পরদিন কৃষ্ণার যতটা মেজাজ খারাপ থাকবে ঋষভ ভেবেছিল, দেখল অতটা খারাপ নেই। ব্রেকফাস্ট নিজেই দিতে এল। ঋষভ আবার আগেরদিনের মত আউটহাউসের কাছে জঙ্গলে এসে বসল। কৃষ্ণা বিশেষ নজর দিল না। শেষে ঋষভ যখন দেখল কৃষ্ণার শাকরেদ শিবা- বাইরে কোথাও গেল, ঋষভ নিজেই কৃষ্ণার কাছে কথা পাড়ল।
"কিছু মনে কোরো না, একটা এক্সপিরিমেন্ট করছিলাম কালকে। একেবারে খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। ভেবেছিলাম তোমরা অনেকদিনের বন্ধু- দুজনকে একত্রিত করব অনেকদিন পর।"
"আর সেটা দেখে মজা নেবো, তাই তো?"
কৃষ্ণার ব্যাপারটা খারাপ লেগেছে ঋষভ জানত, কিন্তু কাল রাতে যতবার ঘুমের মধ্যে এই ভাবনাটা মাথায় এসেছে, ততবার সে এই বলে নিজেকে শান্ত করেছে- যা করেছি বেশ করেছি। কিন্তু শেষরাতে আবার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হওয়া শুরু হল। ঋষভ বলল,
"কিন্তু তুমি তো সবই জানতে? আপত্তি থাকলে আগেও না বলতে পারতে?"
"হুঁ।"
"কী হুঁ?"
"আগে থেকে না বললে সারথির গায়ে হুইস্কিটা ছুঁড়ে মারার আনন্দ পেতাম? দু'খানা গালাগাল দেয়ার আনন্দটা পেতাম?"
"ওহ!"
"ভেবেছিলাম মুখের উপর হুইস্কিটা ছুঁড়ে মারব। তারপর ভাবলাম- নাহ, ওতে প্রচণ্ড চোখ জ্বালা করবে।"
ঋষভ খালি নিজের মনে বলল- লোকে এত ভেবেচিন্তে প্লান করে রাগ করে নাকি! এতদিন তো সে রাগটাকে আকস্মিক একটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলেই জানত। বেশ হতভম্ব লাগছিল নিজেকে তার। কিছু না ভেবে পেয়ে খালি প্রশ্ন করল, "আচ্ছা, আমার জন্য তোমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গেল না তো?"
"বন্ধুত্ব তো ছিল না, একটা মায়া ছিল। কেটে গেছে। ভালই করেছেন।"
কৃষ্ণা চলে যেতে ঋষভের মনে হল- হয়তো সত্যিকারের ভালবাসা ছিল। তাই রাগও ছিল। ঋষভের দৌলতে কৃষ্ণা রাগটা দেখাতেও পারল, আর তাতে ভালই হল- এইটা ভেবে নিজের অপরাধবোধটা ঋষভ একটু কমানোর চেষ্টা করল। সারথির মত কৃষ্ণার পয়সার দরকার পড়ে না- যা আছে তাই নিয়ে খুশী থাকে- ঐটা হয়তো কৃষ্ণার গর্বের জায়গা। সেটা দেখাতে পেরে হয়তো সে আনন্দ পেয়েছে। এইসব ভেবে ঋষভ নিজেকে নিজের সাফাই দিচ্ছিল।
কিন্তু চেক-আউট করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যে কোনও কারণেই হোক সে সারথিকেও ঠিক একই প্রশ্ন করল,
"আচ্ছা, আমার জন্য তোমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গেল না তো?"
"হল তো স্যার, বিশাল অপরাধ করে ফেললেন তো।"
ঋষভের বক্তব্যের সঙ্গে তার মুখের অভিব্যক্তির বিশেষ মিল নেই দেখে ঋষভ একটু আশ্বস্ত হল। কৃষ্ণার মত চাঁছাছোলা লোক ভাল, নাকি সারথির মত লোক যে মিথ্যা বলতে আর সত্যি-মিথ্যে গুলিয়ে দিতে পারে- এমন লোক ভাল- ঋষভ ভাবছিল। ভেবে মনে হল সারথিরাই ভাল- কারণ তাদের সত্যিগুলোকেও মিথ্যে ধরে নিয়ে নিজের অপরাধবোধটাকে কাটানো যায়।
চিকমাগালুর থেকে দুশো কিলোমিটার ড্রাইভ করে উডুপি। জায়গাটা ঋষভের বোরিং লাগল, তাই পরদিন সকালে গোয়ার দিকে দুজনে রওনা হল।
"ঋষভ স্যার। আমার তো অনেক ছবি তুললে, তোমার তুলি?"
