কীসের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে ভারতের স্বধর্ম আজ আক্রমণের মুখে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য নিবন্ধের প্রথম পর্বে আমি স্বধর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বোঝাতে চেয়েছি যে স্বধর্ম আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতার সেই অংশ, যাকে আমরা সর্বোত্তম হিসেবে গ্রহণ করতে চাই। অর্থাৎ মানব জীবনের আদর্শ হল স্বধর্ম খুঁজে বের করে তাকে অনুসরণ করা।
এখন প্রশ্ন জাগে, একটি দেশের কি স্বধর্ম থাকতে পারে? আপনি যদি এর বাইরের রূপটি নিয়ে চিন্তা করেন, তবে কথাটি অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। ধর্ম তাই, যা ধারণ করা যায়। ধারণ করার জন্য প্রয়োজন চেতনাশীল ধারক। তাই একজন মানুষের ধর্ম থাকতে পারে। পশুপাখি বা গাছ-গাছালিরও থাকে। কিন্তু দেশের মত একটা অচেতন সত্ত্বার কীভাবে ধর্ম থাকতে পারে? দেশ যদি মানচিত্রে চিহ্নিত একটি রেখা হয়, তবে তার ইতিহাস এবং আবহাওয়া থাকতে পারে, কিন্তু ধর্ম থাকতে পারে না।
‘ধর্ম’ মানে যদি শুধু ‘রিলিজয়ন’ বা ‘মজহব’ হয়, তাহলে সেটা দেশের ধর্ম হওয়া উচিত নয়। ইংরেজি শব্দ ‘রিলিজিয়ন’-এর ভুল অনুবাদের কারণে এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। পছন্দের দেবদেবী বা উপাসনা পদ্ধতির বিশ্বাসকে ‘পন্থা’ বলা উচিত, ‘ধর্ম’ নয়। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান ইত্যাদি বিভিন্ন পন্থার নাম। স্পষ্টতই, যে কোনো একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুসারে, তার অনুসারীদের নিজস্ব ধর্ম থাকতে পারে। কিন্তু কোনো একটি সম্প্রদায় বা পন্থার ধর্ম সমগ্র দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীতে যেখানে কোনো বহুত্ববাদী দেশে একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে দেশের স্বধর্ম বলে মেনে নেওয়ার ভুল করা হয়েছে, সেই দেশ ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে এবং শেষে ভেঙে পড়েছে।
কিন্তু অন্য এক বিশেষ অর্থে দেশেরও স্বধর্ম থাকতে পারে। দেশ যদি একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় হয়, তার নিজস্ব ধর্ম থাকা অসম্ভব নয়। সচেতন ব্যক্তির যদি ধর্ম থাকে, তবে সচেতন গোষ্ঠীরও একটি ধর্ম থাকবে। তাই একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় গঠনের প্রক্রিয়া দেশপ্রেমের সংকল্পের চাবিকাঠি। একজন ব্যক্তির স্বধর্মে, ‘স্ব’-এর মাত্রাগুলি তার নশ্বর দেহের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হবে, তার জন্মের প্রেক্ষিতে (পরিবার, জাতি/শ্রেণী) যুক্ত থাকবে। এবং ‘ধর্ম’ তার মনন, কথা এবং কাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে। দেশের মতো সম্প্রদায়ের স্বধর্ম দীর্ঘজীবী – সময় এবং স্থান অনুসারে সংজ্ঞায়িত, জাতীয় মর্যাদা সংজ্ঞায়িত করে। দেশের স্বধর্মকে চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী ইতিহাসের চাকা ঘোরানোই প্রকৃত ‘পুরুষার্থ’, যদি না ‘পুরুষ’কে শুধুমাত্র ‘পুংলিঙ্গ’ অর্থে বোঝানো হয়।
