"জানেন, সত্যি একটাই হয়, মিথ্যে অনেকরকম। সূর্য পশ্চিমে অস্ত যায় এটা হল সত্যি, কিন্তু মিথ্যের জগতে উত্তর-দক্ষিণ-পুব যেকোনো দিকে সূর্য ডুবতে পারে। মিথ্যার মধ্যে যত সম্ভাবনা থাকে তা সত্যের মধ্যে থাকে না স্যার!"
অনেকদিন পর এই কথাগুলো ঋষভের মনে পড়ছিল, আর যে এই উৎপটাং কথাগুলো বলত তার কথা। বৃষ্টির রকমফের হয়। মন ভালো করা বৃষ্টি, মন খারাপের বৃষ্টি। পিপাসা মেটানোর বৃষ্টি, অথবা উল্টে আগুন লাগিয়ে যায় এমন বৃষ্টি। ঠিক এখন যে বৃষ্টিটা ঋষভের সামনে এসে পড়ছে সেটা হল মন খারাপের বৃষ্টি। শুধু এখন কেন, আজকাল তো তার মনে হয় প্রতিদিনের বৃষ্টিই মন খারাপের বৃষ্টি, প্রতিটা দিনই মন খারাপের দিন। খালি নিজেকে এসবের মধ্যে একটু টেনে হিঁচড়ে ভাসিয়ে রাখা। অথচ আগে বৃষ্টি দেখলেই ঋষভের মনটা ভাল হয়ে যেত। এখন মন ভাল করার জন্য কখনও কফির গন্ধ শোঁকা, কখনও নিজের গায়ে একেকদিন একেকরকম পার্ফ্যুম লাগিয়ে নিজেরই গন্ধ শোঁকা। কফি বেশি খেলে রাতের ঘুমটা নষ্ট হয়, তাই কখনো একটু ডিক্যাফ কফি খাওয়া বা কখনও স্রেফ গন্ধ শোঁকা। ছোটবেলায় কেমন বৃষ্টির মাটির গন্ধ শুঁকলেই মন ভালো হয়ে যেত, এখন হয় না! অথবা এই আমেরিকার বৃষ্টিতে বা আমেরিকার মাটিতে ঐ গন্ধ নেই।
মন খারাপের বৃষ্টি দেখতে দেখতেই ঋষভের চোখে মাঝে মাঝে ভেসে আসে অনেক পুরোনো একটা বৃষ্টির কথা, যেটা ভেবে ভেবে সে নিজের মনেই হাসে। খুব মজার বৃষ্টি ছিল সেটা, কিন্তু অসময়ের বৃষ্টি ছিল। স্থান কাল পাত্র না মানা এক বৃষ্টি। বিছানায় নিজেকে জড়িয়ে ধরে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা ঋষভ একটু একটু করে ফিরে গেল চার বছর আগে, স্পষ্ট দেখতে পেল তখনকার বৃষ্টি, নাকে ভেসে এল মাটির গন্ধ। অনুভব করল সেই বয়সটা যখন আলাদা করে জীবনের `অর্থ` খুঁজতে হত না! তখন ঋষভের চুল এমন উসকো খুসকো হত না। জেল লাগিয়ে ভালভাবে আঁচড়ে বাইরে বের হত সে। শুধু তাই নয়, কোথাও আয়না বা আয়নার মত কিছু দেখতে পেলে চুলটা আবার ঠিক করে নিত। হোটেলের বাইরে একটা বাইকের আয়নায় চুলগুলো ঠিক করছিল, দুই হাতের দশ আঙুল দিয়ে। হঠাৎ আয়নায় দেখা গেল অন্য একটা মুখ। শ্যামলা গায়ের রং, কোঁকড়ানো চুল।
"ওঃ, সরি, তোমার বাইক এটা?"
