সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য নতুন অগ্নিপথ প্রকল্পটি বিভিন্নভাবে পর্যালোচনা করা হলেও এখনও কৃষকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়নি। এই প্রকল্পটি কৃষকদের এবং বিশেষত কৃষক আন্দোলনে যোগদানকারী কৃষকদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার একটি কৌশল হতে পারে।
এটা বোঝার জন্য, আগে এই তথ্যগুলি বিবেচনা করুন।
১ম তথ্য: সেনাবাহিনীর চাকরি সেই কয়েকটি সরকারি চাকরির মধ্যে একটি যা এখনও শহুরে ব্যক্তি এবং শহুরে সমাজের লোকেদের দখলে নেই। ভারত সরকারের রিপোর্ট দেখায় যে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত সৈন্যদের ৭৮% গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামের এই সেনার বেশির ভাগই কৃষক পরিবারের সন্তান। শহর থেকে আসা বেশিরভাগ সেনারও গ্রামীণ ও কৃষক পরিবারের শেকড় আছে।
২য় তথ্য: সরকারি পরিসংখ্যান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে কৃষক পরিবারগুলি তাদের জীবিকার জন্য শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে চালাতে পারে না। সরকারের সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে কৃষক পরিবারের আয়ের এক-তৃতীয়াংশ আসে মজুরি ও চাকরি থেকে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ ইত্যাদি চাকরি এই আয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
৩য় তথ্য: কৃষক আন্দোলনের কাছে মোদী সরকারকে মাথা নত করতে বাধ্য হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সৈন্যদের অসন্তোষ। সরকার জানত যে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পূর্ব রাজস্থান এবং পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মতো এলাকা থেকে সেনাবাহিনীতে বেশিরভাগ নিয়োগ করা হয় এবং তাদের কৃষক আন্দোলনের প্রতি গভীর সহানুভূতি রয়েছে। আন্দোলন দমন করলে সেনাবাহিনীর মনোবলের ওপর প্রভাব পড়তে পারত।
৪র্থ তথ্য: এটা কারো কাছে গোপন নয় যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃষক আন্দোলনে তার পরাজয় কোনোভাবেই হজম করতে পারেননি। জাতির উদ্দেশে বার্তা দেওয়ার সময় তাঁর অঙ্গভঙ্গি এবং তারপর থেকে তাঁর ভাষা আর কাজ থেকে স্পষ্ট যে তিনি কৃষক আন্দোলনের সাথে হিসাব মেটাতে চান।
এই তথ্যগুলির ভিত্তিতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের অগ্নিপথ প্রকল্পকে মূল্যায়ন করা উচিত। স্পষ্টতই, এই প্রকল্পটি কৃষক পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। সৈনিক হওয়ার অর্থ হল ১৫ থেকে ২০ বছরের চাকরি, তারপর আজীবন পেনশন এবং সম্মান। অগ্নিপথ প্রকল্প নিমিষেই এই রোজগার ও সম্মানের দফারফা করবে। “ওয়ান র্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন” স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী মোদি এখন “নো র্যাঙ্ক নো পেনশন” প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। অগ্নিবীররা চার বছর কেবলমাত্র বেতনের টাকাটা পাবেন। কোনো ভাতা, কোনো ক্যান্টিন বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই এবং চার বছর পর যে টাকা সে পাবে তার অর্ধেক তার নিজের বেতন থেকেই কেটে নেওয়া। না কোনো গ্র্যাচুইটি, না কোনো পেনশন। আগে পরিবারে কোনো একজন সৈনিক হলে পুরো পরিবারের হাল বদলাত; এখন চার বছর চাকরির পর সেই অগ্নিবীরের দেখভাল করতে হবে পরিবারকে।
এই প্রকল্পের আরও গভীর প্রভাব হল সেনাবাহিনীতে নিয়োগ কমবে। বর্তমানে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোট সংখ্যা (সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী মিলিয়ে) ১৪ লাখের কাছাকাছি। এই সংখ্যা বজায় রাখতে প্রতি বছর ৬৫ থেকে ৮০ হাজার স্থায়ী সৈন্যের নিয়োগ প্রয়োজন। অগ্নিপথ প্রকল্পে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার অগ্নিবীর নিয়োগ করা হবে এবং কিন্তু মাত্র ৪ বছরের জন্য। এরপর তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে বারো হাজারকে সেনাবাহিনীতে স্থায়ী চাকরি দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী, আজ থেকে ১৫ বছর পরে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোট সংখ্যা ৪ থেকে ৫ লক্ষের মধ্যে নেমে আসবে। প্রতি বছর ৫০ হাজারের পরিবর্তে ১ লাখ অগ্নিবীর নিয়োগ করা হলেও ১৫ বছর পর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রায় ৭ লাখ লোক অবশিষ্ট থাকবে। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সংখ্যা অর্ধেক হবে। এতে দেশের নিরাপত্তার ওপর যে প্রভাব পড়বে তা সবারই জানা, পাশাপাশি কৃষক পরিবারে বেকারত্বও শেষ সীমায় পৌঁছবে।
সেনা নিয়োগ হ্রাসের সবচেয়ে গভীর প্রভাব সেই অঞ্চলগুলিতে পড়বে যেগুলি কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল। অগ্নিপথ প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল যে এখন থেকে সমস্ত নিয়োগ ‘সর্বভারতীয়, সর্বশ্রেণীর’ ভিত্তিতে হবে৷ এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ রেজিমেন্টের একটি স্বতন্ত্র সামাজিক চরিত্র ছিল। প্রত্যেক রেজিমেন্টে যে নামে, সেই এলাকা বা বর্ণ থেকেই শুধু নিয়োগ করা উচিত নয়। অর্থাৎ জাট রেজিমেন্টে শুধু জাট সৈন্যদেরই থাকতে হবে এমন নয় বা মহার রেজিমেন্টে শুধু মহারদেরই থাকতে হবে, তাও না। তবে প্রতিটি রেজিমেন্টের এলাকা এবং সম্প্রদায়ের কোটা রয়েছে। সরকারের নতুন ঘোষণার মানে হবে এখন প্রতিটি রেজিমেন্টে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে লোক নেওয়া হবে এবং কোন কোটা থাকবে না। ধীরে ধীরে, প্রতিটি এলাকা এবং সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। এই নীতি সেই সমস্ত অঞ্চল এবং সম্প্রদায়ের উপর সবচেয়ে গভীর প্রভাব ফেলবে যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন।
সংসদে প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭.৯% সৈন্য পাঞ্জাবের বাসিন্দা কিন্তু জনসংখ্যায় পাঞ্জাবের অংশ মাত্র ২.৩%। একইভাবে, হরিয়ানা ৫.৯% (জনসংখ্যা ২.১%) ও রাজস্থান ৭.১% (জনসংখ্যা ৭.১%) থেকে সেনা নিয়োগ হয়। এই এলাকাগুলোতে নিয়োগের উপর নতুন প্রকল্পের প্রভাব একবার দেখুন। ২০১৯-২০ সালের নিয়োগে পাঞ্জাব থেকে মোট ৭,৮১৩ জন সৈন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। অগ্নিবীরের প্রথম নিয়োগে, পাঞ্জাবের কোটা কমিয়ে ১,০৫৪ করা হবে। হরিয়ানা থেকে ৫,০৯৭ সৈন্য নিয়োগ করা হয়েছিল, এর সংখ্যা এখন ৯৬৩ তে নেমে আসবে। রাজস্থানে এই সংখ্যা ৬,৮৮৭ থেকে ২,৬০৪, হিমাচল প্রদেশে ৫,৮৮২ থেকে ২৬১ এবং উত্তরাখণ্ডে ৪,৩৬৬ থেকে ৩৮৩-এ নেমে আসবে। এই পরিবর্তন রাতারাতি নাও হতে পারে। প্রথম কয়েক বছর সরকার নিয়োগের বর্তমান কেন্দ্র এবং আঞ্চলিক ভিত্তি বজায় রাখতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে "সর্বশ্রেণী, সর্বভারতীয়" নিয়োগের কারণে কৃষক আন্দোলনের এলাকায় এবং কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে এমন সম্প্রদায়গুলিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বিশাল ভাঁটা পড়া অনিবার্য। সরকারের উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক, এই যোজনা আন্দোলনকারী কৃষকদের শাস্তি হিসেবে গণ্য হবে।
এই প্রেক্ষাপটে, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ২৪ জুন সারা দেশে অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করেছে।