"এক্সকিউজ মি, সিটটা আপনারই ছিল? মানে শুরু থেকে আপনারই ছিল।"
এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, "মানে?"
মেপে মেপে ঠিক এস থ্রি কোচের সামনে দাঁড়িয়েছিল ঋষভ। ট্রেন এল, প্লাটফর্মে ঢুকল- একটু আগু-পিছু তো হয়ই, তাও ট্রেনের সঙ্গে দৌড়ে ঠিক বারো নম্বর বার্থের সামনে এসে দাঁড়ালো। ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ করে ট্রেনটা দাঁড়ালো বেংলুরু সিটি স্টেশনে। কিন্তু ঐ বার্থে বা ঐ খোপের মধ্যে চেনা মুখ দেখতে পেল না। বারো নম্বর বার্থ থেকে একজন টাকমাথা লোক নামল। আচ্ছা- সারথি সিটটা এক্সচেঞ্জ করে নেয়নি তো? ভারতীয় রেলে এটা তো লোকে খুব করে। টাকমাথা লোকটাকে ঋষভ ইংরাজিতে জিজ্ঞেস করল-
"মানে ঐ এস থ্রি কোচের বারো নম্বর সীটের বুকিং আপনারই ছিল? কারও সাথে এক্সচেঞ্জ করেছিলেন?"
"আমার তো এগারো নম্বর ছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম বারো নম্বর খালি- জানালার ধার- বসে পড়লাম।"
"ওটাতে কেউ ওঠেইনি?"
"কে জানে! মনে পড়ছে না। আমার ক্যাব ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে। গুড বাই।"
এতটা মিথ্যে কথা সারথি বলতে পারে! সেই সান ফ্রান্সিস্কো থেকে ঋষভ উড়ে এল- রেশমীকে বিজনেস ট্রিপের অজুহাত দেখিয়ে। সারথি ওর সঙ্গে দু'সপ্তাহ কাটাতে রাজি হয়েছিল। হাম্পি থেকে ফেরার পর মাসের পর মাস ঋষভের মনে হয়েছিল সারথির কথা। ওদেশে যখনই ওরকম দক্ষিণি গড়নের কাউকে দেখেছে, ভেবেছে- এই ছেলেটা তো সারথি হতে পারত। সেদিন বছর চব্বিশেকের একটি ছেলে- সবে কলেজ পাশ করে কোম্পানিতে ঢুকেছে- জীবনে প্রথম মনে হল এরকম স্ক্যানার মেশিন দেখছে। ঋষভ ছেলেটির ভাবসাব দেখেই বুঝতে পারছিল এবার ছেলেটির কিছু সাহায্য দরকার। এই মেশিনটা ঋষভের নিজেরও খুব একটা সুবিধের লাগে না- কখন কী টিপতে হবে বোঝা যায় না। ঋষভ শুধু অপেক্ষা করছিল কখন ছেলেটা যন্ত্রটার উপর তিতিবিরক্ত হয়ে উল্টোপাল্টা টেপাটেপি শুরু করবে। শুরু করলও।
"এই বাচ্চা ছেলেটা, এভাবে যন্ত্রের উপর অত্যাচার করলে চলবে? সিনিয়রদের ডেকে দেখে নিতে হয় কিনা?"
