বেশ কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু পোস্ট অফিসে পোস্টকার্ড নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কাছে কোনও পোস্টকার্ড ছিল না। অন্তর্দেশীয় চিঠিও স্টকে ছিল না। তাদের হাত-পা বাঁধা, “স্যার এখন তো সমস্ত কাজ ক্যুরিয়ার কোম্পানির”। এ বড় করুণ সত্য। ডাক অফিস আজ জীবন্ত ইতিহাসের টুকরো ছাড়া আর কিছুই না। যেমন সরকারের বিএসএনএল প্রায় বন্ধের মুখে। যেমন সরকারি স্কুল আর সরকারি হাসপাতাল এখন দুঃস্থ পরিবারগুলোকে পড়াচ্ছে আর ওষুধের ভাঁওতাবাজি দিয়ে বেড়াচ্ছে। যদি সরকারের মর্জি চলে, তাহলে এই একই অবস্থা এবারে দেশের বিদ্যুৎ প্রদান ব্যবস্থার সাথেও হতে চলেছে। গত সোমবার, সরকার প্রতারণা করে যে বিদ্যুৎ সংশোধন আইন ২০২২ সংসদে পেশ করেছে, সেটা যদি পাস হয়ে যায়, তাহলে কৃষক এবং দুঃস্থদের মাথায় বাজ পড়বে। এই আইন যদি তৈরি হয়, তবে বিদ্যুৎও বাজারি হয়ে যাবে। যেখানে টাকা আছে, সেই জায়গা হবে ঝকঝকে-ঝিকমিকে-চকচকে। আর যেখানে কানাকড়িও নেই, সে জায়গা চির-আঁধার।
এই বিষয়টাকে চুপচাপ লোকসভায় তুলে ধরা – স্পষ্ট প্রতারণা ছাড়া আর কিচ্ছু না। তেরো মাসের টানা কৃষক আন্দোলনের আরো নানান দাবির মধ্যে বিদ্যুৎ প্রদানের এই দাবি ছিল অন্যতম। কৃষকদের সেই আন্দোলন দমন করার অভিপ্রায়ে ৯ ডিসেম্বর ২০২১-এ কেন্দ্রীয় সরকার সংযুক্ত কিষাণ মোর্চাকে লেখেন, “বিদ্যুৎ বিলের কুপ্রভাব কৃষকের উপর পড়বে না। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার সাথে আলোচনার পরেই বিদ্যুৎ বিল সংসদে উপস্থাপন করা হবে।” কিন্তু, গত ন’মাসে কৃষকের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। এই বিষয়ের বড় স্টেকহোল্ডার, বিদ্যুৎ কর্মচারী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় সমন্বয় কমিটি (NCCOEEE)-র সাথে সরকার কিছু আলোচনায় বসেন। কিন্তু এটা বলার পরেও, সংসদে এই বিলকে পেশ করা হল। তবে একটাই বাঁচোয়া, বিলটা হাতে-হাতে পাশ না করে সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে।
“বিদ্যুৎ (সংশোধনী) আইন ২০২২” নামক এই বিলের আসল কাজ হল বিদ্যুৎ বিতরণকে প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তাদের মনমাফিক শর্তের ভিত্তিতে তুলে দেওয়া। বিদ্যুৎ ব্যবসার মোট তিনটে অঙ্গ আছে: কয়লা, জল বা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন (জেনরেশন), হাইটেনশন টাওয়ার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ (ট্রান্সমিশন) এবং স্থানীয় বা আঞ্চলিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ (ডিস্ট্রিবিউশন)। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ২০০৩ সাল থেকেই প্রাইভেট কোম্পানি অনুমতি পেয়েছে। এখনো পর্যন্ত অর্ধেক উৎপাদন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এদিকে সাধারণ মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর একটুও আগ্রহ নেই।
অনেক বছর ধরেই বহু কোম্পানি বিদ্যুৎ বিতরণের ব্যবসায় নজরদারি করছে। ঝোপ বুঝে কোপ মারবে। কিন্তু, তাদের পথে নানান সমস্যা দানা বেঁধেছে। বিদ্যুৎ রাজ্য সরকারের অধীনে রয়েছে। জনগণের চাপে পড়ে রাজ্য সরকার হত-দরিদ্র মানুষকে, গ্রামকে ও কৃষককে সস্তায় বিদ্যুৎ দিতে বাধ্য হয়। রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ বোর্ড, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেটা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া – এই পুরো ঘটনাগুলো রাজ্য সরকারের নির্দেশে ঘটে। গ্রাম হোক শহর, গরিব হোক বা কোটিপতি, কৃষক হোক বা সরকারি চাকরিজীবী মানুষ – সকলকে সমানভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সরকারের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর চাই বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্ঝঞ্ঝাট ব্যবসা। প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ বিতরণে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর প্রবেশের পথ পরিষ্কার করছে। এবারে সরকারি বিদ্যুৎ বোর্ডের জন্য এটা বাধ্যতামূলক করতে হবে – যে দামে