কংগ্রেসের ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা গভীর অর্থে রাজনৈতিক। এটি জোট তৈরি বা সামাজিক প্রকৌশল নয়।
‘আপনি শুধু রাজনীতি দিয়ে বিজেপি-আরএসএসকে হারাতে পারবেন না। রাজনীতির সঙ্গে আদর্শও থাকতে হবে। জনগণের আন্দোলন ভারত জোড়ো অভিযানের কর্মীদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রাহুল গান্ধী এমনটাই বলেছিলেন। রাহুল সেই বৈঠকেই কর্মীদের ভারত জোড়া ন্যায় যাত্রায় যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যা ১৪ জানুয়ারি মণিপুর থেকে শুরু হয়েছিল।
এই যাত্রা সম্পর্কে তৈরি হওয়া প্রশ্নের যেমন: কেন সরাসরি নির্বাচনী প্রচার করার পরিবর্তে যাত্রায় যাবেন? সবাই যখন রামমন্দিরের কথা বলছে তখন কেন ন্যায়ের কথা বলবেন? কেন উত্তর-পূর্বে এত সময় ব্যয় করা, যেখানে এত কম সংসদীয় আসন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে? এর সহজ উত্তর হল: যে আদর্শ বোধ বিজেপির রাজনৈতিক আখ্যানের টুটি চেপে ধরে বসে আছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে তাকে না হারিয়ে আপনি ভারতীয় জনতা পার্টিকে পরাজিত করতে পারবেন না। ন্যায় যাত্রার লক্ষ্যই হল তা অর্জন করা।
রাজনীতির বাইরে
রাহুল গান্ধীর এই বিবৃতি আরও বিতর্কিত প্রশ্নের জন্ম দেয়: এই যাত্রা কি রাজনৈতিক? খুব গভীর অর্থে না হলেও এটা রাজনৈতিক কৌশল, জোট তৈরি বা সামাজিক প্রকৌশল সম্পর্কিত নয়। যাইহোক, 'রাজনীতি করা' মানেই কেবল তথাকথিত রাজনীতি নয়। গভীর অর্থে, রাজনীতি হল ক্ষমতার স্থির সমীকরণ পরিবর্তন করা এবং স্বাভাবিকভাবে কাম্য এবং করণীয় বলে বিবেচিত প্রচলিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা। ভাল হোক বা মন্দ, আমাদের সামনে থাকা ধারনাগুলোকে নিয়ে দৈনন্দিন সংকীর্ণ রাজনীতির খেলা হয়। স্বাভাবিক ভাবে, রাজনৈতিক খেলোয়াড়রা এই ধারনাগুলোকে গ্রহণ করে নিয়েই খেলা জেতার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন আপনি একদম শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যান, যখন আপনার রাজনীতি নিয়মিতভাবে ব্যর্থ হয়, ঠিক তখনই এর মৌলিক পরিবর্তনের সময়। এই রকম গভীর অর্থে, ন্যায় যাত্রা রাজনৈতিক, যেমনটা যে কোনও উদ্যোগ ই হওয়া উচিত।
নিঃসন্দেহে যাত্রার সময় নিয়ে দু’রকম মত থাকতে পারে। সঙ্গত কারণে অনেকেই বলছেন, এটা আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। তাহলেই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য বার্তাটি সময় মতো ছড়িয়ে দেওয়া যেত। আবার কেউ বলছেন, বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের আগেই এই যাত্রার ঘোষণা করা উচিত ছিল। সেটা হলে নির্বাচনী বিপর্যয়ের ফলাফলের কারণেই এই যাত্রা বলে যে পরিহারযোগ্য ধারণা আছে, সেটা দূর করে দিত। যাত্রা পথ এবং এবং যাত্রার ধরন নিয়ে, আপনি যেমনটা শুনতে চাইবেন তেমনই প্রচুর শুনতে পাবেন।
এছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে। (রাহুল গান্ধীর তরফ থেকে প্রথম থেকেই অস্বীকার করা সত্ত্বেও), বিজেপির পরিকল্পনা মাফিক, এই যাত্রা রাহুল গান্ধীর যাত্রা হিসাবে উপস্থাপন করে, আসন্ন নির্বাচনকে রাষ্ট্রপতি -সুলভ ব্যক্তিত্বের প্রতিযোগিতায় পরিণত করলে, তা কি ক্ষমতাসীন দলের সুবিধার জন্য কাজ করতে পারে? মোদী বনাম মুদ্দা অবস্থানে বিরোধীরা স্পষ্টতই লাভবান হবে। কিন্তু বর্তমান যাত্রা কি সেই সুবিধা দেবে? এছাড়াও, এখন যখন ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছে, এই পর্যায়ে শুধুমাত্র কংগ্রেসের যাত্রাই কি শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হবে? একটি সম্মিলিত যাত্রা কি আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে না এবং আত্মবিশ্বাস জাগাবে না? ইন্ডিয়ার শরিকদের যুক্ত করার জন্য কংগ্রেসের কি আরও বেশি চেষ্টা করা উচিত নয়?
