত, দাঁড়া, তোর বাপ আসছে। তা এই ছবিতেও শেষের দিকে একটা ট্র্যাজিক দৃশ্যে যথারীতি রাজেশ খান্নার কালো শাল মাটিতে লুটোচ্ছে আর তিনি ঘুরে ঘুরে দীর্ঘ সংলাপ বলছেন তখন কে যেন বলে উঠল, যাত্রা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ রোয়ের আরেক কোণ থেকে প্রতিবাদ ভেসে এল, ‘অভিনয়ের কিছু বুঝিস বে?’ ওটা বোধহয় হাবলদাই ছিল।

    দুর্জনে বলত হাবলদা ধোপঘাটির বস্তিতে মালতীর কাছে যায়। মালতী নাকি লাইনের মেয়ে। ওদিকে চার বছর আগে দেবযানীর বিয়ে হয়েছিল ওই পাড়ায় থাকতেই। তখন দেশে এমার্জেন্সি চলছিল। ছেলে বোম্বেতে থাকত, বোধহয় ও এন জি সির ইঞ্জিনিয়ার। সেই বোম্বে, যেখানে রাজেশ খান্না থাকতেন আর ছিল স্বপ্ন উৎপাদনের কারখানা। হাবলদা পরে মালতীর কাছেই থাকত। সুধাময়জ্যাঠুর মৃত্যুর পরই হাবলদার অবস্থা বাড়িতে কোণঠাসা হয়েছিল। অপূর্বদা ততদিনে পার্টির বড় নেতা। বৌদিরও মত ছিল হাবলদাকে রাখলে ছেলেমেয়ে ‘ব্যাড এগজাম্পল’ দেখে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। উমারাণি একা আর কী করে হাবলকে বাঁচাবেন? তার নিজেরই তো স্থান হয়েছিল পরে ছাদের ওপর একটা ঘরে। সেখানে বসে তিনি কার প্রতীক্ষায় থাকতেন কে জানে। তবে হাবলদা, মালতী আর মালতীর ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে যে বস্তিটায় থাকত কোনো একটা ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টের আওতায় পরে সেটার উচ্ছেদ হয়ে যায়। সেসব অনেক কথা। বলতে গেলে কাহিনীর ভেতর বিস্তর কাহিনী ঢুকে পড়বে। মানুষ না ফিরলেও তার গল্পগুলো তো থেকে যায়। থেকে যায় ‘ফিরে আসো’ – এই আকুতি।

    ফেরাতে হাল, ফিরুক লাল। ফেরে কই? হাবলদা একসময় হারিয়ে গিয়েছিল। আর ফেরে নি। আমরা ওর গল্পগুলোকে সাজিয়ে রাখছি। এটুকুও না করলে যদি হাবলদা কখনও ফিরে আসে ওর কাছে খিস্তি খাব। আগে পিছে দুটো চার অক্ষর জুড়ে দিয়ে বলবে সবই তো ভেঙ্গে চুরে বেচে বুচে বসে আছিস, শালা বাপ পিতেমোর স্মৃতিও কি ছিল না তোদের?

    মোহনবাঁশি (৩) ঃ করবীর রাত্রিগুলি
    --------------------------------------
    করবীকে লোকে চিনত তেওয়ারিজীর মেয়ে বলে। শিবতলায় ছোট্ট মনোহারির দোকান ছিল তেওয়ারিজীর। করবীর আসল নাম রানি। করবী নামটা বুলুদির বাবার দেওয়া। বুলুদির সঙ্গে খুব ভাব ছিল করবীর। কিন্তু তেওয়ারিজীর ক্যান্সার হওয়ায় ফ্যামিলিটা শেষ হয়ে গেল। দোকানটা বিক্রি হয় নি বটে কিন্তু তারপর থেকে বন্ধ হয়েই পড়ে রইল। মহাজনের ঋণও ছিল অনেক। করবীর তো আর ভাইবোন নেই, অনেক সাধ্যসাধনার পর চিররুগ্না মায়ের কোলে করবী এসেছিল। করবীর বিয়ের একসপ্তাহের মধ্যে তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসতে হয়, সেই শোকেই বোধহয় একমাসের মধ্যে চলে গেলেন মা। তারপর প্রবল কষ্ট পেয়ে তেওয়ারিজী মারা যাওয়ার পর করবী একা হয়ে গেল বিলকুল। কিন্তু খুব কাঁদলে কী হবে, বাবার কাজকর্ম মিটে যেতেই করবী বেশ সামলে নিল। আগের চেয়েও যেন বেশি সাজগোজ করতে লাগল। করবীর ছিল সিনেমার নেশা। বুলুদির হিন্দী সিনেমা দেখার পারমিশন ছিল না। করবী মোহনে প্রতিটি ছবি দেখত। আর এমন করে প্রতিটি দৃশ্য অভিনয় করে, গান করে, নেচে ডেমোনস্ট্রেট করে দেখাত যে বুলুদির পুরো সিনেমা দেখা হয়ে যেত। ওটা দেখার জন্য বুলুদির ঘরে পাড়ার আরো চার পাঁচ জন মেয়ে চলে আসত। তাদের সামনে করবী ‘প্রেম পূজারী’র মাতাল ওয়াহিদা রেহমানের মত নেচে গাইত ‘রঙ্গিলা রে, তেরে রঙ্গ মে য়ুঁ রঙ্গা হ্যায় মেরা মন’।

