“ভারতের স্বধর্মের ওপর বিধর্মী হামলা বন্ধ করার একটি প্রয়াস হিসেবেও আমরা ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’কে চিহ্নিত করতে পারি।”
স্পষ্টতই, শুরুর এই বাক্যটি অধিকাংশ মানুষের কৌতূহল মেটায় না। বরং উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন বেশি আসতে থাকে।
ভারতের স্বধর্ম কী? ব্যক্তি বা বর্ণের স্বধর্মের কথা আপনি শুনেছেন। কিন্তু দেশেরও কি স্বধর্ম থাকতে পারে? স্বধর্মের মতো একটি শব্দ শুনলে কিছু লোক আতঙ্কিত হয় যে এটি একটি জাতীয় ধর্মের মতো কিছু। কিছু দেশে ইসলাম বা খ্রিস্টধর্ম সরকারিভাবে স্বীকৃত। তার আদলে কিছু মানুষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইছেন। তাহলে ভারতের স্বধর্মের ভাবনা কি কোথাও এই বিষয়টিতেই ইঙ্গিত করছে? যাই হোক, এখন প্রশ্ন, ভারতের স্বধর্ম কোথায় পাব? এটা কে ব্যাখ্যা করবে? আসুন ভগবদ্গীতা দিয়ে শুরু করি। ধর্মের ধারণাটি এই গ্রন্থ থেকে শুরু হওয়ার কারণে নয়। বরং ভগবদ্গীতা বৈদিক ঐতিহ্য এবং বৌদ্ধ প্রতিস্পর্ধার মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে দেশীয় সভ্যতার কিছু মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
গীতার এক প্রসিদ্ধ শ্লোক: “শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ / স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ” (ভগবদ্গীতা ৩. ৩৫)। অর্থাৎ, অন্য সৎকর্মশীলের ধর্মের চেয়ে নিজের ধর্মই সর্বোত্তম। যদি সদগুণের অভাব থাকে, তাহলেও। নিজের ধর্মে মরে যাওয়াও কল্যাণকর। অন্যের ধর্ম গ্রহণ করলে ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে। স্পষ্টতই, এখানে ধর্ম মানে মজহব বা রিলিজিয়ন নয়। এটি হিন্দু, ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্ম বোঝাচ্ছে না। এগুলোকে সম্প্রদায় বলা উচিত। এখানে ধর্ম হল সেই বিষয়, যা ধারণ করার যোগ্য। যা নৈতিক।
একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট করা দরকার যে, ধর্মের এই ব্যাখ্যা ব্রাহ্মণ্যবাদী নয়। অবশ্য, ভগবদ্গীতায় বলা স্বধর্মের কথা ব্যবহার করে বর্ণবাদী গোঁড়ামিকে শক্তিশালী করতে দেখা যায়। কিন্তু প্রথম থেকেই ধর্মের ব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা ও সাধকদের ব্যাখ্যার দুটি ধারা একসঙ্গে চলে। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যেকোন একটি জাতি, সম্প্রদায় বা পরিস্থিতির সাথে যুক্ত। কিন্তু সাধকদের ঐতিহ্য ধর্মকে একটি সাধারণ নৈতিক আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অশোকের শিলালিপির ‘ধম্ম’ এই ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। ভারতের স্বধর্মের ব্যাখ্যাকে আমাদের সভ্যতার এই মহৎ স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
‘স্বধর্ম’ হল দুটি উপাদানের সঙ্গম: ‘স্ব’ এবং ‘ধর্ম’। ‘স্বার্থ’-র মধ্যে ‘স্ব’ আছে কিন্তু ‘ধর্ম’ নেই। অন্যদিকে ‘সর্বধর্ম’-তে ‘ধর্ম’ আছে, কিন্তু ‘স্ব’ নেই। স্বধর্মের একটি উপাদান ধারককে নির্দেশ করে এবং অন্যটি অধিকারীর দিক নির্দেশ করে। স্বধর্ম কেবল একটি স্বভাব নয়, সাধারণ প্রবৃত্তি নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রবণতা নয়। স্বভাব ভালো হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। সাধারণ প্রবৃত্তি প্রায়ই পতনের দিকে নিয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনোভাব নিপীড়নমূলক এবং অন্যায় হতে পারে। কিন্তু স্বধর্ম কখনোই অন্যায় হতে পারে না। স্বধর্ম কোনো চিরন্তন নৈতিক মূল্যবোধ নয়। কারণ কিছু শাশ্বত মূল্যবোধ স্ব-এর সঙ্গে সম্পর্কিত নাও হতে পারে।
