যখন থেকে রাহুল গান্ধি-সহ বিরোধীরা আদানির বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন, তখন থেকে শেয়ার বাজারের ভূমিকম্প দেশের রাজনীতিতে কম্পন সৃষ্টি করছে। প্রধানমন্ত্রী মৌনতা পালন করে আছেন। এমনকি সংসদে দু’জনের নাম একসঙ্গে নেওয়ার পরে দুই কক্ষের স্পিকাররা কার্যক্রম থেকে গৌতম আদানি এবং নরেন্দ্র মোদির নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে অনড় রয়েছেন। সরকার যৌথ সংসদীয় কমিটি দিয়ে তদন্ত করতেও প্রস্তুত নয়। এই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া “চুপ চুপ খাড়ে হো জরুর কোই বাত হ্যায়”-এর ইঙ্গিত দেয়। জনগণ চিন্তায় পড়েছে, এমন কী কথা যা সংসদে বলা যায় না? এতকিছুর পরেও কে, যার নাম নিতে দ্বিধা করছেন প্রধানমন্ত্রী? কিছু তো গণ্ডগোল আছেই।
শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক গোপন নয়। ২০০০ সালে মোদিজি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে আদানির মোট সম্পত্তি ছিল ৩৩০০ কোটি টাকা। ২০১৪ সাল নাগাদ মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় যা পাঁচ গুণ বেড়ে ১৬৭৮০ কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু আসল খেলা শুরু হয় তার পরেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম পাঁচ বছরে গৌতম আদানির মোট সম্পদ পাঁচ গুণ বাড়ে। লকডাউন শুরুর সময় ২০২০ সালের মার্চ মাসে তাঁর সম্পত্তি ছিল ৬৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু যে দুই বছরে দেশের ৯৭% পরিবারের আয় ও সম্পদ কমেছে, সেই একই সময়ে গৌতম আদানির সম্পদ ২০২২ সালের মার্চ মাসের হিসেবের নিরিখে দশ গুণ বেড়ে ৬ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে এবং পরের ৬ মাসে সেটিই এক লাফে বেড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকা হয়।
স্পষ্টতই, এই জাদুকরি সম্পত্তি বৃদ্ধিকে জনগণ আদানি এবং মোদির বন্ধুত্বের সঙ্গে মেলাবেই। রাহুল গান্ধি লোকসভায় মোদিজি এবং আদানির ছবিও দেখান। নিঃসন্দেহে, মোদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর বিমানে গৌতম আদানির বসা দৃঢ় বন্ধুত্বের ইঙ্গিত দেয়। এরপরও টিভিতে বিজেপির মুখপাত্ররা এই যোগসাজশের প্রমাণ চান।
প্রমাণের জন্য বেশিদূর যেতে হবে না। প্রথম প্রমাণ হল, শেয়ারবাজারে আদানি গোষ্ঠীর গোলোযোগে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আদানি গ্রুপ সম্পর্কে আমেরিকান ফার্ম হিন্ডেনবার্গ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে নতুন কিছু ছিল না। স্টক মার্কেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি সম্পূর্ণরূপে সচেতন ছিল যে মরিশাস থেকে কিছু নামহীন তহবিল আদানির সংস্থাগুলোয় প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে। ‘পানামা পেপারস’-এর মাধ্যমে জানা গেছে যে এই তহবিলটি গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানির সঙ্গে যুক্ত। প্রশ্ন হল, এত কিছু জানার পরও কেন সেবি তদন্ত করল না, যেখানে শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলছে এই বিষয়টি? তাদের কি সরকার চুপ থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিল?
আদানি গোষ্ঠীর দুর্বলতা জেনে পাবলিক ফান্ডগুলি আদানি কোম্পানিগুলিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছিল এবং সরকারি ব্যাঙ্কগুলি তাদের অবাধে ঋণ দেয়। গত দশ বছর ধরে আদানির লাভের চেয়ে ঋণ বহুগুণ বেশি। এটা দেখে মিউচুয়াল ফান্ড আদানির স্টক থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু এলআইসি আদানির শেয়ারে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আদানির শেয়ার ডুবে যাওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি কষ্টার্জিত টাকা নষ্ট হয়ে গেছে। স্টেট ব্যাঙ্ক এবং পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক আদানিকে ৩৪,০০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যা এখন অনিশ্চয়তার মুখে। প্রশ্ন হল, দেশের সম্পত্তি নিয়ে খেলার অনুমতি কে দিল?
এমন প্রত্যক্ষ প্রমাণেরও অভাব নেই যেখানে মোদি সরকার এমন নীতি তৈরি করেছিল যা সরাসরি আদানি গোষ্ঠীকে উপকৃত করে। একদিকে আদানি অস্ট্রেলিয়া থেকে ভারতে কয়লা আমদানি শুরু করে, অন্যদিকে সরকার সেই কয়লা আমদানিতে শুল্ক বাতিল করে। আদানি 'গ্রিন হাইড্রোজেন' তৈরির পরিকল্পনা ঘোষণা করার পরপরই, সরকার গ্রিন মিশনের অধীনে এটিকে ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। আদানি শস্য সঞ্চয় করার জন্য সাইলো নির্মাণ শুরু করে। কখন? যখন সরকার মজুত রাখার আইন শিথিল করার জন্য কৃষক বিরোধী আইন সংশোধন করে। সরকারি নিয়ম পরিবর্তন করার ফলে আদানি দেশের বেশিরভাগ বন্দর ও বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থ মন্ত্রক এবং নীতি আয়োগের আপত্তিও উপেক্ষা করা হয়েছিল। এছাড়াও সন্দেহ রয়েছে যে আদানির প্রতিদ্বন্দ্বী জিভিকে-র কাছে আয়কর এবং ইডি অভিযানের হুমকি দিয়ে মুম্বাই বিমানবন্দর আদানির হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
এই অংশীদারিত্ব শুধুমাত্র ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী মোদি বিদেশের যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই আদানি গোষ্ঠী বড় চুক্তি পেয়েছে। আদানি গ্রুপ অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় তাদের ডানা বিস্তার করেছে। শ্রীলঙ্কায় এটি প্রকাশ্যে আসে যখন শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ বোর্ডের চেয়ারম্যান সংসদের সামনে স্বীকার করেন যে তাঁকে রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষ বলেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন আদানি গোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ চুক্তি দেওয়ার জন্য। রাজনীতি ও ব্যবসার মিলনের আর কত প্রমাণ দরকার?
এরকম জোট ভারতে নতুন নয়। কিন্তু আদানি ও মোদিজির মধ্যে এই সম্পর্ক নজিরবিহীন। আমার বন্ধু ও কৃষক নেতা ডঃ সুনীলম এটাকে উন্নয়নের ‘মোদানি’ মডেল বলেছেন, অর্থাৎ মোদি + আদানির জোট মডেল। মোদিজি আদানির জন্য কী করেছিলেন আমরা তার আভাস পেয়েছি, তবে আদানি মোদিজির জন্য কী করেছিলেন তা আমরা কেবল কল্পনা করতে পারি। বিজেপির সাফল্যের পিছনে কি আদানির আশীর্বাদ? বর্তমানে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, গত কয়েকদিনের সংকট শুধু আদানির সংকট নয়। রাজনীতিবিদ ও ধনকুবেরদের জোটের নতুন মডেল মোদানির তৈরি সংকট। এটা শুধু শেয়ারবাজারের সংকট নয়। বরং এটি সেই প্রজাতন্ত্রের সংকট যার শেয়ার হোল্ডার ভারতের জনগণ।