    করবীর বিয়ে হয়েছিল বিহারে। শোনা যায়, ওর বরের আরও দুটো বিয়ে ছিল। ওদের আসল মতলব নাকি ছিল করবীকে বিক্রি করে দেওয়া। বুঝতে পেরে করবী অনেক কষ্টে প্রায় একবস্ত্রে পালিয়ে এসেছিল। তাতেও পাড়ার কিছু লোক বলত করবীকে নাকি খেপী বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও করবীর মুখের মধ্যে একটা বোকা বোকা সারল্য ছাড়া খেপামির কেউ কিছু দেখে নি। মোহন হাউসে সিনেমা দেখতে গিয়ে একটা লোকের সঙ্গে প্রায়ই দেখা যেত করবীকে। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে গা ধুয়ে খোঁপা করে করবী যখন পরিপাটি সেজে বেরিয়ে যেত তখন ওকে নিয়ে ফিসফিস চলত পাড়ায়। বিশেষত ফেরার টাইমটা নাকি একেবারেই ঠিক থাকত না। অনেক সময় ভোরের দিকেও পা টিপে টিপে নাকি ফিরতে দেখা গেছে করবীকে। শাড়িটাড়িও বেশ ভাল পড়ত করবী। সবার মনে একটা প্রশ্ন ছিল যে পয়সা কোথায় পায় সে। একবার নিজের জন্মদিনে লোকটার অনুরোধমত অনেক গয়না টয়না পরে গঙ্গার ধারে পোর্ট ট্রাস্টের পাশের ফাঁকা বাগানটায় বসেছিল করবী। চাঁদ উঠেছিল। লোকটা করবীর কোলে শুয়ে গাইছিল - ‘ও শাম কুছ অজীব থী, এ শাম ভী অজীব হ্যায়’ – গলাটা খারাপ ছিল না লোকটার, একদম ‘খামোশি’ সিনেমার রাজেশ, ওয়াহিদার মত মনে হচ্ছিল নিজেদের। হ্যাঁ, এরকমই একটা সন্ধ্যা ছিল, কিশোরীবেলা ছিল, ছিল সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা কিশোরের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় আর বুকের ভেতর কেঁপে ওঠা, ছিল না? গানটা শেষ করেই মস্ত একটা চাকু বের করেছিল লোকটা। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে ওঠা ছুরির ফলার সামনে গয়নাগুলো খুলে দেওয়ার আগে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল করবী। ওর কান্না থামানোর জন্য লোকটা হালকা করে ছুরির একটা দাগ করবীর গালে স্থায়ীভাবে এঁকে দিয়েছিল।