"সে ঠিক আছে, বাইক আমার। আয়নাটা যার মুখ দেখায় তার। আপনি আয়না ব্যবহার করতেই পারেন। কোনো অসুবিধা নেই। বাই দা ওয়ে, আমি সারথি।"
ঋষভ দেখল- বেশ ঝকঝকে সুপুরুষ চেহারার একটি ছেলে। শ্যামলা রং, কিন্তু চেহারায় একটা অদ্ভুত উজ্জ্বলতা আছে, আর চোখের মধ্যে একটা অদ্ভুত গভীরতা। সাজপোশাকে একটা পারিপাট্য আছে- ঘিয়ে রঙের ফুলশার্টের সঙ্গে মানানসই হাল্কা কফি রঙের নেহরু জ্যাকেট আর গাঢ় কফি রঙের ট্রাউজার। বুকপকেটে একটা চেইনের মত। বেশ সুগঠিত চেহারা- আর পোশাকটাও এমনভাবে বেছে পড়েছে যাতে তার সুঠাম শরীরটা আরও ভালভাবে ফুটে ওঠে।
ওভাবেই প্রথম দেখা সারথির সঙ্গে। আর তার পর দিনই নেমেছিল অসময়ের বৃষ্টিটা। বৃষ্টিতে হঠাৎ করে ধুলোর গন্ধগুলো বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ হয়ে গেছে। এই জায়গায় বৃষ্টিই এত কম হয়, আর সেখানে এই ডিসেম্বরে বৃষ্টি তো বাড়তি পাওনা। পাওনার থেকে উপরি পাওনার প্রতি মানুষের টান বেশি। সারথি হল ঋষভের এই সফরের বাড়তি পাওনা। অথবা বাড়তি বোঝা। অথবা দুটোই। যাই হোক, অসময়ের বৃষ্টিকে তো আর ডেকে বলা যায় না- ও বৃষ্টি, এ তো অসময়, অসময়ে নামোই বা কেন? আজ নয় কাল এসো। যেদিন বর্ষাঋতু আসবে সেদিন এসো।
না, ওভাবে বলা যায় না। অসময়ে এলেও যে এসেছে তাকে আপ্যায়ন করতে হয়। উপভোগ করতে হয়, নইলে সে হয় আর আসবে না, অথবা ঋষভের জন্য আসবে না। অতএব সময়-অসময়, স্থান-অস্থান, উচিত-অনুচিত সব অগ্রাহ্য করে, এই বৃষ্টিভেজা বিকেলে, পাঁচশো বছর পুরোনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে, ঋষভ এক ভাবাকুল ভক্তের মত নিজদেহের অঞ্জলি সঁপে দিল সারথির হাতে। মন্দিরের ভাঙা ছাদ থেকে টপটপ করে পড়া বৃষ্টির জল হল তাদের শান্তিজল, আর যে জঙ্গুলে ফুল আর পাতাগুলো এই ধ্বংসাবশেষকে এখনো প্রাণের ছোয়াঁচ দিয়ে রেখেছে, তারা হল এই পূজার ফুল বেলপাতা। আর বুকের ধুকপুকগুলো হল এই পুজোর মন্ত্র।
কর্নাটকের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হাম্পি। সাতশো বছর পুরোনো পম্পা নগরীর ধ্বংসস্তূপ। সারথি সেখানে প্রাইভেট গাইডের কাজ করে। বিদেশি টুরিস্টদের জন্য, এন আর আই দের জন্য।
"এতক্ষণ ধরে সাজলে আমাদের গাইড পালিয়ে যাবে যে। আমি হোটেলের লবিতে গিয়ে বসছি।"
"বসো গে। এমন তাড়া দাও আর পারি না।"
তা গাইডবাবু অর্থাৎ সারথি হোটেলের লবিতে এসে অপেক্ষাই করছিল। তার পালিয়ে যাবার কোনো কারণ নেই। কারণ এই ট্রিপে সে ঋষভ এবং রেশমীর প্রাইভেট গাইড, অতএব অপেক্ষা করারই কথা! কিন্তু তার পালিয়ে যাবার অমূলক ভয় বা যে কারণেই হোক ঋষভ লবিতে এসে বসেছিল।
"রেশমীর রেডি হতে একটু টাইম লাগে। তুমি ডিএসেলার ক্যামেরায় আমাদের যেকটা ছবি তুলেছ, দেখেই বুঝতে পারছি আগে ডিএসেলার সেভাবে ব্যবহার করোনি। চলো রেশমী যতক্ষণ রেডি হচ্ছে, ঐ বাগানটাতে চলো, দেখাচ্ছি কীভাবে তোলে।"
"স্যার, আপনি নিশ্চয়ই আমেরিকায় বছর দশ পনেরো হলো রয়েছেন?"
ইংরাজি-হিন্দি মিশিয়ে দুজনের কথা হচ্ছিল।
"হ্যাঁ, ওদেশেই সেটলড, ছোটবেলা থেকে।"
"কিন্তু ম্যাডাম মনে হয় ওদেশে বছর তিন চারেক হবে?"
"কীভাবে বুঝলে?"
"আপনাদের অ্যাক্সেন্ট থেকে!"
ঋষভ দেখল সারথি ছেলেটির বুদ্ধিশুদ্ধি আছে!
"বিয়েরও বছর তিন চার হয়ে গেছে?"
"না না এই তিনমাস হল, আমেরিকাতেই বিয়ে হল, এখন ভারতে ছুটি কাটাতে আর রেশমীর বাবা মা, আমার অত্মীয়স্বজন - সবার সঙ্গে দেখা করতে। হাম্পি ঘুরতে আসার অনেক দিনের শখ ছিল।"
সারথি অবাক হয়েছিল- তিনমাস বিয়ে, মানে নূতন বৌ, মানে যাকে বলে একদম নূতন বৌ- সে একঘন্টা ধরে সাজলে বরের তো উল্টে আরো রসসিক্ত চোখ নিয়ে তাকে ঘরে বসে বসে দেখার কথা। বৌয়ের সাজতে টাইম লাগে এই অভিযোগ তো পুরোনো বৌ নিয়ে লোকে করে! মেকআপের ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি, কাপড়ের রংমিলান্তির চিন্তা- এগুলো দেখে তো নূতন বরের মজা পাওয়ার কথা। আর এ কিনা বাগানে বসে সারথিকে ছবি তোলা শেখাচ্ছে আর পটাপট সারথিকে এভাবে দাঁড়াও, ওখানে বসো, ঘাসে শুয়ে পড়ো- এই সব নির্দেশ দিয়ে দিয়ে তার ছবি তুলে যাচ্ছে!
প্রাইভেট গাইডের কাজ করলে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। সারথির অনুধাবনশক্তি বেশ তীক্ষ্ণ। তার বেশি সময় লাগেনি ঋষভকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাঙাচোরা মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে নিয়ে যেতে। আর এইসব খণ্ডহর যেখানে কোনো সাধারণ টুরিস্ট আসে না, তার খবর এই সারথি গাইড ছাড়া আর জানবেই বা কে? আর ঐ অসময়ের বৃষ্টি তো মেঘ না চাইতে জলের মতন জলপিপাসু ঋষভকে উল্টে সুরাপান করিয়ে দিয়েছে। সে জলের জন্য কাতরাচ্ছে, কিন্তু প্রতিটা শিরা-ধমনীতে ঢুকে গেছে নেশালো এক সুরার রস!
বিট্ঠল মন্দির দিয়ে আজকের ঘোরা শুরু হয়েছিল। গ্র্যানাইট দিয়ে তৈরি অদ্ভুত সব ভাস্কর্য। তাক লেগে যায় পাথরের রথটা দেখলে। চকচকে রোদে গ্র্যানাইট পাথর প্রায় সোনার মত জ্বলজ্বল করছে। স্থবির, তাও যেন চলে বেড়াচ্ছে! "দিন, ঠেলা দিন। ঠেলুন দু'জনে। আরে দুজনে দু'দিক থেকে ঠেললে কী করে চলবে? এগোবেই না তো রথটা। স্যার, ম্যাডাম, দুজনেই একদিক থেকে ঠেলুন, দু'জনে দুটো চাকার পিছনে যান।" রথটা চলার কথা নয়। তবে ছবি তোলার জন্য রেশমী আর ঋষভ দুজনেই রথের চাকাদুটো মিছিমিছি ঠেলল - হাওয়ায় হাত রেখে। ভারতবর্ষে ঘুরতে এলে এইসব ভঙ্গিমায় ছবি না তুললে আবার কেউ বিশ্বাস করবে না ভারতে গিয়েছিল বলে!
সারথি হাত-পা নাড়িয়ে নাটকের ভঙ্গিতে দু'জনকে বলল, "এই যে পাপীতাপী মানুষেরা, তোমাদের ঠেলায় রথ নড়বে না। বিট্ঠলদেব হলেন এই রথের সারথি। উনি নিজে যেদিন পৃথিবীতে নেমে এই রথ টানবেন, সেদিন রথ চলবে। ততদিন রথের কাজ সারথির অপেক্ষায় বসে থাকা।" সারথির অঙ্গভঙ্গি দেখে ঋষভ ভাবল জানতে চাইবে- তুমি অভিনয় শিখতে নাকি?
মন্দির জুড়ে শুধু থাম। বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে থাম হয়ে। থাম হওয়ার জন্য তারা দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, সামনের দুই পা আকাশের দিকে তুলে। সিংহ, ঘোড়া, জিভ বের করা ড্রাগন। এরা সবাই পাথরের থাম, কিন্তু ছোটার জন্য উদ্যত। কোথাও সিংহের পায়ের তলায় হাতি, কোথাও থামকে অবলম্বন দিয়ে বসে আছে সিংহ। শ’খানেক থাম একসময়ে ধরে রেখেছিল মন্দিরের বিশাল চূড়াটাকে- সেটা অবশ্য এখন ধ্বসে গেছে। থামগুলোর এখন অন্য ব্যবহার আছে। থামগুলোর মাঝখান দিয়ে রেশমী ছুটে বেড়াল, উড়ে বেড়াল বেশ কিছুক্ষণ- ওড়নাটার ছোঁয়া প্রতিটা থামের উপর রেখে- আর ঋষভ সেটার ভিডিও করল। সারথি জানাল পরের গন্তব্য তুলাপুরুষদান।
"সেটা আবার কী?"
"দাঁড়িপাল্লা।"
"দাঁড়িপাল্লা?"
"একমসয় রাজারা দান করতেন নিজের ওজনের হিসেবে। সেই দাঁড়িপাল্লা। তবে হাম্পির রাজারা একটু বেশি দয়ালু হত। জানেন ম্যাডাম, ওজন নেয়ার আগের কয়েকদিন রাজার পাচকরা রাজাকে আরও বেশি বেশি করে খাওয়াত- যাতে দানের ওজনটাও ভারি হয়। এর অর্থ হল ভাল দান পাবার জন্য প্রজাদের উচিত রাজার ভাল খাওয়াপরার ব্যবস্থা করা। রাজা যত ওজনদার, প্রজা তত খুশি।"
ঋষভ বলে উঠল, "সে তো প্রজারা ট্যাক্স দিয়ে দিয়ে সারাবছরই রাজাকে বাড়তি খাওয়াত। দু'দিন বাড়তি খাওয়ানো আর কী?"
সারথির মুখচোখ দেখে মনে হল এই আঙ্গিকে সে ভাবেনি। ঋষভ মনে হয় ওর নিজের শহর, নিজের রাজা- তা সাতশ বছর আগেরই হোক না কেন- সেই রোমান্সগুলো ভেঙে দিল!
"কই, দাঁড়িপাল্লা কোথায়?"
"দাঁড়িপাল্লা নেই ম্যাডাম। খালি দাঁড়িপাল্লা ঝোলানোর তোরণটা রয়েছে। ওটাই দেখার। এখন আর সেই যুগের মত দানবীর রাজা কোথায় বলুন?"
"হুঁ।"
ঋষভ বাংলায় রেশমীকে বলল, "অ্যাই রেশু, তুমি কি ভাবছিলে এখানে দাঁড়িপাল্লার দুই পাল্লায় বসে তুমি আমি ঝুলব, আর ছবি তুলব?"
ঋষভ চারিদিকে তাকিয়ে দেখল- খুব অদ্ভুত জায়গাটা। অনেক এবড়ো-খেবড়ো পাথর পেরিয়ে তারা এই জনশূন্য জায়গায় এসেছে। টিলার পর টিলা- চারিদিকে গোলাপি রঙের গ্র্যানাইট পাথর। পাথর পাথর পাথর- চারিদিকে পাথর। কিন্তু একটু ভাল করে চেয়ে দেখলে পাথরগুলো জ্যান্ত হয়ে ওঠে। পাথরের মাঝখানে মাঝখানে চোখে পড়ে থাম- ভাল করে দেখলে দেখা যায় থামের সারি- সেইযুগের বাড়িঘর আর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ঐ পাথরগুলোর মধ্যে মিশে আছে। একই রং- তাই ভাল করে না দেখলে তারা চোখে ধরা দেয় না, একে অপরের সঙ্গে মিশে এক হয়ে থাকে।
রেশমী রোদে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় ঠিক হল ওরা দুপুরটা হোটেলে কাটিয়ে আবার চারটের পর বেরোবে।
"ঋষি, আমি দেখেছি আর সবাই ঘুরতে গেলে, তাদের ডিএসেলারে দারুন দারুন ছবি ওঠে। একদম ফ্যাশন ম্যাগাজিনের কভারের মতো! এই সারথি লোকটা কিছুই তুলতে পারছে না।"
"আজকে আমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছি। রাত্রে আইপ্যাডে ট্রান্সফার করে দেখো। আজকেরগুলো তো মনে হচ্ছে ঠিকই উঠছে!" লাঞ্চের টেবিলে ঋষভ রেশমীকে বলল "আর ওর কাজটা গাইডের কাজ। ওকে তো আর আমরা প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার হিসাবে হায়ার করিনি!"
"হুমম।"
"তা ম্যাডাম, এর পরের বার আমরা প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার নিয়ে ঘুরব!"
"একটা প্রাইভেট গাইড, একটা ড্রাইভার কম পড়ছে না, পরের বার প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার! একটা মেকআপ ম্যান নিলে ষোলোকলা পূর্ণ হয়। রানি ভিক্টোরিয়া এত লোক নিয়ে ঘোরে না বোধহয়।"
রেশমীকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে ঋষভ হোটেলের লবিতে এসে দেখল, উঠোনের একটা বেদীতে গাছের ছায়ায় বসে সারথি একটা স্টিলের টিফিন বক্স থেকে চামচ দিয়ে কার্ড রাইস খাচ্ছে। সারথির বাক্সে খানকয়েক মশলা দিয়ে শুকোনো লংকা ছিল। একটা নিজে খাচ্ছিল, আরেকটা ঋষভকে অফার করল।
"খেয়ে দেখুন স্যার। ভালই লাগবে।"
"না ভাই অতো ঝাল সয় না!"
"ঝাল না সইলে যে সাউথ ইন্ডিয়া ঘুরতে পারবেন না স্যার।"
"কেন, এই তো দিব্যি ঘুরছি।"
"স্যার, এগুলো তো বিদেশি টুরিস্টদের ঘোরার জায়গা, তাই সবকিছু `নন্-স্পাইসি`!"
"বুঝলাম।"
"য়ু শুড টেস্ট সাম রিয়াল সাউথ ইন্ডিয়ান স্পাইসেস!"
"বুঝলাম।"
"তা দুপুরটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটাবে, না কি কোথাও ঘোরাতে নিয়ে যাব? যদি পয়সা দিয়ে প্রাইভেট গাইড হায়ারই করে থাকো, য়ু শুড য়ুটিলাইজ হিম অ্যাজ় মাচ অ্যাজ় পসিবল!"
"রেশমী একটু টায়ার্ড আছে..."
"তুমি তো টায়ার্ড নও! এমন জায়গা দেখাব, দেখলে গায়ে কাঁটা দেবে!"
"ঠিক আছে চলো, ড্রাইভারকে ডাকছি।"
"ড্রাইভার কেন? অত্যন্ত খরবরে রাস্তা, চার চাকার গাড়ি যায় না। আমার বাইকে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছি!"
বাইকে করে কিছুদূর গিয়ে বাকিটা জঙ্গল-কাঁটাঝোপ ভেদ করে হেঁটে উঠলে বীরভদ্রস্বামী মন্দির। আর্কিওলোজিস্টরা রিস্টোর করার বিশেষ চেষ্টা করেনি। ভাঙাচোরা মন্দিরে পুজোপাটও হয় না। দেবতাকে একা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দেবতারও একাকিত্বের দরকার পড়ে, নিভৃতের প্রয়োজন হয়, মানুষের মতো!