"ওহ। সরি।"
"সিসিটিভি আছে। সব দেখা যায়- কে যন্ত্র খারাপ করছে, কে হাত দিচ্ছে সব। অবশ্য তোমরা আজকের ছেলেপুলেরা এসব নিয়ে ভয় পাও না।"
"তা নয় স্যার, একটু দেখিয়ে দিন।"
এই সুযোগে ঋষভও ছেলেটিকে দেখে নিল। দক্ষিণ ভারতীয় চেহারা, অনেকটা সারথির মতই গড়নটা- সত্যি কিনা জানা নেই- হয়তো ঋষভের ছেলেটাকে সারথি বলে ভাবতে ভাল লাগছে।
পরদিন ক্যাফেটেরিয়াতেও ছেলেটাকে ঋষভ দেখছিল। লংকার আচার খাচ্ছিল। মনে হল অফিসের লাঞ্চ পানসে খেতে হয় বলে বাড়ি থেকে কৌটো করে ওটা নিয়ে আসে। ছেলেটা টের পেয়েছিল। কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে বলে গেল, "স্যার, কাল আপনাকে থ্যাংকস বলা হয়নি।"
শেষ অবধি ঋষভ একদিন সারথিকে ফোন করে বসল। সারথি এত সহজে রাজি হয়ে যাবে সে ভাবতে পারেনি। সারথি দু'সপ্তাহ দেবে। সময়ের দাম দিতে হয়। ঋষভ নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিল- দু'সপ্তাহের গাইডের যা খরচ ঋষভ দিয়ে দেবে। তার থেকে কিছু বেশিই দেবে। ঋষভ আগেরদিন সন্ধেবেলা প্লেনে এসে বেংলুরুতে নেমেছে- দুই সপ্তাহের জন্য সেল্ফ ড্রাইভিং গাড়িও ভাড়া করে নিয়েছে। সারথির আসার কথা ট্রেনে- আজ সকালে- এল না।
রাগ হচ্ছিল। ছোট ছোট গল্প বানানো আর এত বড় মিথ্যে বলা- দুটো আলাদা। এত বড় মিথ্যে! কে জানে ঋষভের কাছে যা বড় ব্যাপার, সারথির কাছে হয়তো নয়। হাজার হোক- আসার কোনো দায় তো ছিল না। অগ্রিম টাকাও সে দেয়নি- ট্রেনের টিকেটের কয়েকশো টাকা খরচ করেছিল মাত্র। ঋষভ নিজেও কোনো সত্যবাদী যুধিষ্ঠির নয়- আগে যাও বা ছিল- এখন হঠাৎ মিথ্যে বলতে শিখে গেছে।
হোটেলে ফিরে ডেটিং সাইটে কিছুক্ষণ আঙুল চালালো ঋষভ। নাহ- এসব করে শান্তি হচ্ছিল না। একটা দেহের বিকল্প অন্য দেহ হতে পারে। কিন্তু সারথির বিকল্প হিসেবে অন্য কাউকে যখন তার ইচ্ছে করছে না- তখন কে জানে হয়তো দেহটাকে নয়- মানুষটাকেই হয়তো সে চাইছিল। শেষ অবধি ঋষভ ফোন করল।
"এলে না?"
"তুমি সত্যি চাইছিলে আমি আসব?"
"সত্যি চাইছিলাম না মিথ্যা চাইছিলাম- সেটা মাপার কি এখন সময় সারথি?"
"মেপে নিলাম। আসছি আমি।"
"কী মাপলে?"
"থাক সে কথা- আজ রাতের মধ্যেই আসছি।"
"রাতের মধ্যে? এক রাত লেগে যায় তো আসতে!"
"আমি মাঝপথে নেমে পড়েছিলাম ট্রেন থেকে- যেখানে আছি সেখান থেকে ঘন্টা ছয়েকের রাস্তা। অপেক্ষা করো- আসছি।"
মাঝপথে নেমে পড়েছিল! তাহলে সারথিও কি নানারকম সংশয়ে ভুগছিল? ঋষভ এই ভেবেই সান্ত্বনা পেল যে সারথি সংশয়ে ভুগছিল- একেবারে না আসার সিদ্ধান্ত বানিয়ে নেয়নি। সিদ্ধান্তের থেকে সংশয় ভাল- কিছু সুযোগ রেখে যায়।
সন্ধেবেলা হোটেলের বাগানে এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পায়চারি করছিল ঋষভ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। প্রায় একবছর পর দেখা হচ্ছে। সত্যি আসবে তো! এতটা উত্তেজনা যে রেশমীও ফোনে কী আন্দাজ করে জিজ্ঞাসা করে বসল, "শরীর ঠিক আছে তো?"