এই সবই বৈধ প্রশ্ন। রাজনীতির অনিশ্চয়তার জগতে, এমন কোনও কর্মপরিকল্পনা রচনা করে বলে দেওয়া যায়না, যে এটাই এইসব বৈধ প্রশ্নের নিখুঁত ও অব্যর্থ উত্তর। সঠিক উত্তর হিসেবে কি উঠে আসে এবং যাত্রার কৌশল এবং তার মূল্যায়ন করার জন্য আমাদের অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
এই পর্যায়ে, আমরা এই যাত্রার মৌলিক যুক্তি মূল্যায়ন করতে পারি মাত্র। সেটা ঠিক কেমন তা এখানে আলোচনা করা হল।
বিজেপির উত্থান, এবং এর অব্যাহত নির্বাচনী আধিপত্য, তাদের সাংস্কৃতিক-মতাদর্শের আধিপত্যের স্বরূপ। নিঃসন্দেহে, এদের সাংগঠনিক শক্তি, আর্থশক্তি, রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার, মিডিয়ার ওপর অদৃশ্য একচেটিয়া আধিপত্য, এবং সযত্নে তৈরি করা নরেন্দ্র মোদীর আরাধ্য ভাবমূর্তি নির্বাচনী সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয়। তবুও, বিজেপি আজ যে সাফল্য উপভোগ করছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য শুধুমাত্র এই কারণগুলিই যথেষ্ট নয়। শেষ কথা এই, যে বিজেপি সংযোগ স্থাপনের যুদ্ধে জিতেছে। এবং তার আদর্শগত বিষয়টা সঠিক বলে সফলভাবে চালিত করতে পেরেছে। এক দশক আগে যা আপত্তিকর বলে মনে হত তা এখন খুব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত চলে আসা মধ্যপন্থী অবস্থানকে এখন চরম চরমপন্থা বলে দেগে দেওয়া যেতে পারে। পাহাড়-প্রমাণ অনৈতিক শাসন, নির্লজ্জ কাজের নজীর থাকা সত্ত্বেও, তাই বিজেপি তাদের এজেন্ডা প্রতিষ্ঠিত করতে ও নির্বাচনে জিততে সক্ষম হয়।
মতাদর্শের যুদ্ধ
যদি একদম ভুল না হয়, তবে একথা বলাই চলে যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিও যদি করা হয়, তাহলেও শুধুমাত্র তাই দিয়ে বিজেপিকে পরাজিত করা যাবে না। ভাল সাংগঠনিক ক্ষমতা, বুদ্ধিদীপ্ত জোট, আকর্ষণীয় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, সম্ভাব্য সেরা প্রার্থী বাছাই এবং জোরালো প্রচার বিরোধীদের ভোট এবং আসন বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, কিছু কিছু নির্বাচন জেতাতেও পারে। কিন্তু, শুধুমাত্র এগুলো দিয়েই বিজেপির আধিপত্যকে খতম করা যাবেনা। মতাদর্শের যুদ্ধে বিরোধীদের জয়লাভ করতে হবে এবং নতুন প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে নতুন ভাষায় সাংবিধানিক আদর্শগুলিকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের নিজেদের জাতীয়তাবাদের উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে যে তারাই আমাদের সভ্যতার সেরা উত্তরাধিকারী। যারা আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চায় তাদের অবশ্যই মতাদর্শগত ধারণাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
এখানে, 'মতাদর্শ' বলতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন মতবাদ থেকে সাধারণভাবে নেওয়া কিছু মতবাদের প্যাকেজ বোঝায় না। আমাদের সংবিধান উদারবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এমনকি গান্ধীবাদ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এগুলির বিংশ শতাব্দীর কোন সংস্করণে আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই বা সংবিধান প্রণেতাদের দ্বারা ব্যবহৃত এগুলির কোন মিশ্রণ আমাদের গ্রহণ করার দরকার নেই। এই মতাদর্শগত কাঠামোর বেশিরভাগই পুরনো, যদিও সেগুলোর মধ্যে গভীর মূল্যবান অনেক কিছু রয়েছে। একবিংশ শতকের বাস্তবতা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী এবং প্রেক্ষাপটের উপযোগী একটি আদর্শগত পরিকাঠামো নিয়ে আসার দাবি রাখে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ। এক সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, আমাদের এই মুহূর্তের আদর্শগত যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে।
ভারত জোড় ন্যায় যাত্রা সেটাই করতে চায়। ন্যায় নিজে কোনও ‘বাদ’ নয় কিন্তু সংবিধানের ছত্রছায়ায় থাকা উপযুক্ত ধারণা। যা বিভিন্ন পাল্টা-আধিপত্যবাদী সংগ্রামকে খণ্ডন করে। সমস্ত আন্দোলনের দাবিগুলিকে প্রকাশ করার জন্য একই অভিব্যক্তি ব্যবহৃত হয় না, তবে তারা যা চায় তার বেশিরভাগই, প্রতিফলিত শিরোনামের মাধ্যমে বোঝা যায়। ন্যায়কে শুধু জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। এই নতুন সংস্করণে, ন্যায় বলতে বোঝায়, পিরামিডের নীচে থাকা মানুষের এক নতুন সামাজিক জোটের, আদর্শগত সঙ্গবদ্ধতা। সবই নির্ভর করছে কীভাবে এই যাত্রা তার এই বিমূর্ত ধারণাটিকে প্রান্তিক মানুষ যেমন- দরিদ্র, নারী, কৃষক, শ্রমিক, দলিত, আদিবাসী এবং ওবিসিদের মনে পোক্ত প্রতিশ্রুতি এবং নিশ্চয়তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
এই যাত্রা কতটা সফল হবে আমরা এখনও জানি না। মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডে ব্যতিক্রমী ইতিবাচক অভ্যর্থনা ইতিমধ্যেই উত্তর-পূর্বের সমস্যা-বিধ্বস্ত রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের যাত্রা শুরু করার সাহসী এবং ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তকে প্রমাণ করেছে। কিন্তু এই সীমিত এবং অনন্য অভিজ্ঞতাকে খুব তাড়াতাড়ি বিবেচনার মধ্যে নিয়ে নেওয়া ঠিক নয়। আসল পরীক্ষা এখন শুরু, কারণ যাত্রা বিজেপি শাসিত আসামে প্রবেশ করছে। আমরা জানি না বিজেপির নির্বাচনী আধিপত্যের মূল কেন্দ্র হিন্দি হার্টল্যান্ডে এই যাত্রা কেমন হবে। এবং আমরা অনুমান করতে পারি না যে ইন্ডিয়া জোটের অংশীদাররা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
কিন্তু আমরা জানি যে এই আদর্শগত লড়াই অনেক আগেই শুরু করা উচিত ছিল। আমরা জানি বিভিন্ন আন্দোলন, সংগঠন ও নাগরিকরা এর জন্য অপেক্ষা করেছে। আমরা জানি যে মিথ্যা ও ঘৃণার রাজনীতি গ্রহণ করার জন্য সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবিরা কেউই বসে নেই। কংগ্রেস এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী প্রথম মূলধারার দল হতে পারে, কিন্তু আমরা জানি যে আরও অনেকে ভারতের আত্মাকে বাঁচাতে এই যুদ্ধে এসে যোগ দেবে।
সেই কারণেই আমি আমার ভারত জোড়ো অভিযানের সহকর্মীদের সঙ্গে এই যাত্রায় আছি। আর তাই আপনারও সেখানে থাকা উচিত।