আমি ২০১৯ সালে বলেছিলাম, “কংগ্রেসকে অবশ্যই মরতে হবে”। আমি তখন কী বোঝাতে চেয়েছিলাম? এখন কি সেই চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়েছে?
ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে, আপনি ক্ষোভ চেপে রাখবেন না। পল স্যামুয়েলসনের অনুসরণে আমি সবাইকে জিজ্ঞাসা করি: “পরিস্থিতি বদল হলে আমার মূল্যায়ন পরিবর্তন করি। আপনি কী করেন, স্যার?”
আপনি কি বলেননি, “কংগ্রেসকে অবশ্যই মরতে হবে”? এখন কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আপনি কীভাবে হাঁটছেন? কংগ্রেস আয়োজিত ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রায় কীভাবে যোগ দিতে পারলেন?
গত তিন সপ্তাহ ধরে আমি বারবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। আমার সমালোচকরা তাতে মজা পেয়েছেন। মিডিয়াকর্মীরা ধরে নেন, যে, আমি এই ‘কঠিন’ প্রশ্ন এড়িয়ে যাব এবং মুচড়ে থাকব। এটি সোজাসাপটা উত্তর দাবি করা ন্যায্য প্রশ্ন এবং তাঁদের কাছে সহজ ‘কিস্তিমাৎ’ চাল। যদিও এখানে কোনো ডিগবাজি নেই, হঠাৎ মনের পরিবর্তন নেই, সম্পূর্ণ ঘুরে যাওয়ার কোনো ব্যাপারও নেই।
কারণটি সহজ: তখন আমি যা বলেছিলাম এবং লিখেছিলাম এবং এখন যা বলছি, তাতে মনোযোগ দেন না বেশিরভাগ ভাষ্যকার। তাঁদের শুধু মনে আছে, “কংগ্রেসকে অবশ্যই মরতে হবে” কথাটি। এখন তাঁরা দেখছেন ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রায় রাহুল গান্ধির সঙ্গে আমার হাঁটার দৃশ্য। তাঁরা অনুমান করেন, যে, আর কিছু বলার দরকার নেই – এটি গণিতশাস্ত্রের মত কিউ.ই.ডি।
“কংগ্রেসকে মরতে হবে”-র রহস্য
এই তিনটি শব্দ প্রথমবার আসে ১৯মে ২০১৯ তারিখে আমার ৪১ শব্দের ট্যুইটে, যা এরকম ছিল: “কংগ্রেসকে অবশ্যই মরতে হবে। ভারতকে বাঁচাতে যদি এবারের নির্বাচনে বিজেপিকে আটকাতে না পারে, তাহলে ভারতের ইতিহাসে এই দলের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নেই, বরং বিকল্প তৈরির ক্ষেত্রে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
দু’দিন পরে, আমি দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ১,১২৩ শব্দের একটি নিবন্ধে ট্যুইটটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি: “কংগ্রেসের অস্তিত্ব বজায় রেখে বিকল্প রাজনীতি শুরু হতে পারে না... মৃত্যুর রূপকটা এভাবেই বোঝা উচিত।” আমি বর্ণনা করেছি, যে আমার অবস্থান কংগ্রেসের অন্ধ বিরোধিতা করার কোনো চিন্তাহীন অভ্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি: “কংগ্রেস বিরোধিতা একটি স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক কৌশল ছিল এবং এটিকে আদর্শে পরিণত করা উচিত নয়”। এটি কংগ্রেস নেতৃত্বের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণও ছিল না: “রাহুল গান্ধি আমার দেখা বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে বেশি আন্তরিক এবং সবাই যা ভাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান।” বেশিরভাগ ভাষ্যকার এই বাক্যগুলিতে মনোনিবেশ করেননি।