    করবীর সব রাত্রিগুলো এরকম নিকষ কালো ছিল কিনা তা অবশ্য আমরা জানিনা। শুনেছি খাগড়ার বড় ব্যবসায়ী শ্যামবাবু নাকি করবীকে নিয়ে মাঝে মাঝে কলকাতায় যেতেন আর সন্ধ্যের পর ফিটন গাড়ি ভাড়া করে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে নিয়ে যেতেন ।কলকাতার বড় বড় বার রেস্তোরাঁর খাদ্য পানীয়ও বাদ যেত না। আমাদের মফস্বলের কটা মানুষের ভাগ্যে সেসবের দর্শনও কোনোদিন জুটেছে কে বলবে। তবে সময় যে কার কখন খারাপ যাবে কে বলতে পারে। বুলুদির অত সুন্দর বিয়ে হল, কিন্তু ছেলেটা হল কেমন অস্বাভাবিক। পাঁচ বছর বয়সেও বিছানা থেকে নামতে পারে না। হাজার চিকিৎসাতেও যখন কিছু হল না তখন বুলুদি কোথা থেকে হরিদ্বারের এক সাধুবাবার খোঁজ নিয়ে এল। বুলুদির বর আর্মিতে কাজ করে, বুলুদির সঙ্গে যাওয়ার কোনো সঙ্গী পাওয়া গেল না। তখন করবী বলল আমি যাব তোর সঙ্গে। হরিদ্বারে বাবার আশ্রমে পৌঁছে করবীর চোখে জল চলে এল। কত মানুষ কত জায়গা থেকে কত ভক্তি নিয়ে এসেছে। সবাই বলছে, বাবা, দয়া কর। বুলুদির ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাবা বললেন, চিন্তা করিস না, ঠিক হয়ে যাবে। করবী হাত জোড় করে শুধু বলতে পারল, বাবা, আমার জীবনটা পালটে দাও। ফিরে আসার এক সপ্তাহ পর শ্যামবাবুর ডাক এল কলকাতা যাবার জন্য। শরীর খারাপ বলে করবী গেল না। তার একসপ্তাহ পর আবার ফিরিয়ে দিল ডাক। একমাসের মাথায় আর পারল না । ঘরে দানাপানি ছিল না। কলকাতা থেকে ফিরে বুলুদির বাড়িতে বুলুদির ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ধরা গলায় করবী বলছিল, জীবন পালটায় না রে বুলু। তারপর অমরপ্রেম ছবির শর্মিলা ঠাকুরের মত গেয়ে উঠেছিল - রয়না বীত যায়ে শ্যাম না আয়ে। অমরপ্রেম মোহনে চারবার দেখেছিল করবী। এটা আসলে বাংলাই, নিশিপদ্মের হিন্দী, এসব বলে পারমিশান জোগাড় করে বুলুদিও একবার দেখেছিল।

    করবী এরপর সেয়ানা হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার মোটা জুলপির কংশাল ছেলে কুমার করবীকে প্রেম নিবেদন করার অনেক ফিকির করেছিল, করবী পাত্তা দেয় নি। কিন্তু বাঁধ ভেঙ্গে গেল যখন করবীর জীবনে দীপক এল। এত ভদ্র ছেলে জীবনে খুব কমই দেখেছে করবী। একদম জঞ্জীরের অমিতাভ বচ্চনের মত, মেয়েদের দিকে হ্যাংলার মত কখনও তাকায় না, কিন্তু যখন তাকায় তখন মনে হয় ভেতরটা পর্যন্ত পড়ে ফেলছে। রাজনীতির জন্য জেল খাটা, আদর্শবাদী ছেলে, তখন টিউশন করে খায়। এই একটা ছেলে দেখল করবী যে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বাড়তি আগ্রহ দেখায় না, করবীর ব্যাংকে কত টাকা আছে জিজ্ঞেস করে না। তা, সেই ছেলেটা যখন বলল, করবী, আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য পেতে চাই। তখন করবী মুখ নিচু করে রইল বটে, কিন্তু ওর ভেতরটা গান করে উঠল, আজ ফির জীনে কি তমান্না হ্যায়, আজ ফির মরনে কি ইরাদা হ্যায়। করবী ঠিক করল ওর সর্বস্ব দিয়ে দীপককে ভালবাসবে। কিন্তু এখানে থাকলে তো শ্যামবাবুর হাত থেকে রেহাই পাবে না। গোপনে বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করল করবী। বুলুদি ছাড়া দু একজন জানত শুধু। গোপনতার কারণে দাম বেশি না পেলেও, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে আর বাড়ি বিক্রির টাকা মিলে প্রায় সতের হাজার টাকা হল। যাওয়ার আগে বুলুদির চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল করবী, কাঁদিস না বুলু, দেখবি তোর ছেলেও ভাল হয়ে যাবে। কখন কার ওপর কৃপা হয়। দেখলি না আমার ওপরও শেষে হল।

    বোলপুরে হোটেলে পৌঁছে বিছানার ওপর টাকার বাণ্ডিলটা রেখে করবী বলল, এই টাকাটা তোমার কাছেই রেখে দাও । আমার টাকা, তোমার টাকা বলে তো আর আলাদা কিছু নেই। একটা কিছু ব্যবসা ট্যবসা তো করতে হবে তোমাকে,নাকি?

    উত্তর না পেয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে করবী বলে, একি তুমি এত ঘামছ কেন? শরীর খারাপ করছে নাকি?

    বিকেলের দিকে দীপক বলে, চল তোমাকে সূর্যাস্ত দেখিয়ে নিয়ে আসি। এখানে একটা বড় দীঘির পাড় থেকে খুব ভাল সূর্যাস্ত দেখা যায়। টাকার ব্যাগটা সঙ্গে নিয়েই বেড়িও। এখানে ঘরে তালা থাকলেও হোটেলগুলো খুব সুবিধের নয়।

    দীঘিটা শহরের বেশ বাইরে। সূর্যাস্ত সত্যি সুন্দর দেখা গেল। কিন্তু জায়গাটা বড় নির্জন।দীঘির একদম পাড়ে দাঁড়িয়েছিল করবী। মুখ ফিরিয়ে চমকে উঠল করবী । তার গা ঘেঁসে একদম পিছনে দাঁড়িয়ে আছে দীপক। সূর্যাস্তের আলোতেও বোঝা যাচ্ছে তার মুখ ঘামছে।

    করবী কোনো রকমে বলল, তুমি কি আমায় মারবে? এই টাকাগুলোর জন্য আমায় মারবে?

    দীপক চুপ করে রইল। করবী বলল, আমি কিন্তু সাঁতার জানি না। তুমি আমায় ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দাও দীপক। আমি নিজে মরতে পারি না।
    কাঁদতে কাঁদতে করবী দীপকের পায়ের কাছে টাকার ব্যাগটা রেখে মিনতি করতে লাগল, মেরে ফেল আমায়। মেরে ফেল। বাঁচিয়ে রেখ না।

    দীপক হিসহিসে গলায় বলল, চুপ, তোমাকে মারব বলে এখানে আনি নি। টাকাটা নেব বলে এনেছি।

    এই বলে টাকার ব্যাগটা তুলে নিয়ে আসন্ন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল দীপক। দীঘির ঠাণ্ডা জলের অতল থেকে একটা চেনা গন্ধ উঠে আসছিল। করবীর মনে হল ছোটোবেলায় মায়ের পাশে শুয়ে মায়ের গা থেকে এই গন্ধটা পেত সে।

    একটু রাতে দীঘির ধার থেকে উঠে একটা বেতো ঘোড়ার মত নিজেকে টেনে নিয়ে চলল করবী। আস্তে আস্তে একটু দূরে বড় রাস্তায় উঠে এসে আলোর দেখা পেল সে। একটা শোভাযাত্রা আসছে। বোধহয় অবাঙালি কোনো বিয়ের। কারণ ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও নাচছে দু একজন। করবী তাদের মাঝে পড়ে গেল। হাঁটতে থাকল চোখের জল মোছার কোনো চেষ্টা না করেই। গান হচ্ছে, স্বপ্না হর টুটা রে, ফির ভি তু রুঠা রে পিয়া, বাহ রে প্যার, বাহ রে বাহ, রঙ্গিলা রে।

    করবী মাইকের গানের সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করল। সবাই তাকে লক্ষ্য করছে, হাততালিও দিচ্ছে দুএকজন। করবীর নাচতে ইচ্ছে করছে, মাতালের মত, ওয়াহিদা রেহমানের মত। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠছে। করবী শেষাবধি নাচতে শুরু করে। বাহ রে প্যার, বাহ রে বাহ, রঙ্গিলা রে।

    [ ফেদেরিকো ফেলিনি পরিচালিত এবং তাঁর স্ত্রী গিউলিয়েত্তা মাসিনার অসাধারণ অভিনয় সমৃদ্ধ মহৎ মানবিক আবেদন সম্পন্ন ‘নাইটস অব ক্যাবিরিয়া’ (১৯৫৭) ছবিটির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যও বটে এই লেখাটি ]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন