'বিজেপির সংকল্প: মোদীর গ্যারান্টি ২০২৪' শীর্ষক শিরোনামের নথিটি কৃষকদের জন্য এক বিপদ ঘণ্টা। প্রথম দফার নির্বাচনের মাত্র চার দিন আগে প্রকাশিত বিজেপির ইশতেহার খোলাখুলি একথাই বলে যে বিজেপি তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলে কৃষি এবং কৃষক কারও জন্যই কোনও আশার আলো নেই। সাধারণত, ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো ভাল ভাল কথা বলে, শুধু তাই নয় অতিরঞ্জিত দাবি বা প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকে। এবার, বিজেপির ইশতেহারের আগে, অন্যান্য বিরোধী দলের বেশিরভাগই তাদের ইশতেহার প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা গেছে তারা কৃষকদের জন্য অনেকগুলি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা বলেছে। বিজেপি চাইলে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে কয়েকটি অন্তত গ্রহণ করতেই পারত, বরং তার থেকে নিজেদের দু’ধাপ এগিয়েও রাখতে পারত।
এসব করার পরিবর্তে, কৃষকদের বিষয় এবং কৃষক আন্দোলনের সব দাবিগুলোর ব্যাপারে বিজেপির নীরবতাই প্রমাণ করে, হয় মোদী কৃষকদের আন্দোলন থেকে পাওয়া অপমান ভুলে যাননি অথবা বিজেপি বিশ্বাস করে কৃষকদের ভোট পেতে কৃষিকাজ নিয়ে কিছু বলার বা করার দরকার নেই। বিজেপি ‘দাবির জায়গায় মোদী’ এবং কৃষক-সৈনিকদের জায়গায়, হিন্দু ও মুসলমান বলে কাজ চালিয়ে নিতে চাইছে। এই ইশতেহারে একেবারে শুরুতে, 'সর্বস্পর্শী সমাবেশী' অর্থাৎ বিজেপি সরকারের ১০ বছরের তথাকথিত সুশাসন এবং উন্নয়ন সম্পর্কে কিছু দাবি করা হয়েছে এবং তারপরে বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কে কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এখানে তাদের দাবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিজেপির নীরবতা। ২০১৬ থেকে বিজেপি ক্রমাগত দেশের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার ঢাক বাজিয়েছিল। গত নির্বাচনী ইস্তেহারেও এই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে এই ৬ বছরের পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে, বিজেপির তরফে কৃষকের আয় সম্পর্কে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি। একদিকে না তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল, অন্যদিকে না দেশবাসীকে হিসেব দিল, কেন তারা এই প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ।
বদলে, বিজেপি কিষাণ সম্মান নিধির অধীনে বার্ষিক ১১ কোটি কৃষক পরিবারকে ৬০০০ টাকা দেওয়ার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে। এখানেও সত্যের অপলাপ করা হয়েছে। কেন ঘোষিত ১৪ কোটি কৃষক পরিবারের পরিবর্তে কখনও ৯, কখনও ১০ কখনও ১১ কোটি পরিবার সেই টাকা পেল তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। এই বড় সত্যটি থেকেও মুখ ঘুরিয়ে রাখা হয়েছে যে এই প্রকল্প ঘোষণার পর থেকে মুদ্রাস্ফীতি সূচক বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। তার মানে, ২০১৯ সালে ৬০০০ টাকার মান বজায় রাখতে, আজ ৯০০০ টাকার প্রয়োজন। মিডিয়ায় খবর ছিল যে মোদী সরকার তার শেষ বাজেটে বা ইশতেহারে কিষাণ সম্মান নিধির পরিমাণ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করবে, কিন্তু ইশতেহার এ সম্পর্কে নীরব।
ফসলের দামের সঙ্গে কৃষকের আয় জড়িত। সারাদেশে কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আন্দোলন করছে। এই প্রশ্নে বিরোধী দলগুলি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কংগ্রেসের ইশতেহারে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে স্বামীনাথন কমিশনের সূত্র অনুসারে সমস্ত কৃষককে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দেড়গুণ এমএসপির আইনি গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এর সঙ্গে বলা হয় কৃষি মূল্য কমিশনকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যাতে এমএসপির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সরকার কোনও ভাবে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সিপিআই (এম), সমাজবাদী পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো বিরোধী দলগুলোর ইশতেহারে ও একই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সমাজবাদী পার্টির ইশতেহার আরও এক ধাপ এগিয়ে দুধ এবং অন্যান্য সমস্ত কৃষি পণ্যকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অধীনে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়। এবারই প্রথমবারের মতো দেশের প্রধান জাতীয় দলগুলোর মধ্যে কৃষক আন্দোলনের এই গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মোদীর গ্যারান্টিতে এর কোনও স্থান নেই।