ঋষভ ঠিক করল অপেক্ষা করবে না। মানে অপেক্ষা করবে, কিন্তু অপেক্ষা করার মত করে অপেক্ষা করবে না। অস্থির হবে না, উত্তেজিত হবে না। শান্ত থাকবে। ঘরে বসে ঘড়ি দেখবে না, নাহয় ফুটপাথে পায়চারি করে বেরাবে। ফুটপাথে বেরোলেও পথ চেয়ে থাকবে না। নিজেকে বোঝাবে- সারথি আসুক না আসুক কিছু যায় আসে না। এই পৃথিবী অনেক বড়, সারথি একজন মানুষমাত্র।
সারথি এল। সেই আগের মত করেই প্রথম দেখা। মানে, সারথি মাথা থেকে পা অবধি ঋষভকে যেন মেপে নিল। সারথির চোখে সারাদিনের বাসযাত্রার ধকল, কিন্তু মুখে অল্প হাসি। ঋষভ বুঝতে পারছে তার অস্থিরতা আর অপেক্ষাটাকে মাপা হচ্ছে। তা মাপুক গে! যা মাপার সকালেই মেপে নিয়েছে, হয়তো তারও আগে যখন আমেরিকা থেকে ফোনে কথা হচ্ছিল তখনই মেপে নিয়েছে।
সারথি এসে ঘুমিয়ে পড়ল। হোটেলের ধবধবে সাদা চাদরে সারথির বলিষ্ঠ শ্যামলা রঙের দেহটা ঘুমিয়ে আছে, আর জেটল্যাগ নিয়ে জেগে বসে আছে ঋষভ। সারথিকে দেখছে আর অনেক কিছু সে পরিকল্পনা করছে আগামী দু'সপ্তাহের। সারথিকে নিয়ে, সারথির দেহটাকে নিয়ে। কল্পনার জ্বালায় মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে সারথিকে এখনই জাগিয়ে তোলে সে। এই দুই সপ্তাহ সারথিকে যখন তখন জাগিয়ে তোলার অধিকার তার আছে। তারপর আবার নিজেকে সামলে নেয়, আর ভাবে- নাঃ, এতটা অধিকারও সারথি তাকে দেয়নি। সকালবেলা ওভাবে হতভম্ব করে দেবার পর লোকটা যে এসেছে- তাই অনেক।
পরদিন গাড়ি নিয়ে বেরোনো। অনেকদূর যেতে হবে- কিন্তু কোথায়- এখনও ঠিক হয়নি। ঠিক হল চিকমাগালুরের কফি বাগিচায় রাত কাটানো।
"ঋষভ স্যার- ওখানকার একটা কফি বাগিচার একটা হোমস্টের সাথে পরিচয় আছে- কিছু ডিসকাউন্ট করিয়ে দেব। তিনশো কিলোমিটার রাস্তা। চলো যাওয়া যাক।"
পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে।
রাত্রে হঠাৎ কে যেন ঋষভকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে।
"কী হল সারথি? ঘুমের মধ্যে ঝাঁকাও কেন?"