আমার মূল যুক্তি ছিল সোজাসাপ্টা: “নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির উত্থান গণতন্ত্র এবং বহুত্ববাদী সাংবিধানিক মূল্যবোধের জন্য একটি হুমকি... প্রধান জাতীয় বিরোধী দল হিসেবে, কংগ্রেস তাকে প্রতিরোধের প্রাথমিক দায়িত্ব বহন করে। গত পাঁচ বছরে কংগ্রেস কি এই ঐতিহাসিক দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করেছে? অথবা, অদূর ভবিষ্যতে এই দায়িত্ব পালনে বিশ্বাস করা যেতে পারে? আমার স্পষ্ট উত্তর – ‘না’। কংগ্রেস শুধু এই কাজটি করতে না চেয়েই থেমে থাকেনি, যারা করতে চায় তাদের জন্যও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সুতরাং, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ একটি মৌলিক প্রত্যাশার উপর ভিত্তি করে ছিল, যে ভারতকে বাঁচানোর জন্য তাদের অবশ্যই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এই কারণেই আমি ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রাকে সমর্থন করছি। এই সমর্থন শর্তহীন নয়। ভারত জোড়ো যাত্রাকে সমর্থন করার জন্য ২০০ জনেরও বেশি কর্মী এবং বুদ্ধিজীবী-সহ আমি যে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছি, তা সাংবিধানিক মূল্যবোধের প্রতি অভূতপূর্ব হুমকির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। বিবৃতিটি স্পষ্টভাবে বলে: “’ভারত জোড়ো’ যাত্রার মত একটি উদ্যোগকে এককালীন সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো নেতার সাথে আবদ্ধ করি না। তবে পক্ষপাত দূরে সরিয়ে রেখে সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র রক্ষার জন্য অর্থবহ ও কার্যকরী উদ্যোগ সফল করতে যে কোনো রাজনৈতিক দলের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিই৷”
কিছু কি বদলেছে?
সুতরাং, মৌলিক অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। এখন এবং তখন আমার সূচনাবিন্দু একই। এমন রাজনীতির সন্ধান, যা বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দ্বারা আক্রমণের মুখে সাংবিধানিক মূল্যবোধকে রক্ষা করে। তার জন্য আমি প্রথমে কংগ্রেসের দিকেই তাকাই। কারণ, তখন এবং এখনও জাতীয় স্তরে বৃহত্তম বিরোধী দল এটি।
যদিও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তখন কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা ও পূর্বাভাসের ওপর ভিত্তি করে। আমি তখন কংগ্রেসকে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, প্রকৃতপক্ষে একটি বাধা হিসেবে বিচার করেছিলাম। তারপর কী কী পাল্টাল? কংগ্রেস? নাকি আমি?
আমি কি ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে আমার সমালোচনা পরিবর্তন করেছি? না। সাম্প্রতিক ইতিহাস পড়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো গুরুতর পরিবর্তন নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচন কীভাবে তছনছ হয়েছিল, তা নিয়ে আমার মতামত, হতাশা এবং ক্ষোভ পরিবর্তন করার কোনো কারণ নেই। আমি-সহ যাঁরা বিজেপি-বিরোধী শিবিরে আছি, সবাইকেই তার জন্য দোষী সাব্যস্ত করি। কিন্তু জাতীয় স্তরে বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসকেই দায়ভার নিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং তাকে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করা নিয়ে কোন আফসোস নেই (আগেই লিখেছি যে বিক্ষুব্ধদের সেই দলে চলে যাওয়া আমায় দুঃখ দিয়েছে)।
কংগ্রেস কি শেষ তিন বছরে একটুও বদলেছে? আমাদের প্রজাতন্ত্রের ভিত্তির ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে আমি প্রতিরোধের সম্ভাবনা হিসেবে এখন বিশ্বাস করি?