স্বধর্মের ধারণা বুঝতে হলে পরধর্ম, অধর্ম ও বিধর্মের অর্থ বুঝতে হবে। অন্যায় বুঝতে অসুবিধা হয় না। অধর্ম সেটা, যা ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ধর্ম যদি পুণ্য উৎপাদন করে, তবে ধর্ম থেকে পলায়ন বা পতনের ফলে যে অপকর্মের উদ্ভব হয় তার মূলে রয়েছে অধর্ম। অনেক সময় অন্যায় কাজ ভন্ডামিতে রূপ নেয়। অধর্ম কিন্তু ধর্মকে প্রশ্ন করে না। মুখে ধর্মকে সম্মান করে কিন্তু বাস্তবে অবজ্ঞা করে। এটি সমস্ত মানব সমাজের সাধারণ প্রবণতা। যেমন সকালে মন্দিরে যাওয়ার পর সারাদিন পাপ কাজ করা। কিংবা অহিংসার বাণী শুনিয়ে তারপর কথায় ও কাজে হিংসার প্রয়োগ করে যাওয়া। এমন উদাহরণ প্রচুর দেখা যায়।
এই ধরনের অন্যায়কে এড়িয়ে যাওয়া এবং বর্জন করা আমাদের কর্তব্য। পরধর্ম এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পরধর্ম মানে অন্যের ধর্ম। এটিও ধারণ করে। কিন্তু সময়, স্থান, পরিস্থিতির জন্য সঠিক নয়। এটি ধর্মের রূপ নিয়ে থাকে, তাই লোভনীয়। কিন্তু বিচ্যুতি আনে, তাই ভীতিকর। প্রায়শই অন্যের স্বধর্মের অনুকরণ বা দাসত্ব অতি-ধর্মের আকর্ষণ সৃষ্টি করে। অন্যের বানানো পথে চলার নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তার মিথ্যা মোহ আমাদেরকে পরধর্মের দিকে টানে। আধুনিকতার নামে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পশ্চিমি ভাষা, পোশাক, খাবার ও ব্যবহারের অনুকরণ কিংবা ইউরোপের মতাদর্শ ও প্রতিশ্রুতিকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার প্রবণতা পরধর্মের প্রতি আকর্ষণের নমুনা। ভগবদ্গীতা আমাদের সতর্ক করে যে পরধর্মকে সম্মান করার সময় এটি এড়িয়ে চলাই ভালো।
বিধর্মের বিপদ অধর্ম বা পরধর্ম থেকে আলাদা। যা ধর্মের বিরোধিতা করে তাকেই বিধর্ম বলে। বিধর্ম শুধুমাত্র ধর্মের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মকে খণ্ডন করতে যায়। এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক বিচ্যুতি। কারণ স্বধর্মকে একটি ধর্ম হিসাবে বিবেচনা করে না এবং ক্রমাগত ভাঙার চেষ্টা করে। বৈদিক পরম্পরা যখন জৈন এবং বৌদ্ধ ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, সেটা ছিল বিধর্মের আক্রমণ। বিধর্ম প্রতিরোধ করা অপরিহার্য।
ধর্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিনোবা ভাবে বলেছিলেন: “স্বধর্মের প্রতি ভালবাসা, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অধর্মের প্রতি উপেক্ষা মিলে ধর্ম গড়ে ওঠে”। এটির পরিবর্ধন করে বলা যেতে পারে, ধর্ম পালনের অর্থ হল স্বধর্মের প্রতি ভালবাসা, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, অধর্মের প্রতি উপেক্ষা এবং বিধর্মকে প্রতিরোধ। কিন্তু একটি দেশের স্বধর্ম থাকতে পারে কি? আমরা কীভাবে বলতে পারি যে ভারতে আজ যা ঘটছে তা আমাদের দেশের স্বধর্মের উপর আক্রমণ? পরের পর্বে এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন।