কোটি কোটি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক ভগবান রাম। আস্তিক হোক বা নাস্তিক, হিন্দু হোক বা অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষ, এই ভূমিতে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে রামচরিত। যে দেশে রাম নাম উচ্চারণ করে বহু মানুষের দিন শুরু হয়, এটাই স্বাভাবিক সেখানে তার আদর্শে হাজার হাজার মন্দির তৈরি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
যদিও মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার বা গির্জা তৈরি হওয়া ধর্ম, নৈতিকতা বা চরিত্র নির্মাণের পরিচয় হতে পারে না, তবে সাধারণত সেখানে ধর্ম তার সুনির্দিষ্ট রূপ খুঁজে পায়। অতএব, বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীকগুলিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করাই শ্রেয়। প্রগতিশীলতার নামে মালা, মূর্তি ও মন্দিরকে তুচ্ছ বা ব্যঙ্গ করার প্রবণতা আধুনিকতার অজ্ঞতা ও ঔদ্ধত্যের প্রতীক। মন্দির তৈরি হওয়া মানে দেবতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা। সুতরাং রামমন্দিরে ভগবান রামের মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা একটি শুভ উপলক্ষ্য হিসেবে উদযাপন করাই স্বাভাবিক। সাধারণত, এই ধরনের ঘটনায় কোনও রকম ‘কিন্তু’ থাকা উচিত নয়।
তবে ২২ জানুয়ারি জন্মভূমি অযোধ্যায় রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠার আয়োজন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আরও বড়ো কথা এই জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ স্বাভাবিক বিষয় নয়। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে সহমত হওয়া না হওয়ার তর্কের অধ্যায় বন্ধ রাখাই ভাল। এখন একটাই প্রশ্ন, ২২ জানুয়ারি যেভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তা কি যথাযথ?
উচিত ও অনুচিতের মাপকাঠি কী হওয়া উচিত? এর উত্তর দিতে আমাদের বেশিদূর যেতে হবে না। ভগবান রামের কাহিনী হল এর সবচেয়ে সুন্দর এবং প্রামাণ্য মাপকাঠি। এই দেশ ভগবান রামকে মর্যাদা পুরুষোত্তম হিসেবে চেনে। তার সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্ত কিছু মর্যাদার প্রতীক। অতএব, প্রশ্ন ওঠে ২২ জানুয়ারির প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানটা কি সেই মর্যাদার সঙ্গে মেলে? যে মর্যাদার প্রতীক ছিলেন স্বয়ং রাম?
গত কয়েকদিন ধরে মন্দির নির্মাণে শাস্ত্রীয় মর্যাদা লঙ্ঘনের চর্চা চলছে। অবশ্য এই ক্ষেত্রে শঙ্করাচার্য বা অন্য ধর্মগুরু যা বলবেন তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার দরকার নেই। কখনও কখনও তাঁদের বিরোধিতা করা সম্ভব এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু গত কয়েকদিনের বিতর্ক থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে কোথাও মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগে কিংবা চূড়ায় পতাকা উত্তোলনের আগে দেবতার মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। এটা স্পষ্ট যে এক প্রতিষ্ঠিত মর্যাদার নিয়ম ভঙ্গ হচ্ছে এবং এর কারণ নির্বাচনী প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। শুভ-অশুভ মুহূর্ত নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে এটা স্পষ্ট যে শুভ বা অশুভ ভেবে এই তারিখ বেছে নেওয়া হয়নি বরং নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি নিয়ে ভেবেই এই সময় ঠিক করা হয়েছে। এটি অবশ্যই মর্যাদাহীনতা।
আমরা যদি আইনের কথা বলি, তাহলে এই অনুষ্ঠানটি অনেক স্তরেই সেটি লঙ্ঘন করে। অবশ্যই, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়, তবে একই আদেশে রাম মন্দির ট্রাস্টের অরাজনৈতিকতার বিধানও রয়েছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, ধর্মীয় গুরুর পরিবর্তে সরকার বিজেপির সঙ্গে যুক্ত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং সরকারী কর্মকর্তাদের ট্রাস্ট বানিয়েছে। যা আদালতের আদেশের লঙ্ঘন। দেশের আইনে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কোন নির্বাচনী বা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, কিন্তু ২২ জানুয়ারির ঘটনা সেই আইনি মর্যাদাকেও লঙ্ঘন করছে।
আইনি মর্যাদার চেয়ে বড় প্রশ্ন সাংবিধানিক মর্যাদার। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী (বা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কোনও ব্যক্তি) কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করতে পারেন? আমাদের সংবিধানের বিধান স্পষ্ট: সাংবিধানিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ভাবে যেমন খুশি ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুশীলনে অংশগ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু একজন পদাধিকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তা করতে বাধা দেয়। সংবিধান এও বলে যে সরকারকে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, যে কোনও একটি ধর্মের প্রতি ঝোঁক সাংবিধানিক মর্যাদার লঙ্ঘন। ২২ জানুয়ারির আচার-অনুষ্ঠানে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে বিভাজন রেখা ঝাপসা হয়ে গেছে। কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই দেশের অন্যান্য ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে হিন্দু ধর্মকে।
কিন্তু সবচেয়ে গভীর লঙ্ঘন হল ধর্মীয় মর্যাদা। এখানে ধর্মীয় অর্থ হিন্দু বা মুসলমানের মতো ধর্ম নয়, বরং এর মূল অর্থ: ধর্ম অর্থাৎ যা অনুসরণ করার যোগ্য, যা নীতি অনুসরণ করে। ২২ জানুয়ারির অনুষ্ঠান আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির গরিমার লঙ্ঘন।
তুলসীদাস বলেন,
"নাহিন রাম রাজকে ভুখে
ধর্ম ধুরিন বিষয় রস রুখে।"
যার মানে করলে দাঁড়ায়, রাজ্যের জন্য রামের কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। তিনিতো ধর্মের ধ্বজাধারী এবং সাংসারিক আনন্দের ঊর্ধ্বে। ক্ষমতার প্রতি নির্লিপ্ততা আমাদের ধর্মীয় মর্যাদা। কিন্তু ২২ জানুয়ারির আয়োজন আসলে এক ধরনের শক্তি প্রদর্শন, এবং ক্ষমতা অর্জনের অঙ্গীকার। এটি হিন্দু ধর্মের উপর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "দীন দান" কবিতায় সাধু ও রাজার কথোপকথনে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশাল মন্দির প্রতিষ্ঠা করা রাজার অহংকারের প্রতীক, এমন মন্দিরে ঈশ্বর থাকতে পারেন না।
ধর্ম, বিশ্বাস ও মর্যাদার সঙ্গে এ ধরনের আয়োজনের কোনও সম্পর্কই নেই। রামের প্রবল ভক্ত মহাত্মা গান্ধীকে স্মরণ করে আমরা শুধু এইটুকুই বলতে পারি: হে রাম!