"স্যার, ঘুমোতে তো আমরা আসিনি। বাইরে চলো।"
"ঘুমের ঘোরে হাঁটলে আছাড় খেয়ে পড়ব।"
"আমি আছি।"
"তুমি আছো? বেশ। কিন্তু তুমি কখন আছো, কখন নেই- সেটাই তো টের পাই না।"
"এখন আছি- চলো।"
পশ্চিমঘাট পর্বতের পুবের ঢালটাকে এইদিকে বলে মালনাড বা মালেনাডু- মানে বৃষ্টির দেশ। এখন বৃষ্টির সময় নয়, তাও গা ভিজে যাচ্ছে- কুয়াশায়। চাঁদের আলো, পশ্চিমঘাট পাহাড় আর জঙ্গল- কেন হেঁটে যাচ্ছে ঋষভ জানে না। সারথি বলল- "আমি আছি"। এটাই হয়তো যথেষ্ট টেনে নিয়ে যাবার জন্য। সারথির কাজ হল রথকে টেনে নিয়ে যাওয়া।
"এখানে ঢালু- সাবধানে স্যার।"
মালনাড জায়গাটা ঠিক পাহাড় না, আবার সমতলও না। পাহাড়ের আঁকেবাঁকে ঢাল থাকে, কিন্তু এখানে পথ চলতে চলতে কীসের মুখোমুখি হতে হয় আগে থেকে বোঝা যায় না।
"গর্ত থেকে দিব্যি উপরে উঠে গেলে। আমায় তোলো ভাই।"
"যদি না তুলি স্যার?"
"এখানেই থাকব। হোমস্টের মালিক আমায় না দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে যাবে, পুলিশ ডাকবে। কাল তোমার নামে পুলিশ কম্প্লেন হবে- অসহায় বিদেশি মানুষকে ফাঁসানোর। তারপর দুই দেশের দূতাবাস আলোচনায় বসবে।"
"পুলিশকে বলব তুমি স্লিপ-ওয়াকিং করো। এখানে এসে পড়েছ।"
"কেন ভাই? তোমার ঐ রাঁধুনি বন্ধু তোমার অপেক্ষায় বসে আছে?"
"বুদ্ধি তো কম ধরো না দেখছি।"
"দেখতে পেলাম সবই। খাবার দেওয়ার অন্য লোক আছে, তাও নিজে এসে হাজির হল। আবার লজ্জা লজ্জা মুখ করে চলেও গেল।"
"সবই দেখতে পাও তাহলে।"
"তা এইজন্য ক্লায়েন্টকে ছেড়ে পালানোর ধান্দা?"
"দাও, হাত দাও।"
"হুঁ।"
"ব্যবসার একটা এথিক্স থাকে। ক্লায়েন্টকে জঙ্গলে ফেলে পালালে আর এই গাইডকে কেউ কাজ দেবে না।"
"ক্লায়েন্ট না হলে ফেলে পালাতে?"
"হয়তো আনতামই না।"
"আচ্ছা?"
"উত্তর পছন্দ হল না? কী শুনতে চাইছিলে?"
"জানি না..."
"তুমি ক্লায়েন্ট না হলেও তোমায় অনেক অনেক ভালবাসা দিতাম- এই শুনতে চাইছিলে?"
এই মাঝরাতের অত্যাচারের আনন্দও বিনামূল্যে সে পায়নি, সবকিছুই টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ভেবে ঋষভের কেমন নিজেকে লুজার মনে হল। এই গর্তটার মধ্যেই মিশে যেতে তার ইচ্ছে হচ্ছিল। তারপর ভাবল- টাকা থাকলে খরচ করাই উচিত- টাকা না দিয়ে পেতে হলে সময় দিতে হয়- যা তার হাতে নেই, আর সত্যিকারের ভালবাসা দিতে হয়- যা তার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।
ঋষভের নিজে থেকে ওঠার কোনো লক্ষণ না দেখতে পেয়ে সারথি নিজেই গর্তে নামল ঋষভকে তোলার জন্য।
"আই লাভ য়ু, স্যার। কী? খুশী? চলো, উপরে চলো।"
সারথি শক্ত করে ঋষভের হাত ধরল।
ঘরে যেতে বিশেষ ইচ্ছে ঋষভের করছিল না, চাঁদনি রাতে বনে বাদাড়ে ঘুরতেই ভালো লাগছিল। মাঝে মাঝে সারথি পাথরে শুয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। ঋষভ এখনও জেট ল্যাগে- আমেরিকার টাইম জোন অনুযায়ী জেগে আছে- নিজেকে তার নিশাচর প্রাণীর মত মনে হচ্ছে। সারথির জ্যোৎস্নাস্নাত ঘুমন্ত শরীরটাকে সে নিশাচর প্রাণীর রাতের শিকার বলে ভাবার চেষ্টা করছে।
সারথি জেগে উঠে ঋষভকে ঘরে ফেরানোর চেষ্টা করল। ঋষভ জিজ্ঞেস করল, "গাইডের কি রাতে ঘোরানোর জন্য এক্সট্রা চার্জ লাগে?"
"এক্সট্রা চার্জ লাগে কিনা জানি না, গাইডের ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেছে, চলো এবার।"
শেষ অবধি ঘরে ফেরা হল। রাতটা বাইরে বাইরে, দিনটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটল।
আজকেও রাঁধুনি ছেলেটি নিজেই খাবার দিতে এল।
"কী নাম তোমার?"
"কৃষ্ণা।"
"বেশ।"
কৃষ্ণা বেশ ভাল করে টেবিল সাজিয়ে দিয়ে গেল। কৃষ্ণা ছেলেটা বেশ চুপচাপ স্বভাবের মনে হল।
রাত্রে সারথি বলল, "কৃষ্ণা ডাকছে। আমার সঙ্গে হুইস্কি খেতে চায়।"
"যদি ছুটি না দিই?"
"কৃষ্ণার মালিক ওকে ছুটি দিয়েছে, সারথির মালিক দিতেই পারে।"
"না, পারে না। কৃষ্ণার ডিউটি দিনে, সারথির ডিউটি রাতে।"
সারথি কিছুক্ষণ বেজার মুখে দাঁড়িয়ে, তারপর বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন ব্রেকফাস্ট দিতে কৃষ্ণা এল না। শেষ অবধি এল, কারণ সার্ভ করার ছেলেটির অন্য কাজে ডাক পড়ল। কৃষ্ণার আজ পরিপাটি করে খাওয়ানোর বিশেষ ইচ্ছা নেই, সাম্বরের বাটি ঠং করে টেবিলে রাখল। সবকিছু বেশ সশব্দে টেবিলে রাখছে। মানুষকে মুখে শব্দ করতে না দেওয়া হলেই যে সে নীরব হয়ে যাবে, এমন আশা তো আর করা যায় না। ঋষভের এগুলো ভাল লাগছিল না। কফি বাগিচায় অনেক ঘোরা হয়েছে- প্রকৃতির কোলে বোর হচ্ছে এখন সে- অতএব গাড়ি নিয়ে হালেবিডুর মন্দির ঘুরে আসার প্ল্যান হল। গাড়িতে ওঠার সময়ও কৃষ্ণাকে একটু দূরে দেখা গেল, সে একটা নীরস বিরস দৃষ্টি সারথিকে দিল।
"স্যার একটা কথা বলি।"
"বলোই না।"
"এখানে থার্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টের বন্দোবস্ত কৃষ্ণাই করে দিয়েছে ওর মালিককে ধরে। আমার অনেকদিনের চেনা তো।"
"আচ্ছা, তো ওর ডিস্কাউন্টের প্রতিদান চাই?"
"মানে… ওরকম নয়..."
"পাবে। ও পাবে। চিন্তা নেই।"
সারথি আর কথা এগোলো না।
"সারথি?"
"কী?"
"সারথি, আমি কি সবকিছুই টাকার হিসেব বানিয়ে দিয়েছি? মানে পুরোটাকেই একটা ব্যবসায়িক চুক্তি বানিয়ে দিয়েছি?"
"দিয়েছ। তবে অমনটাই থাকুক। ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছু বানিয়ে কাজ নেই।"
"ঠিক বলছ?"
"হ্যাঁ। এটা ব্যবসাই থাকুক। আর গাইড হিসেবে যা করার কথা, আমি হয়তো কিছুই করছি না। হোটেলে বসে আরাম করছি। চলো, আজ না হয় গাইডেরই কাজ করি। তোমায় গল্প শোনাই- ভুলভাল গল্প- শুনে তুমিও মজা পাবে, আমারও কাজ করা হবে।"
"বেশ।"
নাচের ছবি বা ভিডিও তোলার পক্ষে হালেবিডুর মন্দিরটা বেশ আদর্শ জায়গা মনে হল ঋষভের। হাম্পির পট্টাভিরমের তুলনায় এখানে আরও ভাল ভিডিও করা যায়। চারিদিকে সোপস্টোনের হাজার হাজার ভাস্কর্য, নয়শো বছর পুরোনো। অদ্ভুত সূক্ষ্ম কাজ, অনেক ডিটেল সহকারে গয়না আর পোশাক তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্যগুলোতে- সবই সোপস্টোন দিয়ে। ঋষভ হাম্পির মত একটা নাচের ভিডিওর প্রস্তাব দিল সারথিকে। চারিদিকে নাচের পরিবেশ- শিব নাচছে, গণেশ নাচছে, যক্ষ নাচছে, অপ্সরা নাচছে, সাধারণ গ্রামবাসীরাও নাচছে। কিন্তু সারথি রাজি হল না। রোদ, গরম, ঘুম হয়নি- নানা অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেল।
"সারথি, তোমার তাণ্ডবটা দেখা বাকি ছিল যে। অন্য কখনও, অন্য কোনো মন্দিরে- বলেছিলে। আর রাজার গলার হারটাও যে বাকি আছে।"
"এই মন্দিরে তাণ্ডব নাচলে পুলিশ পেটাবে!"
রাতে ডিনার অন্য ছেলেটি দিতে এল।
ঋষভ বলল, “নুন কম হয়েছে- একটু রাঁধুনিকে ডাকো।"
কৃষ্ণা এল।
"এনি কম্প্লেন স্যার?"
"কম্প্লেন করতে তো ডাকিনি, কৃষ্ণা!" ঋষভ উত্তর দিল।
"তাহলে শিবা যে বলল- নুন কম..."
"যদি ওকে বলতাম কৃষ্ণা খুব ভালো রাঁধে আর সেটা বলার জন্য ওকে ডাকাচ্ছি- তুমি আসতে না। কম্প্লেন শুনতে পেলে তাই এলে।"
"ওহ।"
"রাত্রে সব কাজ হয়ে গেলে ঘরে এসে টোকা মেরো। খুব ভালো লাগল তোমার রান্না, তাই কিছু উপহার দিতে চাই।"
"বেশ।"
কৃষ্ণার বিরস মুখে একটু হাসি ফুটল।
কিন্তু রাত্রে কৃষ্ণা এল না। ঋষভ দেখল আউটহাউসের আলো বন্ধ। আউটহাউসেই রান্নাঘর। বারান্দা থেকেই দেখা যায়। একটু আগে কৃষ্ণা আর শিবা বাসন মাজছিল। এখন আলো নিভিয়ে দিয়েছে। ছিঁটেফোটা শব্দ নেই। খালি জঙ্গলের ঝিঁঝির ডাক। মিনিট দশেক পরেও যখন আউটহাউসের নিঃশব্দতা কাটল না, তখন ঐ হিড়হিড়ে ঠান্ডার মধ্যে নিজেই বেরোতে গেল ঋষভ। তারপর ভাবল- এই কৃষ্ণা ছেলেটির আত্মসম্মানবোধ বেশ জোরালো- এভাবে ঘাঁটিয়ে কাজ নেই, অন্য উপায় দেখতে হবে।
এখানে তিন রাত্রি হতে চলেছে- তিন রাতেরই প্লান ছিল- কিন্তু ঋষভ এক্সটেন্ড করিয়ে নেবে ঠিক করল। কৃষ্ণার সঙ্গে একটা দরকারের কথা না বলে সে যাবে না। খুব দরকারি একটা কাজ সে কৃষ্ণার জন্য ভেবে রেখেছে।