বিজেপির ইশতেহারে কেবল দাবি করা হয়েছে যে- ‘আমরা প্রধান ফসলগুলোর অভূতপূর্ব এমএসপি বৃদ্ধি করেছি এবং ঠিক সময়ে সময়ে তা বাড়িয়ে যাব’। আসলে মোদী সরকারের এমএসপি মূল্যের বৃদ্ধির দাবি মিথ্যা। সত্যিটা হল ২৩টির মধ্যে ২২টি ফসলেরই এমএসপি বৃদ্ধির হার মোদী সরকারের সময়ের তুলনায় মনমোহন সিং সরকারের সময়ে অনেক বেশি ছিল। বিজেপির ইশতেহারের ভাষা থেকে এটা স্পষ্ট যে না তারা স্বামীনাথন কমিশনের সূত্র মেনে নিতে চায় না এমএসপিকে কৃষকের আইনি অধিকারে পরিণত করতে চায়। এই ইশতেহারে দেশকে ডাল ও ভোজ্য তেলে স্বাবলম্বী করার কথা বলা হয়েছে এবং বিশ্বের জন্য মোটা শস্য উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এখানেও কৃষকদের এই ফসলের ন্যূনতম এমএসপি’র কথা বলছে না। দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেও নারাজ। এই ইস্যুতে 'ইন্ডিয়া' ব্লক কৃষকদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং বিজেপি তার বিরুদ্ধাচরণ করছে।
একইভাবে, বিজেপির ইশতেহারে কৃষকদের ঋণের বোঝার প্রশ্নে সম্পূর্ণ নীরব, যেখানে সরকারের নিজস্ব নথিই বলে দেয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ঋণের বোঝায় জর্জরিত। সমাজবাদী পার্টির ইস্তেহারে ঋণ মকুবের কথা বলা হয়েছে আবার কংগ্রেসের ইশতেহারে ঋণে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যা সময়ে সময়ে ঋণের বোঝা মূল্যায়ন করবে এবং এটি হ্রাস বা নির্মূল করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ফসলের ক্ষতির সমস্যা সম্পর্কে বিজেপির ইশতেহারে আশ্বস্ত করে দেওয়া হয়েছে যে শস্য বীমা প্রকল্পের মাধ্যমে এর সমাধান করা হয়েছে এবং বাকি থেকে যাওয়া কাজগুলি আরও ভাল ভাবে করে দেওয়া হবে। তবে বাস্তবে এই নতুন প্রকল্প চালু হওয়ার পর ফসল বীমায় সরকারি ব্যয় এবং বীমা কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়লেও তার থেকে লাভ ওঠানো কৃষকের সংখ্যা আগের থেকে কমেছে। এই তথ্য স্বীকার করে কংগ্রেসের ইশতেহারে সমস্ত কৃষককে শস্য বীমার আওতায় আনার এবং ক্ষতির ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়াবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
দেশের কৃষকদের এই প্রধান দাবিগুলিতে কিছু দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরিবর্তে, তাদের চার পাতার ইশতেহারে মোদী সরকার এমন বহু মিথ্যের পুনরাবৃত্তি করেছে যা দিইয়ে বিগত বছরগুলোতে থেকে কৃষকদের বোকা বানিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছে, যেমন শ্রী অন্ন সুপারফুড, ন্যানো ইউরিয়া, পরিকাঠামো, ফসলের বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক চাষের সম্প্রসারণ। কিন্তু এখানেও বিজেপি সুকৌশলে কোনও বিষয়েই কোনও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেয়নি। শুধু সহজভাবে প্রতিটি বিষয় উল্লেখ করে দাবি করে গেছে যে বিজেপি সরকার এই বিষয়ে অনেক কিছু করেছে এবং বলেছে যে ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছু করা হবে।
স্পষ্টতই মোদীজি তাঁর অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আগে কৃষককে এমএসপি এবং আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদী ফেঁসেছেন। তাই এবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া চলবে না, যার হিসাব পরবর্তীতে বিজেপিকে দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হল গত ১০ বছর ধরে এই মিথ্যের ভার বহন করা কৃষক শিক্ষা নেবে কি না। গত কয়েকদিন ধরে বিজেপির কাছে হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের হিসাব দাবি করা এবং বিজেপি নেতাদের প্রবেশ বন্ধ করার খবর হয়তো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।