ভারত জোড়ো যাত্রার মূল উদ্দেশ্য যদি দেশের জাগরণ হয়, আমাদের জাতীয় সভ্যতার ঐতিহ্য, একতা এবং বৈচিত্র্যই যদি হয় এর মূল দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলে সকল ভারতীয়ের উচিত এই পদক্ষেপকে সুদূর প্রসারী করে তোলা।
প্রশ্ন জাগে, ভারত জোড়ো যাত্রার পর কী? এই জরুরি প্রশ্নটি চাপা পড়ে যাচ্ছে সৌভাগ্যের উদযাপনে।
চারটি অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি যাত্রার পরবর্তী কিছু সুযোগ সুবিধের পাল্লা খুলে দিয়েছে। যাত্রা সফল হওয়ার নজিরবিহীন ফলাফল হল শ্রীনগরে এক জাতীয় নেতার জনপ্রিয়তা লাভ ও অভূতপূর্ব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। রাহুল গান্ধি তাঁর সমাপ্তি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নিজের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে তোলেন। এই ঘটনা হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এবং আদানি মেলডাউনের সঙ্গে মিলে যায়। এই ঘটনা কর্পোরেট দুর্নীতির অবসান ও ক্রোনিইসমের বাস্তবতাকে তুলে ধরে। এটিই ছিল যাত্রার মূল বক্তব্য ও উদ্দেশ্য।
বিবিসি’এর তথ্যচিত্র ‘দি মোদি’ বর্তমান সময়ের রাজনীতির ভয়ঙ্কর হিংসাত্মক দিকটি এবং ঘৃণার রাজনীতির বাস্তবতা সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছে। এই তথ্যচিত্রকে নিষিদ্ধ করার আনাড়ি প্রচেষ্টা এবং বিবিসি’র দিল্লি ও মুম্বাইয়ের অফিসে ইনকাম ট্যাক্সের রেইড সত্যিই ভাবনার স্বাধীনতাকে সীমিত করে আনছে, সীমাবদ্ধ করে তুলছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা – দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরেও। যাত্রার সময় রাহুল গান্ধীর বক্তব্যের মধ্যে ধ্বনিত হয়েছে ভারতে সংবাদমাধ্যমের এই সমস্যার কথাই। অবশেষে রাজনৈতিক উদ্যোগে সিনেমা বয়কট অভিযানের ব্যর্থতার সামনে ‘পাঠান’-এর ব্যপক সাফল্য চূড়ান্ত জবাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনা কেবল শাহরুখ খানের নিজস্ব উত্থানের নজির রাখেনি, তার সঙ্গে রেখেছে সংখ্যালঘুদের জাতীয়তাবোধের দৃষ্টান্তও। এই ঘটনাকে একটি সাংস্কৃতিক সংকেত হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিষিয়ে ওঠা বর্তমান রাজনীতির প্রতি দেশের আপামর জনসাধারণের ক্লান্তির সংকেত।
যাত্রা কর্মসূচির অর্জিত সাফল্যের একত্রীকরণ
এই ঐতিহাসিক যাত্রা কর্মসূচির মূল অর্জিত সাফল্য ও অগ্রগতি দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীর ওপর। কংগ্রেস ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে তাদের পরবর্তী প্রচার ‘হাত সে হাত জোড়ো’ কর্মসূচির প্রাথমিক পদক্ষেপ। এই পরিকল্পনা শুরু হয় ২৬ জানুয়ারিতে যাত্রা সমাপ্তির পূর্বেই। যাত্রার সাফল্য সকলের আশাকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং সকলেই প্রত্যাশা করছে আরও প্রগতিশীল জনমুখী প্রচারের। আমরা কিছু উত্তর আশা করতে পারি কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশন ও সাধারণ সভার থেকে, যা অনুষ্ঠিত হবে ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাইপুরে।
তবে ভারত জোড়ো কর্মসূচির ভার কোনও সংগঠন বা নেতৃত্বের দায়ভারের মধ্যে সীমিত নয়। যদি এই অভিযানের উদ্দেশ্য জাতির বৈচিত্র্য, ঐক্য ও নিজস্ব সভ্যতার ঐতিহ্যকে জাগ্রত করা হয়, তবে প্রত্যেক ভারতীয়ের দায়িত্ব এই মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিশেষত বিভিন্ন সময়ে এই যাত্রায় যোগ দেওয়া শত শত গণ-সংগঠন ও গোষ্ঠী-সহ হাজার হাজার মানুষ যাঁরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সমভাবাপন্ন তাদের সকলকেই এর দায়ভার ভাগ করে নিতে হবে। সকল মানুষই অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন এই নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগের প্রতি।
যাত্রার সমাপ্তির এক সপ্তাহ পরে ৬ ফেব্রুয়ারি ‘নাগরিক সমাজ’-এ অংশগ্রহণকারীরা নতুন শক্তিতে সাড়া দেওয়ার জন্য স্বল্প নোটিসে দিল্লিতে ডাকা একটি জাতীয় কনভেনশনে একত্রিত হন। এই সম্মেলনের আয়োজনকারী দলের একজন হিসেবে আমি কোনও ভাবেই নিরপেক্ষ সাংবাদিক হওয়ার ভান করতে পারি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন প্রতিবেশী রাজ্যগুলির থেকে প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিয়ে আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম মোটামুটি ২৫০ জন, কিন্তু প্রায় ৫০০ জন প্রতিনিধি এসেছেন। তার ওপর আবার আসাম ও তামিলনাড়ুর থেকেও প্রতিনিধিরা এসেছেন। আমি অনেক দিন পর এরকম যৌথ সমাবেশ ও ইতিবাচক জমায়েতের সম্মুখীন হলাম। এই সমাবেশ সেই সকলকে একত্রিত করেছে যারা এক সঙ্গে লড়াই করে প্রতিরোধ করতে চাইছেন বর্তমান ব্যবস্থাকে।
রাহুল গান্ধী অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনার জন্য এই সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি মনে করিয়ে দেন যে কংগ্রেসের উৎপত্তিই ছিল এক আন্দোলন হিসেবে এবং তিনি সুশীল সমাজ ও অন্যান্য জনসংগঠনগুলিকে পুনরায় অংশগ্রহণের ও অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দেন। নিজের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রাহুল গান্ধী আশ্বাস দেন যে তিনি নিজে অর্ধেক পা বাড়িয়ে আছেন নাগরিক সমাজের দিকে। জাতীয় কংগ্রেস ছাড়াও রাষ্ট্রীয় জনতা দল, রাষ্ট্রীয় লোকদল, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), এবং তেলেঙ্গানা জন সমিতি (জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টির অনুপস্থিতিতে সমর্থিত) এই সমাবেশে যোগ দেয়। তারা সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষায় রাজনৈতিক দল এবং গণসংগঠনের মধ্যে সেতুবন্ধনের বার্তা দিয়েছে।
ভারত জোড়ো যাত্রা এখন আন্দোলন
এই সমাবেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাত্রাকে আন্দোলনে পরিণত করা হবে ‘ভারত জোড়ো অভিযান’ নাম দিয়ে। অভিযানের মূল মন্ত্র হল- “এটি আমাদের প্রজাতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করবে, পুনর্নবীকরণ করবে সাংবিধানিক মূল্যকে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে পুনরুদ্ধার করবে এবং পুনরুদ্দীপ্ত করে তুলবে স্বাধীনতা সংগ্রামকে।” মিশন বিজিএ শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ৭ বছরের রোডম্যাপ নিয়ে (৮০ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের বার্ষিক উদযাপন পর্যন্ত) এবং সেই সঙ্গে আগামী ১৫ মাসের জন্য স্থায়ী কর্ম পরিকল্পনা। সমাবেশে অনুমোদিত এই সমাধানটি স্বল্পমেয়াদি উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তুলেছে যথাযথভাবেই। আর তা হল আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সেই সব সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা যারা প্রভাবশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বিজেপি ও আরএসএস-এর রাজনীতি ও মতাদর্শের বিরুদ্ধে, আন্তঃবিরোধী মতভেদে না পড়ে।
স্থায়ী কর্ম পরিকল্পনার দু’টি প্রধান উপাদান রয়েছে: যোগাযোগ ও ক্ষেত্রসমীক্ষা। যোগাযোগের লক্ষ্য হল ‘ট্রথ আর্মি’র গঠন। ট্রথ আর্মি একটি ধারনা যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ভুয়ো তথ্য এবং ঘৃণামূলক ইঙ্গিতকে চিহ্নিত করা ও তার প্রতিরোধ। প্রচলিত ন্যারেটিভ খণ্ডন করা ও তার পরিবর্তে স্থানীয় ভাষায় নতুন ও বিকল্প ভাষ্যের নির্মাণ করা। কাউকে অন্তত কুখ্যাত আইটি সেলের বিরুদ্ধে মোকাবিলার দায়িত্ব নিতে হবে কিন্তু তার নোংরা কৌশল অবলম্বন করা চলবে না।
এই উদ্যোগ এক পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে ‘লক্ষ্যযুক্ত নির্বাচনী প্রচার অভিযান’ যা কিনা সক্রিয় ও ভিত্তিগত সমর্থন প্রদান করবে সেই সব সংগঠন ও প্রার্থীদের, যারা পরাজিত করতে সক্ষম হবে বিজেপি ও তার বন্ধু সংগঠনগুলিকে। বিজেপি’র বিখ্যাত নির্বাচনী পদ্ধতি তার একার নয় বরং তার মালিকানা আরএসএস পরিবারের বিভিন্ন নামি-বেনামি শাখার। বেশির ভাগ বিরোধী দল নির্বাচনে এই সুবিধে পায় না। নির্বাচন এমন একটি জায়গা যেখানে গণ-আন্দোলন ও সংগঠনগুলি সেই পরিসরে পা রাখতে পারে। তাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যদি তারা কাজকে প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচেষ্টার সাথে সামঞ্জস্য সাধন করতে সক্ষম হয়।
আন্দোলন ও সংগঠনের মাঝখানে সেতু
ভারত জোড়ো অভিযান বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে প্রতীক্ষিত সেতুবন্ধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি প্রথমবার নয় যেখানে অদলীয় রাজনৈতিক গঠন গড়ে তোলা হচ্ছে। এই সংগঠনগুলির সঙ্গে রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক রজনী কোঠারি, ডি. এল. শেঠ এবং হর্ষ শেঠি সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছেন। তবে এই অভিযানই সম্ভবত একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেশন চালানোর প্রথম প্রয়াস, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে গণসংগঠনের সমন্বয় স্থাপনের মাধ্যমে কাজ করা হয়েছে।
ভারত জোড়ো যাত্রার সূচনা পর্বেই আমি উল্লেখ করেছি সেতুবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা: “আন্দোলন থেকে আসে গভীরতা, পার্টি দেয় ব্যাপ্তি। আন্দোলন ইস্যুর জোগান দেয়, পার্টি সেগুলিকে কার্যকরী ফলাফলে পরিণত করে।” আমি বিশেযভাবে আবেদন জানিয়েছিলাম “প্রতিরোধের অদলীয় রাজনীতির” উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে বর্তমান আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে কিন্তু কোনও একটি বিরোধী দলের পক্ষপাতমূলক স্বার্থে আবদ্ধ না হয়ে।
ভারত জোড়ো যাত্রার অপ্রত্যাশিত সাফল্য কর্তৃত্ববাদী ও ধর্মান্ধ রাজনীতিকে পরাজিত করার, প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার এবং দল ও আন্দোলনের রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ খুলে দিয়েছে। এটাই এখন কাজের সময়।