"বেশ।"
সাউথ গোয়ার এই আগোডা বিচটাতে লোকের ভিড় বেশ কম থাকে। ছবি তোলার পক্ষে ভালই।
"ঐ ফিশিং নেট দেখছ। ওটা তোমার গায়ে জড়িয়ে।"
আইডিয়াটা মন্দ নয়- ঋষভ দেখল। একটার পর একটা ছবি। প্রতিটা ছবির সাথে সারথি একটু একটু করে জালটা ঋষভের গায়ে আরও বেশি করে জড়িয়ে দেয়। সবশেষে ঋষভ দেখল সে একেবারেই জালে জড়িয়ে গেছে।
"টা টা, স্যার।"
"এ কী, কোথায় চললে?"
"এই যাচ্ছি..."
"আরে আমাকে ছাড়িয়ে দিয়ে যাও।"
"জাল ছাড়াতে জানলে ছাড়াতাম।"
ছবি তুলতে তুলতে সারথি ঋষভের শার্টও খুলে নিয়েছিল।
"সারথি, শার্টটা তো দিয়ে যাও।"
সারথি মুচকি হেসে ঋষভের শার্টটা কাঁধে নিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। জাল অবধি ঠিক আছে, কিন্তু এই মাছের গন্ধে কতক্ষণ থাকা যায়! আর যত ছাড়ানোর চেষ্টা করে, আরও জড়িয়ে যায়।
মিনিট দশেক পর এক জেলে এসে হাজির হল, দা হাতে। ঋষভের খুব হতভম্ব লাগছিল- মাছের জায়গায় মানুষ দেখে জেলে কী ভাববে, আর কিছু জিজ্ঞেস করলে ঋষভই বা কী উত্তর দেবে। তবে সে কিছু জিজ্ঞেস করল না, ঋষভ শুধু চোখমুখ দিয়ে আকুতি করল। দা হাতে নিয়ে জেলে কিছুক্ষণ ঋষভকে দেখল। দা দেখে ঋষভের ভয় লাগছিল। জেলে আর ঋষভ একে অপরের ভাষা বিশেষ বুঝবে না, তাই প্রশ্নোত্তরের বিশেষ সুযোগ নেই। জেলে বিশেষ প্রশ্ন না করেই জাল ছাড়িয়ে দিল। তার জালে মাছের বদলে মানুষ ধরা পড়লে তারও বিশেষ লাভ নেই- ছাড়িয়ে দিলেই তার পক্ষে কাজের কাজ। ঋষভ অনাবৃত দেহে বুক হাত দিয়ে চেপে বেরিয়ে এল। সংকোচ হচ্ছিল। জেলে মুচকি হেসে তার পিঠের ঝোলা থেকে কী একটা বের করে ঋষভের গায়ে ছুঁড়ে দিল। ঋষভেরই শার্ট। ঋষভ মনে মনে বলল, "আচ্ছা, প্ল্যান করে এসব করা হয়েছে!"
হোটেলে ফিরে এসে দেখল সারথি নেই। ঘর থেকে নেমে রিসেপশনে আসতে রিসেপশনিস্ট বলল,
"ইয়োর ফ্রেন্ড ওএন্ট উথ হিজ ড্যাড।"
"ওহ।"
"হিজ ড্যাড জাস্ট কেম অ্যান্ড পিকড হিম আপ।"
ঋষভ অবাক হল। এখানে আবার বাবা কোথা থেকে এসে হাজির হল! এর আগে কখনও বাবার অসুখের কথা শুনেছে, বাপে তাড়িয়ে দিয়েছে সেকথাও শুনেছে, বাপ মরে গেছে তাও শুনেছে। বাবা গোয়ায় থাকে এটা শোনাই বাকি ছিল! আর থাকলে সেটা বলতেই বা ক্ষতি কী ছিল!
ঋষভ ফোন তুলে সারথিকে কল করতে গিয়েও করল না। বিচে এসে বসল। বিচের এই লোনা হাওয়াটাকেই এখন একমাত্র সঙ্গী করতে ইচ্ছে করছে তার। অনেকদিন পর সারথিকে ছাড়া সে সময় কাটাচ্ছে। মনে হচ্ছে- এইই ভাল। সারথিকেও একটু জায়গা ছেড়ে দেয়া উচিত। ভাড়া খাটাচ্ছে বলে সে সারথির উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব চাইছে, অথচ যার ঋষভকে পূর্ণাঙ্গভাবে পাবার ন্যায্য অধিকার সে তো পুরো ঋষভটাকে পায়নি। সারথি কোথায় গেছে তার খোঁজ করে কাজ নেই। ঋষভের মালিকও ঋষভকে সপ্তাহে দু'দিন ছাড় দেয়, সে-ও না হয় দিল! কে জানে কেন, সারথির অনুপস্থিতিটাই আজ তার বেশি ভাল লাগছে।
রেশমীর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল- কিন্তু এখন তো ওখানে মাঝরাত, এখন জাগিয়ে বেচারিকে কষ্ট দেয়াটা ঠিক হবে না।
"তোমার বাবা খুব কামড়ায় বুঝি?"
"দেখতে পেয়েছ?"
"সুন্দর লাগছে তো দাগগুলো। কোনোটা খুব আলতো কামড়, কোনোটা অনেক সময় ধরে দাঁতের খেলা, কোনোটা মনে হচ্ছে শ্বদন্তধারী জন্তুর।"
"কত কি গল্প বানিয়ে নিলে। শোনো ভাই, আমার তো সবকটা একই রকম লাগল। এগুলো তোমার কল্পনা।"
"বেশ তো! জানো তোমার গায়ের এই কামড়ের দাগগুলো দেখে আমার ভেতরেও একটা বন্য কুকুর জেগে উঠছে। মনে হচ্ছে- তোমার গায়ে যে জায়গাগুলো বাকি আছে- সেগুলোও ভরে দেয়া দরকার।"
"ব্যথা লাগে খুব।"
"হুঁ, আর বাবা ব্যথা দিলে লাগে না?"
"উনি বাবা নন।"
"কে জানে! তোমার গল্পে মানুষের পরিচয় দুমদাম বদলায়।"
এই কামড়গুলো রেশমীর গায়ে দেখতে পেলে কেমন লাগত- ঋষভ ভাবার চেষ্টা করল। ধরা যাক রেশমী বাড়ি ফিরল গায়ে এমন দাগ নিয়ে। তারপর মনে হল- নাঃ, রেশমীকে নিয়ে এসব উল্টোপাল্টা জিনিস ভাবা যায় না।
রেশমীর সাথে মোবাইলে ভিডিওকল হচ্ছিল।
"তোমাদের কোম্পানিটা তো বেশ- একেকদিন একেকরকম হোটেলে থাকতে দেয়।"
ঋষভ এই প্রশ্ন আশা করেনি। বিছানায় শুয়েই সে কলগুলো নেয়, আর সারথিকেও বাইরে পাঠিয়ে দেয়। নিজেকে সামলে নিয়ে ঋষভ বলল, "এমন কেন মনে হচ্ছে রেশু?"
"তোমার পেছনের দেয়ালটা একেকদিন একেকরকম লাগে।"
বালিশ ছাড়া আর কিছু রেশমী দেখতে পায় ঋষভ সেটা টেরও পায়নি।
"ওহ, মাঝখানে দু'বার ঘর চেঞ্জ করতে হয়েছে। প্রথমটার বাথরুমে লিকেজ ছিল, পরেরটার... মানে... ঐ... খুব নয়েজি ছিল, কোথা থেকে একটা এসির আওয়াজ আসত।"
"ওহ, তাই বুঝি।"
"ভারতীয় হোটেল, বুঝতেই পারছ।"
"পারছি।"
ঋষভ নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবত, হঠাৎ নিজেকে কেমন বোকাবোকা মনে হল।
দরজায় জোর ধাক্কা। ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে। ঋষভ দরজা খুলল। সাধারণত ভিডিওকল হলে গেলেই সে সারথিকে ডেকে নেয়। আজকে কল শেষ হবার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে আবোলতাবোল ভাবছিল, কখন মিনিট কুড়ি চলে গেছে বুঝতে পারেনি। তাই সারথিও অধৈর্য হয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছিল।
"সব ঠিক আছে তো স্যার? ম্যাডাম ভাল আছেন তো?"
পরদিন সকালে বিচে বসে ঋষভ সারথিকে দেখছিল। বিচের গরম রোদচকচকে বালির মধ্যে সারথির শ্যামলা দেহটা যেন একটা জঙ্গুলে গাছের শীতলতা হয়ে বসে আছে। হাতে মোবাইল- সেই নিয়েই সারথি ব্যস্ত। দেখে ঋষভ বিরক্ত হচ্ছিল।
পাশ দিয়ে একজন ইউরোপীয় চেহারার লোক যাচ্ছিল। একটা মৃদু হাসি হেসে সারথিকে জিজ্ঞাসা করল, "ইজ দ্যাট ইয়োর ব্রো, মিস্টার সারথি?"
"ইয়েস, হি ইজ।"
সারথি উত্তর দিল। ঋষভ বুঝতে পারল, এই শহরে অনেক বাবা-দাদা তার পাতানো হয়ে গেছে। সে নিজেও এখন সারথির দাদা! ঋষভ খালি বলল, "এই শহরে অনেকেই তোমায় চেনে!"
"গোয়ার একটা কলেজে টুরিস্ট গাইডের কোর্স করতাম তো!", মোবাইলে চোখ রেখেই সারথি উত্তর দিল।
"টুরিস্ট গাইডের কোর্স হয় নাকি?"
"এই, তুমি কি ভাবতে আমরা এমনিই আঁটভাট বকি নাকি?", এই এতক্ষণে সারথি মোবাইল থেকে চোখ তুলল।
"আমি সেটা মিন করতে চাইনি..."
সারথি আবার ফোনে চোখ গুঁজল।
"তাকাও এদিকে সারথি! ক্লায়েন্টকে ইগনোর করলে হবে?"
ঋষভ হাতের মুঠোয় বালি নিয়ে সারথির গায়ে ছুঁড়ল। সারথি তখনও মোবাইলে মুখ গুঁজে। ঋষভ আরেকমুঠো বালি সারথির গালে ছুঁড়ল। সারথি চোখ কুঁচকে গাল সরিয়ে নিল। এবার মোবাইলটা সে মাটিতে রাখল।
"আমার চোখে বালি ঢুকে গেলে? হ্যাঁ?"
সারথি এবার ঋষভের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্ত দু'হাত দিয়ে ঋষভের দু'মুঠো চেপে ধরে তাকে বালিতে শুয়িয়ে দিল। বালিতে শোয়া ঋষভের মুখে এবার হাসি ফুটেছে। তার চোখাচোখি সারথি। তার মুখেও এবার হাসি ফুটেছে। ঋষভের পুরো গা বালি হয়ে আছে। সেই বালিটার মধ্যে সারথি এবার একটু একটু করে নিজেকে মিশিয়ে দিল।
দুপুরে সারথি তিন ঘন্টার ছুটি নিয়ে কোথায় চলে গেল। ছুটি না দিয়ে উপায় নেই। সারাদিনের সারথির জোগান ঋষভেরও দরকার নেই।
"এই যে, তোমার আবদারে ফাইভ স্টার হোটেল বুক করলাম- কিন্তু তোমার ফাইভ স্টারে থাকার তো কোনো আগ্রহ দেখছি না। বাইরে বাইরেই চড়ে বেড়াচ্ছ। ফাইভ স্টারটা শুধুই দুটো সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে ইন্স্টায় দেবার জন্য নাকি?" ঋষভের ইচ্ছে হচ্ছিল এই প্রশ্নগুলো করার- তবে করল না। যাবার আগে সারথি একটা বাধো বাধো ভাব দেখাচ্ছিল- মানে ঐ কর্তব্যটা ঠিক করে উঠতে পারছে না তো। কিন্তু ঋষভ বলল, "যাও।" মনে মনে বলল- তুমি নাহয় একটু অবাধ্য হও। তাহলে প্রেম প্রেম লাগবে। সবসময় আমার বাধ্য হলে মনে হবে দায়িত্বপালন করাচ্ছি। তুমি পালাবে- আমি ধরে আনতে যাব- তাহলে মনে হবে প্রেম করছি। রাতে আবার সারথি জানতে চাইল, "ছুটি নিলে রাগ করো না তো?"
"করি তো!"
"বেঁধে না রাখলে মানুষ পালিয়ে যায়। মানুষের হাত পা থাকে তো!"
"তাহলে বেঁধেই রাখি তোমাকে।"
"কী দিয়ে?"
ঋষভ দড়ি দেখাল। তারপর একটু একটু করে সে সারথিকে বাঁধল।
"তা সারথিবাবু, এবার তুমি আমার তো?"
"বেঁধেই যখন ফেললে ঋষভ স্যার, তখন আর কার হতে যাবো?"
"তুমি আমার। অন্ততঃ এই মুহুর্তে আমার।"
"বৌকেও এভাবে বাঁধো?"
"নাঃ।"
"বৌ তোমায় এভাবে বাঁধে?"
"নাঃ।"
"কেন?"
"আমরা সাতজন্মের জন্য বাঁধা। পবিত্র বন্ধন। আলাদা করে বাঁধতে হয় না।"
"আচ্ছা, তাহলে..."
"চুপ, শাট-আপ। আর বকবক নয়। কাজে ফোকাস করো সারথি। কাজে মন দাও। কথা বলার অনেক সময় পড়ে আছে।"
সারথি নিজের দুমুঠো এগিয়ে দিল। ঋষভ মুঠোদুটোও বাঁধল। সারথির হাতদুটো বেঁধে ঋষভ এবার দড়িটা টান দিল- হাতের মুঠোসুদ্ধ সারথি ঋষভের বুকে এসে পড়ল।
"ধীরে, ঋষভ স্যার, ধীরে।"
সত্যি তো! সবসময় সে তাড়াহুড়ো করে এসেছে। সারথির ভালবাসাগুলো কত দ্রুত নিংড়ে নেয়া যায়,তাই ভেবে এসেছে। যেন পৃথিবীতে কারো হাতে ছিটেফোঁটা সময় নেই। আজ ঋষভের মনে হল, এত তাড়া কেন! ধীরে ধীরেই ভোগ করা উচিত এই সময়টাকে। সারথি আজ পালিয়ে যাবে না। তার হাত পা বাঁধা। তাই আস্তে আস্তে সে মিশে যাবে সারথির এই শরীরটার মধ্যে। একবার মিশে গেলে সে বেরিয়ে আসার জন্য তাড়াহুড়ো করবে না। শরীরটার মধ্যেই মিশে থাকবে যতক্ষণ পারা যায়।
পরদিন সকালে সারথি আবার বাঁধন খুলে কোথায় চলে গেছে। বাবা-দাদা-ভাই কে জানে কে কে আছে এই শহরে তার!
ঋষভ আবার সমুদ্রে এসে বসল।
"ভালবাসা ছিল না- একটা মায়া ছিল- কেটে গেল। ভাল হয়েছে।" ওরকমই কী একটা সেদিন কৃষ্ণা বলেছিল- ঋষভ ভাবছিল। হিসেব কষছিল- সারথিকে আর কতটা আষ্টেপৃষ্টে ধরে ভালবাসলে তার জীবন থেকে সারথির মায়া কাটবে। মায়া কাটাতেই হবে। মায়া দু'ভাবে কাটে- বৈরাগ্য দিয়ে, অথবা এত ভোগ করে যে আর তাকে ভোগ করার কোনও ইচ্ছা বাকী না থাকে। আর কতটা সারথিকে ভোগ করলে তার এই মায়া যাবে- এই হিসেব ঋষভ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এ যে হিসাবের বস্তু নয়।
তবে হাম্পিতে সারথি তাকে বিনামূল্যে যে ভালবাসা দিয়েছিল, এবারে অনেক অর্থের বিনিময়েও সে ভালবাসা পাওয়া যাচ্ছে না- হয়তো পাবার কথাও নয়। ঋষভ ভাবল- হয়তো তাকে দাসের মত বন্দি করার চেষ্টায় হয়তো যে অদৃশ্য বাঁধনটুকু ছিল- সেটাও আলগা হতে বসেছে।
ঋষভের খুব হাসি পাচ্ছিল। সে কখনও ভাবতেও পারেনি এতরকমের উল্টোপাল্টা জিনিস সে জীবনে করবে। সেদিনকার সারথি আর কৃষ্ণার হতভম্ব হয়ে বসে থাকা- বিছানার দুকোণে- ভেবে খুব হাসি পাচ্ছিল। সারথির গায়ে কৃষ্ণার হুইস্কি ঢেলে দেয়া- খুব হাসি পাচ্ছিল। আবার একটু কেমন কেমন লাগলও। কখনও হয়তো দুজনের মধ্যে একটা ভালবাসার মত কিছু ছিল! কালকের ঘটনাগুলো ভেবেও সে হাসছিল। এমনকি রেশমীর হাতে প্রায় ধরা পড়ে যাওয়াটা ভেবেও সে হাসছিল। থাক- আর হা-হা করে হাসবে না- সে ঠিক করল। দূরের জেলেগুলোও হয়তো ওকে পাগল ভাবছে- পরশুদিন তো ওদের একজন দেখেই গেছে ওর অবস্থা। তবু তার হাসি থামে না।
এসব কথা ভেবে ঋষভ এখনও হেসে যাচ্ছে- ওর আমেরিকার বাড়ির খাটের এক-তৃতীয়াংশটার মধ্যে শুয়ে। অন্য দুই-তৃতীয়াংশে সে তাকায় না- কারণ ওখানকার খাঁ খাঁ করা শূন্যতাটাও এভাবেই হাসে- ওর দিকে তাকিয়ে।