এই প্রশ্নের সৎ জবাব হবে, “আমি জানি না”। অন্য অনেকের মত, আমিও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছি। শুধুমাত্র কংগ্রেস নেতৃত্ব অথবা যাত্রীদের থেকে নয়। আমি সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তর খুঁজছি। আমি লক্ষ্য করেছি, যে কংগ্রেস নেতারা এবং বিশেষ করে রাহুল গান্ধি ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক সাম্যের বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কথা বলে চলেছেন। লক্ষ্য করেছি, যে কংগ্রেস অন্যান্য রাজনৈতিক দল, গণ-আন্দোলন এবং সংগঠনকে এই যাত্রায় অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। আমি জানি, কেবলমাত্র ভোটবাক্সে নয়, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক এবং আদর্শগতভাবে কংগ্রেস বিজেপিকে প্রতিহত করতে চায়। কিন্তু তারা পারবে কি? এটিই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কংগ্রেস দল তো বটেই, ভারতের জন্যও একটি সওয়াল। এমন প্রশ্নের আত্মবিশ্বাসী উত্তর এখনই দিতে চাইলে খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে।
ভারতে শেষ তিন বছরে কী কী পরিবর্তন হয়েছে? ২০১৯ সালে আমরা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে আমরা যে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে ডুবে গিয়েছি, তার কাছাকাছি আর কিছু নেই। আজ এক পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে, যেখানে আমাদের সংবিধান, স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তরাধিকার এবং সভ্যতার যাবতীয় ঐতিহ্য প্রবল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কেবল সরকার বা গণতন্ত্র নয়, ভারতকে যেভাবে এতদিন জেনেছি, তার টিকে থাকা এখন আক্রমণের মুখে। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ঝগড়া ভুলে গিয়ে একজোট হয়ে আগুন নেভাতে হবে। পল স্যামুয়েলসনকে (কেইনস নয়) অনুসরণ করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, “যখন পরিস্থিতি বদলায়, আমার মূল্যায়ন আমি পরিবর্তন করি। আপনি কী করেন স্যার?”
মৃত্যু না পুনর্জন্ম?
তাহলে পূর্বাভাস কী হতে পারে? আমি কংগ্রেসকে যে কোনো বিকল্প সৃষ্টির বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে অনুমান করা হয়েছিল, বিজেপি বিরোধী কিন্তু অ-কংগ্রেসি পরিসর একটি বিকল্পের সন্ধান দিতে পারে। এই আশা বিগত তিন বছরে পূর্ণতা পায়নি। আসল বিষয়টি হল, আমরা যাঁরা বিকল্প রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, তাঁরা নৈতিক ও টেকসই একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গড়তে ব্যর্থ হয়েছি। কিছু আঞ্চলিক দল বিজেপি-কে প্রতিরোধ করেছে বলিষ্ঠভাবে। কিন্তু তারা জাতীয় স্তরে বিকল্প রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করতে ব্যর্থ। গণ-আন্দোলনগুলি শক্তি এবং সাহস থাকা সত্ত্বেও ভোটের ময়দানে বিজেপি-কে প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ঠ নয়। আগামী দু’বছর কংগ্রেস এবং অন্যান্য মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলিই আমাদের প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার একমাত্র কার্যকর হাতিয়ার। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করব যে আমার অবস্থানের সমালোচনায় অধ্যাপক সুহাস পালশিকর যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর পড়াশোনা ও পর্যবেক্ষণ সব সময়েই দূরদৃষ্টিতে পরিণত হয়।
একটি শেষ বক্তব্য। যাঁরা “কংগ্রেস অবশ্যই মরবে”কথাটি মনে রেখেছেন, তাঁরা ভুলে যেতে পারেন, আমি কীভাবে এই নিবন্ধের উপসংহার লিখছি। “কংগ্রেসের বাইরে এবং ভিতরে নতুন বিকল্পে মিলে যাওয়ার শক্তি” কী হতে পারে, তা আন্দাজ করেছি আমি।
“মৃত্যুর অন্ধকার রূপক একটি নতুন জন্ম সম্পর্কে চিন্তা করার আমন্ত্রণ নাকি পুনর্জন্ম”? ভারত জোড়ো যাত্রাকে পুনর্জন্মের সম্ভাব্য মুহূর্ত হিসেবে কি ভাবা উচিত?