আপনার ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়, সরকার প্রাইভেট কোম্পানিকে সেই একই দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। কোম্পানিগুলোকে বিদ্যুৎ বিতরণের অনুমতিও দেওয়া হল আবার হত-দরিদ্র মানুষ, কৃষক আর গ্রামের সাধারণ মানুষকে সস্তায় প্রদানের হাত থেকে মুক্তিও পাওয়া গেল। রাজ্য সরকারের ওপর শর্ত চাপাবে, যদি সস্তা বিদ্যুৎ দিতে চায়, তার জন্য আলাদা ফান্ড তৈরি করে গ্যারান্টি দিতে হবে। রাজ্য সরকার যাতে জনগণের চাপের মুখে না পড়ে, তাই নিয়ম তৈরি করার কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের করতে হবে।
এই আইনের পক্ষে সরকার যুক্তি খাড়া করছে যে সরকারি বিদ্যুৎ বোর্ড আর কোম্পানিগুলিতে এখন ভারি মন্দা চলছে। রাজ্য সরকারের পক্ষে এই বোঝা বহন করা আর সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎ বিতরণে চুরি কোনোভাবে আটকানো যাচ্ছে না। বাড়িতে বাড়িতে সস্তার বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরকারের অর্থের ক্ষতি হয় বেশ অনেকখানি। প্রাইভেট কোম্পানির গ্রাহকরা একের বেশি বিকল্প পাবেন। গ্রাহক নিজের পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারেন।
কিন্তু বাস্তব এক ভিন্ন ছবি তুলে ধরছে। এটাই সত্য, যে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর সমগ্র জনগণকে বিদ্যুৎ দেওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। তারা শহরের লগ্নিপতি বা দেশের কোটিপতিদেরই বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। যার পকেট গরম, তার ঘরে আলোর রোশনাই অনেক সস্তা হয়ে যাবে। সাধারণ জনগণকে পাওয়ার সাপ্লাই করার দায় সরকারি বিদ্যুৎ বোর্ডের ঘাড়ে গিয়ে উঠবে। এবারে সরকার তো আর বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারবে না। সেইজন্য গ্রামে এবং খুব ধনবান নয় – এমন কলোনিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ আগের থেকে আরো খারাপ হয়ে যাবে। না বিদ্যুতের থাম আর মিটার ঠিক সময়ে লাগানো হবে, না ট্রান্সফারমার ঠিক সময়ে পাল্টানো হবে। অনেক রাজ্যেই কৃষকদের সস্তায় বা বিনামূল্যে বিদ্যুৎ প্রদানের প্রকল্প বন্ধ হতে পারে। আদানির মত ব্যবসায়ীদেরই কেবল সুবিধা হবে।
আমাদের দেশের বিদ্যুৎ বিতরণের প্রক্রিয়া প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা ওড়িশায় টিকতে পারেনি। এটা যে একটা ভুল প্রচেষ্টা, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা খুব সত্যি, যে বিদ্যুৎ আজ সকলের সবথেকে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর একটা হয়ে উঠলেও এখনো অনেক মানুষেরই বিদ্যুৎ সংযোগ রাখার সামর্থ্য নেই। চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকা দাম আর বেকারত্ব গোটা দেশের সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা দুষ্কর করে তুলেছে। এককালে বিদ্যুৎ বিতরণ প্রক্রিয়া যেন তেন প্রকারেণ প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিতে চাওয়া মানুষরাও এখন এমন নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখে আজকাল। কিন্তু মনে হয় আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এই ঘটনা থেকেও কিছু শেখার চেষ্টা করে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া রাজ্য সরকারের কাজ। এবারে বিদ্যুৎ খাতে খরচা যদি রাজ্য সরকার করতে চায়, তবে তার নিয়মকানুন কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে দেবে – এটা মোটেই কোনো উচিত কথা নয়। ঠিক এই কারণেই তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীরা এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। আগামী দিনে এই বিলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্বর আরো চড়াও হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করব রাজ্য সরকার নিজের কাঁধে সমস্ত বিদ্যুৎ বিতরণের দায় না নিয়ে সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে যথাসম্ভব সাহায্য করবে, পাশাপাশি বিদ্যুৎ চুরি যাওয়া রোধ করার দায়িত্ব পালন করবে।