বর্তমানে দিল্লির তিন-মূর্তি ভবনে দেশের প্রধানমন্ত্রীদের জাদুঘরে নরেন্দ্র মোদীর কক্ষটি অসম্পূর্ণ রয়েছে। তাঁর প্রয়াণের পর জাতি যখন তাঁর ভালো-মন্দ সিদ্ধান্তের স্মৃতি লালন করবে, তখন নিশ্চয়ই সেই জাদুঘরে নোটবন্দির একটি স্থান থাকবে এবং সেই ঘরে অবশ্যই গোলাপি ২০০০-এর নোটের জন্যও একটি জায়গা থাকবে। ওই ঘরটিকে কি পাগল তুঘলক বলা হবে নাকি তামাশার ঘর বলা হবে?
এই নোট নিয়ে করা কৌতুকগুলিও সেই নতুন মেজাজের জাদুঘরে স্থান পাবে। যাই ঘটে যাক না কেন, “আজ তক”-এর সঞ্চালক অবশ্যই পরবর্তীকালে সেই ক্লিপিং খুঁজে পাবেন, যেখানে তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নোটবন্দির দিনে ২০০০ টাকার নোটে ঢোকানো “ন্যানো চিপ”-এর বিবরণ দিয়েছিলেন। আমি যদি এমন করতে পারি, তাহলে আমি জাদুঘরে ২০০০ সালের নোটটি প্রত্যাহার করার বিষয়ে রোফাল গান্ধীর নামে এই ট্যুইটটিকেও চিহ্নিত করব— “নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুসারে, ৫জি-এর সঙ্গে ২০০০-এর নোটে চিপের সংযোগ উপযুক্ত ছিল না৷ এখন নতুন ৫০০০ ৫জি সুপার ন্যানো চিপ নোট আসবে। কালো টাকা আলমারিতে রাখলে সে নিজেই উবার বুক করে আরবিআই অফিসে ফিরে আসবে।”
সেই জাদুঘরের কক্ষে ৮ নভেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যা থেকে ১৯ মে ২০২৩ পর্যন্ত নোটবন্দির গল্প বলা হবে। গল্পটি শুরু হবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের একটি ভিডিও ক্লিপ দিয়ে, যেখানে বড় বড় দাবি করা হয়েছিল। এতে আরও অনেক ছবি থাকবে, যেমন, সারা দেশে সারি সারি চোখ কুঁচকে থাকা অকেজো নোট। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক থেকে প্রতিদিনের নতুন নির্দেশাবলি, ব্যাঙ্কগুলির প্রতিদিনের পরিবর্তনের নিয়মের নথিও থাকবে তাতে ।
যদি সেই জাদুঘরটি সততার সঙ্গে তৈরি করা হয়, তবে সেখানে এটিও রেকর্ড হবে যে কীভাবে কোনও অর্থনীতিবিদের মতামত ছাড়াই দেশের মুদ্রার সঙ্গে এত বড় গণ্ডগোল করা হয়েছিল এবং রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সতর্কতা সত্ত্বেও কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যদি সেই জাদুঘরটি ভবিষ্যৎ-সচেতন হয়, তবে এটির একটি প্যানেল থাকবে, যা বাস্তবিক নোট বাতিলের দাবির মুখোমুখি হবে। বাস্তব হল এই, যে, রিজার্ভ ব্যাংকের নিজস্ব রিপোর্ট অনুযায়ী – ৯৯.৩ শতাংশ নোট ব্যাংকে ফিরে এসেছে। বড় ব্যাগধারী রাজাদের টাকা ডোবেনি। কিন্তু হ্যাঁ, গরিবদের সুদে পড়ে থাকা কিছু নোট অবশ্যই পচে গেছে। এই সিদ্ধান্তের পিছনে একটি বোঝাপড়া ছিল, যে, দুর্নীতিবাজ—যারা কালো টাকার মালিক—তারা মুদ্রা নোটের বান্ডিল লুকিয়ে রাখে। দেখা গেল—কালো টাকা যাদের আছে, তারা আমাদের চেয়ে বেশি চালাক এবং তাদের টাকা বেনামি সম্পত্তি, জমিজমা বা হীরা ও গহনাতে রূপান্তরিত করে রাখা হয়। জাল নোটের সংখ্যা অনেক বেশি বলেও দাবি করা হয়েছে। পরে, রিজার্ভ ব্যাংক নিজেই জানিয়েছিল যে জাল নোটের অনুপাত মাত্র ০.০০০৭ শতাংশ।
এখানে প্রধানমন্ত্রীর জাদুঘরে, গোলাপি রঙের কমিক ঘরটি আপনাকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে তা হল, যদি সমস্যাটি ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটের চেয়ে বড় সংখ্যার নোট হয়, তাহলে ২০০০ টাকার বড়ো নোট কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে? যদি ১০০০ টাকার নোট দুর্নীতিবাজদের টাকা জমাতে সুবিধা দেয়, তাহলে ২০০০ টাকার নোট কি তাদের জালিয়াতির পথ আরও সহজ করে দেবে না? এই প্রশ্নের উত্তর তখনও পাওয়া যাবে না, পরেও পাওয়া যাবে না। নোটবন্দির তুঘলকি সিদ্ধান্তের জন্য সরকার কখনও জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। হ্যাঁ, কালো টাকা নির্মূলের দাবির ভিত্তিতে নির্বাচনে জিতেছেন, কয়েকবার নোটবন্দি উদ্যাপন করেছেন এবং তারপরে তা ভুলেও গেছেন। সরকার চুপচাপ ২০১৮ সালে নিজেই ২০০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধ করে দেয় এবং তারপর ১৯ মে ২০২৩-এ আবার তা প্রত্যাহার করার ঘোষণা করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত যুদ্ধে জনগণ দরবারি চম্পু দাবি করলেও এবার তারা আর শুনছে না। রিজার্ভ ব্যাংক জানিয়েছে, যে, ২০০০-এর নোটের প্রচলন খুব বেশি ছিল না, কিন্তু এত সহজ একটা জিনিস জানার জন্য সারা দেশে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কী দরকার ছিল—তা বলেনি। ২০০০ টাকার নোটের জাল সংস্করণ তৈরি করা আগের চেয়ে আরও সহজ ছিল বলেও শোনা গেছে। আরও একবার মহড়া করা হয়েছিল ব্যাংকে ২০০০ টাকার ১৮১ কোটি নোট ফেরত দেওয়ার। তারপরে প্রতিদিনের সীমা নির্ধারিত হয় ও এই নিয়মগুলি প্রতি সপ্তাহে পরিবর্তন করা হয়, যাতে নোটগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রচলনের বাইরে চলে যায়। কেন এত ব্যয়বহুল পরিশ্রম করা হয়েছিল? যদিও, এর কারণ কেউই বুঝতে পারেনি। শুধু এটুকুই বুঝুন, যে, সরকার নোটবন্দির সমাধিতে ২০০০ নোটের আকারে গোলাপি ফুল দিয়েছিল মাত্র।
যতদিন প্রধানমন্ত্রীর জাদুঘরে তাঁর মন্ত্রীত্বের যুগের নোটবন্দীকরণ কক্ষটি প্রস্তুত হবে ততদিন, ভারতে নোটবন্দির কেস-স্টাডি বিশ্বের অর্থনীতির বইগুলিতে প্রকাশিত হবে চলমান অর্থনীতির সঙ্গে মোদীজির খেলা করার উদাহরণ হিসাবে। তাতে বলা হবে, চোখের অপারেশন যেমন স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে করা যায় না, তেমনই আধুনিক অর্থনীতির মুদ্রাও অপেশাদারদের হাতে দেওয়া যায় না। সেই ঘরের শেষে একটি চিহ্নও থাকতে পারে যে,
“সাবধান, মুদ্রার সঙ্গে খেলা, বিদ্যুতের সঙ্গে খেলার মতো!”