সারথি বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কোঁকড়ানো চুলগুলো রুমাল দিয়ে মুছছিল, জামাটাও আধা ভিজে গেছে, ঋষভ টুক করে একটা ছবি তুলে নিল মোবাইল ক্যামেরায়।
"কেন স্যার? এত সাধের ডিএসেলার ছেড়ে মোবাইলে ছবি তোলা কেন?"
কাঁধের ডিএসেলারটা দেখিয়ে ঋষভ বলল "এটা বৌয়ের। মোবাইলটা আমার।"
"হুঁ!"
মন্দিরের থামের একটা ভাস্কর্য হাত দিয়ে বুলিয়ে ঋষভ দেখছিল। হঠাৎ সারথি ওর তাগড়াই হাতটা দিয়ে ঋষভের হাতে থাবড়া মেরে বলল, "এগুলো হাত দিয়ে ধরা বারণ, নষ্ট হয়ে যায়!"
"এমন কোনো ভাস্কর্য আছে যা ধরে দেখা যায়?"
"আছে, যদি সোনা রঙের গ্র্যানাইটের থেকে কালো কষ্টিপাথর বেশি ভালো লাগে!"
"লাগে তো!"
"তাহলে ছুঁয়ে দেখো!"
ঋষভ ছুঁয়ে দেখল! এ যেন সত্যি-ই এক ভাস্কর্য। স্থবির নয়, জীবন্ত। কষ্টিপাথর, কিন্তু নিশ্বাস নেয়। বৃষ্টি মন্দিরের ছাতে পড়ছে, কিন্তু বিদ্যুৎ খেলছে ঋষভের হাতে! ঋষভের মনে হচ্ছে যেন এই কষ্টিপাথরে আঙুল চালিয়ে সে-ই বুঝি এর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করছে! হঠাৎ ঋষভ ভয় পেয়ে দূরে ছিটকে গেল। না, সে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়নি।
"সামান্য কাঠবিড়ালি স্যার, ভয় পেলে চলবে?"
"ওহ, কাঠবিড়ালি আগে কখনও গায়ে ওঠেনি। কী করে বুঝব?"
"ওঠার কথা নয়। ওরা মানুষকে ভয় পেয়ে পেয়ে চলে। দূরে দূরে থাকে।"
ঋষভ দেখল কাঠবিড়ালিটা এবার দেবদেবীদের মূর্তির মধ্যে এর গা থেকে ওর গায়ে লাফিয়ে বেরাচ্ছে। সারথি বলে গেল, "এখানে মূর্তিদের মধ্যে থেকে থেকে অভ্যেস, আমাদেরও মূর্তি ভেবেছে।"
ঋষভ তখন এক মূর্তি থেকে অন্য মূর্তিতে কাঠবিড়ালির লাফিয়ে বেড়ানো দেখছে। চারিদিকে এত দেবদেবী যক্ষযক্ষীদের মূর্তি আছে সে আগে লক্ষ করেনি। কাঠবিড়ালিটাই লাফিয়ে লাফিয়ে ঋষভের চোখকে ভাঙা মন্দিরের এই কোণ থেকে ঐ কোণে নিয়ে যাচ্ছে। স্বর্গলোক কেমন হয় তার বিশেষ ধারণা ছিল না। ছোটবেলায় একটা কল্পনা তার ছিল। তার সঙ্গে এই ভাঙাচোরা জায়গাটা মিলছে না, কিন্তু চারদিকে দেবদেবী যক্ষযক্ষীদের ভিড়ে মনে হচ্ছে এটাই দেবলোক। সব দেবতারা সাক্ষী হয়ে থাকছে আজকের ঘটনার। শরীরের কোনায় কোনায় যে সুখ সে উপলব্ধি করছে তা স্বর্গসুখের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
অন্য দেবদেবীদের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঋষভ আবার হাত বোলাতে শুরু করল কষ্টিপাথরের গায়ে। কষ্টিপাথর কথা বলল। ফিসফিস করে ঋষভের কানে সে বলল, "স্যার, দুপুরে কী বলেছিলাম? পয়সা দিয়ে প্রাইভেট গাইড হায়ার করলে, য়ু শুড য়ুটিলাইজ হিম অ্যাজ় মাচ অ্যাজ় পসিবল!"
"সেটাই করছি!"