এখন প্রশ্ন জাগে, দেশের স্বধর্ম কোথায় পাব? এটি খুব গভীর প্রশ্ন। যে দেশ গঠনের প্রক্রিয়া কোনো মতবাদের ওপর ভিত্তি করে হয়, তার স্বধর্ম স্পষ্টভাবে এবং লিখিত আকারে পাওয়া যায়। তবে সেখানেও বিষয়টি সহজ নয়। উদাহরণ হিসেবে ইসরায়েলের কথাই ধরুন। দেশটি গড়ে উঠেছে ইহুদি চিন্তাধারা এবং জাতিগত পরিচয়কে ঘিরে। কিন্তু সেই ভূখণ্ডের আদি ফিলিস্তিনি জনগণ এই চিন্তাধারার ফলে অস্পৃশ্য রয়ে গেছে। এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি মতাদর্শ ভিত্তিক দেশ ছিল, কিন্তু যখন এটি ভেঙে গেল, তখন মতাদর্শ তাকে একত্রিত রাখতে পারেনি। ইসলামের নামে গঠিত পাকিস্তান নিজের বাংলাভাষী নাগরিকদের বেঁধে রাখতে পারেনি। স্বধর্ম কেবল দলিল, লিখিত আদর্শ কিংবা মতাদর্শের ভিতর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেশের স্বধর্মের অনুসন্ধান শুরু করতে হবে জনগণের মধ্যে। প্রতিটি দেশের মানসিকতায় কিছু আদর্শের বুনিয়াদ রয়েছে যা তাকে একটি অনন্য চরিত্র দেয়। এটি সাধারণ জনমত নয়, কারণ লোকেরা সাধারণত এই আদর্শ অনুসারে চিন্তা করে না এবং আচরণ করে না। তাই জনমত জরিপ এখানে কাজ করবে না। জনগণের ওপর বহু শতাব্দীর সাংস্কৃতিক ছাপ রয়েছে। কিন্তু তা কোনো প্রাচীন সনাতন ঐতিহ্য বা ধর্মগ্রন্থে সরাসরি পাওয়া যাবে না। একইভাবে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নকলনবিশি ভাষায় আমরা ভারতের স্বধর্ম পাব না।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের স্বধর্ম এদেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের শিকড়ে রয়েছে। কিন্তু এই প্রাচীন সাংস্কৃতিক আদর্শগুলি এখনকার আধুনিক রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আধুনিক ভারতের জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় এই প্রাচীন আদর্শগুলি নবায়ন ও পরিমার্জিত হয়েছিল। সেই নির্মাণ চলাকালীন এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের মানসিকতার সম্পর্ক এবং ইউরোপের আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গমের মধ্যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের স্বধর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে। ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারায় দেশীয় আধুনিকতার যে ব্যাখ্যা ঘটেছে তা ভারতের স্বধর্মের দিশা দেখাবে।
ঔপনিবেশিক আধুনিকতার হস্তক্ষেপে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের চরিত্র পরিবর্তিত হয় এবং জাতীয় চেতনার জন্ম হয়। এখানে পুরানো দেশের ধর্ম মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সভ্যতার ধর্মকে দেশধর্মের রূপ দেওয়া হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের প্রকৃত গুরুত্ব হল, এটি কেবল প্রজাতন্ত্রের মৌলিক দলিল নয়, বরং আধুনিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সভ্যতায় বেড়ে ওঠা মূল্যবোধের পুনঃসংজ্ঞায়নের বুনন। সংবিধান আমাদের আমাদের দেশীয় আধুনিকতাকে এক সূত্রে গেঁথেছে।
এই স্বধর্ম জড় এবং শাশ্বত নয়। আমাদের স্বধর্ম বহমান। দেশধর্ম কখনই চিরন্তন নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। যুগে যুগে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশধর্মের সময়কাল সংজ্ঞায়িত করা হয়। ঔপনিবেশিক ভারতের যুগধর্ম আলাদা ছিল, স্বাধীন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের যুগধর্ম আলাদা। বিশ্বশক্তির কালচক্রও একে প্রভাবিত করে। এই নিবন্ধের পরবর্তী পর্বে আমরা আধুনিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের স্বধর্মের তিনটি মৌলিক নীতি সম্পর্কে আলোচনা করব।